সদ্য প্রয়াত কথাকার হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিক এই সাক্ষাৎকার গুলো গ্রহন করেছিলেন ইমদাদুল হক মিলন। সেই সাক্ষাৎকার গুলো নিয়ে এই পোস্ট। ধারাবাহিক ভাবে দেয়া হবে।
আগের পর্বের লিঙ্ক - পর্ব ৫-৬ পর্ব ৪ , পর্ব ১-৩
৭ম পর্ব
হুমায়ূন আহমেদ এবং হুমায়ূন আহমেদ
ইমদাদুল হক মিলন
চুয়াডাঙ্গা থেকে এক ভদ্রমহিলা ফোন করলেন, 'হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আপনার লেখাটা নিয়মিত পড়ছি। তিনি এখন কেমন আছেন এ কথা আপনি একবারও লিখছেন না।
আমরা জানতে চাই তিনি কেমন আছেন। '
আমি বিনীতভাবে বললাম, আমি তাঁর অসুস্থতার কথা লিখতে চাই না। আমার কলম সায় দেয় না। তবে তাঁর অসুস্থতার কথা, তিনি এখন কেমন আছেন_এসব দু-চার দিন পর পর সব কাগজেই লেখা হচ্ছে। আমাদের কালের কণ্ঠেও প্রথম কিংবা শেষ পৃষ্ঠায় আমরা ছাপছি।
ভদ্রমহিলা একটু নাছোড় ধরনের। বললেন, 'আপনি কবে কিভাবে তাঁর অসুস্থতার কথা জানলেন?'
আমার বলতে ভালো লাগছিল না। ব্যস্ততার ভান করে ফোন রেখে দিলাম। আজ এই লেখা লিখতে বসে মনে হচ্ছে, সেই ভদ্রমহিলার মতো হয়তো অনেক পাঠকেরই জানার আগ্রহ, আমি কিভাবে হুমায়ূন আহমেদের অসুস্থতার কথা জানলাম।
ঘটনাটা বলি।
আমার বহু বছরের পুরনো বন্ধু আলমগীর রহমান। বাংলাদেশের অত্যন্ত রুচিশীল ও বিখ্যাত প্রকাশন সংস্থা প্রতীক আর অবসরের স্বত্বাধিকারী। একসময় চমৎকার গল্প লিখতেন, সাংবাদিকতা করতেন। তারপর এলেন প্রকাশনায়। খুবই বন্ধুবৎসল মেজাজি মানুষ আলমগীর ভাই।
হঠাৎ একদিন তাঁর ফোন, 'মিলন, আপনি হুমায়ূনের সঙ্গে দেখা করেন। '
আমি অবাক। হুমায়ূন ভাই সিঙ্গাপুর থেকে ফিরেছেন?
হ্যাঁ। শাশুড়ির পায়ের চিকিৎসার জন্য গিয়েছিল। নিজের চেকআপও করিয়ে আসছে।
আপনি দেখা করেন। তিন দিন পর হুমায়ূন আমেরিকায় যাচ্ছে।
আমি ছিলাম গাড়িতে। অফিসে যাচ্ছিলাম। আলমগীর ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, জরুরি কিছু?
বলতে পারব না।
আপনি দেখা করেন।
আলমগীর ভাইয়ের গলায় এক ধরনের বিষণ্নতা ছিল। তিনি আর কথা বললেন না। ফোন রেখে দিলেন।
আমি একটু চিন্তিত হলাম।
ব্যাপারটা কী?
