সদ্য প্রয়াত কথাকার হুমায়ূন আহমেদের ধারাবাহিক এই সাক্ষাৎকার গুলো গ্রহন করেছিলেন ইমদাদুল হক মিলন। সেই সাক্ষাৎকার গুলো নিয়ে এই পোস্ট। ধারাবাহিক ভাবে দেয়া হবে।
আগের পর্বের লিঙ্ক - পর্ব ৭ , পর্ব ৫-৬ পর্ব ৪ , পর্ব ১-৩
৮ম পর্ব :
হুমায়ূন আহমেদ এবং হুমায়ূন আহমেদ
ইমদাদুল হক মিলন
হুমায়ূন ভাই আর আমি যে একবার বিজনেস প্ল্যান করেছিলাম, সেই ঘটনাটা বলি।
১৯৮৫ সালের কথা।
হুমায়ূন ভাই থাকতেন আজিমপুর কবরস্থানের পশ্চিম-উত্তর দিককার গলির ভেতর তৃতীয় তলার একটি ফ্ল্যাটে। আমি গেণ্ডারিয়ায়। হুমায়ূন ভাইয়ের তো ঢাকা ইউনিভার্সিটির চাকরি আছে, তখন তিনি অ্যাসিস্ট্যান্ট প্রফেসর। আমি একেবারেই বেকার। বাড়ি থেকে বিতাড়িত।
থাকি কলুটোলার একটি বাসায়। চারদিকে ইটের দেয়াল, মাথার ওপর টিনের চাল। আমার স্ত্রী লজ্জায় ওই বাসায় আসেন না। তিনি থাকেন কাছেই তাঁদের তিনতলা বাড়িতে। বিতাড়িত হওয়ার পর শাশুড়ি আমাকেও তাঁদের বাড়িতে থাকতে বলেছিলেন।
ব্যর্থ লোকদের অহংকার তীব্র হয়। আমার পকেটে দশটা টাকাও নেই। তবু শ্বশুরবাড়িতে না থেকে বারো শ না পনেরো শ টাকা দিয়ে যেন ওই টিনশেড ভাড়া নিয়েছি শ্বশুরবাড়ির কাছেই। এই বাসায় আমাকে একদিন দেখতে এসেছিলেন কবি রফিক আজাদ। আমার শোচনীয় অবস্থা দেখে নানা ধরনের জ্ঞান দিয়ে চলে গেলেন।
লেখকদের জীবন এ রকমই হয়... ইত্যাদি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের উদাহরণও দিলেন।
আমার কি আর ওসব কথায় মন ভালো হয়!
মন ভালো করার জন্য দু-এক দিন পরপরই হুমায়ূন ভাইয়ের কাছে যাই। দুপুরে তাঁর ফ্ল্যাটে খাই, বিকেলে আড্ডা দিতে যাই ইউনিভার্সিটি ক্লাবে। দু-এক দিন হুমায়ুন আজাদের বাসায়।
শামসুর রাহমান, সালেহ চৌধুরী, হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ আর এই অধম, আমরা ইন্ডিয়ান এম্বাসির এক ভদ্রলোকের ধানমণ্ডির ফ্ল্যাটেও আড্ডা দিতে যাই কোনো কোনো সন্ধ্যায়। অর্থাৎ আমার খুবই এলোমেলো জীবন।
এর আগে এবং পরে আমি বেশ কয়েকবার ছোটখাটো নানা রকম ব্যবসা-বাণিজ্য করার চেষ্টা করেছি। শুরু করার পর সেই সব ব্যবসায় লালবাতি জ্বলে যেতে একদম সময় লাগেনি। আমার ধারণা, আমার মতো ব্যর্থ ব্যবসায়ী এই পৃথিবীতে আর একজনও নেই।
