হারিয়ে গেছি হারিয়ে গেছি হারিয়ে গেছি ওরে, হারিয়ে গেছি অন্ধরাতে শিশির ভেজা ভোরে । হারিয়ে গেছি ভোরের আলোয় আজকে সারা দিন, হারিয়ে গেছি রাতের কালোয় বাজছে সাপের বীণ। হারিয়ে গেছি রক্ত লালে হারিয়ে গেছি ভাই, হারিয়ে গেছি শূন্য মাঝে আর যে আমি নাই । প্রানপ্রিয় ফারজানা,
আমাদের এখানে এখন বৃষ্টি হচ্ছে । ঘন কালো মেঘে ছেয়ে আছে আকাশ ।
বৃষ্টিতে ভেজার খুব ইচ্ছা থাকলেও ডাক্তারের বারনে ভিজতে পারছিনা । আগে মেঘ দেখলেই মনে হত তারা আমার জন্য বৃষ্টিকে ডেকে নিয়ে আসছে । কতদিন ধরে ভিজিনা । সুন্দরী নার্স আপুটা চোখে চোখে রাখছে, না জানি আমি আবার বৃষ্টিতে ভিজি । আপুটা খুব ভালো আর লক্ষ্মী ।
বর্তমানে এরকম মানুষ খুব কমই দেখা যায়, আপন আপন মানুষ ।
ছোট্ট বারান্দাটা থেকে বাহিরে আকাশ দেখা যায় । খোলা মুক্ত আকাশ, ডানা মেলে ঘুরে বেড়াবার আকাশ , এখন মেঘে ঢাকা কালো আকাশ । ইচ্ছে করে আকাশের পানে চলে যাই , তারার কাছে চলে যাই । মিশে যাই বৃষ্টির জলে , আরো কত হাবিজাবি ইচ্ছে ।
হয়তো ইচ্ছেগুলো আর পুরন হবেনা । মানুষের সব ইচ্ছে পুরন হতে নেই , ছোটবেলার হাজারো ইচ্ছেগুলোও কখনো পুরন হয় নি । তারপরেও নতুন নতুন ইচ্ছেরা শুধু বেড়েই চলছে। বৃষ্টির কারনে বাতাসের আদ্রতা বেড়েছে । দমবন্ধ বিষাক্ত শহরের কালো ধোঁয়া চাপা পড়েছে জলের নিচে ।
আমি চোখ বন্ধ করে জোরে জোরে শ্বাস নেই , নিজেকে এখন আমাদের গ্রামের বিশাল বটগাছটার মত মনে হচ্ছে । যেটা শত বছর ধরে শত আঘাত বঞ্চনা সয়েও বেঁচে আছে ।
তোমাকে বহুবার একটা কথা বলতে যেয়েও বলতে পারিনি । আমি খুব দুঃখিত , আমি অসহায়, আমি তোমাকে ভালবেসেছিলাম । সম্ভবত তুমিও আমার প্রতি দুর্বল ছিলে, তাই তোমার জীবন থেকে আমি আস্তে আস্তে সরে গেছি ।
আমার মত মানুষের জন্য ভালবাসা মানে ভালবাসার অপচয় ছাড়া আর কিছুই নয় । এখন তোমার ভালবাসা পাওয়ার ইচ্ছেও তাই আমার নেই । যদিও কখনো ভালবাসা পাওয়ার সৌভাগ্যও হয় , তবুও আমি পারবনা তোমার সাথী হতে।
আমি পারবনা তোমার জীবনটাকে নষ্ট করতে । এত সুন্দর চাঁদের মত জীবন আমি নিজ হাতে নষ্ট করতে পারব না ।
আমাকে যদি সত্যিই ভালবেসে থাকো তাহলে অন্য কাউকে জীবনসাথী করে তার মাঝেই আমাকে খুঁজে নিও । তোমার মন থেকে আমাকে হারিয়ে ফেলো না আমাকে ভুলেও যেওনা আমাকে মুছেও ফেলোনা । ভালোবাসি বলব বলে আমি কত রাত কত দিন আয়না আর ওয়েব ক্যামে রিহার্সেল করেছি ! অনেক কেঁদেছি , নিজে নিজেই নিঃশেষ হয়েছি , কাউকে জানতে দেই নি ।
