ঝুমির বিয়ের ফাঁদে সর্বস্বান্ত হয়েছে শতাধিক পুরুষ। লন্ডন- আমেরিকা যাওয়ার স্বপ্নে বিভোর এসব যুবককে ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নেয়া হয়েছে কোটি কোটি টাকা। আর এ জন্য ঝুমির রয়েছে একটি বাহিনী। পত্রিকায় লন্ডন কিংবা আমেরিকাপ্রবাসী পাত্রীর জন্য সুশিক্ষিত পাত্র চাই বিজ্ঞাপন দিয়ে টেনে নেয় যুবকদের। এরপর বিয়ের নাটক সাজিয়ে হাতিয়ে নেয় লাখ লাখ টাকা।
একের পর এক এমন প্রতারণার পর সমপ্রতি ঝুমি ধরা পড়লেও জামিন নিয়ে বেরিয়ে এসেছে জেল থেকে। কোনভাবেই রাখা যায় না তাকে জেলে। বার বার বের হয়ে একই প্রতারণা করে। তার পুরো নাম ঝুমি আক্তার রোজ। বয়স ২৮।
দেখতে সুন্দরী। ঢাকার ১০ মধ্য বাসাবো’র বাসায় তার আস্তানা। পরিপাটি করে সাজানো ফ্ল্যাট। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে লন্ডন কিংবা আমেরিকা যাওয়ার লোভে সুশিক্ষিত যুবকরা ভিড় জমায় এখানে। তারপর আটকা পড়ে ফাঁদে।
এরকমই একজন আলমগীর হোসেন। বাড়ি যশোরে। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে ছুটে যান বাসাবোতে। এরপর পাত্রী দেখা, পছন্দ সবই হয়। হয় সাজানো বিয়েও।
আর এসবের আগে ভিসা, প্লেনের টিকিটসহ আনুষঙ্গিক খরচ বাবদ তার কাছ থেকে নেয়া হয় প্রায় ৫ লাখ টাকা।
আলমগীর জানান, বিজ্ঞাপনে বলা হয় প্রবাসী পাত্রীকে বিয়ে করলে পাত্রকে আমেরিকা নিয়ে যাওয়া হবে। মধ্য বাসাবো এসে তিনি সেই কাঙ্ক্ষিত মোবাইল ফোন নম্বরে কল করেন। কিরণ নামে এক ব্যক্তি তাকে যেতে বলেন। এরপর আলমগীর হোসেন ওই ঠিকানায় দেখা করতে যান রোজের সঙ্গে।
তখন এক প্রতারক জাহাঙ্গীর তার সঙ্গে দেখা করে। রোজ নামে পাত্রীকে নিয়ে আসা হয়। আলমগীর পাত্রী দেখে চমকে যান। চোখ ধাঁধানো সুন্দরী। এক সঙ্গে দুই পাখি শিকারের মতো ব্যাপার আলমগীরের কাছে।
সুন্দরী বউও পাবেন আবার স্বপ্নের দেশ আমেরিকাপ্রবাসী হতে পারবেন। পাত্রী সুমিকে পছন্দ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আলমগীরের কাছে পাত্রীপক্ষ দাবি করে টাকা। আমেরিকা যাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। ভিসা বানানো ও প্লেনের টিকিট কাটার জন্য ৩ লাখ ৪০ হাজার টাকা দাবি করে ঝুমি। হঠাৎ যশোর থেকে ঢাকায় আসার সময় আলমগীর এত টাকা সঙ্গে আনেননি।
তবে সেদিন কনে দেখতে যাওয়ার সময় পাত্রীর বাসায় মিষ্টি নিয়ে যান তিনি। পছন্দের পাত্রীকে তাই পকেটে থাকা ৫০ হাজার টাকা তুলে দেন ওইদিনই। বাকি ২ লাখ ৯০ হাজার টাকার জন্য বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা ও বিয়ের কাগজপত্র কিছুই আর করা হয় না সেদিন। তাই তিনি যশোর গিয়ে বাকি ২ লাখ ৯০ হাজার টাকা কুরিয়ার সার্ভিসে পাঠিয়ে দেন পাত্রীর ঠিকানায়। পরে রোজের সঙ্গে আলমগীর হোসেনের বিয়ের কাবিন হয়।
সবুজবাগের একটি বাসায় এসব সমাধা হয়। কাবিননামা হওয়ার পর বউকে ঘরে তুলতে গেলে দেখা দেয় বিপত্তি। পাত্রীর মা-বাবা নতুন জামাইকে বরণ না করলে আপাতত আলমগীরের সঙ্গে থাকতে চায় না ঝুমি। তবে এসময় পাত্র আলমগীর আমেরিকা যাওয়ার ভিসা, পাসপোর্ট ও প্লেনের টিকিট তৈরি হয়েছে কিনা জানতে চায়। শুরু হয় আলমগীরের সঙ্গে ছলচাতুরি।
আলমগীর জানান, তখন তাদের ব্যাপারে আমার কোন সন্দেহ হয়নি। তাছাড়া, মনমতো সুন্দরী বউ। তার কথামতো সবকিছু করতে চেয়েছে। তবে পাসপোর্ট, ভিসা নিয়ে একের পর এক তারিখ পাল্টানোর কারণে আলমগীরের মনে খটকা লাগে। আসা-যাওয়ার এক পর্যায়ে জানতে পারেন ঝুমি আমেরিকাপ্রবাসী নন।
বাসাবো নয়, থাকেন বাড্ডার কুড়িল বিশ্বরোড এলাকার মৃধা বাড়িতে। এর মধ্যে আলমগীরকে ফাঁকি দিয়ে ঝুমি লাপাত্তা হয়ে যায়। আলমগীর জানান, তখন আমেরিকা নয় যে টাকা দিয়েছি এ টাকার জন্য আমি ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে থাকি। এমনকি তাদের গ্রামের বাড়ি খুলনার ফুলতলা থানার দামোদর গ্রামেও যাই। সেখানে যাওয়ার পর আলমগীর হোসেনকে নাজেহাল করে ঝুমির বড় বোন সুমি।