যদি কখনো আত্মজীবনী লিখি তাহলে একটা চ্যাপ্টারের শিরোনাম হবে 'আমার ব্যর্থ ব্যবসায়ী জীবন'।
যা হোক, ওই টিনশেডের বাসায় এক গরমের দুপুরে বসে ঘামে ভিজতে ভিজতে সিদ্ধান্ত নিলাম, লিখেই রুজি-রোজগারের চেষ্টা করব। এ ছাড়া আমি অন্য কোনো কাজ জানি না। '৭৭ সালের শেষদিকে সাপ্তাহিক 'রোববার' পত্রিকায় ঢুকেছিলাম জুনিয়র রিপোর্টার হিসেবে। পুলিশ নিয়ে রিপোর্ট লেখার কারণে চাকরি চলে গিয়েছিল।
এসব কথা আগেও কোথাও কোথাও লিখেছি, কিন্তু লিখে জীবনধারণের সিদ্ধান্তটা তখন ছিল প্রায় আত্মঘাতী। পত্রপত্রিকা বলতে গেলে হাতে গোনা দু-চারটা। একটা গল্প লিখলে পাওয়া যায় বড়জোর ২০ টাকা। তাও সে টাকা তুলতে বাসভাড়া, রিকশাভাড়া চলে যায় অর্ধেকের বেশি। বিটিভি একমাত্র টিভি চ্যানেল।
তিন মাসে ছয় মাসে একটা নাটক লেখার সুযোগ মেলে। তাও নানা প্রকার ধরাধরি, তদবির। শেষ পর্যন্ত নাটক প্রচারিত হলে টাকা পাওয়া যায় শ চারেক। পাবলিশাররা বই ছাপলে সেই বই কায়ক্লেশে পাঁচ-সাত শ-এক হাজার বিক্রি হয় বছরে। রয়্যালিটি যেটুকু পাওয়া যায় তাতে মাসখানেক চলা মুশকিল।
এ অবস্থায় ও-রকম সিদ্ধান্ত।
তবে সিদ্ধান্ত মোতাবেক কাজ আমি শুরু করলাম। আজানের সময় ঘুম থেকে উঠে লিখতে বসি। টানা ১১টা ১২টা পর্যন্ত লিখি। এক ফাঁকে গরিব মানুষের দিন-দরিদ্র নাশতাটা সেরে নিই।
তারপর যাই বাংলাবাজারে, প্রকাশকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরি। কোথাও কোথাও বসে আড্ডা দিই। দুপুরে কেউ কেউ খাওয়ায়। যেদিন ও-রকম হয় সেদিন আর বাড়ি ফিরি না। একবারে আড্ডা-ফাড্ডা দিয়ে রাতে ফিরি।
হুমায়ূন ভাইও তখন দু-একদিন পরপরই বাংলাবাজারে আসেন। বিউটি বুক হাউস, স্টুডেন্ট ওয়েজ আর নওরোজ কিতাবিস্তানে বসে আড্ডা দিই, চা-সিগ্রেট খাই।
ও-রকম একদিনের ঘটনা।
আমরা দুজনই এক প্রকাশকের কাছ থেকে কিছু টাকা পেয়েছি। দুপুরের দিকে হুমায়ূন ভাই বললেন, চলো আমার বাসায়।
আমি সঙ্গে সঙ্গে রাজি। চলুন।
বাংলাবাজার থেকে রিকশা নিলাম। যাব আজিমপুর। তখনো বাংলাদেশের প্রকাশনা জগৎ আধুনিক হয়নি।
আমাদের বইপত্র তৈরি হয় হ্যান্ড কম্পোজে, প্রচ্ছদ তৈরি হয় হাতে তৈরি ব্লকে। অফসেটে প্রচ্ছদ ছাপার কথা তখনো ভাবতে পারেন না অনেক প্রকাশক।
