ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই ছোটো সে তরী!
শেষ কিস্তিতে যখন লিখি তখনো শুক্রবার। পরের দিন সকাল ৯টায় আবার মনোজদা হাজির। মনোজদা হল সে গাড়ির ড্রাইভার যেটায় করে আমি ঘুরেছি। বিহারী বংশোদ্ভূত, কিন্তু কথাবার্তায় প্রায় বাঙ্গালী! সেরকম খাতির হয়ে গিয়েছিল ওনার সাথে, ফলস্বরুপ উনি নিজে থেকেই আমাকে নানা জায়গা দেখাচ্ছিলেন আর রানিং কমেন্ট্রি দিচ্ছিলেন, বেশ রংচং লাগিয়ে। সবই বোনাস!
শনিবার সল্ট লেক, লেক টাউন, নিউ টাউন, সায়েন্স সিটি (আর এর আগে সাউথ সিটি) ঘুরে কলকাতার কিছু অংশ দুবাই দুবাই লাগছিল।
সত্যি বলতে এইসব নতুন জায়গাগুলোকে অন্য একটা শহরই মনে হয়, কলকাতা না। ঢাকাতে শহরের বিভিন্ন এলাকায় এতটা আকাশপাতাল তফাৎ দেখা যায় না, তবে বস্তির পাশে লাক্সারি এপার্টমেন্ট দেখা যায়। সেদিক দিয়ে দেখলে কলকাতার পাড়াগুলোর চরিত্র অনেকটাই একরকম, ঢাকার মত জগাখিচুড়ি না। বস্তি-টস্তিও দেখলাম না! একটা চিন্তা মনে জাগলো যদিও, ধনী আর উচ্চ মধ্যবিত্তরা তো সব এখানেই চলে আসবে, কেমন একটা অবস্থা হবে না? একই শহরে 'স্বর্গ' আর 'নরক'!
সল্ট লেকের ওদিকের বিশাল হাইওয়েতে গাড়ি চালিয়ে আর চড়েও সেরকম মজা লাগলো। কলকাতার ভিতরে তো খালি 'ক্লোজ ব্রাশ'।
পায়ে হেঁটে গলি রাস্তা পার হতেই ভয় লাগে, ব্রেক টেক কষে না কেউ, আর এই ধুকধুকা অ্যাম্বাসাডরগুলিতে মনে হয় সহজে ব্রেকও কষা যায় না। মনোজদার কথা হল কলকাতার ড্রাইভাররা দুনিয়ার সেরা ড্রাইভার, এই গোলমালের মধ্যেও গাড়ির রং-ও উঠতে দিবে না। আমি বললাম "আপনে আগে ঢাকায় আসেন, তারপর বাকি কথা হবে!" ভুটানের অভিজ্ঞতাও বললাম, পৃথিবীর সবচেয়ে বেশিবার বাঁক খাওয়া রাস্তা, ১০,০০০ ফিট উঁচু দিয়ে। সে এক অভিজ্ঞতা, গাড়িতে আর সোজা হয়ে বসা লাগবে না, একবার বামে দুলবেন, পর মূহুর্তে ডানে!
কলকাতায় প্রচুর, প্রচুর ফিরিঙ্গী টুরিস্ট দেখলাম। মীর্জা গালিব স্ট্রীটে বাঙ্গালী রেস্টুরেন্টে সর্ষে ইলিশ আর ডাল দিয়ে কনুই পর্যন্ত ডুবিয়ে ভাত খাচ্ছি, কথা নেই বার্তা নেই হাফ-প্যান্ট পড়া আমেরিকান তরুন আর তার মাইক্রো-স্কার্ট পড়া সঙ্গিনী (এই ডিটেইলটা না বললেই হচ্ছিলো না! ) পিছনের টেবিলে এসে বসে পড়লো! হিপ্পি টাইপ-ও দেখলাম বেশ কিছু! কলকাতার পশ এলাকাগুলোর চেয়ে পুরোন অংশগুলোতেই দেখলাম বিদেশী লোকজন বেশি।
লোকে অভ্যাস হয়ে যাওয়ায় পাত্তাও দেয় না। ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালে ছায়ায় এক বেঞ্চিতে আরাম করে বসে বই পড়ছি, পাশে বিদেশী দুইজন (ছেলে আর বাবা হবে) বসলো, এসময় তিনজন (নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেনীর মনে হল) লোক হেঁটে যাওয়ার পথে হঠাৎ 'হ্যালো! হাউ আর ইউ? হোয়্যার আর ইউ ফ্রম?' বলে উঠলো। ওরা মহা উৎসাহে উত্তর দিল: "হাই! ফাইন। ইংল্যান্ড। " বাহ! এরপর অবশ্য লোকগুলো বেশ দ্রুত হিন্দিতে কি যেন (টুরিস্টদের নিয়ে রসিক কিছু মনে হল!) বলে বেশ হো হো করে হেসে উঠল।
তবে কলকাতার রাস্তায় মানুষ বাংলা কমই বলে। বৃহস্পতিবার দিন পেপার কিনতে গিয়ে হাঁটতে হল আঁধ মাইল, আর কমপক্ষে চারটি ভাষা শুনতে পেলাম, বাংলা বাদে! কেএফসিতে আর আমার সাইবার ক্যাফেতেও একই অবস্থা! কি মুশকিল।
আমার ড্রাইভার এ প্রসঙ্গে বলছিল বাঙ্গালী-অবাঙ্গালী গোলমালের কথা, এটা নাকি বেশ ভালই আছে। থাকারই কথা। বাঙ্গালী হয়ে নিজের চারপাশে কত হিন্দী-উর্দু-ভোজপুরী-মারাঠী শোনা যায়?
