সুলতান আইনজীবী সমিতির নির্বাচনে সাংস্কৃতিক সম্পাদক পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিল। সুলতান বললো-ভাই, দোয়া করবেন, আমি ইলেকশনে দাড়াইছি। বললাম- তুমি তো অবশ্যই পাশ করে যাবে।
ফলাফল বের হলে জানালাম সুলতান পাশ করেনি।
আইনজীবীদের প্রতি আমার রাগ হল।
সুলতানকেও পাশ করালো না তারা! পরে আমি যখন সুলতানকে নিয়ে নিগুঢ়ভাবে ভাবতে থাকি, তার জীবন, তৎসঙ্গে আমাদের জীবনের সাথে তার পাথর্ক্য, আমাদের প্রকৃতির ও এর সঙ্গে সুলতানের ব্যবধান- ইত্যাদি নিয়ে, তখন আমার সত্তা আইনজীবীদের প্রতি রাগ হওয়ার বদলে এক গভীর শ্রদ্ধায় আমাকে অবনত করালো, ঠিক যেন হেরে যাওয়া একটি লতার মত। আমার মুর্খতা আমাকে আঙ্গুল উচিয়ে দেখালো -শেখার শেষেও শেখা আছে, দেখার শেষে ও দেখা আছে।
এডভোকেট সুলতান জন্মান্ধ বলে তার প্রতি এক একটি করুনা ভোটই যথেষ্ঠ ছিল তাকে পাশ করিয়ে দিতে। সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকতো নয়, বরং এটা হল অপোকৃত কম গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ। কিন্তু আইনজীবীরা সুলতানকে করুনা করে তার প্রতি শিশুকে খুশি করার মত চকলেট তুলে দেয়নি, কারণ তারা সুলতানকে চক্ষুহীন হবার কারণে মোটেও অবজ্ঞা ও তাচ্ছিল্য করে না।
এখানে তাই আইনজীবীরাও জয়ী, সুলতান ও জয়ী।
দুটো চোখের মত জগতের প্রধান সম্পদ না থাকা সত্ত্বেও সুলতান তার কর্ম, মেধা ও অধ্যবসায় দিয়ে নির্বাচনে পরাজিত হয়ে এ বিজয় ছিনিয়ে নিয়েছে।
তাকে আমি ছোট ভাইয়ের মত দেখি। উভয়ের ব্যস্ততার জন্য একত্রিত হতে পারি না । কিন্তু যখনই সুলতানের মোবাইল পাই, সে যখন তার বাচ্চাগুলিকে কিংবা তার ভাইয়ের বাচ্চাদের অথবা পাড়া প্রতিবেশীদের কোন সন্তান নিয়ে আমার চেম্বারে আসে, তখন তাকে আমি কিছুটা সময় ধরে পেতে চাই।
তার প্রতি আমার অনেক জিজ্ঞাসা থাকে। এগুলো নিগুঢ় দর্শনমূলক, আত্মার ভিতরে অবুঝ পাখির আর্তনাদের মত যে বিবেক মুর্খতার জন্য শতত লজ্জিত, আমার সেই আত্মাকে কিছুটা শিক্ষিত করতে আমার মন বলে যে সুলতানের সঙ্গে কথোপকতনের কোন বিকল্প নাই। কেননা আমাদের সুলতান চর্মচক্ষুর সীমাবদ্ধতা থেকে মুক্ত, তার কাছে প্রকৃত সত্য পাওয়া যেতে পারে। সুলতান এত সব না পাওয়ার বেদনা হজম করেও কি করে সুখী জীবন পালন করে, কি তার মন্ত্র, আমাদের কি হল! আমরা সব থেকেও কেন পারি না, কেন আমরা উড়াল দিয়ে পালাতে চাই. লুকিয়ে পড়তে চাই, আমাদের এত অসুখ কেন? এসব নানান প্রশ্ন আমার। জগতের ভেদজ্ঞান শিক্ষার শিশু পাঠে সুলতানকে আমার শিক্ষক হিসাবে, বন্ধু হিসাবে বড় বেশী প্রয়োজন।