আমার প্রথম বই 'ভালোবাসার গল্প' ছিল ১২ ফর্মার। দাম ছিল সাত টাকা। আমি রয়্যালিটি পেয়েছিলাম ৪০০ টাকা।
হুমায়ূন ভাইয়ের 'নন্দিত নরকে'র দাম ছিল সাড়ে তিন টাকা। তখন বিশ-ত্রিশ হাজার টাকা হলে বাংলাবাজার এলাকার কোনো গলির ভেতর একটা রুম ভাড়া নিয়ে 'কম্পোজ সেকশন' করা যেত। সিসা দিয়ে তৈরি টাইপ সাজানো থাকে একধরনের কাঠের ছোট ছোট খোপওয়ালা পাত্রে। সামনে টুল নিয়ে বসে একটা একটা করে টাইপ তুলে পাণ্ডুলিপি অনুযায়ী লাইনগুলো তৈরি করে কম্পোজিটর, পৃষ্ঠা তৈরি করে। একেক খোপে একেক অক্ষরের টাইপ।
১৬ পৃষ্ঠা তৈরি হলে এক ফর্মা। ভারী একটা তক্তার ওপর ওই টাইপের দুটো করে পৃষ্ঠা। মোট আটটি ও-রকম কাঠের তক্তা চলে যায় মেশিনে। অর্থাৎ একটা ফর্মা।
এভাবে ছাপা হয় বই।
যারা বই ছাপার কাজ করে, ও-রকম প্রেসগুলোরও অনেকেরই থাকে 'কম্পোজ সেকশন'। ওসব ক্ষেত্রে ইনভেস্টমেন্টটা বেশি। আর মেশিন ছাড়া শুধু 'কম্পোজ সেকশন' ছোটখাটোভাবে করেও অল্প পুঁজিতে ব্যবসা করে কেউ কেউ। ও-রকম কম্পোজ সেকশনের একটা সমস্যা হলো কম্পোজিটররা অনেকেই সিসায় তৈরি টাইপ চুরি করে নিয়ে সের দরে বিক্রি করে ফেলে। পার্টনারশিপে যারা 'কম্পোজ সেকশন' করে তারা নিজেরাও এক পার্টনার আরেক পার্টনারের অজান্তে টাইপ চুরি করে।
বিক্রি করলেই তো ক্যাশ টাকা।
রিকশায় বসে হুমায়ূন ভাইকে আমি বললাম, হুমায়ূন ভাই, চলেন আমরা দুজন একটা বিজনেস করি।
হুমায়ূন ভাই সিগ্রেট টান দিয়ে বললেন, কী বিজনেস?
একটা কম্পোজ সেকশন করি।
হ্যাঁ, করা যায়। ভালো আইডিয়া।
কত টাকা লাগবে?
একেকজনে দশ-পনেরো হাজার করে দিলে হয়ে যাবে।
সেটা দেওয়া যাবে।
তাহলে চলেন শুরু করি।
তোমার টাকা রেডি আছে?
আরে না। দশ টাকাও নেই।
তাহলে?
ধার করতে হবে।
সেটা না হয় করলে, তবে আমার একটা শর্ত আছে।
কী শর্ত?
হুমায়ূন ভাই আমার মুখের দিকে তাকালেন। চুরি করে টাইপ বিক্রির অধিকার সমান থাকতে হবে।
আমি হাসতে হাসতে রিকশা থেকে প্রায় ছিটকে পড়ি।
আমাদের ব্যবসার ওখানেই যবনিকাপাত।
হুমায়ূন আহমেদের সাক্ষাৎকার
ইমদাদুল হক মিলন : হ্যাঁ, আমি অনেক দেখেছি। জানেন, ছেলে হিমু ছাড়াও আমি একদিন মেয়ে হিমুও দেখেছি। হলুদ শাড়ি, হলুদ ব্লাউজ, হলুদ ব্যাগ। হা হা হা।
আচ্ছা, একবার আপনি 'হিমু পার্টি' নামে একটা দল করতে চেয়েছিলেন?
