বলুনঃ সত্য এসেছে এবং মিথ্যা বিলুপ্ত হয়েছে। নিশ্চয় মিথ্যা বিলুপ্ত হওয়ারই ছিল। [১৭:৮১-পবিত্র কুরআন]
আহমেদ দীদাতের নাম আমি প্রথম শুনি স্কুলে থাকতে। যতদূর মনে পড়ে দৈনিক ইনকিলাবে প্রকাশিত একটি আর্টিকেল থেকেই তার সম্পর্কে জানতে পারি। তার লেকচার প্রথম যখন টিভিতে দেখি তখন আমার মাঝে অবাক ও বিস্ময় কাজ করে।
কি করে এত সুন্দর বক্তৃতা করেন তিনি? আমার খুব ইচ্ছা ছিল তার সাথে দেখা করার। কিন্তু ততদিনে অবশ্য তিনি এই নশ্বর পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরকালে পাড়ি দেন। আজকে আমি আপনাদের দীদাতের কথা বলবো। এক কিংবদন্তীর কথা বলবো।
শেখ আহমেদ হোসাইন দীদাত (১লা জুলাই, ১৯১৮ - ৮ই আগষ্ট ২০০৫) এর জন্ম ভারতের গুজরাট প্রদেশের সুরাট জেলায়।
দীদাতের জন্মের কিছুদিন পরেই তার পিতা ইমিগ্রেশন নিয়ে পারি জমান সাউথ আফ্রিকায়। দীদাতের পিতা ছিলেন একজন দর্জি। তার বয়স যখন মাত্র ৯ তখন তিনি পিতার সাথে থাকার জন্য ভাগ্যের অন্বেষণে, সাউথ আফ্রিকা যান। দীদাত সাউথ আফ্রিকা যাওয়ার কয়েকমাস পরেই তার মা ইন্তেকাল করেন। পড়াশোনার প্রতি প্রবল আগ্রহ এবং মেধা থাকা সত্ত্বেও দারিদ্র তাকে standard class-6 এর পরে আর প্রথাগত শিক্ষা নিতে দেয়নি।
জীবিকার জন্য মাত্র পনের বছর বয়সে একজন মুসলিম মালিকের ফার্নিচারের দোকানে চাকুরি করা শুরু করেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন সেসময় সাউথ আফ্রিকার বর্ণবিদ্বেষী সরকারের ছত্রছায়ায় খ্রীষ্টান মিশনারিরা অনেকটা জোর করেই জনগণকে খ্রীষ্ট ধর্মে দীক্ষা দিত এবং প্রকাশ্যে মুসলিমদেরকে নিয়ে কটাক্ষ করতো। শেখ দীদাতের দোকানটি ছিলো নাতাল সাউথ আফ্রিকার একটি খ্রীষ্টান সেমিনারির পাশেই। ট্রেইনি খ্রীষ্টান মিশনারিরা দীদাতের দোকানে প্রায়ই যেতো এবং বিভিন্নভাবে ইসলাম ও রাসূলুল্লাহ্ (সাঃ) সম্পর্কে কটাক্ষ করে মন্তব্য করতো। এদের অপপ্রচারকে মোকাবেলা করার জন্যই শেখ দীদাত তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব এবং ধর্ম গ্রন্থ বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেন।
একদিন ফার্নিচারের দোকানের বেসমেন্টে বইপত্র খুঁজতে গিয়েই তিনি আল্লামা রাহমাতুল্লাহ কীরানবীর বিখ্যাত বই ইযহারুল হক (সত্যের প্রকাশ) এর সন্ধান পান যা তাকে প্রথম যুক্তি দিয়ে ইসলামের বিরুদ্ধে অপপ্রচার মোকাবেলা করার ধারণা দেয়। তার জীবণের প্রথম বাইবেলটি কিনেন এই সময়ই। শুরু হয় তার পথ চলা।
খুব অল্পদিনের মধ্যেই তিনি বাইবেলে অসাধারণ দক্ষতা অর্জন করেন। ট্রেইনি মিশনারিদের তিনি এমন সব প্রশ্ন করতে লাগলেন যার জবাব দিতে না পেরে তারা তাদের শিক্ষকদের সাথে যোগাযোগ করলো।
