I am not bad boy!
"কলিকাতা" এখানে পুননির্দেশ করা হয়েছে। অন্য ব্যবহারের জন্য, দেখুন কলিকাতা (দ্ব্যর্থতা নিরসন)
কলকাতা
— পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী —
(ঘড়ির কাঁটার ক্রমে) ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল, মাদার তেরেসা সরণি ও ময়দান সংলগ্ন বাণিজ্যাঞ্চল, রবীন্দ্র সেতু, কলকাতার ট্রাম ও বিদ্যাসাগর সেতু-প্রিন্সেপ ঘাট।
(ঘড়ির কাঁটার ক্রমে) ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হল, সেন্ট পলস ক্যাথিড্রাল, মাদার তেরেসা সরণি ও ময়দান সংলগ্ন বাণিজ্যাঞ্চল, রবীন্দ্র সেতু, কলকাতার ট্রাম ও বিদ্যাসাগর সেতু-প্রিন্সেপ ঘাট।
Official seal of কলকাতা
Seal
নীতিবাক্য: পুরশ্রী বিবর্ধন
Kolkata locator map bengali svg.png
দেশ ভারত এর পতাকা ভারত
রাজ্য পশ্চিমবঙ্গ
বিভাগ প্রেসিডেন্সি বিভাগ
জেলা কলকাতা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা (কিয়দংশ)
লোকসভা কেন্দ্র কলকাতা উত্তর, কলকাতা দক্ষিণ, যাদবপুর (কিয়দংশ)
সরকার ব্যবস্থা
- ধরন পৌরসংস্থা
- মহানাগরিক শোভন চট্টোপাধ্যায়
- শেরিফ উৎপল চট্টোপাধ্যায়
আয়তন
- মোট ৭১.৪ sq mi (১৮৫ km²)
উচ্চতা ৩০ ফুট (৯ মিটার)
জনসংখ্যা (২০০৯)
- মোট জনসংখ্যা ১৫,৪১৪,৮৫৯
- জনঘনত্ব ৭১,১২৬.৩/sq mi (২৭,৪৬২/km²)
সময় অঞ্চল ভারতীয় সময় (ইউটিসি+৫.৩০)
PIN ৭০০ xxx
আঞ্চলিক কোড +৯১ ৩৩
† কলকাতা মহানগরীয় অঞ্চল উত্তর চব্বিশ পরগনা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, হাওড়া ও হুগলি জেলা জুড়ে প্রসারিত।
ওয়েবসাইট: [www.kolkatamycity.com]
কলকাতা (পূর্বনাম: কলিকাতা; ইংরেজি: Kolkata, পূর্বে Calcutta সহায়িকা·তথ্য) ভারতের পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী, প্রধান বাণিজ্যকেন্দ্র এবং বৃহত্তম শহর।
হুগলী নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত[১] এই শহরের পৌরএলাকার জনসংখ্যা ৫০ লক্ষের কিছু বেশি। তবে কলকাতা ও তার পার্শ্ববর্তী জেলাগুলির অংশবিশেষ নিয়ে গঠিত বৃহত্তর কলকাতার জনসংখ্যা ১ কোটি ৪০ লক্ষের কাছাকাছি। এই জনসংখ্যার বিচারে কলকাতা ভারতের তৃতীয় বৃহত্তম শহর ও দ্বিতীয় বৃহত্তম মেট্রোপলিটান বা মহানগরীয় অঞ্চল এবং বিশ্বের অষ্টম বৃহত্তম মহানগর অঞ্চল। [২] কলকাতা পৌরএলাকার উত্তর দিকে উত্তর চব্বিশ পরগনা, পূর্বে উত্তর ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা এবং দক্ষিণ দিকে দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলা অবস্থিত। পশ্চিম দিকে হুগলি নদী এই শহরকে হাওড়া জেলা থেকে বিচ্ছিন্ন করেছে।
১৭৭২ সালে মুর্শিদাবাদ শহর থেকে বাংলার রাজধানী কলকাতায় স্থানান্তরিত করা হয়। ১৯১১ সাল পর্যন্ত কলকাতা শুধুমাত্র বাংলারই নয়, বরং সমগ্র ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ছিল। ১৯২৩ সালে ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্টের অধীনে কলকাতার স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন কর্তৃপক্ষ কলকাতা পৌরসংস্থা স্থাপিত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর কলকাতা নবগঠিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের রাজধানী ঘোষিত হয়। এই সময় কলকাতা ছিল আধুনিক ভারতের শিক্ষা, বিজ্ঞান, শিল্প, সংস্কৃতি ও রাজনীতির এক পীঠস্থান।
১৯৫৪ সালের পর থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের ফলে সেই গৌরব অনেকাংশে খর্ব হয়। তবে ২০০০ সালের পর থেকে এই শহর পুনরায় অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক সমৃদ্ধির পথে অগ্রসর হয় এবং সাংস্কৃতিক হৃতগৌরব অনেকাংশেই পুনরুদ্ধার করে। যদিও ভারতের অন্যান্য শহরের মতো কলকাতাতেও নগরায়ণজনিত দারিদ্র্য ও পরিবেশ দূষণ একটি গুরুতর সমস্যা।
কলকাতা শহরের প্রসিদ্ধি এই শহরের বৈপ্লবিক আন্দোলন ও সুদীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন ও পরবর্তীকালে বামপন্থী গণআন্দোলনগুলিতে এই শহর এক বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