তাই আমার প্রিয় প্রসংগ সুলতান।
আমি বলি- সুলতান বস, তোমার ছেলেকে বাসায় দিয়ে আবার এস, আজ আমার রোগী কম, পাশের কামড়ায় চল, একটা নতুন ধরনের চা বানাতে শিখেছি-পুদিনা পাতা চা। তোমাকে খাওয়াবো। সুলতান হেসে বলে- ইকবাল ভাই আজ না, মক্কেল আছে, কাজ আছে, বাজার করতে হবে, আমি আবার বাজারটা নিজে করি, রাত হইলে আপনার বউ কুইট্টা রানতে রানতে দেরী কইরা ফালাইব। আমি তাকে বলি- বাজার থেইক্কা মাছ কাইট্টা আনলে কি হয়? সে বলে- বাজারের কুটা আমার পছন্দ না।
টুকরাগুলি মনমত করতে পারে না।
যারা জানেন তারা তো জানেনই, যারা জানেন না তাদের জন্য বলি- সুলতানের বউও জন্মান্ধ। ইসলামের ইতিহাসে এমএ। শুনলে অবাক হতে হয় যে, সে তার ঘর দোর খুবই পরিপাটি করে সাজিয়ে রাখে। ঘরে থাকে সুলতান, সুলতানের বউ, তার দুই ছেলে, একটা কাজের মেয়ে।
আর মা আসলে মাঝে মধ্যে থাকে। এর মধ্যে দুই ছেলে ও কাজের মেয়ে চর্মচক্ষুধারী। বাড়ীর কর্তা ও গিন্নি এ নেয়ামত থেকে চির বঞ্চিত। তবু সংসার চলে স্বাভাবিক গতিতে। এ জন্য কোন কিছুর অভাব এখানে আছে বলে মনে হয় না।
এটাই সবার কাছে স্বাভাবিক হয়ে গেছে। বরং চক্ষুহীনরাই যেন এখানে বেশী দেখে। তাদের আদর সোহাগ ও শাসনে এ সংসারে, ধোয়ামুছা, লেখাপড়া, ধর্মকর্ম সবই চলে নিয়মমাফিক।
একদিন তার ঘরে গিয়ে দেখি দরজা পেরিয়েই লম্বা সরু করিডোরে তাক পেতে থরে থরে বই সাজানো। প্রায় সবই ওকালতি বই এবং কিছু ফাইল।
করিডোরটাকে চেম্বার হিসাবে ব্যবহার করছে সুলতান। সরু করিডোরে আছে চেয়ার ও টেবিল। মক্কেল বসার স্থান। সহকারীরা ফাইল পড়ে শোনায়। সুলতান মুখে বলে চলে, তারা ড্রাফট লিখে নেয়।
অল্প পরিসর ঘরটা পরিপাটি করে সাজানো। এত সাজানো যে তা চোখে পড়ার মত। ফুলদানীতে ফুলও আছে। আমাকে ঘরে নিতে নিতে সুলতান হাক ডাক শুরু করলো- কই গেলা, ইকবাল ভাই আইছে। তার স্ত্রীও হন্তদন্ত হয়ে গেল।
আসেন ভাই- আমরা কিভাবে থাকি দেখেন।
ঘরের লোকের মত আমি তার থাকার কামরায় ঢুকে গেলাম, এমনকি রান্না ঘরেও। রান্না ঘরে কাজের মেয়েটি পাক করছে। । সুলতানের বউ থাকার ঘরে বিছানায় বসে লালশাক দিয়ে তার ছেলেকে নলা দিয়ে খাওয়াচ্ছে বড়ই সুনিপুন হাতে।
মায়ের মমতা মায়ের জন্যই সাজে। সন্তানের মোটেও পরওয়া নেই যে তার মা অন্ধ। বরং তার মা’ই যেন জগতের সবচেয়ে সামর্থ ও সার্থক মা।
একদিন ঝড়ো বৃষ্টির সন্ধ্যায় সুলতান তার বড় ছেলেকে দেখাতে আনলো আমার চেম্বারে। চেম্বারে আর কেউ ছিল না।
