আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গাঁও গেরামের গল্প (ফুলি পর্ব)

পুরনো আমিটাই ভাল ছিলাম...

গাঁও গেরামের গল্প (ঝরু পর্ব) বাবা ছিলেন কাদের মুন্সীর দূর-সম্পর্কের ভাই। বিয়ে করে মা’কে ঘরে নিয়ে আসার মাস দুয়েক পরে বাবা রাজমিস্ত্রি কাজে ঢাকা চলে যান। আমার জন্মের কিছুদিন আগে প্রথম সন্তানের মুখ দেখতে বাবা বাড়িতে ফেরার জন্য লঞ্চে ওঠেন। কিন্তু নিয়তি তার সেই আশা পূরণ করেনি। ঝড়ো আবহাওয়ায় পড়ে ভাঙাচুরা লোকাল লঞ্চটি চাঁদপুরের কাছে মেঘনায় ডুবে যায়।

কাদের মুন্সী তিনদিন নদীর পারে অপেক্ষা করে খালি হাতে বাড়ি ফেরেন, বাবার লাশ নিয়ে ফিরতে পারেননা। আমার মায়ের আশ্রয় হয় কাদের মুন্সীর বাড়িতে। বাবা মারা যাওয়ার মাসখানেক পরে আমার জন্ম। আমার যখন দুই বছর বয়স তখন কাদের মুন্সী বিয়ে করেন। স্বামী হারানোর শোক আর অজ-পাড়াগাঁয়ের ঝাড়ফুঁক চিকিৎসার বলি হয়ে আমার মা’ও তিন বছরের বেশি বাঁচতে পারেননি।

এরপর থেকেই আমি কাদের মুন্সীর ঘরের সদস্য হয়ে গেলাম। আমি কাদের মুন্সীর বউকে মা ডাকতে শুরু করি আর কাদের মুন্সীকে বাবা। বছর দেড়েক পরে ফুলির জন্ম। কাদের মুন্সী মুসুল্লি-মুত্তাকি মানুষ; মিথ্যা কথা বলেননা, দান সদকা করেন, পাঁচ ওয়াক্ত আজান দিয়ে নামাজ আদায় করেন, কোরআন তেলাওয়াত করেন। আমার বুঝ হওয়ার পরে তিনি আমাকে সত্য কথাটা জানানো দায়িত্ব মনে করলেন।

আমার তখন নয় বছর বয়স। কাদের মুন্সীর মা মারা যাওয়ার পর আমার মায়ের পাশে কবর দেয়া হয়। আর আমাকে আমার মায়ের কবর দেখিয়ে দেয়া হয়, বলা হয় আমার বাবার পরিণতি। জীবনে প্রথমবারের মতো আমি স্বজন হারানোর ব্যাথা অনুভব করি। সেদিন থেকে আমি কাদের মুন্সীকে বাবা ডাকা বন্ধ করে দেই।

আমি তাকে কিছুই ডাকিনা। আর এই একলা হয়ে যাওয়া সময়ে আমার আশ্রয় আর অবলম্বন হয়ে উঠলো সদা হাসিখুশি অবুঝ একটা ছোট মেয়ে, ফুলি। সেদিন থেকে আমি নিজের জগৎ বানিয়ে নিতে লাগলাম। আমি বিমুখ হয়ে থাকলেও কাদের মুন্সী আর ফুলির মা আমাকে সন্তানের মতোই স্নেহ-দৃষ্টিতে লালন করতে লাগলেন। কাদের মুন্সী তার চার বোনের সবাইকে বিয়ে দেয়ার পর পুরান বাড়ির ভিটা ছেড়ে নদীর কাছাকাছি এসে নতুন বাড়ি করেন।

এই বাড়িটা নির্জন। আশেপাশে বাড়িঘর কম থাকায় আমার খেলার সাথী বলতে ফুলিই। আমি নদীতে গোসল করতে গেলে ফুলি আমার সাথে সাথে যাবে। কলা গাছের ভেলা বানাতে হবে, ফুলি দা নিয়ে হাজির। বিলে মাছ তুলতে যাওয়ার সময় খালুই নিয়ে পিছু পিছু।

শাপলা ফুল দেখলে তুলে দিতে বলবে। ফড়িং দেখলে ধরে দিতে বলবে। খুব ভোরবেলা উঠে খেজুরের রস আনতে যেতাম, কখন এই মেয়ে উঠে পিছু নিতো টের পেতামনা। রসের হাড়ি নিয়ে যখন গাছের গোঁড়ায় নামি, আবছা কুয়াশায় ফুলির ফোকলা দাঁতের হাসি দেখে আমিও হেসে ফেলতাম। গাছ থেকে ডাব পারবো, সুপারি পারবো ফুলি গাছতলায় দাঁড়িয়ে।