বাংলা-ইংরেজি কোন পত্রিকা পড়েই দেশী পত্রিকার মত আরাম পেলাম না যদিও, বিশেষত টাইমস অফ ইন্ডিয়া।
ডেইলি স্টার পড়ে এর চেয়ে অনেক আরাম পাই। হয়তো আমার ডেইলি স্টারকে অনেক সিরিয়াস মনে হয়, হয়তো পরিচয় বেশি, কি জানি! টাইমস অফ ইন্ডিয়া কেন জানি অতিরিক্ত সেনশেসনালিস্টিক মনে হল। আনন্দবাজার আসলে খুঁটিয়ে পড়া হয়নি, তাই না জেনে কিছু বলবো না। তবে পেপারগুলির দাম দেখে আমার চক্ষু চড়কগাছ! আনন্দবাজার আড়াই টাকা, টাইমস অফ ইন্ডিয়া মনে হয় ৩! বাংলাদেশে প্রথম আলো ৮ টাকা, ডেইলি স্টারও!
জিনিসপত্রের দাম কম মনে হল কলকাতায়। মনোজদার কথায় ৫,০০০ টাকায় কলকাতায় বেশ ভালভাবে থেকে ১-১,৫০০ টাকা জমানোও যাবে! এ ফাঁকে মনোজদাকে ওনার মাসিক আয় জিজ্ঞেস করে ফেললাম আমি।
২০-২২,০০০ টাকার মত নাকি কামান উনি, নিজের দোতলা বাড়ি আছে, ছেলে পড়ে সেন্ট জেভয়ার্সে! সেন্ট জেভিয়ার্স আর ডন বসকোর মত স্কুলের মাসিক বেতন নাকি ১,০০০ টাকা। আর আমাদের ঢাকায় তো স্কলাস্টিকার বেতন ৭,০০০ টাকা!
বাবার আব্দার রাখার জন্য বড়বাজারের জুবিলী টি হাউজে গিয়েছিলাম দার্জিলিং এর চা কিনতে। ভাল চা কিনে যাওয়ার সময় দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম বাংলাদেশী চা সম্পর্কে। দোকানদারের সহজ সরল উত্তর: "ও চা কি মুখে দেয়া যায় নাকি দাদা?" বোকার মত একটা হাসি দিয়ে দোকান থেকে বের হয়ে আসলাম। আমার ব্যক্তিগত মতামত? কলকাতায় যে চা খেয়েছি তা বেশ কিছুটা ভাল না তা না, কিন্তু এতটা মনে হয় না।
তবে দার্জিলিং এর চা-টা আসলেই ভাল লেগেছে খেয়ে।
ঠাকুরবাড়ি ঘুরতে গিয়ে পুরোনো কলকাতা দেখা হল। ড্রাইভার বিহারী হওয়ায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের নাম শুনলেও জোড়াসাঁকো চেনে না, সুতরাং ট্যাক্সি ড্রাইভারদের থেকে জিজ্ঞেস করতে করতে পুরনো কলকাতার অর্ধেকই ঘুরে ফেললাম। ঠাকুরবাড়ির সামনে দেখি ঠিক রাস্তার মাঝখানে মন্দির, বিশাল করে হনুমান পূজা হচ্ছে। ব্রাক্ষ ধর্মটা কি উধাওই হয়ে যাচ্ছে নাকি ভারত থেকে? কোথায় জানি রাস্তার মাঝখানে আরেকটা মন্দির ছিল।
আমি মনোজদাকে জিজ্ঞেস করলাম কি ব্যাপার, এগুলো কি সরানো যায় না? মনোজদার রসিক উত্তর, "কারো সাধ্য নেই, মমতা দাঁড়িয়ে পড়বে না!"
দমদম বিমানবন্দরটা ছোট হলেও বেশ ছিমছাম লাগল। তবে ইন্টারন্যাশনাল টার্মিনালের বাংলা 'অন্তর্দেশীয় প্রান্তিকালয়' দেখে চোখ কপালে ওঠার দশা আমার; যাহোক, শেখা হল, টার্মিনালের পরিভাষা প্রান্তিকালয়। প্রান্তিকালয় হইতে স্বদেশগমনউদ্দেশ্যপূর্বক উড়োজাহাজে চড়িয়া বসিলাম। নটে গাছটি এখানেই মুড়াইয়া দেই!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।