বললাম, ছেলেকে বাইরে খেলতে দাও। বারান্দায় অনেক জায়গা। ছিটা বৃষ্টির সঙ্গে বাতাস, এসব নিশ্চয়ই ছেলেটার কাছে পছন্দই হবে। চল আমরা আমার পড়ার ঘরে যাই। কিছুক্ষণ কথা বলি।
আচ্ছা সুলতান- তুমিতো বৃষ্টি দেখনা, কোন দিন দেখও নি। এই যে, প্রথমে মেঘ গোমড়া হয়ে আকাশটা রাগ করে বসে থাকলো কিছুক্ষণ, যেন কোন কিছু চেয়ে না পাওয়া নববধু, তারপর এক সময় কেঁদেই ফেললো অঝোরে, শুধু কি তাই, চারপাশের আসবাবপত্রগুলোও খেলাচ্ছলে অভিমান ভরে হেলেদুলে উঠছে, তছনছ হচ্ছে গাছপালা, ধুলি, গুড়া পাথর, পাতা ও কাগজ উড়ছে, ঝাপ ফেলে দ্রুত বৃষ্টির তোড় থেকে রক্ষা পেতে চাচ্ছে চা দোকানী, ভিতরে তিনজন গরম চায়ে চুমুক দিতে দিতে কুচকে গেল নিরাপদ কোনে, বৃষ্টির শব্দ ও ভেজা আকর্ষন তাদের মনের বেদনা কিছুক্ষণের জন্য ডাষ্টার দিয়ে মুছে দিল যেন, কিংবা আমার ঘরের পাশে ওপারে এএসপি সার্কেলের বাসার ছোট্ট ডোবাটায় বৃষ্টি এতক্ষণে তার জল তরঙ্গ বাজাচ্ছে তবলচির দ্রুত আঙ্গুল নাড়াবার মত ভঙ্গিমায়, একটি কি দুটি ব্যাঙ আনন্দে ডুব সাতারে মত্ত হয়েছে বহু দিন পর, এতসব নিয়ে যে পৃথিবী তার কিছুই তো তুমি দেখনি। তোমার অবস্থা কি? তোমার দশাই বা কি! আনন্দ বা দুঃখই বা কেমন তর! অনুভুতির কোন স্তরে তুমি এসব কিছু জমা রাখ? কেমন করে সাজাও তুমি তোমার আপন ভূবন।
-ভাই, আপনে একটানা এতগুলি সুন্দর কথা এত সুন্দর উপমা দিয়া বললেন, আমার মনটা ভইরা গেল।
-আমি ইচ্ছা করেই কাব্য করেছি, তোমাকে উসকে দিয়ে একদম কাবু করে ফেলার জন্য।
-আপনি যতগুলি কথা বলেছেন, বৃষ্টি, ব্যাঙ , গাছ, ঝাপ, চা, দোকানী, ধুলি-বালি, এসব কিছুই আমি চর্ম চোখে দেখিনা, দেখিনা ঠিকই তবে আমার আরেকটা চোখ আছে, অন্তর চোখ। সেই চোখে সব কিছুরই একটা মানে আছে, আলাদা আলাদা স্থান আছে এসবের, সেখানে গিয়ে সব কিছুই একটা অর্থ হয়ে যায়, যেমন আপনি চোখ বুঝে অনেক না দেখা জিনিস দেখার মত করে দেখেন, ঠিক তেমনি। আসলে ইকবাল ভাই, চোখ না থাকার ক্ষতি কি পুষানো যায়? যায় না। তবে কি জানেন, আমার কাছে সব কিছুই কবিতার মত বিমুর্ত। আপনার কাছে মুর্ত বলে আপনি বান্ধা পড়ে গেছেন।
তবে মুর্তের বাইরে আপনারও একটা বিমুর্ত জগত আছে। আমার বিমুর্ত জগত অনেক বড়, মুর্ত জগত নাই বললেই চলে, বরং বলা ভাল নাই ই। আপনার মুর্ত জগত অনেক বড়, বিমুর্ত জগতে যেতে তাই আপনার পদে পদে বাধা। একদিন সব শেষ হবে। মুর্ত বিমুর্ত সব একাকার হবে।