অন্যদিকে আধুনিক ভারতের প্রধান প্রধান সাংস্কৃতিক আন্দোলনগুলিরও প্রাণকেন্দ্র এই কলকাতা। এই কারণে এই শহরকে ভারতের সাংস্কৃতিক রাজধানী নামে অভিহিত করা হয়। [৩] আবার কলকাতা শহরে বিভিন্ন ভাষা, জাতি ও ধর্মাবলম্বী মানুষদের শান্তিপূর্ণ ও সৌহার্দ্যময় সহাবস্থানের জন্য এই শহরকে আনন্দ নগরী বা সিটি অফ জয় নামেও অভিহিত করা হয়। রাজা রামমোহন রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, স্বামী বিবেকানন্দ, রোনাল্ড রস, সুভাষচন্দ্র বসু, মাদার তেরেসা, সত্যজিৎ রায়, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, সি ভি রামন, অমর্ত্য সেন প্রমুখ বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বের কর্মভূমি কলকাতা মহানগরী তার সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য আজও বিশ্ববাসীর চোখে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত।
সূচিপত্র
[আড়ালে রাখো]
* ১ নামকরণ
* ২ ইতিহাস
o ২.১ প্রাক-ব্রিটিশ যুগ
o ২.২ সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দী
o ২.৩ বাংলার নবজাগরণ
o ২.৪ ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন
o ২.৫ স্বাধীনোত্তর যুগ
* ৩ ভূগোল
o ৩.১ নগরাঞ্চলের গঠন
o ৩.২ জলবায়ু
* ৪ অর্থনীতি
* ৫ প্রশাসন
o ৫.১ পৌরসংস্থা
o ৫.২ জেলা প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা
o ৫.৩ সংসদীয় ক্ষেত্র
* ৬ জনপরিসংখ্যান
* ৭ সংস্কৃতি
o ৭.১ সাহিত্য
o ৭.২ সংগীত
o ৭.৩ নাটক ও চলচ্চিত্র
o ৭.৪ শিল্প ও স্থাপত্য
o ৭.৫ উৎসব
o ৭.৬ খাদ্যাভ্যাস ও পোষাকপরিচ্ছদ
* ৮ শিক্ষাব্যবস্থা
* ৯ গণমাধ্যম
* ১০ পরিবহণ
* ১১ নাগরিক পরিষেবা
* ১২ খেলাধূলা
* ১৩ ভগিনী নগরী
* ১৪ পাদটীকা
* ১৫ তথ্যসূত্র
* ১৬ বহিঃসংযোগ
[সম্পাদনা] নামকরণ
কালীঘাট মন্দির, ১৮৮৭ খ্রি.; একটি মতে, "কালীক্ষেত্র" শব্দটি থেকে "কলিকাতা" নামটির উৎপত্তি
ব্রিটিশদের আগমনের পূর্বে বর্তমান কলকাতা অঞ্চলে সুতানুটি, গোবিন্দপুর, কলিকাতা নামে তিনটি গ্রাম ছিল।
বাংলা "কলকাতা" ও ইংরেজি "ক্যালকাটা" নামদুটির উৎস এই "কলিকাতা" নামটি। [৪] "কলিকাতা" নামটির ব্যুৎপত্তি প্রসঙ্গে গবেষকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। একটি মতে, "কলিকাতা" শব্দটির উৎপত্তি "কালীক্ষেত্র" শব্দ থেকে; যার অর্থ "দেবী কালীর রাজ্য"। মতান্তরে, এই শব্দটির উৎস বাংলা "কিলকিলা" শব্দটি; যার অর্থ "চ্যাপ্টা অঞ্চল"। [৫] অপর একটি মতে, খাল (নালা) শব্দটির সঙ্গে কাট্টা (খনন করা) শব্দটি যুক্ত হয়ে এই নামটি সৃষ্টি করেছে।
[৬] আবার অন্য একটি মতে এই অঞ্চলে উন্নত মানের কলি (কলিচুন) ও কাতা (নারকেল দড়ি) উৎপাদিত হত বলে এই অঞ্চলের নাম হয় কলিকাতা। [৭] ভাষাতাত্ত্বিক সুকুমার সেন অবশ্য কলিকাতা নামটির একটি সম্পূর্ণ ভিন্নতর ব্যুৎপত্তি ব্যাখ্যা করেছেন। তাঁর মতে:[৮]
'কলিকাতা' – এই পরগণা নামটি এসেছে ফারসিতে গৃহীত দুটি আরবি শব্দের সংযোগে, - 'কলি' (qali) মানে "অস্থির; নির্বোধ", এবং 'কাতা' (qatta) মানে "বদমাইস দল; খুনেরা"। নামটি খুবই সঙ্গত হয়েছিল। কেননা গঙ্গার পূর্বতীর ভাগের খাড়ি, বাদা ও জঙ্গল জলদস্যু, স্থল-ডাকাতি ও বিবিধ দেশি-বিদেশি বদমাইসদের পালিয়ে লুকোবার স্থান ছিল।
২০০১ সালে কলকাতার সরকারি ইংরেজি নাম "ক্যালকাটা" ("Calcutta") পরিবর্তন করে "কলকাতা" ("Kolkata") করা হয়। কেউ কেউ এই নাম পরিবর্তনকে শহরের ব্রিটিশ উত্তরাধিকার সূত্রটি মুছে ফেলার এক প্রচেষ্টা রূপে দেখেছেন। [৯] বিদেশি গণমাধ্যমের সর্বত্র এই নাম পরিবর্তনকে গ্রহণ করা হয়নি। তবে বিবিসি "বোম্বাই"-এর বদলে "মুম্বই"[১০] এবং "ক্যালকাটা"-র বদলে "কলকাতা"[১১] নামদুটি গ্রহণ করেছে।
[সম্পাদনা] ইতিহাস
মূল নিবন্ধ: কলকাতার ইতিহাস
[সম্পাদনা] প্রাক-ব্রিটিশ যুগ
ফোর্ট উইলিয়াম, কলকাতা, উইলিয়াম উড অঙ্কিত, ১৮২৮ খ্রি.