তোমার কি মনে আছে আমাদের প্রথম পরিচয় হয় ঝগড়ার মাধ্যমে । তারপর তোমার সাথে আমার শুধু চ্যাটেই কথা হত ।
অনেকদিন পর তোমার অনেক জোরাজুরির কারনে স্কাইপে শুধু ভয়েস কল রিসিভ করেছিলাম । তুমি অনেক চেষ্টা করেছ কিন্তু আমি ভিডিও কল রিসিভ করিনি । তারপর আস্তে আস্তে তোমা থেকে হারিয়ে গিয়ে আমি অজানাতে চলে যাই । তোমার সাথে আর আমার যোগাযোগ থাকেনা ।
আমি আমার এড্রেস তোমাকে দিই নি , চাইনি কোন যোগাযোগ থাকুক ।
অকারনে তোমাকে কাঁদানোর কোন মানে হয় না । ভালোবাসা দিবসে তোমাকে দিব বলে একটা স্পেশাল কার্ড কিনেছিলাম , এটা খুললে লাল-নীল বাতি জ্বলে মিউজিক বাজে । পাছে ঠিকানা পাও তাই আর পাঠানো হয় নি । এখন এটা আমার মতই সব আলো হারিয়ে নীরব আর নিস্তব্ধ হয়ে গেছে, মিউজিক ও বাজেনা আর । ব্যাটারি পাল্টালে হয়তো ঠিক হয়ে যাবে ।
আচ্ছা মানুষের জীবনটাও কি এভাবে ব্যাটারি দিয়ে পুনরায় সচল করা যায় না ?
তোমার সাথে যোগাযোগ বন্ধ করার পর প্রতিদিন এই কার্ডটা দেখি । তুমি মেইলে যে দুকপি ছবি পাঠিয়েছ তোমার অনুমতি না নিয়েই তা প্রিন্ট করেছি । আমি ছবির সাথে কথা বলি , কার্ডের সাথে কথা বলি , মনে মনে তোমার সাথেও কথা বলি । মাঝে মাঝে তোমাকে নিয়ে ছোট্ট দু-একটা স্বপ্নও দেখি । মজার ব্যাপার কি জানো তোমার ছবিগুলো খুব দুষ্ট , সবসময় শুধু বুকেই থাকতে চায় ।
বাহিরে বৃষ্টি থেমে গেছে , বাড়ছে মানুষের আনাগোনা । একটুপরেই শহর টা আবার কথার শহর হয়ে উঠবে , কথার বাজার বসবে । মানুষ কত সুন্দর ভাবে কথা বলে ! আমি প্রতিদিনই তাদের দেখি , প্রতিদিনই আমার অবাক লাগে ।
দূরের দোকানগুলুতে সন্ধায় এনার্জিলাইট জ্বালিয়েছে, কেউ কেউ ধূপের ধোঁয়া দিচ্ছে । তীব্র আলোর আকর্ষনে লাইটগুলোকে কেন্দ্র করে শত শত পোকা ঘুরপাক খাচ্ছে ।
তারা যেন সব একসাথে আত্মহত্যা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে । আলো তাদের ভুলিয়ে ভালিয়ে মোহগ্রস্থ করে অন্ধকার জগতে নিয়ে যাচ্ছে , অনেকটা আমার জগতে ।
এখন নিঝুম রাত , সারাদিনের কাজ শেষে ক্লান্ত পাখিরা সব ঘরে ফিরে গেছে । মা পাখিটা নিশ্চই বাচ্চাগুলোকে তার সারাদিনের বিভিন্ন মজার ঘটনা শুনাচ্ছে, বাচ্চারা হাসতে হাসতে চলে গেছে ঘুমের রাজ্যে , পরীর রাজ্যে । আমার না একটা পাখির মত সংসার সাজানোর ইচ্ছে ছিল ।
জন্মের কিছুদিন পরেই বাবা-মা অজানাতে চলে যাওয়াতে পাখির মত সংসার আমার কখনো দেখা হয় নি ।
রাত হলে খুব বিমর্ষ লাগে । মনে হয় সকাল আসেনা কেন ? পৃথিবীর সবাই ক্লান্ত হয়ে ঘুমিয়ে যায় আর আমি জেগে জেগে তারা দেখি , জেগে জেগে ঘুমিয়ে যাই , ঘোরের মধ্যে চলে যাই । বাতাসে গাছের পাতারা কেঁপে উঠে শব্দ করে । কখনো দূরে রাত জাগা পাখির ডাক শুনতে পাই ।