ফোন করলাম মাজহারকে।
[আমার এই লেখায় প্রায়ই মাজহারের নাম আসে। হুমায়ূন ভাইয়ের পাশের ফ্ল্যাটে থাকেন মাজহার। ঠিক নিচের ফ্ল্যাটে আলমগীর রহমান। মাজহারের পুরো নাম পাঠক জানেন।
মাজহারুল ইসলাম। অন্যদিন গ্রুপের প্রধান নির্বাহী। এই লেখার আগের পর্ব পড়ে মাজহার আমাকে ফোন করলেন, মিলন ভাই, খাসি জবাই করে আকিকা দিয়ে আমার একটা নাম রাখা হয়েছিল_মাজহারুল ইসলাম। আপনি আমার সেই নামটাকে জবাই করে দিচ্ছেন।
আমি একটু হকচকিয়ে গেলাম।
কী বলব বুঝতে পারছি না। মাজহার হো হো করে হাসলেন, 'ঠাট্টা করছি। আমাকে মাজহার বলেই প্রিয়জনরা ডাকে। কোনো অসুবিধা নেই। '
হুমায়ূন ভাইয়ের পাশে থাকতে থাকতে মাজহারও বেশ রসিক হয়ে উঠেছেন।
অথবা মাজহার শুরু থেকেই রসিক। আমাদের বুঝতে দেরি হয়েছে। তবে মাজহারের একটা ডাকনাম আছে। সেই নামটা আমি বলব না। ] কী খবর, মাজহার? আলমগীর ভাই ফোন করে বললেন...
হ্যাঁ, আপনি স্যারের সঙ্গে দেখা করেন।
ব্যাপারটা কী?
মাজহার বিষণ্ন গলায় বললেন, খারাপ খবর আছে।
কী হয়েছে?
হুমায়ূন ভাইয়ের কোলন ক্যান্সার ধরা পড়েছে।
আমি যেন পরিষ্কার বুঝতে পারলাম না কথাটা। কী? কী ধরা পড়েছে?
কোলন ক্যান্সার।
প্রথমে দিশেহারা হলাম, তারপর স্তব্ধ।
কথা বলতে পারছি না।
মাজহার বললেন, "সিঙ্গাপুরে যাওয়ার পর ভাবি বললেন, 'আসছ যখন, তোমার চেকআপটাও করিয়ে নাও। ' চেকআপ করাতে গিয়ে ধরা পড়েছে। ওখানে চিকিৎসা করাতে রাজি হননি। পরশুর পরদিন নিউ ইয়র্কে যাচ্ছেন।
আমিও যাচ্ছি সঙ্গে। মেমোরিয়াল স্লোয়ান ক্যাটারিং ক্যান্সার হাসপাতালে চিকিৎসা হবে। এই হাসপাতালে সোনিয়া গান্ধীরও ক্যান্সারের চিকিৎসা হয়েছে। পৃথিবী-বিখ্যাত হাসপাতাল। "
মাজহার বলে যাচ্ছেন কিন্তু আমার কানে যেন ঢুকছে না কিছুই।
মৃতের মতো অফিসে এলাম। কোনো কাজে মনই বসল না। প্রায় সারাটা দিন আমার রুমের সোফায় শুয়ে রইলাম। রাতেরবেলা একটু আগেভাগেই অফিস থেকে বেরিয়ে গেলাম দখিন হাওয়ায়। গিয়ে দেখি, হুমায়ূন ভাই যে জায়গাটায় বসে লেখালেখি করেন, বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দেন, সেখানে তাঁর পাশে বসে আছেন জুয়েল আইচ।
কিছুক্ষণ পর আলমগীর ভাই এলেন, মাজহার এলেন। আমাকে দেখে সব সময়কার মতো হুমায়ূন ভাই বললেন, 'আসো, মিলন। বসো। '
আমি তাঁর পাশে বসলাম। তিনি শুরু করলেন তাঁর রসিকতা, 'শোনো মিলন, সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথে আমার আর আমার মায়ের বাইপাস হয়েছিল।
