আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

যে কবিতা পুরোনো হয়না-পর্ব 'সাতটি তারার তিমির'

আমার খুব কষ্ট হয়, যখন RAJAKAR বানানটা বাংলা বর্ণমালায় লিখা হয়। এটা বর্ণমালার জন্য অপমান।

যে কবিতা পুরোনো হয়না-পর্ব ১ যে কবিতা পুরোনো হয়না-পর্ব ২ যে কবিতা পুরোনো হয়না-পর্ব ৩ যে কবিতা পুরোনো হয়না-পর্ব ৪ যে কবিতা পুরোনো হয়না-পর্ব ৫ যে কবিতা পুরোনো হয়না-পর্ব ৬ জীবনানন্দ দাশ। একজন অদ্ভুত কবি! অদ্ভুত বলি এই জন্য যে, এমন একজন মানুষ খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়ে যাবে-যিনি এই কবি'র কবিতা পড়ে মুগ্ধ হননি। আমার কৈশোরের দিনগুলো আচ্ছন্ন করে রেখেছিলেন ইংরেজীর এই প্রফেসর।

উনার সম্পর্কে কতকিছুই তো বলার আছে! হাজার উপমা দিয়েও তো শেষ হবেনা রূপসী বাংলার এই কবির উপাখ্যান। তার চেয়ে বরং কিছু কবিতা পড়ি! ও হ্যাঁ এই পর্বের সব কবিতাই সাজানো হয়েছে জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে। ইচ্ছে আছে কয়েকটি পর্ব করার। এ পর্বের কবিতাগুলোঃ ============== ৩৯. অবসরের গান-জীবনানন্দ দাশ ৪০. কুড়ি বছর পরে-জীবনানন্দ দাশ ৪১. বনলতা সেন-জীবনানন্দ দাশ ৪২. দু’জন-জীবনানন্দ দাশ ৪৩. শব-জীবনানন্দ দাশ ৩৯. অবসরের গানঃ বনে বাদারে রাতবিরাতে ঘুরে বেড়ানো ছিলো আমার কৈশোরের শখ। এমনি এক রাতে দেখা হয়েছিলো একদল শিয়ালের সাথে।

কয়েকশত। একটি সদ্য কাটা ধানক্ষেতের মাঝে গোল হয়ে বসে তারা ডাকছিলো কোরাসে। অদ্ভুত কোরাস! ভয় পেয়েছিলাম। ওরা চলে যাবার পরে যখন ভয়টা একটু একটু করে কাটতে শুরু করলো, তখন মনে পড়লো জীবনানন্দের অবসরের গানের কিছু লাইনঃ "ইঁদুরেরা চলে গেছে — আঁটির ভিতর থেকে চলে গেছে চাষা; শস্যের ক্ষেতের পাশে আজ রাতে আমাদের জেগেছে পিপাসা!" অবসরের গান শুয়েছে ভোরের রোদ ধানের উপরে মাথা পেতে অলস গেঁয়োর মতো এইখানে কার্তিকের ক্ষেতে মাঠের ঘাসের গন্ধ বুকে তার — চোখে তার শিশিরের ঘ্রাণ, তাহার আস্বাদ পেয়ে অবসাদে পেকে ওঠে ধান, দেহের স্বাদের কথা কয় – বিকালের আলো এসে (হয়তো বা) নষ্ট করে দেবে তার সাধের সময়! চারি দিকে এখন সকাল – রোদের নরম রঙ শিশুর গালের মতো লাল! মাঠের ঘাসের পরে শৈশবের ঘ্রাণ – পাড়াগাঁর পথে ক্ষান্ত উৎসবের পড়েছে আহ্বান! চারি দিকে নুয়ে প’ড়ে ফলেছে ফসল, তাদের স্তনের থেকে ফোঁটা ফোঁটা পড়িতেছে শিশিরের জল! প্রচুর শস্যের গন্ধ থেকে থেকে আসিতেছে ভেসে পেঁচা আর ইঁদুরের ঘ্রাণে ভরা আমাদের ভাঁড়ারের দেশে! শরীর