চালতা, কামরাঙ্গা, আমড়া পারবো সেখানেও সে। ভোরবেলা উঠে বকুল ফুল কুড়াবো ফুলি হাজির। পেয়ারা, বড়ই গাছে উঠে বসে আছি, নিচ থেকে ফুলির ডাক, ‘ঐডা মোরে দেবা?’। একবার কালবৈশাখী ঝড়ে পুরান বাড়িতে আম কুড়াতে গিয়ে ঝুম বৃষ্টিতে ভিজে চুপচুপে হয়ে দু’জন বাড়ি ফিরলাম। ফ্রক ভর্তি আম নিয়ে ফুলির হাঁটতে কষ্ট হচ্ছিল, তাও আমাকে দেবেনা।

সেদিন ফুলির প্রচণ্ড জ্বর উঠে গেল। পরেরদিন ভোরবেলা বাড়ির পেছনে দুমদাম পাকা তাল পড়ার শব্দে যখন সব ফেলে ছুট দিলাম, আমি গাছতলা যাওয়ার আগেই দেখি ফুলি আমাকে দেখিয়ে দেখিয়ে তাল নিয়ে বাড়ি ফিরছে। সন্ধ্যা বেলায় ঝিঁঝিঁ পোকা ধরার জন্য কেরোসিনের কুপি জ্বালিয়ে উঠোনে বসে থাকতাম। আঁখের গুঁড়ের জালা ভাঙ্গা চারা অথবা মার্বেল দিয়ে শব্দ করতে হতো। ফুলি মহা উৎসাহে আমার সাথে যোগ দিত।

আমি জোনাকির আলো খুলে ফুলির নাকে নাকফুল করে দিতাম। পাড়ায় পাড়ায় মার্বেল খেলার সময় ফ্রক-ভর্তি মার্বেল নিয়ে ফুলি আমার সহকারীর দায়িত্বে। গুলতি দিয়ে পাখি শিকার করার জন্য উঁই-এর ঢিবি থেকে মাটি এনে গুল্লি বানিয়ে দেবে। আর শিকার করতে গেলে পিছু পিছু ছুটবে। সন্ধ্যার পরে হেরিকেন জ্বালিয়ে যখন পড়াশুনা করতাম ফুলি পাশে বসে আপন মনে বইয়ের পাতা উল্টে যেত।

আর যখন সত্যি সত্যি পড়তে শুরু করল তখনো একসাথে পড়তে না বসলে তার পড়া হতোনা। আমি খাতায় মার্জিন না টেনে দিলে ঐ খাতায় সে লিখতোনা। এমনি করেই খেলাধুলা-দুষ্টুমিতে দিন যায় দুই বালক-বালিকার। ফুলির দশ-এগারো বছর বয়সে স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। মেয়েদের বেশি পড়তে নেই।

কোরআন পড়তে শেখা, নামাজ-রোজা শেখা, সেলাই, রান্না শেখাটাই তার জন্য উপযুক্ত সাব্যস্ত করে ফুলির সহজাত চাঞ্চল্যকে নিমিষে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হলো। আমি অনেকটাই একা হয়ে গেলাম। আর এই সময় আমার বন্ধু হয়ে ওঠে ঝরু। আমার সব কাজের সঙ্গী ফুলির জায়গাটা কি করে যেন ঝরু নিয়ে নিতে লাগলো। তবুও যখনই বাড়ি ফিরতাম, মনে হতো ফুলি আমার জন্য অপেক্ষা করে আছে।

ওর জন্য চালতা, আমড়া, আম, পেয়ারা, পেঁপে যখন যেটা পেতাম নিয়ে আসতাম। রান্না-বান্না আর ঘরের কাজ শেখার অংশ হিসেবেই হয়তো- ফুলি চালতা বানানো, আম বানানো আর নানা রকম আঁচার বানানো এসবে পারদর্শি হয়ে উঠলো। এখন আর ফুল কুড়াতে ফুলি আমার সঙ্গী হয়না। আমি ফুলির জন্য ফুল নিয়ে আসি। ফুলি সুঁই-সূতায় মালা বানায়, আমাকে দেয়, আমি হাতে জড়িয়ে ঘুরে বেড়াই।