হুমায়ূন আহমেদ : আসলে দেশের রাজনীতির এসব কাদা ছোড়াছুড়ি-নোংরামি আমার ভালো লাগে না। দেশের রাজনীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে ভাবলাম, একটা রাজনৈতিক পার্টি যদি আমি করতে পারতাম 'হিমু পার্টি' নামে এবং হিমু পার্টির প্রত্যেক সদস্য হবে মাথা থেকে পায়ের পাতা পর্যন্ত স্বচ্ছ একেকজন মানুষ। তাদের ভেতর স্বার্থপরতা থাকবে না। তাদের ভেতর কোনো ধরনের ডিজ-অনেস্টি থাকবে না। ওরা যদি একজোট হয়ে রাজনীতিতে নামে, তাহলে অতি দ্রুত এই দেশটা ঠিক করে ফেলা যেত।
এ আইডিয়া থেকেই হিমুর নামে ইচ্ছা হলো একটা পার্টি করি_হিমু পার্টি। রাজনীতি করি। ইলেকশন করি। দেশপ্রেমিক একজন হিমুকে খুঁজে বের করি, যার নেতৃত্বে দেশবাসী তরতর করে এগিয়ে যাবে। ভেদাভেদ ভুলে যাবে।
হানাহানি ভুলে যাবে। উদ্ভট চিন্তাভাবনা। কিন্তু মুশকিল হলো, আমার এই চিন্তাভাবনাকে সবাই একটা ফাজলামি হিসেবে নিল। তারপর আমি দেখলাম যে নাহ, এটা সম্ভব নয়। রাজনীতি করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
এরপর হিমু নামে একটা পত্রিকা বের করার কথাও ভেবেছিলাম, যাতে থাকবে হিমুবিষয়ক গল্প-কবিতা আর হিমুর মতাদর্শ। একেও উদ্ভট আইডিয়া হিসেবে যার কাছে বললাম, সে-ই সরিয়ে রাখল। ফলে পত্রিকাটি আর বের করা হলো না।
ইমদাদুল হক মিলন : এবার অন্য প্রসঙ্গে কথা বলি, আমরা জানি, আপনি ভূতের গল্পের খুব ভক্ত। আপনার সম্পাদনায় ভূতের গল্পের বইও প্রকাশিত হয়েছে।
এ বইটিও পপুলার হয়ে ওঠে। বইটি সম্পর্কে কিছু বলবেন?
হুমায়ূন আহমেদ : এখানে আমার কোনো ক্রেডিট নেই। আমার একটিমাত্র গল্প এ বইটায় আছে। যেসব বিখ্যাত লেখকের মারাত্মক মারাত্মক ভূতের গল্প এ বইটায় আছে, সব ক্রেডিট আসলে তাঁদেরই। গল্পগুলোতে বৈচিত্র্য ছিল, তাই পাঠকরা পছন্দ করেছে।
ইমদাদুল হক মিলন : এবার আপনাকে একটা একান্ত ব্যক্তিগত প্রশ্ন করি। আপনি মাকড়সা ভয় পান। এই ভয়টা আপনার কবে কিভাবে তৈরি হলো?
হুমায়ূন আহমেদ : বলতে পারব না। শুধু আমি একা নই, মাকড়সা ভয় পেতেন আমার বাবা, ভাইবোন, পুরো গুষ্টির সবাই। আমার মা অবশ্য মাকড়সা ভয় পান না।
অন্যরা সবাই ভয় পায়। বাচ্চারা বোধ হয় ভয় পাওয়াটা আমাদের কাছ থেকে শিখেছে। এই মাকড়সাভীতির একটা নাম আছে। নামটা হলো_এই মুহূর্তে মনে পড়ছে না_যা-ই হোক, বিদেশে এটার জন্য সাইকিয়াট্রিস্টরা চিকিৎসা করে। ভয়টা এমন এক পর্যায়ে পেঁৗছে যে তা মানুষের মানসিক ভারসাম্য নষ্ট করে দেয়।
আমার অবশ্য সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যাওয়া হয়নি।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার মাকড়সাভীতির একটা ঘটনার কথা আমার মনে আছে। তখন 'এই সব দিনরাত্রি' টিভিতে দেখানো হচ্ছিল। একটা কাজে আমি আপনার সঙ্গে প্রযোজক মোস্তাফিজুর রহমানের বাসায় যাই। আমার মনে আছে, কলিংবেল টিপতে গিয়ে আপনি প্রচণ্ড একটা চিৎকার দিয়ে লাফ মেরে সরে এলেন।
আমি ভয় পেয়ে গেছি। ঘটনা কী? পরে দেখি কী, কলিংবেলের ওপর একটা মাকড়সা। সেদিন থেকেই আমি বুঝতে পারলাম, মাকড়সাকে আপনি প্রচণ্ড রকম ভয় পান।
হুমায়ূন আহমেদ : জ্যান্ত মাকড়সাই নয়, মাকড়সার ছবিটা পর্যন্ত দেখলে আমার ভয় লাগে। এই ভীতি সীমাহীন।
ইমদাদুল হক মিলন : বাবার ব্যাপারে আপনি প্রচণ্ড দুর্বল, সেটাই স্বাভাবিক, কারণ তিনি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। মায়ের সঙ্গে আপনার রিলেশনটা কেমন?
