আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নারীরা কি অবলা নয়?

কি বলব

স্ত্রীকে খুন, এসিডে মুখ ঝলসে দেয়া, পুড়িয়ে মারা, শ্বাসরোধ করে হত্যা, গলাটিপে হত্যা—এই শব্দগুলোর কোনোটাই নতুন নয়। এই শব্দগুলোর/ঘটনার সঙ্গে আমাদের প্রতিদিন নব-নবরূপে সাক্ষাত্ ঘটে। কিন্তু এসব ঘটনায় আমরা মোটেও বিস্মিত হই না। কারণ এসব ঘটনায় আমরা অভ্যস্ত। এক সময় স্বামীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে স্ত্রীকেও সহমরণের স্বাদ আস্বাদন করতে হতো।

রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের অনেক কৃপা। তারা এ অমানবিক নিয়মের বিপক্ষে লড়েছেন এবং সমাজ থেকে এ নিয়ম উত্খাত করতে সমর্থ হয়েছেন। কথাগুলো কেন উঠল সেই আসল ঘটনা এখন খুলে বলছি। ২৫ এপ্রিল, সোমবার ‘দৈনিক আমার দেশ’ পত্রিকায় ‘অভিনব বোম টিজিং’ শিরোনামে লেখাটি সম্পাদকীয় পাতায় প্রকাশিত হয়। একই দিন একই পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ‘অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে হত্যার পর লাশ গুমের ব্যর্থ চেষ্টা’ শিরোনামে খবরটি ছাপা হয়।

সাংবাদিক, লেখক, কবি হাসান হাফিজের ‘অভিনব বোম টিজিং’ লেখাটি পড়লাম, ভালো লেগেছে। তিনি বরাবরই ভালো লেখেন। তিনি তার লেখাটি শুরু করেছেন— ‘কে বলে নারী অবলা? যে বলে, সে ভুল বলে। ’ কবি, আপনার মুখে পুষ্পচন্দন পড়ুক! ‘অবলা’ শব্দটি থেকে বেরিয়ে আসার স্বপ্নই দেখে বাংলার প্রতিটি নারী। কিন্তু এ মুহূর্তে আপনার এ মন্তব্যের সঙ্গে আমি দ্বিমত পোষণ করছি।

বোমা বিস্ফোরণের কথা বলে যে তরুণী পরীক্ষা পেছানোর অপচেষ্টা করেছিল, সে কিন্তু পরীক্ষা পেছাতে পারেনি। কারণ নারী সত্যিই অবলা! আর তাই সে এখন শ্রীঘরে। আমি মোটেও সেই তরুণীর পক্ষ নিয়ে কথা বলছি না। সে মিথ্যে বলার অপরাধে অপরাধী। সে কিন্তু খুনি নয়।

পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালো না থাকায় সে পরীক্ষা বন্ধের অপচেষ্টা করেছে। অন্যায়ভাবে পরীক্ষা পেছানোর চেষ্টা ছাড়া ওই কলেজছাত্রীর আর কোনো অসত্ উদ্দেশ্য ছিল না। পুলিশের বক্তব্যে এটাই প্রমাণিত হয়। আমরা এ ঘটনার জন্য মেয়েটিকে বোকা বা বুদ্ধিহীন বলতে পারি। অভিভাবকদের উদ্দেশে বলতে পারি—ছেলেমেয়েদের পড়াশোনার প্রতি সুতীক্ষষ্ট নজর রাখতে এবং কার সঙ্গে কী কথা বলে সেদিকে সতর্ক থাকতে।

কারণ এইচএসসি পরীক্ষার্থীদের বয়স ১৭-১৯ বছরের মধ্যেই থাকে। তাই তাকে পরিপকস্ফ বলা যাবে না। পরিণতি না ভেবে ওই তরুণী ফোন করে যে মিথ্যে গল্পের আশ্রয় নিয়েছিল। এরই মধ্যে তার শাস্তিও সে ভোগ করতে শুরু করেছে। শুধু এখানেই শেষ নয়, যত দিন সে বেঁচে থাকবে এ কলঙ্কের বোঝা মাথায় নিয়েই তাকে বাঁচতে হবে।