কলকাতার নিকটবর্তী চন্দ্রকেতুগড়ে[১২] প্রত্নতাত্ত্বিক খননকার্য চালিয়ে প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে যে এই অঞ্চলটি বিগত দুই হাজার বছরেরও বেশি সময়কাল ধরে জনবসতিপূর্ণ।
[১৩] মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের একাধিক গ্রন্থে হুগলি নদীর তীরবর্তী কলিকাতা গ্রামের উল্লেখ পাওয়া যায়। এগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বিপ্রদাস পিপলাইয়ের মনসাবিজয় কাব্য (১৪৯৫ খ্রি.), মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কবিকঙ্কণ চণ্ডী (১৫৯৪-১৬০৬ খ্রি.), সৈয়দ আলাওলের পদ্মাবতী (১৬৪৫–৫২ খ্রি.), কৃষ্ণরাম দাসের কালিকামঙ্গল (১৬৭৬–৭৭ খ্রি.), সনাতন ঘোষালের ভাষা-ভাগবত (১৬৭৯–৮০ খ্রি.) ও কৃষ্ণদাসের নারদপুরাণ (১৬৯২ খ্রি.)। [১৪][১৫] ১৫৮২ সালে রাজা টোডরমলের নির্দেশে সমগ্র বাংলা সুবা (প্রদেশ) জরিপ করে ওয়ালিশ-ই-জমা তুমার নামে একটি তালিকা প্রস্তুত করা হয়। আবুল ফজলের আইন-ই-আকবরি (১৫৯০ খ্রি.) গ্রন্থে উদ্ধৃত এই তালিকাটিতে "কলিকাতা" গ্রামটির উল্লেখ রয়েছে। [১৪][১৫] এছাড়াও গোলাম হোসেন সেলিম রচিত রিয়াজ-উস-সালাতিন (১৭৮৬ খ্রি.) নামক একটি ফারসি গ্রন্থেও "কলিকাতা" গ্রামের উল্লেখ রয়েছে।
[১৪]১৬৯০ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় বাণিজ্য বিস্তারের উদ্দেশ্যে এই অঞ্চলে পদার্পন করে। এই সময় থেকেই শহর কলকাতার লিখিত ইতিহাসের সূচনা। জব চার্নক নামে কোম্পানির এক প্রশাসককে সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহাসিকগণ কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা মনে করতেন। [৫] যদিও আধুনিক গবেষকগণ এই মত খণ্ডন করেছেন। ২০০৩ সালে একটি জনস্বার্থ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে কলকাতা হাইকোর্ট জানিয়ে দেন যে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে কলকাতার প্রতিষ্ঠাতা অভিধায় অভিহিত করা যাবে না।
[১৬]
[সম্পাদনা] সপ্তদশ ও অষ্টাদশ শতাব্দী
সেকালের কলকাতা বন্দরে জাহাজ থেকে হাতি নামানোর দৃশ্য, হারপারস উইকলি থেকে, ১৮৫৮ খ্রি.
সপ্তদশ শতাব্দীর শেষভাগে বর্তমান কলকাতা অঞ্চলটি সুতানুটি, গোবিন্দপুর ও ডিহি কলিকাতা নামে তিনটি গ্রামে বিভক্ত ছিল। গ্রাম তিনটি ছিল বাংলার নবাবের প্রত্যক্ষ শাসনাধীনে। এই সময় প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী ওলন্দাজ, পর্তুগিজ ও ফরাসি শক্তিগুলিকে প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে ইংরেজ কর্তৃপক্ষ গোবিন্দপুরে একটি দুর্গনির্মাণের পরিকল্পনা করেন। ১৭০২ সালে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের নির্মাণকার্য সমাপ্ত হয়। [১৭] এই দুর্গটি ছিল একাধারে একটি সেনানিবাস ও আঞ্চলিক সেনা কার্যালয়।
কলকাতা "প্রেসিডেন্সি সিটি" ঘোষিত হয় এবং পরে বাংলা প্রেসিডেন্সির সদরে পরিণত হয়। [১৮] এই সময় ফরাসি বাহিনীর সঙ্গে কোম্পানির ছোটোখাটো সংঘর্ষ লেগেই থাকত। ফরাসিদের ঠেকাতে ১৭৫৬ সালে কোম্পানি ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের সংস্কার শুরু করে। বাংলার তদনীন্তন নবাব সিরাজদ্দৌলা এই সামরিক আয়োজনের প্রতিবাদ জানালেও ইংরেজ কর্তৃপক্ষ তাতে কর্ণপাত করেননি। ক্ষুব্ধ সিরাজ এরপর কলকাতা আক্রমণ করে দুর্গ দখল করে নেন এবং ইংরেজদের কলকাতা থেকে বিতাড়িত করেন।
এরপরই ইংরেজরা কুখ্যাত অন্ধকূপ হত্যার গল্প রটনা করে। [১৯] অবশ্য এক বছর পরে রবার্ট ক্লাইভের নেতৃত্বে কোম্পানির বাহিনী কলকাতা পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিল। [১৯] ১৭৭২ সালে কলকাতা ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী ঘোষিত হয়। পরবর্তীকালে ১৮৬৪ সাল থেকে ভারতের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী অধুনা উত্তরাখণ্ড রাজ্যের শৈলশহর সিমলায় সাময়িকভাবে স্থানান্তরিত করার রেওয়াজ শুরু হয়। [২০] ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে কলকাতার চারপাশের জলাভূমিগুলি বুজিয়ে ফেলা হয়।
হুগলি নদীর তীরবর্তী অঞ্চলে গড়ে ওঠে গভর্নমেন্ট প্লেস বা অফিসপাড়া। লর্ড ওয়েলেসলির (গভর্নর-জেনারেল ১৭৯৭-১৮০৫) শাসনকালে শহরের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি ঘটেছিল। তাঁর আমলেই কলকাতার অধিকাংশ সরকারি ভবনের নির্মাণকার্য শুরু হয়। এই ভবনগুলির বিশালতা ও স্থাপত্যসৌকর্যই কলকাতাকে "প্রাসাদ নগরী" বা "সিটি অফ প্যালেসেস" সম্মান প্রদান করেছিল। [২১] অষ্টাদশ ও ঊনবিংশ শতাব্দীতে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির আফিম ব্যবসার অন্যতম কেন্দ্রও ছিল কলকাতা।
স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত আফিম কলকাতায় নিলামে উঠত এবং তারপর জাহাজবন্দী করে তা চীনে পাঠানো হত। [২২]
[সম্পাদনা] বাংলার নবজাগরণ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বিমান থেকে তোলা কলকাতা বন্দরের দৃশ্য, ১৯৪৫ খ্রি.