হুমায়ূন আহমেদ : ছোটবেলায় বেশির ভাগ সময় দেখা যেত, আমি মায়ের আশপাশে ঘুরঘুর করছি। মা কাজ করছেন, আমি মায়ের সঙ্গে আছি। মা রান্না করছেন, আমি পাশে বসা। মা নামাজ পড়ছেন, আমি পাশে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে দেখছি।
কাজেই মায়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কেমন তা নিশ্চয়ই বলার অপেক্ষা রাখে না। আমার মা চমৎকার গল্প বলতে পারেন। আমি সেই গল্প শোনার জন্য উন্মুখ ছিলাম এবং এখনো আছি। আমার মা মানসিকভাবে একজন কঠিন প্রকৃতির মানুষ। শত প্রতিকূলতার মুখেও তাঁকে কখনো ভেঙে পড়তে দেখিনি।
আমার বাবা তো বিষয়-সম্পত্তির প্রতি বরাবরই উদাসীন ছিলেন। বাবার মৃত্যুর পর একাত্তরের পর থেকে আমরা একটা কঠিন সময়ের মধ্যে পড়ে যাই। এ অবস্থায় দেখেছি, মা কিভাবে শক্ত হাতে আমাদের মানুষ করেছেন। এটা নেই, সেটা নেই...কত অভাব! অথচ আমাদের মা এটা আমাদের বুঝতে দেননি। কোনো না কোনোভাবে আমাদের সব চাহিদা-প্রয়োজন তিনি মিটিয়েছেন।
মায়ের কাছ থেকে আমরা অনেক শিখেছি। তিনি একজন মুক্তবুদ্ধির মহিলা।
মিলন, আজ আর না। আজ এখানেই শেষ।
[হুমায়ূন ভাই বলামাত্র আমি থেমে গেলাম, ক্যাসেট রেকর্ডার অফ করা হলো।
রেকর্ডার অন হলো দুদিন পরের সন্ধ্যায়]
ইমদাদুল হক মিলন : আপনারা তিন ভাই ও তিন বোন। আপনার এক ভাই মুহম্মদ জাফর ইকবাল একজন বড়মাপের লেখক। লেখক ছাড়াও অধ্যাপক হিসেবে সারা দেশে জনপ্রিয়। কলাম লেখক হিসেবে জনপ্রিয়। আরেক ভাই আহসান হাবীব কার্টুন এঁকে বিখ্যাত হয়েছেন।
রম্য লেখালেখিতে বিখ্যাত হয়েছেন। একই পরিবারের তিনজন মানুষ তিন রকমভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছেন। এ বিষয়ে আপনার অনুভূতি কেমন?