সে আলমগীরকে স্থানীয় চেয়ারম্যান হত্যা মামলার আসামি করে জড়িয়ে দেয়ার হুমকি দেয়। পালিয়ে আসেন আলমগীর। অনেকদিন পর রোজকে তিনি খিলগাঁও থানা এলাকায় দেখতে পান। এসময় খিলগাঁও থানা পুলিশের সহযোগিতা চান তিনি। পুলিশ তাকে আটক করে থানায় নিয়ে আসে।
তার বিরুদ্ধে সবুজবাগ থানায় টাকা আত্মসাতের মামলা দেয়া হয়। এরপর আদালত থেকে জামিন নিয়ে আবার লাপাত্তা হয়ে যায় ঝুমি। এরপর গত ২৮শে জানুয়ারি তাকে আবার গ্রেপ্তার করতে সক্ষম হয় সবুজবাগ থানা পুলিশ। শুধু আলমগীর হোসেন নয় বিয়ের ফাঁদ পেতে আমেরিকা নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আরও অনেক তরুণকে পথে বসিয়েছে রোজ ওরফে ঝুমি। আলমগীর জানায়, আমি আগে একটি ব্যাংকে চাকরি করতাম।
এ ঝামেলায় পড়ার পর আমাকে চাকরিও ছেড়ে দিতে হয়েছে। সুমি একা নয় এ প্রতারণা ব্যবসার সঙ্গে জড়িত তার বড় বোন ঝুমিসহ বিশাল সিন্ডিকেট। যেখানে ঝুমি ও সুমি দু’বোন পাত্রী সাজে। প্রতারক পাত্রী আমেরিকাপ্রবাসী সুমি ইসলাম সেজে প্রতারণা করেছে ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের আর এক তরুণের সঙ্গে। তার কাছ থেকেও হাতিয়ে নিয়েছে ৪ লক্ষাধিক টাকা।
এভাবে সুমি ও ঝুমির প্রতারণায় সর্বস্বান্ত হওয়া বিভিন্ন তরুণ সবুজবাগ থানায় এসে অভিযোগ করেছে। এ ব্যাপারে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার মহেষপুর গ্রামের দুলাল মিয়া বলেন, গত বছর ৭ই নভেম্বর আমার কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা নিয়েছে ঝুমি। পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখে আমি তার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিলাম। এসময় কুমিল্লার দেবিদ্বার উপজেলার আলমগীর হোসেন নামে আর এক প্রতারক ছিল। তারা দু’জনে মিলে আমার কাছ থেকে ৫ লাখ টাকা নিয়েছে।
তবে তার কাছ থেকে টাকা নেয়ার সময় এ প্রতারক পাত্রীর নাম বলা হয় ফারজানা জাহান রিতা। তার সঙ্গে দ্বিতীয় বার দেখা হওয়ার পর কাগজপত্রের মাধ্যমে ৫ লাখ টাকা দিয়েছিলেন দুলাল মিয়া। এ ঘটনায় দুলাল মিয়া বাদী হয়ে গত ৭ই ফেব্রুয়ারি আদালতে ঝুমির বিরুদ্ধে প্রতারণা মামলা করেছেন। এভাবে প্রতারণার শিকার হয়ে মামলা করেছেন গফরগাঁওয়ের সাইদুল, ইব্রাহিম, মো. লোকমান সহ অনেকে। সাইদুল বলেন, পত্রিকায় বিজ্ঞাপন মতো আমি গতবছর ১লা জানুয়ারি বাসাবো মায়াকাননের ঠিকানায় এসে বিয়ের কথাবার্তা ঠিক করি।
এরপর ৩ দফায় আমার কাছ থেকে ২ লক্ষাধিক টাকা হাতিয়ে নেয়। পরে প্রতারণার বিষয়টি আমার মাথায় আসে। এসময় বিয়ের কথা বলে তাকে ফোন করি। তখন সে আমার কাছে আরও ৫০ হাজার টাকা দাবি করে। টাকা নিয়ে আমাকে উত্তরার মাসকট প্লাজায় যেতে বলে।
এভাবে উত্তরা থানার পুলিশের সহায়তায় মাসকট প্লাজা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় সুমি আক্তার ওরফে রোজকে। এসময় রোজ ওরফে সুমি ইসলামের সঙ্গে রাজন, মুরাদ, আরিফ, জাহাঙ্গীরসহ তার সিন্ডিকেটের চারজনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সবুজবাগ থানার ওসি আসাদুজ্জামান জানান, ঝুমি ও সুমির অনেক বড় সিন্ডিকেট। গ্রামের অনেক সহজ সরল তরুণ তাদের প্রতারণার শিকার হয়ে শেষ সম্বলটুকুও হারিয়েছে। এতে তাদের মা-বাবা ও পরিবার- পরিজন সহায় সম্বল হারিয়ে পথে বসেছে।
এভাবে একের পর এক ঘটনায় সবুজবাগ থানায় ৩টি মামলা হয়েছে সুমি আক্তারের বিরুদ্ধে। তিনি খুলনার ফুলতলার আজিজ মোল্লার মেয়ে। তবে সবুজবাগ থানা এলাকার বাসিন্দারা জানান, এলাকায় এরকম আর ৫-৬টি ম্যারেজ মিডিয়া ফরেন সিটিজেন পাত্রীর বিজ্ঞাপন দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে প্রতারণার ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
সূত্র : Click This Link
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।