মূল নিবন্ধ: বাংলার নবজাগরণ
ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে কলকাতা শহর দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায়। শহরের দক্ষিণে যে অংশে ব্রিটিশরা বাস করতেন সেটিকে বলা হত হোয়াইট টাউন এবং উত্তরে যে অংশে ভারতীয়েরা বাস করত সেটিকে বলা হত ব্ল্যাক টাউন। [২৩] ১৮৫০-এর দশক থেকে কলকাতা শহর বস্ত্রবয়ন ও পাটশিল্পে বিশেষ সমৃদ্ধি অর্জন করতে শুরু করে। এর ফলে ব্রিটিশ সরকার এখানে রেলপথ ও টেলিগ্রাফ প্রকল্পের মতো পরিকাঠামো উন্নয়নমূলক প্রকল্পে প্রচুর অর্থ বিনিয়োগ করেন।
ব্রিটিশ ও ভারতীয় সংস্কৃতির মিশ্রণে শহুরে বাঙালিদের মধ্যে এক নব্য বাবু শ্রেণির উদ্ভব ঘটেছিল। এই বাবুরা ছিলেন সাধারণত উচ্চবর্ণীয় হিন্দু, ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত ও সংবাদপত্রের পাঠক। পেশাগতভাবে এঁরা ছিলেন জমিদার, সরকারি কর্মচারী বা শিক্ষক। [২৪] ঊনবিংশ শতাব্দীতে বাংলার নবজাগরণ নামে পরিচিত যে যুগান্তকারী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংস্কার আন্দোলন বাঙালি সমাজের চিন্তাধারা ও রুচির আমূল পরিবর্তন ঘটাতে সক্ষম হয়েছিল তার পটভূমিও ছিল এই কলকাতা শহর। বাংলার নবজাগরণ শুধু বাংলা নয়, সমগ্র ভারতের পথপ্রদর্শক হয়েছিল।
এই আন্দোলনের পুরোধাপুরুষেরা ছিলেন রাজা রামমোহন রায় (১৭৭২–১৮৩৩), হেনরি লুই ভিভিয়ান ডিরোজিও (১৮০৯–১৮৩১), রামতনু লাহিড়ী (১৮১৩–১৮৯৮), মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর (১৮১৭–১৯০৫), ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর (১৮২০–১৮৯১), বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় (১৮৩৮–১৮৯৪), রামকৃষ্ণ পরমহংস (১৮৩৬–১৮৮৬), কেশবচন্দ্র সেন (১৮৩৮–১৮৮৪), স্বামী বিবেকানন্দ (১৮৬৩–১৯০২) প্রমুখ ব্যক্তিবর্গ।
[সম্পাদনা] ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন
কলকাতার রাস্তায় প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসের দাঙ্গায় নিহতদের মৃতদেহ, ১৯৪৬ খ্রি.
১৮৮৩ সালে রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় জাতীয় সম্মেলনের আয়োজন করেন। এটিই ছিল ঊনবিংশ শতাব্দীর ভারতের প্রথম রাজনৈতিক সম্মেলন। [৫] এরপর ধীরে ধীরে কলকাতা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে পরিণত হয়। বিশেষত বিপ্লবী সংগঠনগুলির অন্যতম প্রধান কেন্দ্রে পরিণত হয় কলকাতা শহর।
১৯০৫ সালে সাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে বঙ্গভঙ্গের প্রতিবাদে কলকাতায় ব্যাপক গণবিক্ষোভ ও ব্রিটিশ দ্রব্য বয়কট (স্বদেশী আন্দোলন) শুরু হয়। [২৫] এই সব গণআন্দোলনের তীব্রতা এবং দেশের পূর্বভাগে অবস্থিত কলকাতা থেকে দেশ শাসনের প্রশাসনিক অসুবিধার কারণে ১৯১১ সালে ব্রিটিশ ভারতের রাজধানী দিল্লিতে স্থানান্তরিত করা হয়। [২৬] ১৯২৩ সালে ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল অ্যাক্টের অধীনে কলকাতার স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন কর্তৃপক্ষ কলকাতা পৌরসংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৪ সালে এই পৌরসংস্থার প্রথম মেয়র নির্বাচিত হন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ। পরবর্তীকালে সুভাষচন্দ্র বসু, বিধানচন্দ্র রায়, আবুল কাশেম ফজলুল হক প্রমুখ বিশিষ্ট স্বাধীনতা সংগ্রামীরা এই পদ অলংকৃত করেছিলেন।
[২৭] দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাপানি সেনাবাহিনী একাধিকবার কলকাতা শহর ও বন্দরে বোমা নিক্ষেপ করেছিল। [২৮] কলকাতায় জাপানি বোমাবর্ষণের প্রথম ও শেষ ঘটনাটি ঘটে যথাক্রমে ১৯৪২ সালের ২০ ডিসেম্বর[২৯] এবং ১৯৪৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর। [৩০] যুদ্ধের সময় কলকাতায় পঞ্চাশের মন্বন্তরে লক্ষাধিক মানুষ অনাহারে মারা যান। এই মন্বন্তরের কারণ ছিল সামরিক তাণ্ডব, প্রশাসনিক ব্যর্থতা ও প্রাকৃতিক দুর্যোগ। [৩১] ১৯৪৬ সালে পৃথক মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তানের দাবিতে এক ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় কলকাতায় চার হাজারেরও বেশি মানুষ প্রাণ হারান।