হুমায়ূন আহমেদ : এরা প্রত্যেকেই নিজ যোগ্যতায় আজকের পর্যায়ে পেঁৗছেছে, নিজস্বভাবেই তারা প্রতিষ্ঠিত। এরা প্রত্যেকে আলাদা মানুষ। সাধারণভাবে একই পরিবারে দু-তিনজন লেখক তৈরি হলে একজনের ছাপ অন্যজনের ওপর পড়ে।
এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আমার ভাইদের মধ্যে ছাপের কোনো ব্যাপার নেই। জাফর ইকবাল লিখছে একেবারে তার নিজস্ব স্টাইলে। আমার লেখার কোনো ছাপ তার মধ্যে নেই। আহসান হাবীব লিখছে সম্পূর্ণ তার মতো করে।
ছবিটবি আঁকছে তার নিজস্ব চিন্তা থেকে। বড় দুই ভাইয়ের কোনো ছাপ তার মধ্যে নেই। প্রত্যেকেই প্রত্যেকের আলাদা জায়গায় কাজ শুরু করেছে এবং ভালো কাজ করছে। আমরা ভাইবোনরা, ইনক্লুডিং মাই সিস্টার্স, যারা লেখালেখির লাইনে আসেনি_এরা প্রত্যেকেই যে কাজটি করে, খুব সিনসিয়ারলি করে। এটা আমাদের পারিবারিক গুণ বলা যেতে পারে।
আমরা ভাইবোনরা কোনো কাজ হাতে নিলে সেটা ঠিকভাবে করব_এটা স্বতঃসিদ্ধ।
ইমদাদুল হক মিলন : জাফর ইকবালের সায়েন্স ফিকশন বা তাঁর অন্যান্য লেখা কি আপনি পড়েন? পড়লে তাঁর লেখা সম্পর্কে বলুন।
হুমায়ূন আহমেদ : জাফর ইকবালের লেখা আমি পড়ি। তার লেখা অবশ্যই খুব ভালো। সে চমৎকার স্টোরি তৈরি করতে পারে।
তার স্টোরির মধ্যে এক ধরনের সারল্য আছে। বাচ্চাদের জন্য লেখালেখির কাজটা সে বেশি করেছে। তাদের জন্য সারল্যটা খুবই প্রয়োজন। সারল্যের পাশাপাশি কিছু সূক্ষ্ম উপদেশের ভাবও তার লেখালেখিতে আছে। সে অধ্যাপনা করে।
এই ব্যাপারটা অধ্যাপনা থেকে এসেছে কি না জানি না। তার লেখায় উপদেশ অংশটা আমার পছন্দ নয়। লেখকরা ঈশপ নয়। তার সায়েন্স ফিকশনগুলো সত্যিকার অর্থেই সায়েন্স ফিকশন। আমার সায়েন্স ফিকশনে মানবিক বিষয়গুলো ঢোকাই, কিন্তু তার সায়েন্স ফিকশন অন্য রকম।
তার সায়েন্স ফিকশন হার্ড-কোর সায়েন্স ফিকশন। আহসান হাবীবও ভালো লেখে। তার লেখায় সহজবোধ্য ব্যাপারটা আছে। রসিকতা আছে। আমার মনে হয়, আমাদের বোনরাও যদি লেখালেখি করত, তাহলে ভালোই লিখত।
আমার শিখু নামে যে বোনটি আছে, সে কী মনে করে তার বড় ভাই সম্পর্কে বিশাল একটা লেখা লিখেছিল। আমি সেই লেখা পড়ে মজা পেয়েছিলাম। ভাষা-বর্ণনাভঙ্গি-ঘটনাবলি আমাকে মুগ্ধ করেছিল। এটা বই হিসেবে বের করার জন্য প্রকাশক আলমগীর রহমানকে দিয়েছিলাম। আলমগীর খুবই আগ্রহের সঙ্গে সেটা নিয়েছিল।
বই প্রকাশের আগে কন্ডিশন দিয়েছিল, এটার মুখবন্ধটা যেন আমি লিখে দিই, আমি তাতে রাজি হইনি। ওই স্ক্রিপ্টটা কোথায় আছে জানি না। আমার সেই বোনটা আবার হাতের কাজ_বাটিকের কাজ করে। সেগুলো বিক্রিও করে। খুবই ইন্টারেস্টিং।
সুফিয়া নামের আমার যে বোনটি আছে, সে মিরপুর বাঙ্লা কলেজের অ্যাসোসিয়েট প্রফেসর। তারও বাংলা লেখার হাত ভালো। আমি যখন আমেরিকায় ছিলাম, তখন বাসায় কী ঘটছে না ঘটছে জানিয়ে সে চিঠি লিখত। চিঠিগুলো লেখার ভঙ্গি খুবই চমৎকার আর গোছানো। আবার আমাদের সব ভাইবোনই কিন্তু টুকটাক ছবি আঁকতে পারে।
জাফর ইকবাল একসময় তার পকেট খরচ চালাত 'গণকণ্ঠ' পত্রিকায় কার্টুন এঁকে। আর আহসান হাবীব তো কার্টুন চালিয়েই যাচ্ছে।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনার পরিবারের অনেকে ছবি আঁকেন। জাফর ইকবাল আঁকেন, আহসান হাবীব আঁকেন। আপনিও আঁকেন।
কয়েক বছর আগে আপনি হঠাৎ রংতুলি নিয়ে ছবি আঁকতে শুরু করলেন। আপনার মধ্যে এক ধরনের ঘোর আমি দেখেছি, দিনের পর দিন আমি আপনাকে ছবি আঁকতে দেখেছি। হঠাৎ করে ছবি আঁকার প্রতি ঝুঁকেছিলেন কেন?