সেই পট পরিবর্তনের পর সকলেই একই রকম ক্ষমতার ভাগি হবো, সেই দিন হবে সমানে সমান, সব ক্ষতি পুষে যাবে, সব সুযোগের হিসাব হবে।
আমি তো ইকবাল ভাই ধন্য। চোখ না থাকা সত্ত্বেও আল্লাহ আমাকে সব দিয়েছে। নিজের রোজগারে চলি। জন্মের পর যখন তিনচার বছর বয়স, তখন বুঝলাম শব্দ টের পাই কিন্তু দেখিনা, তখনও বুঝি নাই ব্যাপারটা।
নয় দশ বছর বয়সে সব বুঝলাম। আমার চোখ নাই। আমি এই জগতের রস ও গন্ধ নিব কিন্তু রূপ নিব না। রূপ কি জিনিষ তা আমার অজানাই থাকবে। আমার বাপ মা আমাকে নিয়ে চিন্তায় পড়লো।
আমরা দরিদ্র পরিবার। ভাই বোন যাদের চোখ আছে তাদেরই কোন উপায় নাই। আমার কি উপায় হবে! বাবা মায়ের দুশ্চিন্তায় আমার আরও খারাপ লাগতো। হায়! তাদের জন্য আমি এক বোঝা। ভাবতাম আর বলতাম আল্লাহ চোখ দেওনাই দুঃখ নাই, আমারে নিজের ভাত নিজে জোগাড় করার মত ক্ষমতা দিও।
আল্লাহ আমার ডাক শুনেছে। আজ আমি সাবলম্বি। আমার অন্য ভাই বোনদেরও আমি সাহায্য করতে পারি। বাড়ীতে মা বাবার জন্য টাকাও পাঠাই আমি। বড় শান্তিতে আছি, আমার কোন দুঃখ নাই।
আলহামদুলিল্লাহ।
সুলতানের দ্বিতীয় ছেলে যখন জন্মাবে তখন তার বউ ভর্তি হলো নীচতলায় গাইনী বিভাগে। দোতলায় শিশু ওয়ার্ড। তখন সুলতান শিশু ওয়ার্ডে গিয়ে প্রায়ই বসে। আমি শিশুদের দেখি, তাদের বাবা মাকে উপদেশ দেই, সুলতান শোনে।
মনযোগ দিয়ে শোনে শোনে সুলতান বলে- আমার প্রথম ছেলে হবার সময় এতসব জানতাম না ইকবাল ভাই। কত ভূল করছি। আপনে এসব নিয়ে একটা বই লিখেন।
-আর বলোনা সুলতান। বই থাক, একপাতার একটা পরামর্শ বিলি করি।
মায়েরা তাও পড়ে না। পরামর্শের ঠিক বিপরীতটা যখন করে তখন মনে কষ্ট পাই। বোধ হয় এ জন্যই ডাক্তারেরা এসব দিয়ে মাথা ঘামায় না। নগদ রোগী, নগদ ঔষধ, এভাবেই কাজ শেষ করে শান্তি পায় তারা। আমার যাতনা বাড়ে।
অনেক সময় মেজাজ খারাপ করে ফেলি। মায়েরা এতে অত্যন্ত কষ্ট পায়। বুঝি। কিন্তু আমার নীতি পাল্টাই না। শুনেছি ওয়াই ডাবলিও সি স্কুলের পাশে সন্তানদের ক্লাশে দিয়ে মায়েরা যখন অপেক্ষা করে তখন শাড়ী-বাড়ি, ঘর-সংসার, গহনার কথা শেষ হলে কখনো এও বলে ইকবাল আনোয়ার ডাক্তার ভাল, কিন্তু মেজাজ খারাপ।
পূর্বের প্রেসক্রিপশনগুলি চাই বলে এবং শিশু পালনে কোন ভূল করেছে কিনা তা জিজ্ঞাসা করি বলে তারা আমাকে এডিয়ে যেতে চায়।
সুলতান হাসে- এত জলদি হাল ছাড়বেন না। ভাল জিনিষ মানুষ দেরীতে গ্রহণ করে। আপনার নাম তো ইকবাল। ইকবাল মানে সৌভাগ্য।
সৌভাগ্য দেরীতে আসে। এটা আমার কথা না আল্লামা ইকবাল বলেছেন।
-তুমি আল্লামা ইকবালও পড়েছো?