[৩২][৩৩][৩৪] ভারত বিভাগের সময়ও বহু মানুষ সাম্প্রদায়িকতার শিকার হন। দেশভাগের পর বহুসংখ্যক মুসলমান পূর্ব পাকিস্তানে পাড়ি জমান এবং সেই দেশের লক্ষ লক্ষ হিন্দু কলকাতায় চলে আসেন। এর ফলে শহরের জনপরিসংখ্যানে একটি বিরাট পরিবর্তন সূচিত হয়। [৩৫]
[সম্পাদনা] স্বাধীনোত্তর যুগ
১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীনতা অর্জন করলে ব্রিটিশ বাংলা প্রেসিডেন্সির হিন্দুপ্রধান পশ্চিমাঞ্চল পশ্চিমবঙ্গ নামে ভারতের একটি অঙ্গরাজ্যে পরিণত হয়। কলকাতা এই রাজ্যের রাজধানীর মর্যাদা পায়।
এই সময় দেশভাগ-জনিত তীব্র অর্থনৈতিক সংকট ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে হিন্দু শরণার্থীদের ব্যাপক হারে পশ্চিমবঙ্গে অনুপ্রবেশ রাজ্যের তথা শহরের অর্থনীতির উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে। এই সমস্যার মোকাবিলা করার জন্য পশ্চিমবঙ্গের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় একাধিক কার্যকরী উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করেন। কলকাতার জনসংখ্যার চাপ কমাতে শহরের উপকণ্ঠে চব্বিশ পরগনায় (অধুনা উত্তর চব্বিশ পরগনা জেলা) লবনহ্রদ (অধুনা বিধাননগর) ও নদিয়া জেলায় কল্যাণী নামে দুটি পরিকল্পিত উপনগরী গড়ে তোলা হয়। কলকাতা বন্দরের সাহায্যার্থে সহযোগী হলদিয়া বন্দর নির্মিত হয়। হুগলি নদীর নাব্যতা রক্ষার জন্য ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনাও গৃহীত হয়।
[৩৬] তা সত্ত্বেও বিধানচন্দ্রের মৃত্যুর পর ১৯৬০ ও ১৯৭০-এর দশকে ব্যাপক বিদ্যুৎ বিভ্রাট, ধর্মঘট ও জঙ্গী নকশাল আন্দোলনের ফলে শহরের পরিকাঠামো ব্যবস্থা গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়। ফলে শহরের অর্থনৈতিক অবক্ষয়ের সূত্রপাত ঘটে। [৩৭] ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তানের বহুসংখ্যক মানুষ শরণার্থী হিসাবে কলকাতায় আশ্রয় নিলে শহরের অর্থনীতির উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি হয়। [৩৮] ১৯৮০-এর দশকের মধ্যভাগে কলকাতাকে ছাপিয়ে মুম্বই (তৎকালীন নাম বোম্বাই) ভারতের সর্বাধিক জনবহুল শহরের শিরোপা অর্জন করে। ১৯৯০-এর দশকে ভারত সরকারের অর্থনৈতিক উদারীকরণের নীতি শহরের অর্থনৈতিক হৃতগৌরব পুনরুদ্ধারে অনেকাংশে সহায়ক হয়।
২০০০ সাল থেকে তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প কলকাতার অর্থনীতিতে নতুন গতির সঞ্চার করেছে। শহরের উৎপাদন ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে। [৩৯] বিংশ শতাব্দীর শেষভাগে কলকাতা শহর ছিল ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র। পশ্চিমবঙ্গের ৩৩ বছরের সিপিআই(এম)-নেতৃত্বাধীন বামফ্রন্ট শাসন বিশ্বের দীর্ঘতম মেয়াদের গণতান্ত্রিক পদ্ধতি নির্বাচিত কমিউনিস্ট সরকারের একটি উদাহরণ। [৪০][৪১]
[সম্পাদনা] ভূগোল
ভারতের পূর্বদিকে 22°33′N 88°20′E / 22.55°N 88.333°E / 22.55; 88.333 অক্ষ-দ্রাঘিমাংশে গাঙ্গেয় বদ্বীপ অঞ্চলে কলকাতা মহানগরী অবস্থিত।
সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে শহরের উচ্চতা ১.৫ মিটার থেকে ৯ মিটার পর্যন্ত। [৪২] হুগলি নদীর বামতট বরাবর উত্তর থেকে দক্ষিণে শহরের প্রসার। শহরের অধিকাংশ অঞ্চল একসময় জলাভূমি ছিল। পরে বহু দশক ধরে ধীরে ধীরে শহরের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাপ মেটাতে সেই জলাভূমি ভরাট করে শহরের প্রসার ঘটানো হয়। [৪৩] পূর্ব কলকাতা জলাভূমি নামে পরিচিত অবশিষ্ট জলাভূমি রামসার কনভেনশন অনুসারে একটি “আন্তর্জাতিক গুরুত্বসম্পন্ন জলাভূমি”।
[৪৪]
সিন্ধু-গাঙ্গেয় সমভূমির অধিকাংশ অঞ্চলের মতোই কলকাতার মৃত্তিকাও প্রকৃতিগতভাবে পললসমৃদ্ধ। শহরের মাটির তলায় মাটি, কাদা, বিভিন্ন প্রকার বালি ও পাথরের স্তর দেখা যায়। এই স্তরগুলি দুটি কাদার স্তরের মধ্যে চাপা পড়ে আছে। এই স্তরদুটির নিচের স্তরটির গভীরতা ২৫০-৬৫০ মিটার এবং উপরের স্তরটির গভীরতা ১০-৪০ মিটার। [৪৫] ভারতীয় মানক ব্যুরোর হিসেব অনুসারে, শহরটি সিসমিক ক্ষেত্র-৩-এর অন্তর্গত।
ভূমিকম্পের বৃদ্ধিপ্রবণতার হিসেবে এই অঞ্চলের মাত্রা ১ থেকে ৫-এর মধ্যে। [৪৬] আবার রাষ্ট্রসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির রিপোর্ট অনুযায়ী বায়ুপ্রবাহ ও ঘূর্ণিঝড় ক্ষেত্র হিসেবে কলকাতা “অতি উচ্চ ক্ষয়ক্ষতির ঝুঁকিপ্রবণ” অঞ্চল।
[সম্পাদনা] নগরাঞ্চলের গঠন