একই রুমে পাশাপাশি বেডে রাখা হয়েছিল মা-ছেলেকে। এ রকম ইতিহাস ওই হাসপাতালে নেই। মায়ের পাওয়া গিয়েছিল ৯টি ব্লক, ছেলের ১১টি। এবার ওই হাসপাতালে চেকআপে গেছি। ডাক্তার চেকআপ করে বললেন, অমুক রুমে যাও।
গেলাম। আরেক ডাক্তার চেকআপ করে বললেন, আরে, তোমার তো ক্যান্সার। বললেন এমন ভঙ্গিতে, যেন ক্যান্সার কোনো রোগই না। সর্দি-কাশির মতো সামান্য কিছু। '
আমার এমনিতেই সারা দিন ধরে মন খারাপ।
হুমায়ূন ভাইয়ের রসিকতায় হাসার চেষ্টা করছি, হাসতে পারছি না। জুয়েল আইচের মুখে সব সময় হাসি লেগেই আছে। তিনি আমার দিকে তাকালেন, কিন্তু সব সময়কার মতো প্রাণ খুলে হাসতে পারলেন না। আমি মাথা নিচু করে হুমায়ূন ভাইয়ের পাশে বসে আছি। খানিক পর শাওন এসে বসল পাশে।
সে খুবই উচ্ছল, প্রাণবন্ত। একপলক তার মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারি, ভেতরের গভীর কষ্ট অতিকষ্টে চেপে সে উচ্ছল থাকার চেষ্টা করছে। আমার চোখ ভরে আসছিল কান্নায়, গোপনে চেপে রাখছিলাম চোখের পানি।
হুমায়ূন ভাই নানা রকম কথা বলে যাচ্ছিলেন, তাঁর চিরাচরিত রসিকতাও করছিলেন। 'আমি না থাকলে তো তোমার অনেক সুবিধা।
তুমি তখন একচ্ছত্র রাজত্ব করবে' ইত্যাদি ইত্যাদি।
আমি কাতর গলায় বললাম, প্লিজ, হুমায়ূন ভাই...
শাওন উচ্ছল গলায় বলল, 'না না, মিলন আংকেলকে একক রাজত্ব করতে দেওয়া যাবে না। হুমায়ূন আহমেদ কমপক্ষে আরো ২০ বছর আছে। '
প্রিয় পাঠক, আপনাদের কারো কারো মনে হতে পারে শাওন আমাকে কেন 'মিলন ভাই' না বলে 'মিলন আংকেল' বলছে। আসলে আমাদের কয়েকজনের ক্ষেত্রে শাওন তার অভ্যাসটা বদলাতে পারেনি।
যেমন_আসাদুজ্জামান নূর কিংবা আলমগীর রহমান কিংবা আমি। আমি শাওনকে চিনি ওর শিশু বয়স থেকে। বিটিভির 'নতুন কুঁড়ি'র সময় থেকে। শাওনের গুণের পরিচয় তখন থেকেই জানি। ওর অসাধারণ অভিনয়ের কথা, অসাধারণ গায়কি প্রতিভার কথা, এমনকি টিভি নাটক পরিচালনার কথা সবাই জানে।
আমি তার আরেকটা বড় প্রতিভার কথাও জানি। শাওন খুবই উচ্চমানের একজন নৃত্যশিল্পী। এখন আলোকিত করছে হুমায়ূন আহমেদের জীবন, একসময় আলোকিত করেছিল 'নতুন কুঁড়ি' প্রতিযোগিতা।
কথায় কথায় কত কথা যে আসে!
শাওনকে নিয়ে একটা ঘটনার কথা বলি। নুহাশপল্লীতে হুমায়ূন ভাইয়ের নাটকের শুটিং ছিল।
আমি আর ইফতেখার নামে হুমায়ূন ভাইয়ের এক বন্ধু গেছি তাঁর সঙ্গে আড্ডা দিতে। নাটকের নায়িকা শাওন। পরদিন ইউনিভার্সিটিতে তার জরুরি ক্লাস। বিকেলবেলা ফিরতে হবে। আমি আর ইফতেখার ভাই যে মাইক্রোবাসে ফিরব, শাওনও সেই মাইক্রোবাসে আমাদের সঙ্গে রওনা দিল।
রাস্তায় হঠাৎ আমি শাওনকে বললাম, শাওন একটু পুরনো দিনের হিন্দি গান শোনাও না। দু-চার লাইন যা পারো।