আমার নিঃসঙ্গ জীবনে তখন তীব্র আলোড়ন হয় । আমি চিৎকার দিয়ে ডাকতে চাই । সবাইকে বলতে চাই একদিন আমিও তোমাদের মত কথা বলতে পারতাম ।
আহা কতদিন ধরে আমার নিজের কণ্ঠস্বর শুনিনা । কেমোর অসহ্য যন্ত্রনা আর ভালো লাগেনা ।
পতঙ্গপালের মত কোথাও কোন উজ্জ্বল আলো চাই , যা আমাকে আকর্ষন করে ভুলিয়ে-ভালিয়ে ধীরে ধীরে নিয়ে যাবে সে নীরব নিস্তব্ধ শীতল জগতে যেখানে যেতে আমি খুব ভয় পাই ।
আগে জানতাম জীবনটা অনেক সুন্দর । তাই আমি আবার নতুন করে বাঁচতে চেয়েছিলাম , তোমার সাথে নিজেকে জড়িয়েছিলাম । যখন দেখেছি আমার বাঁচার সম্ভাবনা খুব কম তখন সরে এসেছি । প্লিজ আমাকে মাফ করে দিও ।
আমি জানি না বলে হঠাত করে নাই হয়ে যাওয়াতে তোমার মনে আমার প্রতি তীব্র ঘৃণা । আমি ঘৃণা ই গ্রহন করলাম, তোমাকে ভালবাসি তোমার ভালোর জন্যই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম ।
প্রিয় ফারজানা , তুমি ছাড়া আমার জীবনটা শূন্য । গত এক বছর আমি শূন্যতা নিয়ে বেঁচে ছিলাম । আর বেশিদিন হয়তো থাকব না ।
আমাকে ভুলে তোমার সুন্দর জীবনটাকে আরো সুন্দর করে সাজিয়ে রেখ । তবেই আমি শান্তি পাব । আমি আমার প্রিয় তারার পথে নিঃশব্দে যাত্রা করব । মাঝে মাঝে জ্যোৎস্না রাতে বারান্দা কিংবা ছাদে তারাদের শুনিয়ে শুনিয়ে আমার প্রিয় গানটা গাইবে । এটাই আমার জন্য অনেক বড়পাওয়া হবে ।
হাত অসার হয়ে যাচ্ছে আর লিখতে পারছিনা ।
ইতি,
তোমার হাসান
[এ চিঠিটা তুমি যখন পাবে আমি সম্ভবত তখন থাকবনা । আমি একমাস ধরে অনলাইনে অনুপস্থিত থাকলে তোমার কাছে এ মেইলটি আসবে । নার্স আপু আর ভাইয়ার কাছেও আরেকটি মেইল যাবে । তুমি যদি আমাকে ব্লক করে রাখ তাই আমি তাদেরকে এ চিঠির প্রিন্ট, তোমার জন্য কেনা কার্ড, একটা নতুন ব্যাটারি আর তোমার ছবি দুটো প্যাক করে দিয়েছি ।
তারা তোমার ঠিকানা পেয়ে এ চিঠিটা পাঠাবে । ]
*খুব ইচ্ছে ছিল ভাইয়া বিয়ে করলে ভাবীর কোলে মাথা রেখে গল্প শুনব , খুব ইচ্ছে ছিল তোমাকে নিয়ে ঘর বাঁধার , খুব ইচ্ছে ছিল একটা পাখির মত সংসার গড়ার ।
বাংলাদেশ থেকে ফারজানার নামে একটা চিঠি এসেছে । চিঠিটার সাথে ভ্যালেন্টাইন দিবসের পুরনো একটা কার্ড সাথে পিচ্চি একটা ব্যাটারি আর ফারজানার দুকপি ছবি । চিঠি পড়ে ফারজানার মা কাঁদছেন ।
তার মেয়ে গত ছয়মাস ধরে কোন ইমেইলই চেক করেনি । ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।