মাদার টেরিজা সরণির দক্ষিণে কলকাতার দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় বাণিজ্য অঞ্চল
কলকাতা পৌরসংস্থার এক্তিয়ারভুক্ত নগরাঞ্চলের মোট আয়তন ১৮৫ বর্গকিলোমিটার। [৪৭] অন্যদিকে, ২০০৬ সালের হিসেব অনুযায়ী বৃহত্তর কলকাতা নামে পরিচিত শহরের নগরাঞ্চলীয় বিস্তারের মোট আয়তন ১৭৫০ বর্গকিলোমিটার। [৪৭] এই অঞ্চলের মধ্যে ডাকবিভাগের ১৫৭টি অঞ্চল রয়েছে।
[৪৮] বৃহত্তর কলকাতার শাসনকর্তৃত্ব ৩৮টি পুরসভা সহ একাধিক কর্তৃপক্ষের হাতে ন্যস্ত। বৃহত্তর কলকাতায় মোট ৭২টি শহর এবং ৫২৭টি ছোটো শহর ও গ্রাম রয়েছে। [৪৭] কলকাতা মহানগরীয় জেলার শহরতলি অঞ্চলটি উত্তর চব্বিশ পরগনা, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা, হাওড়া, হুগলি ও নদিয়া জেলা পর্যন্ত প্রসারিত।
মূল শহরের পূর্ব থেকে পশ্চিমের বিস্তার অত্যন্ত সংকীর্ণ। পশ্চিমে হুগলি নদী থেকে পূর্বে ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাস পর্যন্ত শহরের প্রস্থ মাত্র ৫-৬ কিলোমিটার।
[৪৯] উত্তর থেকে দক্ষিণে শহরের প্রসার মোটামুটিভাবে তিন ভাগে বিভক্ত – উত্তর কলকাতা, মধ্য কলকাতা ও দক্ষিণ কলকাতা। শ্যামপুকুর, হাতিবাগান, শ্যামবাজার, বাগবাজার, কুমোরটুলি, জোড়াসাঁকো প্রভৃতি কলকাতার পুরনো এলাকাগুলি উত্তর কলকাতায় অবস্থিত। দক্ষিণ কলকাতার বিস্তার স্বাধীনতার পর। টালিগঞ্জ, ভবানীপুর, আলিপুর, নিউ আলিপুর, ঢাকুরিয়া প্রভৃতি শহরের বিলাসবহুল অঞ্চল এই দক্ষিণ কলকাতায় অবস্থিত। শহরের উত্তর-পূর্ব দিকে অবস্থিত বিধাননগর (অন্যনামে সল্টলেক বা লবনহ্রদ) কলকাতার একটি পরিকল্পিত স্যাটেলাইট টাউনশিপ।
জ্যোতি বসু নগর নামে আরও একটি পরিকল্পিত টাউনশিপও কলকাতার উত্তর-পূর্ব দিকে গড়ে উঠছে। কলকাতার পশ্চিমে হাওড়া শহরের প্রান্তে গড়ে উঠছে কলকাতা পশ্চিম আন্তর্জাতিক মহানগরী নামে আর একটি শহরও। ইস্টার্ন মেট্রোপলিটান বাইপাসের পার্শ্ববর্তী অঞ্চলেও দ্রুত জনবসতির বিস্তার ঘটছে।
মধ্য কলকাতা শহরের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল। বিনয়-বাদল-দীনেশ বাগ বা বিবাদীবাগকে কেন্দ্র করে এখানেই গড়ে উঠেছে কলকাতার কেন্দ্রীয় বাণিজ্য অঞ্চল।
মহাকরণ, জিপিও, হাইকোর্ট, লালবাজার পুলিশ সদর, কলকাতা পৌরসংস্থা সহ একাধিক সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কার্যালয় এখানে অবস্থিত। শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত ময়দান নামক এক সুবৃহৎ মাঠে বিভিন্ন ক্রীড়ানুষ্ঠান ও রাজনৈতিক সমাবেশের আয়োজন হয়ে থাকে। কলকাতার দ্বিতীয় কেন্দ্রীয় বাণিজ্য অঞ্চলটি গড়ে উঠেছে মাদার টেরিজা সরণির দক্ষিণে। এখানেও বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার কার্যালয় রয়েছে।
[সম্পাদনা] জলবায়ু
রবীন্দ্র সেতুর উপর বর্ষার মেঘ
কলকাতার জলবায়ু "ক্রান্তীয় সাভানা" প্রকৃতির ("কোপেন জলবায়ু শ্রেণিবিভাগ" অনুসারে Aw)।
বার্ষিক সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ২৬.৮° সেন্টিগ্রেড এবং মাসিক সর্বনিম্ন তাপমাত্রা ১৯°-৩০° সেন্টিগ্রেডের মধ্যে থাকে। [৫০] এখানে গ্রীষ্মকাল উষ্ণ ও আর্দ্র। এই সময় সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা ৩০° সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি থাকলেও মে-জুন মাসে সর্বোচ্চ গড় তাপমাত্রা প্রায়শই ৪০° সেন্টিগ্রেড ছাড়িয়ে যায়। [৫০] শীতকাল সাধারণত মাত্র আড়াই মাস স্থায়ী হয়। ডিসেম্বর-জানুয়ারি মাসে সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা ৯°-১১° সেন্টিগ্রেডের কাছাকাছি থাকে।
শহরের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন তাপমাত্রার রেকর্ড যথাক্রমে ৪৩.৯° সেন্টিগ্রেড ও ৫° সেন্টিগ্রেড। [৫০] সাধারণভাবে মে মাস শহরের উষ্ণতম মাস। এই সময় শহরের সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা থাকে যথাক্রমে ৩৭° সেন্টিগ্রেড ও ২৭° সেন্টিগ্রেড। অন্যদিকে জানুয়ারি শীতলতম মাস। জানুয়ারির সর্বোচ্চ ও সর্বনিম্ন গড় তাপমাত্রা যথাক্রমে ২৩° সেন্টিগ্রেড ও ১২° সেন্টিগ্রেড।
গ্রীষ্মের শুরুতে প্রায়শই শিলাবৃষ্টি, ঝড় ও বজ্রবিদ্যুৎ সহ বৃষ্টিপাত হয়ে থাকে। এই ধরনের ঝড়বৃষ্টি প্রকৃতিগতভাবে পরিচলন। এর স্থানীয় নাম কালবৈশাখী। [৫১]