ধারণা ছিল, শাওন এই জেনারেশানের মেয়ে, ও কি আর পুরনো দিনের হিন্দি গান পুরোপুরি জানে কোনোটা? হয়তো দু-চার লাইন গাইতে পারবে।
শাওন আমার ধারণা তছনছ করে দিল। একটার পর একটা পুরনো দিনের হিন্দি গান গাইতে লাগল।
সামসাদ বেগম, নূরজাহান, লতা মুঙ্গেশকর, গীতা দত্ত, এমনকি মোহাম্মদ রফি, মুকেশের গানও। এমন নিখুঁত সুরে, একটি শব্দও ভুল না করে একের পর এক গেয়ে গেল। শাওন একটা করে গান শুরু করে, আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে তার মুখের দিকে তাকাই।
নুহাশ পল্লী থেকে ঢাকা, সারাটা পথ পুরনো দিনের হিন্দি গান গেয়ে শোনাল শাওন। ওর গান শুনতে শুনতে আমি চলে গেলাম আমার ছেলেবেলায়, কৈশোরকালে।
সেই সময়কার আমার পুরান ঢাকার জীবনে, যেখানে চায়ের দোকানে দিনরাত বাজত এসব গান। গ্রামোফোনে, রেডিওতে। বিয়েবাড়ির অনুষ্ঠানেও বাজত।
বাংলার হেমন্ত মুখোপাধ্যায় মুম্বাইয়ে (তখনকার বোম্বাই) গিয়ে হয়েছিলেন হেমন্তকুমার। হিন্দি গান গেয়ে 'নাগিন' ছবির সুর করে ভারতবর্ষ মাত করে দিলেন।
সেদিন শাওন শেষ গানটা গেয়েছিল হেমন্তকুমারের 'আয় আপনা দিল তো আওয়ারা'।
হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার
ইমদাদুল হক মিলন : হুমায়ূন ভাই, আপনি বললেন আপনার ছাত্রের নাম মিসির আলি আর সবাই হো হো করে হেসে উঠল। এই ঘটনার অনেক আগেই আপনি মিসির আলি চরিত্রটা তৈরি ও প্রতিষ্ঠা করে ফেলেছেন। এই যে একটা অন্য রকম নাম_ মিসির আলি_এই নামটা আপনার মাথায় কিভাবে আসে?
হুমায়ূন আহমেদ : লিখতে লিখতেই চলে এসেছে। প্রথম এই নামটা ব্যবহার করি একটি ভৌতিক উপন্যাসে।
'দেবী' নামের একটা ভৌতিক উপন্যাস লিখছি, এ সময় অন্য চরিত্রগুলোর মতোই মিসির আলি নামের একটা চরিত্র দাঁড় করাই। পরবর্তী সময়ে এই মিসির আলিকে নিয়ে যে আরো লেখালেখি করব, সেটা মাথার মধ্যে ছিল না। পরে লিখতে ইচ্ছা হলো, আবার লিখলাম। দেখলাম, মিসির আলি চরিত্রটা দাঁড়িয়ে গেছে। আলাদাভাবে চিন্তাভাবনা করে মিসির আলি তৈরি করিনি।
তুমি যদি আগেকার মিসির আলির গল্প পড়ো তাহলে দেখবে, ওই মিসির আলি কিন্তু এখনকার মিসির আলির মতো নয়। ওইখানে কেবল তার শুরু হয়েছে। এখনকার মিসির আলি এক জিনিস, আর তখনকার মিসির আলি অন্য জিনিস।
ইমদাদুল হক মিলন : প্রচ্ছন্নভাবে পরের দিকে মিসির আলি চরিত্রটি তৈরি করার সময় অন্য কোনো বিখ্যাত লেখকের বিখ্যাত চরিত্র তৈরির ব্যাপারটি আপনার মাথায় কাজ করেছিল কি? যেমন_শার্লক হোমস, প্রফেসর শঙ্কু বা এ-জাতীয় অন্য কোনো চরিত্র?