এলায়ে আসে এই খানে ফলন্ত ধানের মতো করে যেই রোদ একবার এসে শুধু চলে যায় তাহার ঠোটের চুমো ধ’রে আহ্লাদের অবসাদে ভরে আসে আমার শরীর, চারি দিকে ছায়া — রোদ — ক্ষুদ — কুঁড়া — কার্তিকের ভিড়: চোখের সকল ক্ষুধা মিটে যায় এই খানে, এখানে হতেছে স্নিগ্ধ কান, পাড়াগাঁর গায় আজ লেগে আছে রূপাশালি ধান ভানা রূপসীর শরীরের ঘ্রাণ! আমি সেই সুন্দরীরে দেখে লই — নুয়ে আছে নদীর এপারে বিয়োবার দেরি না — রূপ ঝরে পড়ে তার – শীত এসে নষ্ট করে দিয়ে যাবে তারে! আজও তবুও ফুরায় নি বৎসরের নতুন বয়স, মাঠে মাঠে ঝ’রে পড়ে কাঁচা রোদ, ভাড়ারের রস! মাছির গানের মতো অনেক অলস শব্দ হয় সকালবেলা রৌদ্রে; কুঁড়িমির আজিকে সময়। গাছের ছায়ার তলে মদ লয়ে কোন্‌ ভাঁড় বেঁধেছিল ছড়া! তার সব কবিতার শেষ পাতা হবে আজ পড়া; ভুলে গিয়ে রাজ্য — জয় — সাম্রাজ্যের কথা অনেক মাটির তলে যেই মদ ঢাকা ছিল তুলে লব তার শীতলতা; ডেকে লব আইবুড় পাড়াগাঁর মেয়েদের সব – মাঠের নিস্তেজ রোদের নাচ হবে – শুরু হবে হেমন্তের নরম উৎসব।

হাতে হাত ধরে ধরে গোল হয়ে ঘুরে ঘুরে ঘুরে কার্তিকের মিঠা রোদে আমাদের মুখ যাবে পুড়ে; ফলন্ত ধানের গন্ধে — রঙে তার — স্বাদে তার ভরে যাবে আমাদের সকলের দেহ; রাগ কেহ করিবে না — আমাদের দেখে হিংসা করিবে না কেহ। আমাদের অবসর বেশি নয — ভালোবাসা আহ্লাদের অলস সময় আমাদের সকলের আগে শেষ হয় দূরের নদীর মতো সুর তুলে অন্য এক ঘ্রাণ — অবসাদ – আমাদের ডেকে লয় — তুলে লয় আমাদের ক্লান্ত মাথা — অবসন্ন হাত। তখন শস্যের গন্ধ ফুরায়ে গিয়েছে ক্ষেতে — রোদ গেছে পড়ে, এসেছে বিকালবেলা তার শান্ত শাদা পথ ধরে; তখন গিয়েছে থেমে অই কুঁড়ে গেঁয়োদের মাঠের রগড় হেমন্ত বিয়ায়ে গেছে শেষ ঝরা মেয়ে তার শাদা মরা শেফালির বিছানার পর; মদের ফোঁটার শেষ হয়ে গেছে এ মাঠের মাটির ভিতর! তখন সবুজ ঘাস হয়ে গেছে শাদা সব, হয়ে গেছে আকাশ ধবল, চলে গেছে পাড়াগাঁর আইবুড়ো মেয়েদের দল! ২ পুরনো পেঁচারা সব কোটারের থেকে এসেছে বাহির হয়ে অন্ধকার দেখে মাঠের মুখের পরে সবুজ ধানের নিচে — মাটির ভিতরে ইঁদুরেরা চলে গেছে — আঁটির ভিতর থেকে চলে গেছে চাষা; শস্যের ক্ষেতের পাশে আজ রাতে আমাদের জেগেছে পিপাসা! ফলন্ত মঠের’ পরে আমরা খুঁজি না আজ মরণের স্থান, প্রেম আর পিপাসার গান আমরা গাহিয়া যাই পাড়াগাঁর ভাঁড়ের মতন! ফসল — ধানের ফলে যাহাদের মন ভরে উঠে উপেক্ষা করিয়া গেছে সাম্রাজ্যেরে, অবহেলা করে গেছে – পৃথিবীর সব সিংহাসন – আমাদের পাড়াগাঁর সেই