সদ্য প্রয়াত কথাকার হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিক এই সাক্ষাৎকার গুলো গ্রহন করেছিলেন ইমদাদুল হক মিলন। সেই সাক্ষাৎকার গুলো নিয়ে এই পোস্ট। ধারাবাহিক ভাবে দেয়া হবে। চতুর্থ পর্ব , পর্ব ১-৩
৫ম পর্ব
হুমায়ূন আহমেদ এবং হুমায়ূন আহমেদ
ইমদাদুল হক মিলন
বিশেষ দ্রষ্টব্য
'জোছনা ও জননীর গল্প' নিয়ে আমার মতামত প্রকাশের মাঝখানে এই উপন্যাস নিয়ে আরেকটু তথ্য দেওয়া প্রয়োজন। ভোরের কাগজে কয়েক কিস্তি লেখার পর পাক্ষিক 'অন্যদিন' পত্রিকায় উপন্যাসটির বেশ কয়েকটি কিস্তি লিখেছিলেন হুমায়ূন ভাই।
নিউ ইয়র্ক থেকে ফোন করে 'অন্যদিন' সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম এই তথ্য জানালেন। হুমায়ূন ভাইয়ের চিকিৎসা চলছে নিউ ইয়র্কে। স্ত্রী শাওন এবং হুমায়ূন ভাইয়ের দুই পুত্রের সঙ্গে মাজহারও আছেন সেখানে। আবার জোছনা ও জননীর গল্প
আপনি যা করতে বলবেন, করতে পারব। যদি বলেন, ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়ো, আমি পড়ব।
তোর নাম কী?
মোবারক হোসেন। পুলিশ ইন্সপেক্টর।
দেশের বাড়ি কোথায়?
কিশোরগঞ্জ।
ভালো জায়গায় জন্ম। বীর সখিনার দেশ।
ছেলেমেয়ে কী?
তিন মেয়ে, এক ছেলে। তিন মেয়ের নাম_মরিয়ম, মাসুমা,
মাফরুহা আর ছেলের নাম ইয়াহিয়া।
কী বলিস তুই? ছেলের নাম ইয়াহিয়া?
আমার দাদিজান রেখেছেন। নবীর নামে নাম।
আয় আমার সঙ্গে।
স্যার, কোথায় যাব?
তোকে নিয়ে বাড়ির ছাদে উঠব। তারপর তোকে হুমুক দেব ছাদ থেকে লাফ দিয়ে নিচে পড়তে। দেখি হুকুম তামিল করতে পারিস কি না।
মোবারক হোসেন শান্ত গলায় বললেন, 'স্যার, চলেন। '
শেখ মুজিব মোবারক হোসেনকে নিয়ে দোতলায় এলেন।
তিনি তাঁর স্ত্রীকে বললেন, 'এই, আমাদের দুজনকে নাশতা দাও। এ হলো আমার এক ছেলে। '
অতি সামান্য এক ঘটনায়, মাত্র কয়েক লাইনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের চরিত্রের প্রধান দিকটি নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুললেন হুমায়ূম আহমেদ। মানুষের প্রতি এই মহান নেতার তীব্র ভালোবাসা, অন্যদিকে তাঁর জন্য সাধারণ মানুষের ভালোবাসা। জীবন দিয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার।
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের চরিত্রটি এল এভাবে : 'তাঁর চোখ কালো চশমায় ঢাকা। গায়ে ধবধবে সাদা হাফহাতা গেঞ্জি। বসেছেন ঋজু ভঙ্গিতে। বাঁ হাতের কব্জিতে পরা ঘড়ির বেল্ট সামান্য বড় হয়ে যাওয়ায় হাত নাড়ানোর সময় ঘড়ি উঠানামা করছে। এতে তিনি সামান্য বিরক্ত, তবে বিরক্তি বোঝার উপায় নেই।
যে চোখ মানবিক আবেগ প্রকাশ করে, সেই চোখ তিনি বেশির ভাগ সময় কালো চমশায় ঢেকে রাখতে ভালোবাসেন। মানুষটার চারপাশে এক ধরনের রহস্য আছে।
তাঁর নাম জিয়াউর রহমান। '