হুমায়ূন আহমেদ : শার্লক হোমস তো একজন গোয়েন্দা, আর প্রফেসর শঙ্কু একজন পাগলাটে টাইপের বিজ্ঞানী। মিসির আলি সম্পূর্ণ অন্য রকম।
গোয়েন্দাও নয়, আর পাগলাটে টাইপের বিজ্ঞানীও নয়। মিসির আলি অত্যন্ত ঠাণ্ডা মাথার একজন যুক্তিবাদী মানুষ, যার জীবনের পথচলার সম্বল হলো লজিক। প্রফেসর শঙ্কুর জীবনের চালিকাশক্তি হলো বিজ্ঞান। মিসির আলির চালিকাশক্তি লজিক। তিনি লজিক দিয়ে সব কিছু ব্যাখ্যা করতে চান।
কিন্তু কোনো কোনো সময় থমকেও যান, যখন দেখেন এমন বিষয় বা পরিস্থিতির তিনি মুখোমুখি হচ্ছেন, যা তিনি লজিক দিয়ে ব্যাখ্যা করতে পারছেন না। আমি মনে করি, মিসির আলি একটি মৌলিক চরিত্র। অন্য কোনো বিখ্যাত চরিত্রের ছায়া বা প্রভাব এতে নেই মোটেও।
ইমদাদুল হক মিলন : পরিকল্পনাহীনভাবে মিসির আলির মতো এত বড় আর শক্ত একটা চরিত্র তৈরি করা কী করে সম্ভব? এটা কি বিশ্বাস করবে কেউ?
হুমায়ূন আহমেদ : আসলে লিখতে বসেই মিসির আলি চরিত্রটির জন্ম হয়েছে, কেউ বিশ্বাস না করলে তো করার কিছু নেই। হিমুটাও একইভাবে এসেছে।
প্রথমবার হিমুকে নিয়ে লিখতে বসে মোটেও চিন্তা করিনি যে এটা নিয়ে এতগুলো লেখা লিখব। এই লেখাটি যে মানুষের এতটা পছন্দ হবে কখনো ভাবিনি। আমার ছেলে নুহাশ একদিন এসে আমাকে একটা হলুদ পাঞ্জাবি দেখিয়ে বলল, এই পাঞ্জাবিটা বন্ধুরা আমাকে দিয়েছে। হিমুর মতো নানা রকম চিন্তাভাবনা করি তো, তাই বন্ধুরা এটা বানিয়ে দিয়েছে। হিমু পাঞ্জাবি।
হিমু যে হলুদ পাঞ্জাবি পরে, এটা আজ সবাই জানে। হিমু আর মিসির আলির মতো চরিত্রকে যে আমি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি, এটা আমার বড় ধরনের অ্যাচিভমেন্ট। আজ থেকে ৫০ বছর পর আমার সাহিত্যের কী হবে আমি জানি না। এটা আঁচ করা মুশকিল। হয়তো কোনো কিছুই টিকে থাকবে না।
যদি কোনো কিছুই টিকে না থাকে তবু আমার ধারণা, হিমু টিকে থাকবে। মিসির আলি টিকে থাকবে। দু-একটা অদ্ভুত গল্প টিকে থাকবে।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনি 'হিমু' নামটি দেওয়া প্রসঙ্গে একদিন আমাকে বলেছিলেন, অনেক আগে আপনি সুবোধ ঘোষের একটা উপন্যাস পড়েছিলেন। নাম 'শুনো বরনারী'।
এ উপন্যাসের প্রধান চরিত্রের নাম ছিল 'হিমাদ্রী'। ওটা আপনার প্রিয় একটা চরিত্র। ওখান থেকেই কি আপনার মাথায় 'হিমু' নামটি এল, নাকি সাধারণভাবে লেখার জন্য লিখেছেন?
হুমায়ূন আহমেদ : হিমালয় থেকেও তো হিমু হতে পারে। এটা আমি একটা বইয়ে লিখেছি। হিমালয় থেকে হিমু।
ইমদাদুল হক মিলন : মিসির আলির ভেতরেও অনেকখানি রয়েছে আপনার ছায়া, কারণ অসম্ভব যুক্তিবাদী মানুষ আপনি। আবার হিমুর মধ্যে রয়েছে আরেক হুমায়ূন আহমেদ। এই সব মিলিয়ে...
