আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

‘নিঃশব্দে নিরবে ও বুড়িগঙ্গা বইছো কেন?’গেদু চাচাকে লেখা বুড়িগঙ্গা নদীর খোলা চিঠি।

গেদু চাচার খোলা চিঠি।

চাচা, কত কি নিয়ে লেখলা...আমাকে নিয়ে তো লেখলা না? ফেলানি কে নিয়ে লেখলা...কলম দাদি কে নিয়ে লেখলা...ডঃ ইউনুস কে নিয়ে লেখলা...অথচ আমার কথা তোমার মনেই হল না? আমি কি তোমাদের কিছুই দেইনি? আমার বুকের উপর দিয়ে নৌকা বেয়ে যাওনি? আমার থেকে পানি শুষে নিয়ে জমিতে সেচ দাওনি?আমার কাছ থেকে মাছ ধরে খাওনি?...তাহলে আমাকে নিয়ে লেখতে কেন আমাকেই হল? বড় নিষ্ঠুর তোমরা...বড়ই স্বার্থপর। কত কিই দিলাম তাও আমার নামটা নিতে এখন তোমাদের লজ্জা লাগে...আমাকে দেখে তীব্র ঘৃণায় নাকে রুমাল চেপে আমারই বুকের উপর দিয়ে চলে যাও। তোমাদের উপর খোদার তীব্র গজব নামবে দেখ...আমাকে অবহেলা কর? আমাকে ঘৃণা কর ? তোমাদের লজ্জা লাগেনা?...ভেবে দেখতো কি দিছো বিনিময়ে যা আমি দিছি তোমাদের? চাচা, জানো সেদিন মধ্য রাতে কোথা থেকে একটা নৌকা এসে হাজির। আমি স্পষ্ট শুনলাম একটা তরুনীর সর্বস্ব হারানোর কান্নার আওয়াজ...সব লুটে নিল ওরা।

মেয়েটা আকুতি মিনতি করল,‘আমাকে মারিস না তোরা...সব তো লুটে নিলিই’...ওরা শুনল না। মেয়েটাকে মারল আদিম বন্যতায়...তারপর হাত পা বেঁধে ছুড়ে দিল আমারই বুকে...আমি বুঝলাম ওর জিবনটা তখনো আছে। আমার রক্তে তো বিষ আর তার মাঝে ও বাঁচবে কি করে?আমি খুব চেষ্টা করলাম ওকে ভাসায় রাখতে...ছল ছল শব্দে ওকে পাড়ে নিয়ে আসলাম...আস্তে করে ওকে শোয়ায় দিলাম তীরের মাটিতে...ততক্ষণে ও ঘুমায় পরছে। আমি শেষবারের মত আমার নোংরা,বিষাক্ত আর কালো কান্না দিয়ে ওর গায়ে লেগে থাকা পশুদের রক্ত ধুয়ে দিলাম...তারপর একটা তীব্র আর্তনাদ করে অভিশাপ দিলাম তোমাদের...তোমরা একদিন ধংস্ব হয়ে যাবা। চাচা, আমার কি দোষ ছিল বলতে পারো? বলতে পারো কেন হাজারীবাগ আর তার আশেপাশের রাঘব বোয়াল কোম্পানির মালিক গুলা চামড়া প্রক্রিয়াজাত করে সেই বিষাক্ত তরল আমার বুকে ফেলে? কোন খোঁজ নিলানা...কেন আমার রক্ত কালো হয়ে গেল?কেন আমার বুকে আজকে বিষাক্ত পুজেঁর গন্ধ? আমি কি ক্ষতি করলাম তোমাদের?...আমারই খেয়ে আমার বুকের উপর দিয়ে পার হয়ে আমারই সর্বনাশ করলা? কেরানীগঞ্জের সেতুর উপর দিয়ে আমার দিকে ঘেন্না ভরে তাকাও না?আমার বুকে থু থু মার না? একদিন আমার কাল বিষাক্ত পানিতে তোমাদের আমি চুবায় মারব...।