সব ভাঁড় – যুবরাজ রাজাদের হাড়ে আজ তাহাদের হাড় মিশে গেছে অন্ধকারে অনেক মাটির নীচে পৃথিবীর তলে কোটালের মতো তারা নিশ্বাসের জলে ফুরায় নি তাদের সময়; পৃথিবীর পুরোহিতদের মতো তারা করে নাই ভয়! প্রণয়ীর মতো তারা ছেড়ে নি হৃদয় ছড়া বেঁধে শহরের মেয়েদের নামে! চাষাদের মতো তারা ক্লান্ত হয়ে কপালের ঘামে কাটায় নি — কাটায় কি কাল। অনেক মাটির নিচে তাদের কপাল কোনো এক সম্রাটের সাথে মিশিয়া রয়েছে আজ অন্ধকার রাতে! যোদ্ধা — জয়ী — বিজয়ীর পাঁচ ফুট জমিনের কাছে – পাশাপাশি – জিতিয়া রয়েছে আজ তাদের খুলির অট্টহাসি! অনেক রাতের আগে এসে তারা চলে গেছে — তাদের দিনের আলো হয়েছে আঁধার, সেই সব গেঁয়ো কবি — পাড়াগাঁর ভাঁড় আজ এই অন্ধকারে আসিবে কি আর? তাদের ফলন্ত দেহ শুষে ল’য়ে জন্মিয়াছে আজ এই খেতের ফসল; অনেক দিনের গন্ধে ভরা ঐ ইদুরের জানে তাহা — জানে তাহ নরম রাতের হাতে ঝরা এই শিশিরের জল! সে সব পেঁচারা আজ বিকালের নিশ্চলতা দেখে তাহাদের নাম ধরে যায় ডেকে ডেকে। মাটির নিচের থেকে তারা মৃতের মাথার স্বপ্নে নড়ে উঠে জানায় কী অদ্ভুত ইশারা! আঁধারের মশা আর নক্ষত্র তা জানে – আমরাও আসিয়াছি ফসলের মাঠের আহ্বানে।

সূর্যের আলোর দিন ছেড়ে দিয়ে, পৃথিবীর যশ পিছে ফেলে শহর — বন্দর — বস্তি — কারখানা দেশলাইয়ে জ্বেলে আসিয়াছি নেমে এই ক্ষেতে; শরীরের অবসাদ — হৃদয়ের জ্বর ভুলে যেতে। শীতল চাঁদের মতো শিশিরের ভিজা পথ ধরে আমরা চলিতে চাই, তারপর যেতে চাই মরে দিনের আলোয় লাল আগুনের মুখে পুড়ে মাছির মতন; অগাধ ধানের রসে আমাদের মন আমরা ভরিতে চাই গেয়ো কবি — পাড়াগার ভাঁড়ের মতন! – জমি উপড়ায়ে ফেলে চলে গেছে চাষা নতুন লাঙল তার পড়ে আছে — পুরনো পিপাসা জেগে আছে মাঠের উপরে; সময় হাঁকিয়া যায় পেঁচা অই আমাদের তরে! হেমন্তের ধান ওঠে ফলে – দুই পা ছড়ায়ে বস এইখানে পৃথিবীর কোলে। আকাশের মেঠো পথে থেমে ভেসে চলে চাঁদ অবসর আছে তার — অবোধের মতন আহ্লাদ আমাদের শেষ হবে যখন সে চলে যাবে পশ্চিমের পানে – এটুকু সময় তাই কেটে যাক রূপ আর কামনার গানে! ৩ ফুরোনো ক্ষেতের গন্ধে এইখানে ভরেছে ভাঁড়ার; পৃথিবীর পথে গিয়ে কাজ নাই — কোনো কৃষকের মতো দরকার নাই দূরে মাঠে গিয়ে আর! রোধ — অবরোধ — ক্লেশ — কোলাহল শুনিবার নাহিকো সময় – জানিতে চাই না আর সম্রাট সেজেছে ভাঁড় কোন্‌খানে কোথায় নতুন করে বেবিলন ভেঙে গুঁড়ো হয়! আমার চোখের পাশে আনিয়ো না সৈন্যদের মশালের আগুনের রঙ দামামা থামায়ে ফেল — পেঁচার পাখার মতো