দক্ষিণ-পূর্ব মৌসুমি বায়ুর বঙ্গোপসাগরীয় শাখাটি শহরে বৃষ্টিপাত ঘটানোর জন্য দায়ী। [৫২] বর্ষাকাল সাধারণত স্থায়ী হয় জুন থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত।
শহরের বার্ষিক ১৫৮২ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতের অধিকাংশই এই সময়ে ঘটে থাকে। অগস্ট মাসে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ সর্বোচ্চ থাকে। এই সময় গড়ে ৩০৬ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়। কলকাতা বার্ষিক ২,৫২৮ ঘণ্টার সূর্যালোক পেয়ে থাকে। অধিকাংশ সূর্যালোক প্রাপ্তির সময় মার্চ মাস।
[৫৩] দূষণ কলকাতার অন্যতম প্রধান সমস্যা। ভারতের অন্যান্য প্রধান শহরের তুলনায় কলকাতার সাসপেন্ডেড পার্টিকুলেট ম্যাটার] বা এসপিএম-এর হার এতটাই বেশি যে এর ফলে প্রায়শই ধোঁয়া ও কুয়াশা সৃষ্টি হয়। [৫৪][৫৫] মারাত্মক বায়ুদূষণের ফলে শহরে ফুসফুসের ক্যান্সার সহ দূষণসৃষ্ট অসুখবিসুখ বৃদ্ধি পেয়েছে। [৫৬]
[সম্পাদনা] অর্থনীতি
মূল নিবন্ধ: কলকাতার অর্থনীতি
কগনিজেন্ট টেকনোলজি সলিউশনস ভবন, বিধাননগর, সেক্টর ফাইভ ইলেকট্রনিকস কমপ্লেক্স
কলকাতা পূর্ব ভারত ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলের ব্যবসাবাণিজ্য ও অর্থনীতির প্রধান কেন্দ্র। কলকাতায় অবস্থিত কলকাতা শেয়ার বাজার ভারতের দ্বিতীয় বৃহত্তম শেয়ার বাজার।
[৫৭] এটি একটি প্রধান বাণিজ্যিক ও সামরিক বন্দরও বটে। পশ্চিমবঙ্গের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরটি কলকাতাতেই অবস্থিত। একদা ভারতের রাজধানী ও অগ্রণী শিল্পনগরী কলকাতা স্বাধীনোত্তর কালে অস্থির রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও জঙ্গি ট্রেড-ইউনিয়ন আন্দোলনের শিকার হয়ে দ্রুত আর্থিক অবনতির পথে এগিয়ে যায়। [৫৮] ১৯৬০-এর দশক থেকে ১৯৯০-এর দশক পর্যন্ত একদিকে যেমন মূলধন বিনিয়োগ উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসে, তেমনি অন্যদিকে বন্ধ হয়ে যেতে থাকে বৃহৎ কলকারখানাগুলি। অধিকাংশ কলকারখানাগুলির উৎপাদন কমে আসে।
অনেকেই ব্যবসা অন্যত্র সরিয়ে নেন। [৫৮] মূলধন ও সম্পদের এই হ্রাসের সঙ্গে যুক্ত হয় বিশ্ববাজারে এই অঞ্চলে উৎপাদিত ঐতিহ্যবাহী দ্রব্যগুলির (যেমন পাট ইত্যাদি) চাহিদা হ্রাস। ফলে শহরের আর্থিক অবস্থায় গুরুতর সংকট দেখা দেয়। [৫৯]
১৯৯০-এর দশকে ভারতীয় অর্থনীতির উদারীকরণ কলকাতার ভাগ্যোন্নয়নে বিশেষ সহায়ক হয়। আজও নমনীয় উৎপাদন কলকাতার অর্থব্যবস্থার একটি বৈশিষ্ট্য।
ঘরোয়া সেক্টরগুলি তাই এখানে মোট শ্রমশক্তির ৪০% অধিকার করে আছে। [৬০] উদাহরণস্বরূপ, ২০০৫ সালের হিসাব অনুযায়ী ফুটপাথের হকারদের মোট বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৮,৭৭২ কোটি ভারতীয় টাকা (প্রায় ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার)। [৬১] শহরের অন্যতম বৃহৎ কর্মশক্তি হল রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারি কর্মচারীগণ। এছাড়াও বিভিন্ন কায়িক ও বৌদ্ধিক শ্রমিকসহ শহরে একটি বৃহৎ সংখ্যক অদক্ষ ও অর্ধদক্ষ শ্রমিক জনসংখ্যাও পরিলক্ষিত হয়। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্প কলকাতার অর্থনৈতিক পুনরুজ্জীবনে একটি বিশিষ্ট ভূমিকা গ্রহণ করেছে।
এই শহরে আইটি সেক্টরের বৃদ্ধির হার বছরে ৭০%, যা জাতীয় গড়ের দ্বিগুণ। [৩৯] বিগত কয়েক বছরে আবাসন পরিকাঠামো সেক্টরে উল্লেখযোগ্য হারে বিনিয়োগ হয়েছে। সঙ্গে সঙ্গে গৃহীত হয়েছে বেশ কয়েকটি নতুন প্রকল্পও। [৬২]
বড় বড় ভারতীয় কর্পোরেশনগুলি দ্বারা পরিচালিত অনেকগুলি শিল্প ইউনিট কলকাতায় অবস্থিত। আইটিসি লিমিটেড, ভারত সরকার টাঁকশাল, এক্সাইড ইন্ডাস্ট্রিজ, হিন্দুস্তান মোটরস, ব্রিটানিয়া ইন্ডাস্ট্রিজ, বাটা ইন্ডিয়া, বিড়লা কর্পোরেশন, কোল ইন্ডিয়া লিমিটেড, দামোদর ভ্যালি কর্পোরেশন, ইউনাইটেড ব্যাংক অব ইণ্ডিয়া, ইউকো ব্যাংক ও এলাহাবাদ ব্যাংক ইত্যাদি বেশ কয়েকটি স্বনামধন্য সংস্থার প্রধান কার্যালয় কলকাতায় অবস্থিত।
সাম্প্রতিককালে, কেন্দ্রীয় সরকারের "পুবে তাকাও" ("লুক ইস্ট") নীতির মতো বিভিন্ন কর্মসূচি সিক্কিমের নাথুলা গিরিপথ খুলে দেওয়ায় চীনের সঙ্গে সীমান্ত বাণিজ্যের নতুন সম্ভাবনার দিক খুলে দিয়েছে। তাছাড়া দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলি ভারতীয় বাজারে প্রবেশে ইচ্ছুক হওয়ায় কলকাতার অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এখন অনেকটাই সুবিধাজনক। [৬৩][৬৪]