-কিছুটা, তবে বেশী কিছু না। ইকবালের মোচের গল্পটা জানেন না। তিনি বলেছিলেন নিজেই পাগল হইয়া গেলে অন্যদের পাগল বানাব কি করে।
সুলতানের দুই চোখ বন্ধ। কালো সেভ করা মুখাবয়বে হাসির রেখাগুলি সমস্ত মুখটাকে এমন আন্তরিক করে তুলে যে চোখের মনির অভাব বুঝাই যায় না। চোখের অভার দূর করতে সে তার হাত ও আঙ্গুলের ব্যবহার বেশী করে। এতে আরো বিমুগ্ধ হতে হয় আমাদের। তখন আমার চেম্বারে ডাক্তার সাধন, ডাক্তার আখতার ও অন্যরা বেশ আকর্ষিত হয়ে পড়ে।
কিছু রোগীর অভিভাবক, নার্স, আয়া এসে দাঁড়ায় কিছুটা মজা লুটার জন্য, অন্ধের জন্য এই সব বেকুবদের এক ধরনের বিদ্রুপ মেশানো কৌতুহল তো থাকতেই পারে? আমি তাদের প্রথমেই বলে নেই- তিনি আমার ছোট ভাই, শহরের একজন নামকরা এডভোকেট। তার স্ত্রী ইসলামী ষ্টাডিজে এম এ, এখানে প্রসুতি বিভাগে ভর্তি। এসব কথার মানে হল- সুলতানের প্রাপ্য শ্রদ্ধায় যেন ঘাটতি না পড়ে কোন মতেই।
এবার আমরা দরজা বন্ধ করি। মনে পড়ে যায় এরশাদের শাসন আমলের কথা, জিলা স্কুল মাঠে স্কাউট এগনারী হচ্ছে।
এর উদ্দোক্তাদের আমিও একজন। আমি তখন ‘ডেপুটি রিজনেল স্কাউট কমিশনার হেলথ’। আমাদের উদ্দেশ্য দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের মূল স্কাউটিংএ সম্পূক্ত করা। স্কুল মাঠে এই উদ্দেশ্যে ক্যাম্পের আয়োজন হল। তিনদিন তিনরাত।
দৃষ্টি ও বুদ্ধি প্রতিবন্ধীসহ সারা দেশের স্কাউট নেতারা এলেন। সুলতান তখন একটি তাবুর ক্ষুদে অন্ধ স্কাউট। ক্যাম্প ফায়ারের রাতে সুলতান নিজে হারমনিয়াম বাজিয়ে গান গাইল। দেশাত্ববোধক ও মাটির গান
সুলতানকে অনুরোধ করলাম একটা গান গাইতে। রাজী হয়ে গেল সে।
গাইল সেই বিখ্যাত গান-আমার গায়ে যত দুঃখ সয়-----, আরো গান, একটার পর একটা। আমিও টেবিলে তাল তুললাম, নিজেও গাইলাম। অদ্ভুত দরদমাখা গলা সুলতানের। জানলাম তার স্ত্রীও গাইতে পারে। গান গাইতে গিয়েই ভার্সিটিতে পরিচয়।
তারপর ভাব বিনিময়।
-একজন অন্ধকে কেন বিয়ে করলে?
-ডাক্তার যেমন ডাক্তারকে বিয়ে করতে চায়। ভাবলাম অন্ধই অন্ধের বেদনা বুঝবে। আমাকে দেখবে আমি দেখবো না এর চেয়ে দুজনই একই পথের পথিক হয়ে থাকি। কারো আফসোস থাকবে না।
-তোমার স্ত্রী যে সুন্দর তা কি জান?