কারণ সে নারী। কবি হাসান হাফিজ আরও লিখেছেন—‘দিনবদল হচ্ছে দ্রুতগতিতে। তার সঙ্গে টাল সামলানো দায়। বাংলাদেশ এক রাগী বাঘের পিঠে চেপে বসেছে। এই বাঘের নাম দিনবদল।

সব কিছুই বদল হচ্ছে। ’ এখানে আমি কবির সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। দিন সত্যিই বদল হচ্ছে! এক সময় নারীরা স্বামীর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই বাঁচার অধিকার হারাত। অর্থাত্ সহমরণে যেতে হতো। কারণ পতিই যদি না থাকল তাহলে স্ত্রীর বেঁচে থেকে কী লাভ? কার জন্য বাঁচবে? দিন সত্যিই বদল হয়েছে! তাই তো স্বামীর মৃত্যুর পর স্ত্রীর আর জীবিত অবস্থায় সহমরণে যেতে হয় না।

স্বামীরা জীবিত অবস্থায়ই নিজ হাতে স্ত্রীকে হত্যা করে বেহেশ্ত নিশ্চিত করে দেন। এটা কি স্বামীভক্ত স্ত্রীর জন্য বড় আশীর্বাদের কথা নয়! জি, পাঠক সেই স্বামীর কথাই বলছি; যে অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রীকে শ্বাসরোধ করে হত্যার পর লাশ নির্জন কোথাও ফেলে আসার জন্য প্রাইভেট কার চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল সম্পূর্ণ ঠাণ্ডা মাথায়। আমরা নারীজাতি এই স্বামী নামের পাষাণ পুরুষের কার্যকলাপ দেখে বিস্মিত না হয়ে পারি না। সেই সঙ্গে কুমারী নারীরা হই ভয়ে শিহরিত, চরমভাবে আতঙ্কিত! তার চেয়ে ভালো বিয়ে না করে যত দিন দুনিয়ার আলো-বাতাস প্রাণ ভরে উপভোগ করতে পারি। এত কিছুর পরও পুরুষশাসিত সমাজের শাসকরা যদি এ জন্যও সাধুবাদ দাবি করেন, তাতেও প্রস্তুত।

আমরা দিতে জানি। সৃষ্টির আদিলগ্ন থেকেই দিতে শিখে আসছি। কিন্তু পুরুষ? সবকিছু নেয়া শেষ হলে জীবনটা কেড়ে নিতেও বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। নিহত অন্তঃসত্ত্বার নাম সৈয়দা কামরুন নাহার নাদিয়া। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা প্রশাসনের ছাত্রী।

তার বাবা একজন আইনজীবী। ঘাতক স্বামী শফিকুর রহমান ওরফে রেজা সিকদারের সঙ্গে ৬ মাস আগে নাদিয়ার বিয়ে হয়। অন্তঃসত্ত্বা নাদিয়ার সারা শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে বলে পুলিশ সুরতহাল রিপোর্টে উল্লেখ করে। ঢাকা মেডিকেল মর্গের সূত্রে জানা যায়, নাদিয়াকে বেদম প্রহার ও শ্বাসরোধে হত্যা করা হয়েছে। একাধিক স্ত্রীর স্বামী ও সন্তানের জনক এই রেজা সিকদার গাজীপুর এলাকায় প্রথম বিয়ে করে।

প্রথম স্ত্রীর গর্ভে একটি ছেলে জন্মের পর সে তাকে তালাক দেয়। এর কিছুদিন পর সে মাদারীপুর জেলার কালকিনি উপজেলার ঠেঙ্গামারা গ্রামের খালেক হাওলাদারের মেয়ে সুবর্ণাকে বিয়ে করে। দ্বিতীয় স্ত্রী সুবর্ণাকে তালাক না দিয়েই সে তার ছোট বোন সুজিতাকে বিয়ে করে। সে দুই বোনের সঙ্গে অবলীলায় সংসার করে যাচ্ছিল। সুজিতার গর্ভে তার একটি মেয়েও রয়েছে।