'মেজর জিয়া এস ফোর্সের অধিনায়ক কে এম শফিউল্লাহ এবং কে ফোর্সের অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফের সঙ্গে এক বৈঠকেও খোলাখুলি নিজের এই মত প্রকাশ করেন। তাঁর কথা হলো_গেরিলা ধরনের এই যুদ্ধে আমাদের সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়কের প্রয়োজন নেই।
আমাদের দরকার কমান্ড কাউন্সিল। সবচেয়ে বড় কথা, সেনাবাহিনী থেকে অবসরপ্রাপ্ত কেউ সেনাবাহিনীর প্রধান হতে পারেন না। '
'জোছনা ও জননীর গল্প'তে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর কথা লেখা হয়েছে এইভাবে : "নিয়াজীর ফোঁপানো একটু থামতেই জেনারেল নাগরা তাঁর পাশে দাঁড়ানো মানুষটির সঙ্গে নিয়াজীর পরিচয় করিয়ে দিলেন। শান্ত গলায় হাসি হাসি মুখে বললেন, এই হচ্ছে সেই টাইগার সিদ্দিকী।
জেনারেল নিয়াজী, জেনারেল জামশেদ অবাক হয়ে দীর্ঘ সময় তাকিয়ে থাকলেন কাদের সিদ্দিকীর দিকে।
তাঁদের স্তম্ভিত ভাব কাটতে সময় লাগল। একসময় নিয়াজী করমর্দনের জন্যে তার হাত বাড়িয়ে দিলেন কাদের সিদ্দিকীর দিকে।
কাদের সিদ্দিকী হাত বাড়ালেন না। তিনি সবাইকে অবাক করে দিয়ে ইংরেজিতে বললেন, 'নারী এবং শিশু হত্যাকারীদের সঙ্গে আমি করমর্দন করি না'। "
এ রকম বহু স্মরণীয় উদ্ধৃতি তুলে ধরতে ইচ্ছা করছে।
কত চরিত্র, কত ঘটনার কথা মনে পড়ছে! শাহেদ, আসমানী, জোহর, মোবারক, গৌরাঙ্গ, নাইমুল, মরিয়ম, শাহ কলিম, রুনি, বি হ্যাপি স্যার, ধীরেন্দ্র রায়চৌধুরী ও কংকন। আর অতি ছোট চরিত্র হারুন মাঝি, যে ছিল একজন ডাকাত। একটি উত্তাল সময় কিভাবে দেশের প্রায় প্রতিটি মানুষকে ঠেলে দিয়েছিল স্বাধীনতার দিকে, কিভাবে দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত হয়ে মৃত্যুকে তুচ্ছ জ্ঞান করেছিল মানুষ, এই উপন্যাসের পাতায় পাতায় ছড়ানো আছে সেই কথা। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের, বিভিন্ন স্তরের মানুষ, কখনো একজন ঠেলাগাড়িওয়ালা, কখনো হুমায়ূন আহমেদের নিজ পরিবার, মা-বাবা, ভাইবোন, পাঙ্খাপুলার রশিদ, নানা স্তরের নানা মানুষ, কারো সঙ্গে কারো হয়তো কোনো সম্পর্ক নেই, আবার সবাই যেন সবার সঙ্গে যুক্ত। যে সুতায় সব মানুষকে একত্রে গেঁথে 'জোছনা ও জননীর গল্প' নামের এই মহৎ মালাটি হুমায়ূন আহমেদ গেঁথেছেন, সেই মালার নাম উনিশ শ একাত্তরের বাংলাদেশ।
উপন্যাসটি পড়তে পড়তে একাত্তরের প্রকৃত ইতিহাস পাওয়া যাবে_ক্রোধে, আবেগে, ঘৃণায়, মমতায় এবং চোখের জলে ভাসবে মানুষ।
"তারও অনেক পরে ঘন কুয়াশার ভেতর দিয়ে বাড়ির সামনে দাড়ি-গোঁফ ভর্তি এক যুবক এসে দাঁড়াল। গম্ভীর গলায় বলল, 'সিঁড়িতে যে মেয়েটি বসে আছে, তাকে কি আমি চিনি?' দীর্ঘকায় এই যুবক দু'হাত ছড়িয়ে দাঁড়িয়ে আছে। মরিয়ম চিৎকার করে বলল, 'মা, দেখ কে এসেছে! মাগো, দেখ কে এসেছে!'