শ্রদ্ধাবনত হয়ে সুলতান বলে- মানুষে বলে। তবে আমার কাছে সুন্দর অর্থ- মন সুন্দর।
-তোমার স্ত্রীকে অনুভব কর কিভাবে। একান্ত ব্যক্তিগত প্রশ্ন। (তবে আমার দৃষ্টিতে অশালীন মোটেও নয়, জীবনে এও এক জানার মত রহস্যাবৃত অনুভূতির স্পন্দনের সাথে আমাদের অভিজ্ঞতার শুষ্ক ভান্ডারে আহার্য্য যোগানো প্রয়োজন)।
সুলতান খোলা মেলা। সে সংস্কৃতিমনা। তার মধ্যে কোন বাতুলতা, বাচালতা নাই। সে স্পর্ধিত সাবলম্বি মানুষ। এসব অন্তরঙ্গ নিগুঢ় কথার উত্তর দিয়ে সে যেন তার দায়িত্ব পালন করতে চায়।
-আমাদের উষ্ণতাই আমাদের তৃষ্ণা। এর চাইতে বড় কোন অনুভুতি নাই। ঐকান্তিক একাগ্রতা ও অন্তরঙ্গ স্পর্শের মধ্যে সব কিছু অলৌকিক ভাবে পুর্নাঙ্গতায় পায়। এবং এটাই স্বর্গীয়। চোখের দেখার মধ্যে নানান কুটিলতা ও চোরা গুপ্তা ব্যবধান।
সুলতানের স্বাবলম্বি ভাষায় স্তম্বিত হয়ে যাই আমরা। বোধহয় জীবনের নিগুঢ় প্রসংগের জবাবে এমন ভাষাই ব্যবহার করতে হয় বলে সুলতানের মুখ দিয়ে এভাবে কথার খই ফুটেছে। তার এই অসামান্য উক্তি নিয়ে ভাবনায় পরে যেতে হয়। এভাবেই শালীন উচ্চারণে জীবনের নিখাদ বিনোদনের উচ্চাঙ্গ বিবরণ সুলতান পেশ করে আমাদের মুগ্ধ করে দিল।
এরই মধ্যে একদিন হাসপাতালে গিয়ে শুনি কোন এক মায়ের শিশু রক্তের অভাবে অবেলায় মৃত্যুর দরজায়।
সুলতান সেখানে ছিল। তার মোবাইল বেজে উঠলো। রক্তের গ্রুপ জেনে তার কোন এক কায়েন্ট থেকে সে ইতিমধ্যে রক্ত জোগাড় করে ফেলেছে।
সুলতানের স্ত্রী প্রসব বেদনায় কাতর। তাকে অটিতে নেয়া হচ্ছে।
আমাকে খুজছে মহিলা। আমি তো আছি। এতেই তাদের ভরসা। সন্তান প্রশব হল। পৃথিবীতে এসেই এক উচ্চ কান্নার ধ্বনিতে সে তা জানিয়ে দিল-মা আমি এইতো এখানে।
তোমার জটরের মায়া ছেড়ে পৃথিবীর বিরাট জটরে এসে পৌছেছি। শিশুর কান্না শুনেই মায়ের অবর্ননীয় ব্যাথা, কলিজা ছেড়া কঠিন বেদনার ভার নিমেষেই মিষে গেল বুক পেট হয়ে মাটির ভিতরে। চক্ষুহীন মুখাবয়ব ক্লান্তি যুক্ত অথচ অমলিন কুয়াশায় ভেজা পাপড়ির মত দুই ঠোট দিয়ে একটি জিজ্ঞাসাই আমাদের দিকে ছুড়ে দিলেন তিনি
- ভাই দেখেন তো আমার বাচ্চার চোখ দুইটা ঠিক আছে নি।
- সুন্দর চোখ, মিটমিট করে আপনার দিকেই তাকাচেছ, আমি বললাম।
তখন মা ও বাবা উভয়ে এক যোগে বললেন- আলহামদুলিল্লাহ।
অপারেশন কক্ষ থেকে এই অনুচ্চ আলহামদুলিল্লাহ ধ্বনি আকাশ বেয়ে খোদার আরশে গিয়ে তখন পৌছেছে। সেখানে ফেরেশতারা একযোগে প্রশংসা করছে- হে খোদা মানুষ অকৃতজ্ঞ নয়। চোখ না থাকা সত্বেও স্বামী স্ত্রী এই দুইজন অন্ধ, তারা তোমার কাছে কত অমলীন ভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করলো। তারা সার্থক ও সুখী হোক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।