আমি মেহেদী পাতা পেড়ে এনে দেই, ফুলি বেটে দেয়, আমি পুরান বাড়িতে ওর চাচাতো বোনদের দিয়ে আসি। ফুলি এটা সেটা নতুন রান্না শিখে প্রথমে আমাকেই খেতে দেয়। আমি ঝরুকে দাওয়াত দিয়ে নদীর ঘাটে বসে দু’জনে মজা করে খাই। দেখতে দেখতে আরো কয়েক বছর কেটে গেল। আমি সদ্য ক্লাস টেনে উঠেছি।

একদিনের কথা মনে পড়ছে। বারান্দায় বসে ভাত খাচ্ছি। ফুলির চাচাতো বোন শেফালী আসে পুরান বাড়ি থেকে। ঐদিন কোন কারণে ফুলি মায়ের একটা শাড়ি পরেছিল। শেফালী ফুলিকে শাড়িতে দেখে বেশ জোরেই বলে ওঠে- ‘ও চাচী, তোমার মাইয়্যা দেহি ডাঙ্গর অইয়্যা গ্যাছে, এইবার ভাল দেইখ্যা একটা বিয়া দ্যাওনা ক্যান?’ ‘হ তোর বাহেতো ঘটকালী করে, তুই যাইয়্যা কইস ফুলির লাইগ্যা একটা পোলা ঠিক হরতে, লগে তোর নিজের লাইগ্যাও কইস।

’ ‘হিহিহি... ক্যান চাচী, পোলাতো তোমার ঘরেই আছে, হুজুর বোলাইয়্যা কলমা পড়াইয়্যা দিলেই অয়!’ চাচীর মুখের সেই প্রশ্রয়ের হাসি আর ফুলির লজ্জায় লাল হয়ে যাওয়া মুখ দেখে জীবনে প্রথমবারের মতো আমার অন্যরকম একটা অনুভূতি হয় সেদিন। ফুলি কিল উঁচিয়ে শেফালীকে তাড়া করে বাড়ির বাইরের দিকে নিয়ে যায়। নতুন শাড়ি পরা-অনভ্যাসে কিছুদূর গিয়েই তালগোল পাকিয়ে পড়ে যায়। হাতের কাছে পাওয়া গোবরের শুকনো ঘুটা তুলে শেফালীর গায়ে ছুঁড়ে মারে, সেটা গিয়ে লাগে বাড়ির পোষা কুকুরের গায়ে। কুকুরটা ব্যাথা পেয়ে কেঁউ কেঁউ করে অভিযোগ তোলে।

আর তা দেখে শেফালী আরো উচ্চ স্বরে হাসতে হাসতে বের হয়ে যায়। ফুলি উঠে কপট রাগে পিছু পিছু ছোটে। কয়েক মুহূর্তে ঘটে যাওয়া এই ঘটনা অনেক কিছু পরিবর্তন করে দিয়ে যায়। সেদিনের পর থেকে ফুলি আর আগের মতো চঞ্চল থাকেনা। লজ্জায় সে আমার সামনে সহজে পড়েনা।

কথা বললেও মাথা নিচু করে রাখে। আমি আগের মতো বাড়ির বাইরে যেতে উৎসাহ পাইনা। নিজের ঘরেই থাকি প্রায় সারাদিন। অজানা লজ্জায় আমি নিজেকে সবার কাছ থেকে আড়াল করে রাখি। আমার ভাবনার প্রায় পুরোটা জুড়েই শুধু ফুলির সদ্যফোটা মুখখানা বিরাজ করতে থাকে।

এই বিধাতা পরিত্যাক্ত এলাকায় ভাগ্য যেখানে নিত্য পরিহাস করে, সেখানে এরকম নির্ঝঞ্জাট সুখের ঘনঘটা মনে হয় নিয়তি সহ্য করতে পারেনা। হঠাৎ করেই শুনি ফুলির মা’কে জীনে ধরেছে। সন্ধ্যাবেলায় খোলা চুলে বাইরে গিয়েছিলেন, খারাপ বাতাস লেগেছে। কিছুক্ষণ পরে-পরেই মুর্ছা যান। বিড়বিড় করে কি যেন বলেন।