মরিয়ম যুবকটিকে জড়িয়ে ধরে আছে। যুবকের বুকে মুখ ঘষতে ঘষতে বলছে_'আহা, এইভাবে সবার সামনে আমাকে ধরে আছ কেন? আমাকে ছাড় তো।
আমার লজ্জা লাগে। ' নাইমুল কিন্তু তার স্ত্রীকে ধরে ছিল না। তার হাত এখনো প্রসারিত। কঠিন হাতে নাইমুলকে জড়িয়ে ধরেছিল মরিয়ম নিজেই।
পাঠক, মহান বিজয় দিবসে যে গল্প শেষ হবে, সেই গল্প আনন্দময় হওয়া উচিত বলেই আমি এ রকম একটা সমাপ্তি তৈরি করেছি।
বাস্তবের সমাপ্তি এ রকম ছিল না। নাইমুল কথা রাখেনি। সে ফিরে আসতে পারেনি তার স্ত্রীর কাছে। বাংলার বিশাল প্রান্তরের কোথাও তার কবর হয়েছে। কেউ জানে না কোথায়।
এই দেশের ঠিকানাবিহীন অসংখ্য মুক্তিযোদ্ধার কবরের মধ্যে তারটাও আছে, তাতে কিছু যায়-আসে না। বাংলার মাটি পরম আদরে তার বীর সন্তানকে ধারণ করেছে। জোছনা রাতে সে তার বীর সন্তানদের কবরে অপূর্ব নকশা তৈরি করে। গভীর বেদনায় বলে, আহা রে! আহা রে!"
হুমায়ূন আহমেদের 'জোছনা ও জননীর গল্প' শুধু উপন্যাস নয়, উপন্যাসের চেয়ে বেশি কিছু। এ হচ্ছে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে রচিত এক মহাকাব্য।
এত সার্থক ও সুন্দরভাবে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আর কিছু রচিত হয়নি। বাঙালির ঘরে ঘরে এই গ্রন্থ অত্যন্ত যত্নে ও মায়ায় রক্ষিত হবে। কোনো কোনো জোছনা রাতে বাংলার গ্রাম-প্রান্তরের দাওয়ায় বসে একজন তাঁর উদাত্ত গলায় পড়বেন এই উপন্যাসের একেকটি অধ্যায়, আর তাঁর চারপাশ ঘিরে বসে থাকা শ্রোতারা চোখের জলে ভাসবেন। এই উপন্যাস তাঁদের ফিরিয়ে নেবে স্বপ্ন ও দুঃস্বপ্নের সেই মিশ্র সময়ে_উনিশ শ একাত্তরে।
হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার
ইমদাদুল হক মিলন : লেখায় আপনি সব সময় এক ধরনের রহস্য তৈরি করেন।
এসব রহস্য নিয়ে আপনার ব্যাখ্যা কী?