[সম্পাদনা] প্রশাসন
কলকাতার নগর-প্রশাসক
মহানাগরিক
শোভন চট্টোপাধ্যায়[৬৫]
নগরপাল
গৌতমমোহন চক্রবর্তী[৬৬]
কলকাতা পৌরসংস্থার ওয়ার্ড মানচিত্র
কলকাতা পশ্চিমবঙ্গের রাজধানী। এই কারণে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের শাসনকেন্দ্রও হল কলকাতা। পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা, রাজ্য সচিবালয় মহাকরণ ও মুখ্যমন্ত্রীর কার্যালয়, কলকাতা হাইকোর্ট সহ একাধিক রাজ্য ও কেন্দ্রীয় সরকারি সংস্থার প্রধান কার্যালয় বা আঞ্চলিক কার্যালয় কলকাতায় অবস্থিত।
কলকাতার নগর প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা ও নাগরিক পরিষেবাগুলির দায়িত্ব একাধিক সরকারি সংস্থার হাতে ন্যস্ত। এই সকল সংস্থার এক্তিয়ারভুক্ত এলাকা অনেক ক্ষেত্রেই পরস্পরের সঙ্গে প্রাবৃত। কলকাতা এই জাতীয় অন্তত চারটি এক্তিয়ার এলাকার অন্তর্গত। এগুলি হল:
১. কলকাতা জেলা,
২. কলকাতা পুলিশের এক্তিয়ারভুক্ত এলাকা,
৩. কলকাতা পৌরসংস্থার এক্তিয়ারভুক্ত এলাকা,
৪. বৃহত্তর কলকাতা বা কেএমডিএ এলাকা।
[সম্পাদনা] পৌরসংস্থা
মূল নিবন্ধ: কলকাতা পৌরসংস্থা
কলকাতার স্থানীয় স্বায়ত্ত্বশাসন কর্তৃপক্ষ হল কলকাতা পৌরসংস্থা।
১৯২৩ সালে আধুনিক স্বায়ত্বশাসনমূলক সংস্থা হিসেবে এই পৌরসংস্থা গঠিত হয়। [৬৭] ১৯৮০ সালে কলকাতা পৌরসংস্থা আইন সংশোধনের মাধ্যমে এই পৌরসংস্থা তার বর্তমান চেহারাটি লাভ করে। [৬৮] বর্তমানে কলকাতার সমগ্র এলাকাটি ১৫টি বরো[৬৯] ও মোট ১৪১টি ওয়ার্ডে[৭০] বিভক্ত। ১৯৮০ সালের পৌর আইনের ভিত্তিতে কলকাতা পৌরসংস্থায় প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালে। এই নির্বাচনে বামফ্রন্ট জয়লাভ করেছিল।
এরপর ১৯৯০ ও ১৯৯৫ সালের নির্বাচনেও বামফ্রন্টই ক্ষমতা দখল করে। ২০০০ সালের নির্বাচনে জয়লাভ করে তৃণমূল কংগ্রেস। ২০০৫ সালে পুনরায় বামফ্রন্ট ক্ষমতায় আসে। ২০১০ সালে অনুষ্ঠিত সাম্প্রতিকতম নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস পুনরায় জয়লাভ করেছে। [৭১] কলকাতা পৌরসংস্থায় বর্তমানে তিনটি কর্তৃপক্ষ রয়েছে: পৌরনিগম, মহানাগরিক (মেয়র) ও সপরিষদ-মহানাগরিক।
পৌরসংস্থার ১৪১ জন পৌরপিতা/পৌরমাতা (কাউন্সিলর) শহরের এক একটি ওয়ার্ড থেকে নাগরিকদের ভোটে প্রত্যক্ষভাবে নির্বাচিত হন। [৬৮] নির্বাচিত পৌরপিতা/পৌরমাতাগণ নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে মহানাগরিক নির্বাচিত করেন। মহানাগরিক, উপমহানাগরিক ও ১০ জন পৌরপিতা/পৌরমাতাকে নিয়ে গঠিত হয় সপরিষদ-মহানাগরিক। [৬৮] পৌরসংস্থার প্রধান কাজ হল জল সরবরাহ, শহরের রাস্তাঘাট ও প্রকাশ্য স্থানসমূহের রক্ষণাবেক্ষণ, রাস্তার আলোকদান, বাড়িনির্মাণ নিবন্ধীকরণ ও নিয়ন্ত্রণ, পয়ঃপ্রণালী রক্ষণাবেক্ষণ ও কঠিন বর্জ্য পদার্থের অপসারণ ইত্যাদি। [৭২]
[সম্পাদনা] জেলা প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা
কলকাতার অন্যান্য শাসনবিভাগীয় ও আরক্ষা-সংক্রান্ত কর্তৃপক্ষগুলি হল: কলকাতা জেলার সমাহর্তা (কালেকটর), কলকাতা পুলিশ, দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার সমাহর্তা তথা জেলাশাসক এবং দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার পুলিশ সুপার (এসপি)।
[৭৩] কলকাতায় শেরিফ নামে একটি নামসর্বস্ব সাম্মানিক পদও রয়েছে।
বিভিন্ন ধরনের মামলা নিষ্পত্তির জন্য কলকাতায় একাধিক নিম্ন আদালত, দেওয়ানি মামলার জন্য ছোটো আদালত ও ফৌজদারি মামলার জন্য দায়রা আদালত অবস্থিত। নগরপালের (পুলিশ কমিশনার) নেতৃত্বাধীন কলকাতা পুলিশ সরাসরি পশ্চিমবঙ্গ সরকারের স্বরাষ্ট্র বিভাগের অন্তর্গত।
[সম্পাদনা] সংসদীয় ক্ষেত্র
কলকাতা শহরের অধিকাংশ অঞ্চল ভারতীয় সংসদের কলকাতা উত্তর ও কলকাতা দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্রদুটির অন্তর্গত। দক্ষিণ-পূর্ব কলকাতার কয়েকটি অঞ্চল যাদবপুর লোকসভা কেন্দ্রের অন্তর্গত।
কলকাতা উত্তর লোকসভা কেন্দ্রের বর্তমান সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, কলকাতা দক্ষিণ লোকসভা কেন্দ্রের সাংসদ রেলমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়[৭৪] এবং ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।