হুমায়ূন আহমেদ : তুমি যে সময়টার কথা বলছ, সেই সময়টা আমি খুবই নিঃসঙ্গতার মধ্যে কাটিয়েছি। একটা বিশাল বাড়িতে একা থাকতাম। আমার ফ্যামিলি মেম্বারদের সঙ্গে সেই অর্থে সে রকম যোগাযোগ ছিল না।
নানা কারণে যোগাযোগটা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। একটা মানুষ তো সারা দিন, সারাক্ষণ লেখালেখির মধ্যে থাকতে পারে না। কিংবা সারাক্ষণ বই পড়তে পারে না। এদিকে বাইরে যে বের হব, তাও ইচ্ছা করে না। ঘরেই থাকতাম।
এই যে একটা দীর্ঘ সময়, আমার কিছুই করার নেই। কিছু করার সমস্যাটা দূর করে নিজেকে ব্যস্ত রাখার জন্যই ছবি আঁকা শুরু করলাম।
ইমদাদুল হক মিলন : মুক্তিযুদ্ধের সময়টা আপনার উপন্যাস-চলচ্চিত্রে ঘুরেফিরে এসেছে। সে সময় আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। আপনার সেই জীবনটা সম্পর্কে জানতে চাই।
হুমায়ূন আহমেদ : মিলন, কিছু কিছু আদর্শ ছাত্র থাকে না, যাদের সমস্ত জীবন বইপত্রের ভেতর আটকে থাকে, এর বাইরে যেন কোনো জগৎ নেই। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমি ছিলাম সে রকম তথাকথিত ভালো ছাত্র। শুধু কেমিস্ট্রি পড়া, এর বাইরে কোনো কিছুর সঙ্গে যোগাযোগ নেই, কোনো খেলাধুলা নেই। একটু অবসর পেলে পাবলিক লাইব্রেরিতে গিয়ে গল্পের বই পড়া_এই ছিল আমার জীবনের বৃত্ত। ঊনসত্তরের গণ-আন্দোলনেও একই ব্যাপার।
বাইরে যখন আন্দোলন চলছে, তখন কিন্তু আমি ঘরের মধ্যে বসা।
ইমদাদুল হক মিলন : কিন্তু ছাত্ররা তখন বসে নেই।
হুমায়ূন আহমেদ : হ্যাঁ, সে সময় মিছিল হচ্ছে, মিটিং হচ্ছে, আন্দোলন হচ্ছে, গুলি হচ্ছে। আমি তখন মুহসীন হলে থাকতাম। গুলি খাওয়া লোকজনকে হলে আনা হয়েছে_এমন দৃশ্য চোখে দেখা।
তার পরও আমি সমস্ত কিছু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একা একা একটা নিজস্ব জীবন যাপন করেছি। পড়াশোনা করেছি, পত্রিকা ও গল্পের বই পড়েছি এবং খুব উচ্চ স্তরের চিন্তাভাবনা করেছি, যেন গণ-আন্দোলনের সঙ্গে আমার কোনো যোগাযোগ নেই। আমি সম্পূর্ণ আলাদা।
ইমদাদুল হক মিলন : উচ্চ ধরনের চিন্তাভাবনা মানে?