হুমায়ূন আহমেদ : আসলে মিলন, আমার কাছে পুরো জীবনটাই অত্যন্ত রহম্যময়। এই রহস্যের কোনো রকম কূল-কিনারা আমি পাই না। জীবনের যে রহস্যময়তা আছে, সেই রহস্যময়তা কিছুটা হলেও আমি আমার লেখায় আনতে চাই। জীবনের রহস্যময়তা তো আমি প্রায়ই বোধ করি। একদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙল নুহাশপল্লীতে।
বের হয়ে এলাম। সাধারণত আমার এত সকালে ঘুম ভাঙে না। কী কারণে যেন সেদিন ঘুম ভেঙেছে। দেখি দুনিয়ার পাখি ডাকছে। আকাশ সামান্য লাল এবং গজারিগাছগুলোর ভেতর নতুন পাতা।
গাছে যখন নতুন পাতা আসে, তখন সেটা থাকে একদম সফট গ্রিন। ওই সফট গ্রিনের ওপর সূর্যের আলোটা পড়েছে। গ্রিন এবং সূর্যের আলো মিলে মনে হচ্ছে, পাতাগুলো সোনালি হয়ে গেছে। দেখে মনে হলো, আমি আমার জীবনের অসম্ভব সুন্দর একটা দৃশ্য দেখলাম। তখন হঠাৎ মনে হলো, এই দৃশ্যটি কিন্তু একজন কেউ আমাকে দেখাতে চাইছেন।
দেখিয়ে আমাকে আনন্দ দিতে চাইছেন। সেই একজনটা হচ্ছেন গড অলমাইটি। আর দেখে যে আমি মুগ্ধ হলাম, এটাই আমার মনে হলো আমার প্রার্থনা। আলাদা করে বসে প্রেয়ারের চেয়ে তাঁর সৃষ্টি দেখে মুগ্ধ হওয়া_এই প্রেয়ারটি আমার কাছে সব সময় মনে হয় অনেক অনেক ইম্পরট্যান্ট।
ইমদাদুল হক মিলন : পাখি ডাকার রহস্যটা কী ছিল?
হুমায়ূন আহমেদ : ভোরে কত পাখি যে একসঙ্গে ডাকে! এটা তো কখনো আমরা শোনার চেষ্টা করি না।
আমাদের তো ঘুম ভাঙে কাকের ডাকে। ওখানে তো কাক নেই। আমার জীবনে আরো অনেক রহস্যময় ব্যাপার আছে। যেমন ধরো, নুহাশপল্লীতে একটা পুকুর আছে। একদিন দেখলাম, দুটি অতিথি পাখি পুকুরে নেমেছে_ওদের তো নামার কথা বিলে, এখানে তো নামার কথা না।
আমি মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে আছি এবং সবাইকে বললাম, খবরদার! কেউ যেন ডিস্টার্ব না করে ওদের। ওরা নেমে গেছে ওখানে। অতিথি পাখি দুটি হচ্ছে বালিহাঁস। তো, এটা একটা খুব বড় ঘটনা না? আমি ঝিম ধরে বসে আছি পাখি দুটির কাণ্ডকারখানা দেখার জন্য। পরের বছর আমি আশা করেছিলাম, ওরা গিয়ে অন্যদের খবর দেবে যে এখানে ভালো জায়গা আছে।
আরো পাখি আসবে।
ইমদাদুল হক মিলন : আমার মনে হয়, বাংলাদেশে সায়েন্স ফিকশনের জনক যদি কাউকে বলতে হয় তো সে আপনি। সায়েন্স ফিকশনকে বাংলা সাহিত্যে আপনি জনপ্রিয় করেছেন। 'তোমাদের জন্য ভালোবাসা' একটি চমৎকার বই। এটাই তো আপনার লেখা প্রথম সায়েন্স ফিকশন।
এখন আমার কথা হলো, আপনি একাধারে সায়েন্স ফিকশন লিখছেন, আবার ভূতের গল্প-রহস্য গল্প লিখছেন। দুটোকে আপনি মেলাচ্ছেন কী করে? এটাও আমার কাছে রহস্যময় মনে হয়।
হুমায়ূন আহমেদ : তুমি যে রহস্য নিয়ে ঘটঘট করে যাচ্ছ, এটাও তো আমার কাছে রহস্যময় মনে হচ্ছে। আজকের মতো রহস্যের যবনিকাপাত হোক। এসো শেষ করি।
রবীন্দ্রনাথের কবিতা দিয়ে আজকের মতো শেষ করি_
চিরকাল এইসব
রহস্য আছে নীরব।
রুদ্ধ ওষ্ঠাধর।
জন্মান্তের নবপ্রাতে
সে হয়তো আপনাতে
পেয়েছে উত্তর_
সেদিনের মতো আমরা শেষ করলাম। পরদিন শুরু করলাম রবীন্দ্রনাথ নিয়ে
ইমদাদুল হক মিলন : রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন দিয়ে আপনি প্রচুর উপন্যাসের নাম দিয়েছেন। 'শ্যামল ছায়া', 'সে আসে ধীরে', 'তুমি আমায় ডেকেছিলে ছুটির নিমন্ত্রণে', 'সেদিন চৈত্রমাস'_অনেক অনেক লেখা।
রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন দিয়ে উপন্যাসের নাম রেখেছেন কেন?