জীন টান দিতে ভার বসানো হয়। মরিচ-পোড়া, ধুপের-ধোঁয়া, পড়া-পানি এসব আরো কি কি দিয়ে জীন তাড়ানোর আয়োজন করা হয়। তিনি সেই জীন তাড়ানোর ধকল সামলাতে না পেরে দুইদিন বেহুঁশ থাকার পর দুনিয়া ছেড়ে চলে যান। শোকের পরিবেশ মিইয়ে যেতে না যেতেই সংসার সামলানোর জন্য নতুন বউ ঘরে আনেন কাদের মুন্সী। এরপরে দ্রুত সব পরিবর্তন হতে থাকে।

আমাকে ভেতর বাড়ি থেকে বের করে কাছারি ঘরে থাকতে দেয়া হয়। বাড়ির মধ্যে খাওয়ার সময় ছাড়া ঢোকা নিষেধ। ফুলির সাথে যোগাযোগ প্রায় হয়না বললেই চলে। ফুলির পৃথিবী এখন বাড়ির বেড়াল, কুকুর, ছাগল-ছানা, বাছুর, হাঁস, মুরগী, কবুতর এদের নিয়ে। তার যত রাগ, দুঃখ, অভিমান, ভাল লাগা সব কিছুর সাক্ষী হতে থাকে এইসব অবলা প্রাণীগুলো।

লুকিয়ে লুকিয়ে মাঝে মাঝে দেখা হয়। এরই ফাঁকে একদিন আমাকে বলে, ‘মতি ভাই মোরে একজোড়া ক্লিপ কিন্যা দেবা?’ সেই ক্লিপ কেনাই যে সব কিছু ওলটপালট করা ঝড় বইয়ে দেবে, দুইটি মানুষ হয়তো ঘুণাক্ষরেও টের পাইনি। চুলের মুঠি ধরে সেই অকথ্য গালাগালি আর ক্লিপ কেঁড়ে নিয়ে ভেঙ্গে ফেলার পর ফুলির সাথে আমার আর দেখা হয়নি। সেয়ানা মাইয়্যা ঘরে রাখলে গুনাহ হয়। আর বাড়ির মধ্যে এসব ফষ্টিনষ্টি সহ্য করা কোন ইমানদারের পক্ষে সম্ভবনা, অন্তত কাদের মুন্সীর মতো পরহেজগার মানুষের পক্ষেতো না-ই।

দুই দিনের মধ্যে ফুলির বিয়ে ঠিক হয় নতুন মায়ের বাবার বাড়ির দিকের আত্মীয় এক চল্লিশোর্ধ বউ-মরার সাথে। যেদিন বিয়ে, আমার চারপাশ যেন অন্ধকার হয়ে আসতে থাকে। কিছু ভাল লাগছিলোনা। সারাদিন ঘরে বসে থাকি। রাত তখন মোটামুটি গভীর; আমি একটা পোটলায় অল্প কিছু জামাকাপড় গুছিয়ে বেঁধে রেখেছি।

এমন সময় জানালার পাশে চুড়ির শব্দে আমার ঘোর কাটে। আমি বুঝতে পারি ফুলি এসেছে, শেষবারের মতো আমার সাথে কথা বলতে। কিন্তু আমার সেই অসহায়ত্বের মুহূর্তে যদি ফুলি আমার সাথে যেতে চায় তখন কি হবে? বেশ কিছুক্ষণ কেটে যায়। ঘরের মধ্যে আমি নিশ্চল বসে থাকি। সাড়াশব্দ না পেয়ে জানালার পাশের মানুষটা আস্তে করে নেমে চলে যায়।

সেই নেমে যাওয়ার কিছুক্ষণ পরে আমারো নিরুদ্দেশ হওয়া। নদীর ঘাটের চৌকিটাতে বসে এসব স্মৃতিরোমন্থন করতে করতে আমি আনমনা হয়ে যাই। তখনো আমি জানিনা- বিয়ের পরে স্বামীর সংসারে গিয়ে কি অমানুসিক অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছে ফুলিকে! নিত্য নতুন দাবী পূরণ করতে করতে কাদের মুন্সীর হিমশিম অবস্থা। জুয়া খেলে পয়সা নষ্ট করে আর তাঁরি খেয়ে রাত-বিরেতে বাড়ি ফিরে বউকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করতো ফুলির স্বামী। খুব কম দিনই ছিল গাঁয়ে হাত তুলতোনা।