আমার বুকের সবুজ রং লুট করে আমার পাড়ে বসে কাপড় রং করো?...আর সেই বিষ নালা দিয়ে আমার বুকে ঢাল তাই না? রং বেরং এর কাপড় পরে ফুল বাবু সাজা একদিন বের করব...দেখ। সব ধ্বংস করে দেব একদিন...একটা সিডর যেন আমার বুকে হয়...এক সেকেন্ডে বুঝাব আমি কে...আমারো রাগ আছে...দেওয়ালে পিঠ গেলে আমিও হুংকার দিতে পারি। চাচা, মাফ করে দিও একটু রাগ এসে গেল তো তাই খুব বাজে বকলাম। কি করবো বলো?মানুষ এত বাজে আর স্বার্থপর হয় কিভাবে?জানো চাচা, আমার বুকে পলিথিন দিয়ে ভরে দিছে? একটা না দুইটা পুরা কয়েক ইঞ্চি স্তর দিয়ে? বাজার করবি...পানি খাবি...ঘর বানাবি...তা আমার বুকে কেন সব ফেলিস?আমি কথা বলতে পারিনা তাই? তোরা তাই বলে রাতে জৈবিক কাজ করে সেই জন্ম নিরোধক জানালা দিয়ে আমার বুকে ফেলবি?বাড়ি বানায় বা ভেঙ্গে সেই কংক্রীট আমার বুকে ফেলবি? হায় রে...বোবার অভিশাপ কি জিনিষ জানিস বাঙ্গালী?...শুনিস কি বলি ছল ছল শব্দ করে? বুঝতে চেষ্টা করিস শক্তি নাই তাও তীরে আছড়ে পরে কি জানাতে চাই? চাচা, তোমার রাগ হোক আজকে...তাও অনুরোধ আমার চিঠিটা একবার পড়বা। কি করবো বল?জন্মে আমার নাম কে জানি দিল বুড়িগঙ্গা...কি ছিল না আমার?কি দেইনি আমি?আমাকে দেখে প্রতাপশালী রাজারাও ভয় পেত...তবুও আমি তোমাদের ভাসায় দেইনি হোয়াং হো নদীর মত প্রতি বছর...বা মিশরের নীল নদের মত...কিন্তু কি পেলাম? আমার তীর দখল করে পারলে আমার বুকের উপরে বাড়ি বানাও তোমরা।

আমার বুকের উপর দিয়ে লঞ্চ ভাসায় বড় লোক হও আর সেই লঞ্চ কে সাজাতে আলকাতরা আর রং এর বিষ আমার গায়েই ঢাল...আমার পানিতে কাপড় কেচে সাবানের বিষ দাও আমার ই গায়ে তাই না? আহসানউল্লাহ আমাকে মারেনি; মারেনি নবাব আব্দুল লতিফও...মারেনি বড় বড় নবাব আর সম্রাটরা আর তোমরা ন্যাংটা বাঙ্গালী আমাকে মারতে সব কিছুই করছো তাই না?যে পাতে খাও সেই পাতেই পায়খানা করা শিখে গেছ বাঙ্গালী?কালো পানিতে চুবায় মারব কোন ঘোষনা না দিয়েই...বুঝবা আমি কে আর কেমন আছি। চাচ, জানো মাঝে মাঝে খুব কাঁদি...আমার কান্নায় মাঝে মাঝে আমার বোন পদ্মা...মেঘনার মাথা খারাপ হয়ে যায়...ওরা আমাকে আর স্বান্তনা দেবে কত? ওরা আমাকে বলে আর নিষেধ করবিনা...আমরা শুনব না। তাই ওরা এখন পাড় ভেঙ্গে মানুষের বসতি কেড়ে নেয়...লঞ্চ ডুবিয়ে দিয়ে একসাথে প্রান নিয়ে নেয় কয়েক শত...আমি তো আর কিছু বলতে পারি না...আমি যেয়ে আটকাতেও পারিনা...আমার বিষ যে মেঘনা আর পদ্মা বু কেও বিষাক্ত করে দেবে। আমি সিদ্ধান্ত নিছি...এতদিন আমাকে যারা বিষ দিয়ে তিলে তিলে মারতেছে...একদিন সব বিষ...পলিথিন...বোতল...কংক্রীট উগলে দেব তাদের উপর...কেমন হবে বলো তো গেদু চাচা? চাচা, ন্যাংটা বাঙ্গালী জাত আমার বুকে নৌকা চালায় শুটিং করে...রিপোর্ট করে,ছবি তুলে টাকা কামাই করে...আর আমি হাসি দেই। ছল ছল শব্দ করে পাড়ের মাটিতে আছড়ায় পরি...তীরের মাটিরও তো জোর নাই তাই ওরা খুব রাগ করে।