হুমায়ূন আহমেদ : রবীন্দ্রনাথের কবিতার লাইন দিয়ে উপন্যাসের নাম রাখায় অসুবিধা কোথায়? 'প্রেম করেছি বেশ করেছি'র মতো নামের চেয়ে রবীন্দ্রনাথের নাম সুন্দর না?
ইমদাদুল হক মিলন : এতে বোঝা যায় যে বাংলা কবিতার আপনি একজন অসাধারণ পাঠক। বোঝা যায় যে আপনি রবীন্দ্রনাথ-জীবনানন্দ দাশ প্রচুর পড়েছেন। কবিতাপাঠের ব্যাপারটি আপনার মধ্যে কিভাবে তৈরি হয়েছিল?
হুমায়ূন আহমেদ : আমার বাবা কবিতা মুখস্থ করতে পারলে পয়সা দিতেন। প্রধানত রবীন্দ্রনাথের কবিতা। ছোট কবিতার জন্য এক আনা, দীর্ঘ কবিতার জন্য দুই আনা।
বাবার কাছ থেকে এই পয়সা পাওয়ার জন্যই আমরা ওই সময় কবিতা মুখস্থ করতাম। অর্থাৎ কবিতার প্রতি মমত্ববোধের পেছনে অর্থনীতি কাজ করেছে, ভালোবাসা নয়।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনি যা বললেন, সে তো ছেলেবেলার কথা। কিন্তু এখনো নানা আড্ডায় আপনাকে দেখি যে আপনি রবীন্দ্রনাথ, জীবনানন্দ দাশ, সুধীন্দ্রনাথ, বিষ্ণু দে, অমিয় চক্রবর্তীর কবিতা অনর্গল বলে যাচ্ছেন। আপনার বহু উপন্যাসের পাতায়ও ইংরেজ ও ফরাসি কবিদের উদ্ধৃতি দেখতে পাই।
এতে বোঝা যায় যে আপনি কবিতার সঙ্গে দারুণভাবে সম্পৃক্ত। এটা তো আর সেই ছোটবেলায় পয়সার প্রতি লোভের কারণে নয়।
হুমায়ূন আহমেদ : একটা জিনিস যখন শুরু হয়, তখন তা চলতেই থাকে। আমার স্মৃতিশক্তি আগে ভালো ছিল। একটি কবিতা একবার, দুবার, তিনবার পড়লে মুখস্থ হয়ে যেত।
কবিতা যদি মুখস্থ থাকে, আর আড্ডার মধ্যে যদি একটা দীর্ঘ কবিতা আবৃত্তি করা যায়_সবাই চমকায়। চমকটা আমার ভালো লাগে। আড্ডায় কবিতা পাঠের মানেই হয় না। কবিতা তো নিজের ব্যাপার। আমি তো আবৃত্তিকার নই।
ইমদাদুল হক মিলন : কিন্তু আপনি লেখালেখির শুরুর দিকে কবিতা লিখেছেন, আপনার বোনের নামে সেগুলো ছাপা হয়েছে এবং হুমায়ূন আহমেদ নামেও একটি কবিতার কার্ড ছাপা হয়েছে।
হুমায়ূন আহমেদ : আমি একটি উপন্যাস লিখেছি। নাম 'কবি'। তারাশঙ্করও এই নামে উপন্যাস লিখেছেন_বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠ উপন্যাসগুলোর মধ্যে এটি একটি। সেইখানে আমার মতো একজন লেখকের আরেকজন কবিকে নিয়ে উপন্যাস লেখার ব্যাপারটি কি দুঃসাহসিক নয়? তারাশঙ্করের কবি ছিলেন সেই সময়ের কবি, আর আমার কবি হচ্ছে আজকের কবি।