৬ মাস আগে চতুর্থ স্ত্রী নাদিয়াকে বিয়ে করে। তার আগের স্ত্রী সম্পর্কে নাদিয়ার স্বজনরা জানতেন না। স্ত্রী হচ্ছেন অর্ধাঙ্গিনী! কতটা ঘৃণ্য, নিকৃষ্ট চরিত্রের অধিকারী হলে চতুর্থ বিয়ে করে অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় তাকে হত্যা করা সম্ভব! অপরাধী যেই হোক শিগগিরই ধরা পড়ুক এবং উপযুক্ত বিচার হোক—এটাই আমাদের দাবি। তরুণীর ফোনের রহস্য মাত্র ৫ দিনেই পুলিশ উদ্ঘাটন করতে পেরেছেন। এটি খুবই সুখের বার্তা।

কিন্তু অপরাধের মহানায়ক রাজুর মুখোশ উন্মোচিত হতে প্রায় ২৫ বছর লেগে গেল। আফসোস এখানেই। পুরুষের অপরাধ ধরা পড়ে বহু অবলা নারীর জীবন ধ্বংসের পর। ১৯৮৯ সালে কলেজের ছাত্র থাকাকালেই রাজুর সম্পর্কে নানা নারী কেলেঙ্কারির কথা শোনা যায়। সেই তখন থেকে রাজুর অপরাধ কর্ম শুরু।

কিন্তু যখন তার মুখোশ পুরোপুরি উন্মোচিত হলো তত দিনে এক তালাকপ্রাপ্ত অসহায় নারী বহুকষ্টে সন্তানকে পিতৃহীন অবস্থায় বড় করে তুলেছেন, সুবর্ণার সুখের ঘর তছ্নছ্ হয়ে গেছে, সুজিতার কপাল ভেঙেছে, নাদিয়ার স্বপ্নের ঘর ভেঙে কবর রচিত হয়েছে। অপরিণামদর্শী কলেজছাত্রী মিথ্যে গল্প এঁটে ফোন করে ‘অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয়’, ‘ক্রিমিনাল’ বহু দামি দামি বিশেষণে ভূষিত হয়েছে। এখানে ‘ক্রিমিনাল’ শব্দটি ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমার কিঞ্চিত্ আপত্তি আছে। ‘ক্রিমিনাল’ হতে হলে জোরালো বুদ্ধির প্রয়োজন হয়। ‘ক্রিমিনালরা কখনও প্রমাণ রাখে না।

পরীক্ষার প্রস্তুতি ভালো না থাকায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় কলেজছাত্রীটি কিন্তু নিজের মোবাইল থেকেই পুলিশকে ফোন করেছিল। সে যদি সত্যিকার অর্থেই ‘ক্রিমিনাল’ হতো, অন্তত নিজের মোবাইল ব্যবহার করত না। সুতরাং সে ক্রিমিনাল হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। কলেজছাত্রীর ফোন একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। একটি মাত্র ঘটনায় ‘নারী অবলা নয়’ প্রমাণ হয়ে যায় না।

কিন্তু নাদিয়ার ক্ষেত্রে যা ঘটেছে অর্থাত্ স্ত্রী খুন হর-হামেশাই ঘটেছে। সব পুরুষ খারাপ—এটা কিছুতেই বলা যাবে না। তাই তর্কের খাতিরে তর্ক না করে আসুন আমরা নারী-পুরুষের ভেদাভেদ ভুলে সহকর্মী, সহমর্মী ভেবে একে অন্যের পরিপূরক হিসেবে কাজ করি। সমাজ থেকে এসব অন্যায়-অপকর্ম উত্পাটনের লক্ষ্যে পরস্পর সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিই। নিজেদের কর্ম দ্বারা প্রমাণ করি— ‘সবার উপরে মানুষ সত্য।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।