অন্ধকারে ডুবে যাক রাজ্য আর সাম্রাজ্যের সঙ! এখানে নাহিকো কাজ — উৎসাহের ব্যথা নাই, উদ্যমের নাহিকো ভাবনা; এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার অনেক উত্তেজনা। অলস মাছির শব্দে ভরে থাকে সকালের বিষন্ন সময়, পৃথিবীরে মায়াবীর নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়! সকল পড়ন্ত রোদ চারি দিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে, এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন – জেগে থেকে ঘুমবার সাধ ভালোবেসে। এখানে চকিত হতে হবে নাকো — ত্রস্ত হয়ে পড়িবার নাহিকো সময়; উদ্যমের ব্যথা নাই — এইখানে নাই আর উৎসাহের ভয়! এই খানে কাজ এসে জমে নাকো হাতে, মাথায় চিন্তার ব্যথা হয় না জমাতে! এখানে সৌন্দর্য এসে ধরিবে না হাত আর – রাখিবে না চোখ আর নয়নের পর; ভালোবাসা আসিবে না – জীবন্ত কৃমির কাজ এখানে ফুরায়ে গেছে মাথার ভিতর! অলস মাছির শব্দে ভরে থাকে সকালের বিষন্ন সময় পৃথিবীর মায়াবীর নদীর পারের দেশ বলে মনে হয়; সকল পড়ন্ত রোদ চারি দিকে ছুটি পেয়ে জমিতেছে এইখানে এসে, গ্রীষ্মের সমুদ্র থেকে চোখের ঘুমের গান আসিতেছে ভেসে, এখানে পালঙ্কে শুয়ে কাটিবে অনেক দিন জেগে থেকে ঘুমাবার সাধ ভালোবেসে! ৪০. কুড়ি বছর পরেঃ "জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার- তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার!" "তখন মুখোমুখি আমি আর শৈশব; মাঝখানে ব্যবধান তিরিশ...অথবা চল্লিশ...অথবা... একা একা পথ চলা..." কুড়ি বছর পরে কুড়ি বছর পরে আবার বছর কুড়ি পরে তার সাথে দেখা হয় যদি! আবার বছর কুড়ি পরে- হয়তো ধানের ছড়ার পাশে কার্তিকের মাসে- তখন সন্ধ্যার কাক ঘরে ফেরে-তখন হলুদ নদী নরম নরম হয় শর কাশ হোগলায়-মাঠের ভিতরে! অথবা নাইকো ধান ক্ষেতে আর, ব্যস্ততা নাইকো আর, হাঁসের নীড়ের থেকে খড় পাখির নীড়ের থেকে খড় ছড়াতেছে; মনিয়ার ঘরে রাত, শীত আর শিশিরের জল! জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুঁড়ি কুঁড়ি, বছরের পার- তখন হঠাৎ যদি মেঠো পথে পাই আমি তোমারে আবার! হয়তো এসেছে চাঁদ মাঝরাতে একরাশ পাতার পিছনে সরু-সরু কালো কালো ডালপালা মুখে নিয়ে তার, শিরীষের অথবা জামের, ঝাউয়ের-আমের; কুড়ি বছরের পরে তখন তোমারে নাই মনে! জীবন গিয়েছে চলে আমাদের কুড়ি কুড়ি বছরের পার- তখন আবার যদি দেখা হয় তোমার আমার! তখন হয়তো মাঠে হামাগুড়ি দিয়ে পেঁচা নামে বাবলার গলির অন্ধকারে অশথের জানালার ফাঁকে