তাদের জীবনবোধ, জীবনকে দেখার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। তারাশঙ্করের কবি ছিল অতিদরিদ্র, আমার কবিও অতিদরিদ্র। দুজনের মধ্যেই কাব্যপ্রতিভা আছে। এই জিনিসটা নিয়েই লেখালেখির চেষ্টা করেছিলাম আর কি। তো, এই উপন্যাসের জন্যই কবিতার দরকার পড়ল।
কাকে বলব? ভাবলাম আমিই লিখি। একইভাবে আমার একটি টিভি সিরিয়ালে গ্রাম্য গায়কের কিছু গানের দরকার ছিল। নাটকের গান তো, সিকোয়েন্স অনুযায়ী লিখতে হয়। কাকে দিয়ে গান লেখাব? নিজেই লিখলাম। দায়ে পড়ে আর কি! আমি হলাম দায়ে পড়ে কবি, দায়ে পড়ে গীতিকার।
ইমদাদুল হক মিলন : এটা ঠিক নয়। যেকোনো লেখকের জন্যই কবিতা বা গান লেখা বেশ দুরূহ কাজ। কিন্তু আপনার যে কবিতার কার্ড বের হয়েছে কিংবা 'কবি' উপন্যাসে যে টুকরো টুকরো কবিতার লাইন ব্যবহার করেছেন বা আপনার প্রথম উপন্যাস 'শঙ্খনীল কারাগার'-এ যে কবিতার লাইনগুলো রয়েছে_'দিতে পারো একশ' ফানুস এনে/আজন্ম সলজ্জ সাধ একদিন আকাশে ফানুস ওড়াই। ' এটা একজন কবির লেখা কবিতা_তা আপনি যতই ঠাট্টা-তামাশা করুন না কেন! এবং পরবর্তী সময়ে আপনি কিছু অসাধারণ গান লিখেছেন। তার মানে গান, কবিতা_এসব মিলে আপনার মধ্যে কাব্যপ্রতিভা আছেই।
কবিতার ছন্দ, শব্দের ব্যবহার_এসব নিয়েও আপনি অনেক ভেবেছেন। এ ব্যাপারে আপনার ব্যাখ্যাটা কী?
হুমায়ূন আহমেদ : না, আমি কোনো ব্যাখ্যায় যেতে চাইছি না। আমি নিজেকে একজন গল্পকার মনে করি এবং গল্পকার পরিচয়েই আমি অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করি। কবিতাকে বলা হয় সাহিত্যের ফাইনেস্ট ফর্ম। এই ফাইনেস্ট ফর্মে কাজ করার ক্ষমতা আমার নেই।
গদ্যটা হয়তো খানিকটা লিখতে পারি। কবিতা নিয়ে মাঝে মাঝে একটু চেষ্টা চলতে পারে, তাই বলে নিজেকে কখনোই আমি কবি বলি না। সেই প্রতিভাও আমার নেই।
ইমদাদুল হক মিলন : স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে এ দেশের সাহিত্যের দুটি শাখা খুবই ডেভেলপড্_কবিতা ও মঞ্চনাটক। এ দেশের কবিদের সম্পর্কে আপনার অভিমত কী?