হুমায়ূন আহমেদ : আরেকজন আছে। তাকে বাদ দিলে কেন? শুভ্র আছে না! শুভ্র ছেলেটার মধ্যেও আমি আছি। আমি একের ভেতর তিন।
ইমদাদুল হক মিলন : আচ্ছা, হিমু যে জীবন যাপন করে আর যে বয়সে আছে, শুভ্র যে জীবন যাপন করে আর যে বয়সের মধ্যে আছে এবং মিসির আলির জীবনযাপন ও বয়স_এসবের মধ্য দিয়ে আপনি যে গল্পগুলো তৈরি করছেন, এসব গল্প বা কাহিনীর উপাদান আপনি কোথা থেকে সংগ্রহ করছেন?
হুমায়ূন আহমেদ : আমাদের চারপাশে অহরহ অসংখ্য চমকপ্রদ ঘটনা ঘটছে। এসব ঘটনার মধ্যেই আমরা বেঁচে আছি। লেখকদের একটা প্লাস পয়েন্ট হচ্ছে, তাঁরা একটি ঘটনা যে অন্যটি থেকে আলাদা, তা চট করে বুঝে ফেলেন। এবং ঘটনাটি তাঁদের মাথায় রাখেন, সাধারণ মানুষ যা মাথায় রাখে না বা রাখতে চায় না। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটি বুঝতে পারবে।
একদিন আমি রিকশায় করে যাচ্ছি। হঠাৎ করে আমার মনে হলো, রিকশাওয়ালা মানুষটার শুধু পিঠটাই আমি দেখতে পাচ্ছি। দীর্ঘ সময় এই রিকশায় যাচ্ছি, অথচ আমি তার ফেসটা দেখতে পারছি না। আমার সঙ্গী সে, অথচ তার মুখটাই দেখছি না। আমি যখন ভাড়া দিয়ে চলে যাব, তখন তার যে ফেসটা দেখব, সেটাও আমার মনে থাকবে না।
এটা এমন কোনো জটিল বিষয় নয়। খুব স্বাভাবিক একটা ব্যাপার। কিন্তু থিংকিং প্যাটার্নটা শিফট করছে। একদিন আমি বসে আছি আমাদের বাসায়। দেখি, এক বর্ষা বা বসন্তকালে নতুন পাতা গজিয়েছে আমগাছে।
কী সুন্দর কচি পাতা! তখন হঠাৎ করে আমার মনে হলো, মাই গড! বৃক্ষদের তো প্রতিবছর একবার করে নতুন পাতা গজায়। প্রতিবছর একবার করে তাদের যৌবন আসে। অথচ আমাদের মানুষদের জীবনে যৌবন আসে মাত্র একবার। এটা যে খুব একটা দার্শনিক লেভেলের হায়ার থিংকিং তা কিন্তু নয়। তবু এসব ছোটখাটো বিষয় এমনভাবে মাথায় ঢুকে পড়ে যে পরে তা লেখার মধ্যে চলে আসে।
আর জীবনে তো ছোটখাটো অনেক ঘটনাই ঘটে। সেগুলোও আমার মনে থাকে। উদাহরণ দিই। গতকাল সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে রান্নাঘরে গেছি চা খেতে। গিয়ে দেখি, আমাদের কাজের বুয়াটা একটা সরিষার তেলের শিশি খুলে মুখে ঢালছে।
পুরো বোতল এক টানে শেষ। আমি তো হতভম্ব। কাঁচা সরিষার তেল সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে কেউ খেয়ে ফেলবে, কী আশ্চর্য ব্যাপার! শুধু শুধু কাঁচা তেল খেতে কী মজা লাগে? পরে শুনলাম, বুয়ার খুবই ঠাণ্ডা লেগেছে। সর্দি হচ্ছে। সর্দিতে যদি কেউ কাঁচা সরিষার তেল খায়, তাহলে সর্দিটা ভালো হয়ে যায়।
এই ঘটনা একজন সাধারণ মানুষের কাছে কিছুই নয়। কিন্তু একজন লেখক হিসেবে এই ঘটনা আমাকে অন্যভাবে স্পর্শ করে। এখান থেকে আমি আমার লেখার একটা উপাদান খুঁজে পাই। আমার অবজারভেশনটা এ ধরনের। অন্যদেরও অবজারভেশন আছে, তার প্রয়োগ নেই।