কোথায় লুকায় আপনাকে! চোখের পাতার মতো নেমে চুপি চিলের ডানা থামে- সোনালি সোনালি চিল-শিশির শিকার করে নিয়ে গেছে তারে- কুড়ি বছরের পরে সেই কুয়াশায় পাই যদি হঠাৎ তোমারে! ৪১. বনলতা সেনঃ বনলতা সেন যেন চিরপরিচিত মেয়েটি! যার চোখে কৌতুহল, আর অনুভবে রহস্যময়তা...! ঠিক যেন চেনার মাঝে অচেনা কিছু! বনলতা সেন হাজার বছর ধরে আমি পথ হাটিতেছি পৃথিবীর পথে, সিংহল সমুদ্র থেকে নিশীথের অন্ধকারে মালয় সাগরে অনেক ঘুরেছি আমি ; বিম্বিসার অশোকের ধূসর জগতে সেখানে ছিলাম আমি ; আরো দূর অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে ; আমি ক্লান্ত প্রাণ এক, চারি দিকে জীবনের সমুদ্র সফেন, আমারে দুদণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা, মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য ; অতি দূর সমুদ্রের পর হাল ভেঙে যে নাবিক হারায়েছে দিশা সবুজ ঘাসের দেশ যখন সে চোখে দেখে দারুচিনি দ্বীপের ভিতর, তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে ; বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’ পাখির নীড়ের মতো চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন। সমস্ত দিনের শেষে শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে ; ডানার রৌদ্রের গন্ধ মুছে ফেলে চিল ; পৃথিবীর সব রঙ নিভে গেলে পাণ্ডুলিপি করে আয়োজন তথন গল্পের তরে জেনাকীর রঙে ঝিলমিল ; সব পাখী ঘরে আসে – সব নদী – ফুরায় এ-জীবনের সব লেন দেন ; থাকে শুধু অন্ধকার, মুখোমুখি বসিবার বনলতা সেন। ৪২. দুজনঃ প্রেমের কবিতা। অথচ কি অদ্ভুত আবেগ, কিছুটা প্রতিশ্রুতির মতোঃ "দুজনে আজকে তারা চিরস্থায়ী পৃথিবীর ও আকাশের পাশে আবার প্রথম এল-মনে হয় যেন কিছু চেয়ে-কিছু একান্ত বিশ্বাসে। " দুজন আমাকে খোঁজো না তুমি বহুদিন-কতদিন আমিও তোমাকে খুঁজি নাকো; এক নক্ষত্রের নিচে তবু-একই আলো পৃথিবীর পারে আমরা দুজনে আছি; পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়, প্রেম ধীরে মুছে যায় নক্ষত্রেরও একদিন মরে যেতে হয়, হয় নাকি? বলে সে তাকাল তার সঙ্গিনীর দিকে; আজ এই মাঠ সূর্য সহমর্মী অঘ্রাণ কার্তিকে প্রাণ তার ভরে গেছে।