হুমায়ূন আহমেদ : বাংলাদেশের সাহিত্যে যাঁরা কবিতা লিখছেন, আগে যাঁরা লিখেছেন, এখন যাঁরা লিখছেন_তাঁদের কাব্যপ্রতিভা সম্পর্কে আমার কোনো সংশয় নেই।
বাংলাদেশ কবির দেশ।
ইমদাদুল হক মিলন : দু-চারজন পছন্দের কবির কথা কি বলবেন?
হুমায়ূন আহমেদ : আমার প্রিয় কবিদের মধ্যে অনেকেই আছেন_শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ। এ ছাড়া রয়েছেন আল মাহমুদ_এখন তাঁর ব্যক্তিগত বিশ্বাস কবিতাকে কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, সে প্রসঙ্গে আমি যাচ্ছি না।
ইমদাদুল হক মিলন : ব্যক্তিগত বিশ্বাস মানে?
হুমায়ুন আহমদ : মানে তাঁর ধর্মবিশ্বাস। অনেকেই বলেন, ধর্মবিশ্বাস তাঁর কাব্যপ্রতিভাকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
যেমন_শীর্ষেন্দু সম্পর্কে বলা হয় যে ধর্মবিশ্বাস তাঁর সাহিত্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
ইমদাদুল হক মিলন : শীর্ষেন্দু তো অনুকূল ঠাকুরের শিষ্য। আপনি কি মনে করেন, শিষ্যত্ব গ্রহণ করার পর তাঁর সাহিত্য ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে?
হুমায়ূন আহমেদ : অনেকে সেটা বলেন। আমি বলি না। ব্যক্তিগত বিশ্বাস সাহিত্যকে কেন ক্ষতি করবে? তাঁদের বিশ্বাসে বিশ্বাস স্থাপন না করলেই হয়।
সাহিত্যের সবটাই আমরা নিই না। আমাদের যতটুকু প্রয়োজন ততটুকু নিই।
ইমদাদুল হক মিলন : সৈয়দ শামসুল হকের কবিতা সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?
হুমায়ূন আহমেদ : কবিতার চেয়ে তাঁর গদ্য আমার বেশি পছন্দ, তার পরও তিনি যে কবি মানুষ, সেটা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।
ইমদাদুল হক মিলন : স্বাধীনতা-উত্তর সময়ে কবিতার পরই_যে কথা আমি কিছুক্ষণ আগেই বলেছি_মঞ্চনাটককে ধরা হয়। মঞ্চনাটক একটি বিরাট জায়গায় পেঁৗছে গেছে এবং আপনি নিজেও কয়েকটি মঞ্চনাটক লিখেছেন।
বাংলাদেশের মঞ্চনাটক সম্পর্কে আপনার বিবেচনাটা কী!
হুমায়ূন আহমেদ : মিলন, শোনো ভাই, আমি মোটামুটি ঘরের কোণে থাকা মানুষ, মঞ্চনাটক দেখতে হলে তো ঘরের বাইরে যেতে হয়_সেই আগ্রহটা কখনোই কোনো দিন বোধ করিনি। আমি অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেছি একা একা টিভির সামনে বসে নাটক দেখতে। সিনেমা হলে ছবি দেখতেও আমার খারাপ লাগে না। ভালো লাগে। কিন্তু মঞ্চনাটক দেখতে কখনোই কেন যেন কোনো আগ্রহ বোধ করিনি।
আরেকটি কথা আমার মনে হয়েছে, একজন লেখক চাইবেন তাঁর রচনা কত দ্রুত মানুষের কাছে পেঁৗছায়। মঞ্চের মাধ্যমে কিন্তু ওই কাজটি আমরা করতে পারি না।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।