প্রয়োজন নেই বলেই নেই। নুহাশপল্লীর একটা ঘটনা বলি। সেখানে রাজহাঁস আছে। রাজহাঁস ডিম পাড়ল এবং ডিম ফুটে বাচ্চা দিল। বাচ্চাগুলো নিয়ে মা রাজহাঁসটা ঘুরে বেড়ায়।
আমি গভীর আগ্রহে ওদের দিকে তাকিয়ে থাকি। কী করে বাচ্চাগুলোকে সে বড় করছে? দেখি কি, ওখানে-সেখানে এটা-সেটা পড়ে থাকলে মা রাজহাঁস ঠোকর দিয়ে দেখে নিচ্ছে সেটা খাওয়ার যোগ্য কি না। খাওয়ার যোগ্য হলে মা রাজহাঁস কক্কক্ করে মুখ দিয়ে শব্দ করছে, আর অমনি বাচ্চাগুলো ওই খাবারের ওপর হামলে পড়ছে। আরেক দিন হঠাৎ দেখি, একটা বাচ্চা কী যেন জিনিসের টুকরো পেয়েছে। একটা-দুইটা ঠোকর দিয়ে সেটা ফেলে দিয়েছে।
জিনিসটা হলো, একটা ছোট্ট পলিথিনের টুকরো। ওই টুকরোটা আরেকটা বাচ্চা এসে ঠোকর দিল, খেতে না পেরে ফেলে দিল। তার দেখাদেখি আরেকটা এসে পলিথিনের টুকরোটায় ঠোকর দিতে লাগল। তার দেখাদেখি আরেকটা। এমন সময় দেখি মা রাজহাঁসটা দুই পাখা মেলে রাজকীয় ভঙ্গিতে ছুটে এল।
বাচ্চাদের মুখ থেকে ছোঁ মেরে সে পলিথিনের টুকরোটা কেড়ে নিল। তারপর যেভাবে এসেছিল, ঠিক সেভাবেই দুই পাখা মেলে শোঁ শোঁ করে ওটাকে দূরে ফেলে দিয়ে ফিরে এল। তার মানে মা বাচ্চাদের শেখাল, এটা খাবার নয়। এটা নিয়ে টানাটানি করো না তোমরা। এই জিনিসটা আমাকে এত আনন্দ দিল! মে বি আমি আমার লেখক সত্তার দৃষ্টি দিয়ে ঘটনাটা দেখেছি বলেই এত আনন্দ পেয়েছি।
আর যাঁরা লেখালেখি করেন না, তাঁরা হয়তো এই সামান্য ঘটনাকে গুরুত্বই দেবেন না। নিশ্চয়ই তাঁরা ধৈর্য নিয়ে ঘটনার শেষটুকু দেখার জন্য অপেক্ষা করতেন না। লেখকদের অন্য রকম ধৈর্য থাকে। ধৈর্য নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে রাজহাঁসের বাচ্চাগুলো দেখছিলাম বলেই আমার এই ঘটনা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল।
ইমদাদুল হক মিলন : হুমায়ূন ভাই, বাংলা ভাষায় যাঁরা কিছু বিখ্যাত চরিত্র তৈরি করেছেন, যেমন_সত্যজিৎ রায়ের শঙ্কু বা ফেলুদা, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের নীললোহিত বা সন্তু বা কাকাবাবু, নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায়ের টেনিদা, প্রেমেন্দ্র মিত্রের ঘনাদা প্রভৃতি।
আমি যে প্রসঙ্গে কথা বলছি, ছোটদের আনন্দ দেওয়ার জন্য বাংলা সাহিত্যে এমন কিছু চরিত্র তৈরি করা হয়েছিল একসময়। বাংলা সাহিত্যের ট্র্যাডিশনটা ওই রকম। আপনি ছোটদের জন্য এ রকম কোনো হিমু, মিসির আলি বা শুভ্র তৈরি করেননি। অথচ আপনি ছোটদের জন্য প্রচুর সাহিত্য রচনা করেছেন। সে ক্ষেত্রে কেন ছোটদের জন্য কোনো চরিত্র তৈরি করলেন না?