দুজনে আজকে তারা চিরস্থায়ী পৃথিবীর ও আকাশের পাশে আবার প্রথম এল-মনে হয় যেন কিছু চেয়ে-কিছু একান্ত বিশ্বাসে। লালচে হলদে পাতা অনুষঙ্গে জাম বট অশ্বত্থের শাখার ভিতরে অন্ধকারে নড়ে চড়ে ঘাসের উপর ঝরে পড়ে; তারপর সান্ত্বনায় থাকে চিরকাল; যেখানে আকাশে খুব নীরবতা শান্তি খুব আছে, হৃদয়ে প্রেমের গল্প শেষ হলে ক্রমে ক্রমে যেখানে মানুষ আশ্বাস খুঁজেছে এসে সময়ের দায়ভাগী নক্ষত্রের মানুষ আশ্বাস খুঁজেছে এসে সময়ের দায়ভাগী নক্ষত্রের কাছে: সেই ব্যাপ্ত প্রান্তরে দুজন; চারি দিকে ঝাউ আম নিম নাগেশ্বরে হেমন্ত আসিয়া গেছে; চিলের সোনালি ডানা হয়েছে খয়েরি; ঘুঘুর পালক যেন ঝরে গেছে- শালিকের সেই আর দেরি, হলুদ কঠিন ঠ্যাং উঁচু করে ঘুমাবে সে শিশিরের জলে; ঝরিছে মরিছে সব এই খানে বিদায় নিতেছে ব্যাপ্ত নিয়মের ফলে। নারী তার সঙ্গীকে : ‘পৃথিবীর পুরনো পথের রেখা হয়ে যায় ক্ষয়, জানি আমি; — তারপর আমাদের দুঃস্থ হৃদয় কী নিয়ে থাকিবে বল; — একদিন হৃদয়ে আঘাত ঢের দিয়েছে চেতনা, তারপর ঝরে গেছে আজ তবু মনে হয় যদি ঝরিত না হৃদয়ে প্রেমের শীর্ষ আমাদের — প্রেমের অপূর্ব শিশু আরক্ত বাসনা ফুরত না যদি, আহা, আমাদের হৃদয়ের থেকে–’ এই বলে ম্রিয়মাণ আঁচলের সর্বস্বতা দিয়ে মুখ ঢেকে উদ্বেল কাশের বনে দাঁড়িয়ে রইল হাঁটুভর। হলুদরঙের শাড়ি, চোরকাঁটা বিঁধে আছ, এলোমেলো অঘ্রাণের খড় চারি দিকে শূন্য থেকে ভেসে এসে ছুঁয়ে ছেনে যেতেছে শরীর; চুলের উপর তার কুয়াশা রেখেছে হাত, ঝরিছে শিশির;– প্রেমিকের মনে হল : ‘এই নারী-অপরূপ-খুঁজে পাবে নক্ষত্রের তীরে যেখানে রব না আমি, রবে না মাধুরী এই, রবে না হতাশা, কুয়াশা রবে না আর — জনিত বাসনা নিজে — বাসনার মতো ভালোবাসা খুঁজে নেবে অমৃতের হরিণীর ভিড় থেকে ইপ্সিতেরে তার। ’ ৪৩. শবঃ এই কবিতায় মুগ্ধ হই শেষের দুটি লাইন পড়ে।

সেই দুই লাইনের হাত ধরে উপরের গুলো পড়তে আসা। ছোট্ট কবিতায় কি বিমূর্ত প্রতিভা! একমাত্র তিমির হননের কবিই পারেন! শব যেখানে রূপালি জ্যোৎস্না ভিজিতেছে শরের ভিতর, যেখানে অনেক মশা বানায়েছে তাহাদের ঘর; যেখানে সোনালি মাছ খুঁটে-খুঁটে খায় সেই সব নীল মশা মৌন আকাঙ্ক্ষায়? নির্জন মাছের রঙে যেইখানে হ’য়ে আছে চুপ পৃথিবীর একপাশে একাকী নদীর গাঢ় রূপ; কান্তারের একপাশে যে-নদীর জল বাবলা হোগলা কাশে শুয়ে-শুয়ে দেখিছে কেবল বিকালের লাল মেঘ; নক্ষত্রের রাতের আঁধারে বিরাট নীলাভ খোঁপা নিয়ে যেন নারী মাথা নাড়ে পৃথিবীর অন্য নদী; কিন্তু এই নদী রাঙা মেঘ- হ্লুদ-হলুদ জ্যোৎস্না; চেয়ে দ্যাখো যদি; অন্য সব আলো আর অন্ধকার এখানে ফুরালো; লাল নীল মাছ মেঘ- ম্লান নীল জ্যোৎস্নার আলো এইখানে; এইখানে মৃণালিনী ঘোষালের শব ভাসিতেছে চিরদিনঃ নীল লাল রূপালি নীরব।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.