যখন সহ্যের সীমা পার হয়ে যায়, যেদিন প্রতিবাদ করে ফুলি, সেদিন অকর্মণ্য লোকটার পৌরুষ জেগে ওঠে। প্রবল আক্রোশে যুদ্ধজয় করার মতো ফুলির উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে লোকটা। আধামাতাল অবস্থায় দা দিয়ে আঘাত করে ফুলিকে। আর তখনই উচ্চারিত হয় তিন তালাক। গ্রাম্য আলেম-সমাজ সাব্যস্ত করেন হিল্লা না পড়ালে ফুলিকে আর ঘরে রাখা যাবেনা।

বাপের বাড়ি চলে আসে ফুলি। সৎ মায়ের অত্যাচার সহ্য করেও ফুলিকে দাঁত কামড়ে পড়ে থাকতে হয়। কাদের মুন্সী আগে থেকেই শ্বাস-কষ্টের রোগী। গেলো বন্যার ধকলে কিছুদিন অসুস্থ থাকার পর বছর দু’য়েক আগে মারা যান তিনি। একমাত্র আশ্রয় বাবা হারিয়ে ফুলির চারপাশ অন্ধকার হয়ে আসে।

এমন সময়ই ঝরু আসে ফুলির জীবনে খোলা জানালা হয়ে। অস্থির ঝড়ে একমাত্র খড়কুটোর মতো ঝরুকে আঁকড়ে ধরতে চায় ফুলি। ঝরুর বাবা-মা মারা গেছে বেশ আগেই। থাকার মধ্যে ছিল এক বিধবা ফুফু। মূল বাড়ি ছেড়ে এসে ঝরুও নদীর কাছে নতুন বাড়ি বাঁধে।

ফুফু আর অন্য ভাইরা পুরান বাড়িতে থাকে। কাদের মুন্সীর দ্বিতীয় বউয়ের আগের ঘরের দুই ছেলে এসে বাড়ি দখল করে নেয়। একদিন ফুলিকে বের করে দেয়া হয়। ফুলির আশ্রয় হয় ঝরুর বিধবা ফুফুর কাছে। এরপরে ঝরু সিদ্ধান্ত নেয় ফুলিকে বিয়ে করে ঘরে তুলবে।

একাদশীর ডবকা চাঁদ নিচু হয়ে ঝুলে আছে আকাশে। এলোমেলো কিছু মেঘ হাস্যজ্জ্বল রুপালী চাঁদটাকে ঢেকে দিচ্ছে একটু পরে পরে। এই আলোছায়ার লুকোচুরি খেলার ফাঁকে অপার্থিব জ্যোৎস্নাস্নানে ভিজে যাচ্ছে চরাচর। নদীর শান্ত ঢেউ ছোট্ট মেয়ের গলে গলে পড়া হাসির মতো ছলাৎ ছলাৎ শব্দে আছড়ে পড়ছে পাড়ের গাঁয়ে। দূর থেকে ভেসে আসা নদীর বুক-ছোঁয়া হিমেল বাতাস চোখ বুজে শুষে নিচ্ছে নিস্তব্ধ প্রকৃতি।

আমার কাঁধে মাথা রেখে শব্দহীন কেঁদে চলেছে ফুলি। ফুলির চোখের পানিতে আমার শার্টের একপাশ ভিজে যাচ্ছে। আমি নিশ্চল বসে আছি। আমি কোন কথা বলছিনা। আমি কোন সান্তনা দিচ্ছিনা।

অধীর হয়ে কাঁদতে থাকা ফুলি বলে ওঠে- ‘মতি ভাই, তুমি জানো, তোমার দ্যাওয়া হেই ময়ূর-ক্লিপ এহনো মোর ধারে আছে? পত্তেকদিন যতোবার তোমার কতা মনে অয় ততোবার মুই হেইডা ছুঁইয়্যা দেহি!? এই জীবনের ভার মুই আর বইতে পারিনা। মোরে লইয়্যা যাও তোমার লগে। মোরে এইহানে এ্যালহা থুইয়্যা তুমি যাইওনা...!’ ভেতর-বাড়িতে আমার প্রিয় খাবার হাঁস-নারিকেলের ঝোল আর আতপ চালের রুটি নিয়ে অপেক্ষা করছে ঝরু। বন্ধুর ঘর বাঁধার স্বপ্ন আর চুড়ির শব্দের সেই রাতের দ্বিধা মুখোমুখি করে দিয়ে নদীর ঘাটে বসে আছি আমি। আমার মনে হতে থাকে, সময় দাঁড়িয়ে পড়েছে অনন্তকালের জন্য।

থেমে থাকা প্রকৃতির অংশ হয়ে গেছে নদীর ঘাটে বসে থাকা দু’টি সর্বহারা মানব-মানবী।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।