আমাকে বলে এত জোর কোথায় পাও তুমি? আমি আবার আছড়ে পরে বলি...একদিন তুই ও জোর পাবি...তোর বুকে কালজিরা ধান যেন মাথা উচু করে দাঁড়ায় তার জন্যে পদ্মা মেঘনার কাছ থেকে পলি আনবো...শুধু আমাকে একবার শায়েস্তা করতে দে বেঈমানদের। জানো চাচা, তীরের মাটির মনটা খুব খারাপ হয়...ও তো অনেক অসুস্থ। ও বলে ঠিক আছে আরেক টু আছড়ে পর আমার উপর...আমি হি হি করে হাসি দিয়ে বলি...তুই ঘুমা...আমি যাই। ও ঘুমায় যায়...ওর শরীরটা ভিষন খারাপ...আমি আসার আগে ওর কপালে একটা কালো পানির চুমু আঁকায় দেই। চাচা,আমাকে বাঁচাতে পারো ভুমি দস্যুর হাত থেকে?আমাকে বাঁচাতে পারো যারা আমাকে প্রতিদিন বিষ ঢেলে মারছে তাদের হাত থেকে?আমি কোথায় যাই বলো? আমার কি কোন জিবন নেই? বুয়েটের একদল পানি বিশেষজ্ঞ বলেছেন আমাকে আর বাঁচায় তোলা সম্ভব না; কেন চাচা? লন্ডনের টেমস্ নদী বাঁচতে পারলে আমি কেন পারব না?আমার ইচ্ছা করেনা বুকের মাঝে শুশুক ঘুরে বেড়াক?বড় বড় ডিমওয়ালা বুনো রুই ঘুরে বেড়াক?জেলেরা জাল ফেল্লেই তাতে মাছে ভরে যাক?তোমরা ইচ্ছা করলেই যদি অনেক কিছু করতে পারো তাহলে আমাকে বাঁচাতে পারবা না? আমার রক্তে সেই অক্সিজেন ফিরায় দিতে পারবানা? দিতে পারবানা ফিরায় মাছের আর পানির নানান জীবদের জন্যে অপরিহার্য্য বস্তু ফাইকোপ্লাংটন? আমিও যে প্রান ভরে নিঃশ্বাস নিতে চাই...কালো বিষ থেকে মুক্তি পেতে চাই পেটের মাঝে টলটলে পরিস্কার পানি নিয়ে বাঁচতে চাই।

আমাকে এত তাড়াতাড়ি ই মৃত ঘোষনা করবা? সেদিন কোন এক নব্য কবি নৌকায় চড়ে আমার বুকের উপর দিয়ে যাচ্ছিল...সে দেখলাম ভুপেন হাজারিকার একটা গান বাজায় শুনছে... ‘বিস্তির্ন দু’পাড়ে...অসংখ্য জনড়ে, হাহাকার শুনেও...নিঃশব্দে নিরবে ও গঙ্গা তুমি, ও গঙ্গা বইছো কেন?’ গঙ্গা তো ঠিকই আছে...বেঁচেই আছে; আমি বইছি কোন আশায় চাচা? ‘নিঃশব্দে নিরবে ও বুড়িগঙ্গা বইছো কেন?’গেদু চাচাকে লেখা বুড়িগঙ্গা নদীর খোলা চিঠি।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.