হুমায়ূন আহমেদ : জানি না কেন করলাম না।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার মতো একজন বড়মাপের লেখকের কাছে তো আমরা এ ধরনের কিছু চরিত্র আশা করতে পারি?
হুমায়ূন আহমেদ : কেন, তুমি কি ছোট? হা হা হা।
ইমদাদুল হক মিলন : ছোটদের জন্য লেখালেখি নিয়ে আপনার ভাবনা কী? প্রথম ছোটদের জন্য কবে লেখা শুরু করেন?
হুমায়ূন আহমেদ : প্রথম লেখাটা বোধ হয় 'নীল হাতি'। কবে বের হয়েছিল সেটা ঠিকঠাক বলতে পারব না। অবজারভার গ্রুপ বাচ্চাদের জন্য একটা পত্রিকা বের করেছিল। পত্রিকাটির নাম বোধ হয় 'কিশোর বাংলা'।
ওটার প্রথম সংখ্যার জন্য লেখাটা দিলাম। ভয়ে ভয়ে ছিলাম, বাচ্চাদের জন্য প্রথম লেখা তো... কেমন হয়? ওটাই আমার প্রথম লেখা বাচ্চাদের জন্য। তারপর আমার নিজের বাচ্চারা যখন বড় হলো, তখন ওদের পড়ার জন্য ওদের উপযোগী করে বেশ কয়টি লেখা দাঁড় করাই। ওগুলোতে বেশির ভাগ চরিত্রের নাম ওদের নামেই_নোভা, শীলা, বিপাশা ও নুহাশ। একটা সময় বাচ্চাদের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রচুর বাচ্চাদের বই লিখি।
বাচ্চারা কিন্তু কঠিন পাঠক। বাচ্চাদের মা-বাবা আমাকে ধমক দিতে ভয় পায়। কিন্তু বাচ্চারা পায় না। তারা ধমক দিয়ে আমাকে বলে, কী ব্যাপার, নতুন বই কই? বই নাই কেন? তখন আমি খুব আনন্দ পাই। আমি তখন তাদের বলি, আগামী বইমেলায় তোমাদের জন্য নতুন একটা বই থাকবে।
ওদের মুখের দিকে তাকিয়েই আমাকে কথা রাখতে হয়। এগুলো বাচ্চাদের ফরমায়েশি লেখা বলতে পারো। তবে হ্যাঁ, বাচ্চাদের জন্য লেখার সময় আমাকে খুবই কেয়ারফুল থাকতে হয়। বড়দের জন্য লেখার চেয়ে ছোটদের জন্য লেখাটা অনেক কঠিন। বাচ্চাদের জন্য লেখার সময় আমি কখনোই তাদের বাচ্চা ভেবে লিখি না।
আমি বাচ্চাদের ম্যাচিউরড পাঠক হিসেবে ধরে নিয়েই ওদের জন্য লিখি। বাচ্চাদের জন্য হেলাফেলা করে লেখা যায় না।
ইমদাদুল হক মিলন : কোনো লেখাই তো আপনি হেলাফেলা করে লেখেন না।
হুমায়ূন আহমেদ : কিছু কিছু লেখা অবশ্য সম্পাদক বা প্রকাশকদের চাপে তাড়াহুড়া করে লিখে ফেলতে হয়। ওগুলো তো হেলাফেলার পর্যায়েই পড়ে।
অতি দ্রুত লেখার জন্য যা মনে আসে, তা-ই লিখি। গড়গড় করে লিখে যাই। এগুলো তো হেলাফেলা করেই লেখা।
ইমদাদুল হক মিলন : যদিও আপনি এগুলোকে হেলাফেলা করে লেখা বলছেন, কিন্তু পাঠকের কাছে তো এগুলো পপুলার হয়ে যাচ্ছে। হেলাফেলা করে লেখা কোনো কিছু তো পপুলার হতে পারে না।
এটার রহস্য কী?
হুমায়ূন আহমেদ : লেখা পড়তে ভালো লাগে_এটাই রহস্য। যেমন_হিমুর মতো চরিত্রের কাণ্ডকারখানা সবার ভালো লাগে। কতজনই তো হিমু হতে চায়। [চলবে]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।