হুমায়ূন আহমেদ : উচ্চ ধরনের চিন্তাভাবনা মানে তো তুমি জানো। জানো না? আমি যে এই দেশেরই সন্তান_দেশের সঙ্গে আমার একটা যোগ আছে, দেশের আন্দোলনে যোগ দেওয়াটা ছিল আমার জন্য কর্তব্য।
সেই সামর্থ্যটা আমার ছিল না। অন্য কারণও হতে পারে। মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা একটি ছেলে। বাড়ির বড় ছেলে। তার ঘাড়ে অনেক দায়িত্ব।
তাকে মিটিং-মিছিল করলে চলবে না। তাকে পড়াশোনা করতে হবে। ভালো চাকরি পেতে হবে। একসময় সংসার টানতে হবে। মোট কথা হচ্ছে, সেই সময়ের আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলাম না।
বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরে। সে সময় সরকারি চাকুরে ছিলেন যাঁরা, তাঁরা সবাই ছিলেন অসম্ভব সরকারভক্ত। সরকার যেটা বলছে, সেটাই তাঁরা করেছেন, সরকার ভালো বললে ভালো আর মন্দ বললে মন্দ। আমার বাবাও সে রকম ছিলেন। তাঁর মোহমুক্তি ঘটে, যখন মিলিটারিরা রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করে।
ইমদাদুল হক মিলন : আপনি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে?
হুমায়ূন আহমেদ : না, আমি তখন পিরোজপুরে। বরিশালে। রাজারবাগ পুলিশ লাইন থেকে যখন জানানো হলো, মিলিটারি আক্রমণ করেছে, তখন বাবা বিরাট ধাক্কা খেলেন। আমিও খেলাম। মনে হলো, আমাকে কঠিন একটা ধাক্কা দিয়ে বাস্তবে নিয়ে আসা হলো।
বাস্তব ফেস করার যে ট্রেনিং, সেটাও আমার ছিল না। বাড়ির প্রথম ছেলে আমি। সব সময় আদরে আদরে থেকেছি। বাজার করতে হবে_মা বলছেন, না না ওকে পাঠাতে হবে না। ও বাজারের কী বোঝে? কিন্তু হঠাৎ যখন বাবা মারা গেলেন_যে ছেলেকে জীবনের সমস্ত ঝামেলা থেকে বাইরে রাখা হয়েছে, তার ওপর সমস্ত পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ল।
এদের নিয়ে আমি কোথায় যাব? কোথায় গেলে নিরাপদ থাকব? আমি কি ইন্ডিয়া যাব? কী করে যাব? কে আমাদের আশ্রয় দেবে? মুক্তিযুদ্ধ আমি দেখেছি যুবকের চোখে। যুবকের চোখ, কিশোরের চোখ, বৃদ্ধের চোখ আলাদা। আমি মুক্তিযুদ্ধ যুবকের চোখে খুব কাছ থেকে দেখেছি। শূন্য হাতে দেশে যাওয়া, শর্ষিনার পীর সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নিতে যাওয়া, সেখান থেকে বিতাড়িত হওয়া। যখন ফিরে আসছি, মিলিটারির গানবোট থেকে গুলি হচ্ছে_সেই দৃশ্য দেখা।
হিন্দু যারা আছে, তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছে। প্রত্যেকের কাছে একটা বালিশ। যেখানে যাচ্ছে, আগলে রাখছে বালিশটা। টাকা-পয়সা, গয়না_সব বালিশের মধ্যে ভরা। মানুষ বগলে বালিশ নিয়ে জঙ্গলে ছোটাছুটি করছে।
আহা রে, কী দৃশ্য! সারা দিন কাটত আতঙ্কে। সন্ধ্যার পর একটু স্বস্তি পেতাম। সন্ধ্যা মেলানোর পর মিলিটারি বের হতো না। কিছুদিন পর শুরু হলো রাজাকার-আলবদর বাহিনীর উপদ্রব। [চলবে]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।