যুবক দীদাতের ডাক পরলো গীর্জায় এবং যথারিতি এই শিক্ষকদেরকেও তিনি বাইবেল থেকে যুক্তি দিয়েই ঘায়েল করে ফেললেন। ১৯৪২ সালে দীদাত তার প্রথম লেকচারটি দেন মাত্র পনরজন দর্শকের সামনে ডারবান মুভি থিয়েটার (আভালন সিনেমা হল) হলে যার বিষয় ছিলো "Muhammad(PBUH): Messenger of Peace"। সেই ছিলো শুরু পরবর্তীতে তার লেকচারে দর্শক সংখ্যা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকে। দাওয়াতের কাজের প্রথম দিকে দীদাত ডারবানের বিখ্যাত জুম্মা মসজিদের গাইড হিসেবে কাজ করে বিদেশী ট্যুরিষ্টদের কাছে ইসলামের বাণী প্রচার করতে লাগেন এবং খ্রীষ্ট ধর্মের সাথে ইসলামের সম্পর্ক তুলে ধরেন। খ্রীষ্টান পন্ডিতদের সাথে তিনি সরাসরি দর্শকদের উপস্থিতিতে বিতর্কে অংশ নিতে লাগলেন।
তিনি তার সাথে বিতর্ক করার জন্য খোদ Pope John Paul-2 কে প্রকাশ্যে চ্যালেঞ্জ করেন। কিন্তু মাননীয় পোপ মহোদয় একটি রুদ্ধদার বিতর্কের বাইরে অন্য কোন বিতর্কে অংশ নিতে অস্বীকৃতি জানান।
১৯৫৭ সালে শেখ দীদাত তার ঘনিষ্ট বন্ধু তাহির রাসূল এবং গোলাম হোসেন ভাংকরকে নিয়ে Islamic Propagation Center (IPCI) নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে একজন মুসলিম দাতার অর্থ সাহায্যে As-Salaam Educational Institute নামের আরেকটি সংগঠন গড়ে তোলেন। এখান থেকে শেখ আহমেদ দীদাতের লেখা ২০ টি বইয়ের লক্ষ লক্ষ কপি সারা পৃথিবীতে বিনামূল্যে বিতরন করা হয়।
তার বইগুলো আরবী, উর্দু, বাংলা, রাশিয়ান, চীনা, জাপানীজ, ফ্রেঞ্চ, মালয়, জুলুসহ আরো অসংখ্য ভাষায় অনূদিত হয়।
ইসলামের দাওয়াতের কাজে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ১৯৮৬ সালে বিখ্যাত কিং ফয়সাল এওয়ার্ডে ভূষিত হোন। তিনি সৌদী আরব, মিশর, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, পাকিস্তান, মালদ্বীপ, সুইডেন, ডেনমার্ক, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া সহ অসংখ্য দেশ ভ্রমণ করে বক্তৃতা প্রদান করেন এবং বিভিন্ন খ্রীষ্টান পন্ডিতদের সাথে সরাসরি দর্শকদের উপস্থিতিতে বিতর্কে অংশ নেন। ২০০৫ সালের ৮ই আগষ্ট শেখ দীদাত তার নিজ বাড়িতে ইন্তেকাল করেন। তাকে ভেরুলাম গোরস্থানে দাফন করা হয়।
তুলনামূলক ধর্মতত্ত্ব এবং ধর্ম গ্রন্থ বিষয়ে তিনি ছিলেন একজন গভীর জ্ঞানী মানুষ, বিশেষত খ্রিষ্টানদের ধর্মগ্রন্থ বিষয়ে তার মত সুবিখ্যাত পন্ডিত সম্ভবত খোদ খ্রীষ্টানদের মধ্যেও আর নেই।
তথ্যসূত্রঃ
www.ahmed-deedat.co.za
en.wikipedia.org/wiki/Ahmed_Deedat
english.truthway.tv
(আহমেদ দীদাতের লেকচার)
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।