আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

সুলতানের কৃষক [১]



ফকরুল চৌধুর যে ক্ষেতের গম গরিব কৃষক ভোগ করতে পারে না, সে-ক্ষেতের প্রতিটি শস্যকণা জ্বালিয়ে দাও। পঙ্ক্তিটি সুলতানের প্রিয়কবি আল্লামা ইকবালের। সুলতানের প্রিয়কবিদের মধ্যে আরও আছেন মাইকেল মধুসূদন দত্ত, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্দীন। এঁরা প্রত্যেকেই দ্রোহী কবি, আর জনগোষ্ঠীসংলগ্ন। জসীমউদ্দীন গ্রামীণ সমাজ ও কৃষকসত্তার ভাষ্যরূপ দিয়েছেন।

কাজী নজরুল ইসলাম বিদ্রোহীর ভাস্কর্য রচনা করেছেন। মানুষের মধ্যেই স্থাপন করেছেন ঐশ্বরিক ক্ষমতা। আর মধুসূদন প্রচলিত পুরাণকে বিনির্মাণ করে রাবনকে করেছেন মহামান্বিত, সুলতানের কর্মিষ্ঠ কৃষক যেন বিশালদেহী রাবনের প্রতিচ্ছবি আর এই কৃষকসত্তায় অন্বিষ্ট হয়েছে নজরুলের বিদ্রোহী প্রতিরূপ। এসব কৃষকের সঙ্গে জমিজিরাতের সম্পর্ক সুদৃঢ়, যার তেজের রূপায়ণ আমরা দেখি জসীমউদ্দীনের রুপাইয়ের মধ্যে। জমি যখন বেদখল হয়ে যায় তখন কৃষক রুপাইদের দেহের রক্ত টগবগিয়ে ওঠেÑ ‘মোদের খেতে ধান কেটেছে, কালকে যারা কাঁচির খোঁচায়;/আজকে তাদের নাকের ডগা বাঁধতে হবে লাঠির আগায়।

’ সুলতান আঁকেন এসব কৃষক ও কৃষকজীবন। কৃষকের শক্তি সাহস উদ্দামকে সুলতান বড় করে দেখিয়েছেন, যাতে কৃষক তার ন্যায্য শস্যকণা যেমন উৎপাদন করতে পারে, সামর্থ্য দিয়ে তেমনি পেশির সাহায্যে প্রয়োজনে কাইজা দাঙ্গা করে নিজের ফসলকে নিজের অধিকারে রাখতে পারে। তাই সুলতানের কৃষক যেমন দীর্ঘদেহী, তেমনি উদ্দামশীল। তিনি কৃষকের দৃশ্যমান দেহকে সরিয়ে রেখে তাদের প্রতীকীভাবে এনেছেন। তাদের ভেতরের শক্তিকে বড় করে দেখিয়েছেন।

রুশ বিপ্লবের পর রাশিয়ার শিল্পীরা বড় বড় আকারের কিষান-কিষানীর ভাস্কর্য তৈরি করেছেন। কারণ কৃষক তো গোটা বিশ্বের প্রাণশক্তি। এ ছবিগুলো কৃষকসমাজের বুকের পাটা বিস্তারিত করে, তেমনি শহুরে শেকড়চ্যুত ভদ্দরনোকদের জীবনবোধ জাগ্রত করতে প্ররোচিত করে। ১৯৮৭ সালে সুলতান তেল রং-এ একটি ছবি আঁকেন, নাম ‘হত্যাযজ্ঞ’। বিশাল ক্যানভাসে অসংখ্য মানুষের লাশ।

করুণ, ভয়ঙ্কর, বীভৎস। নারকীয় তা-বলীলা দুমড়েমুচড়ে দিয়েছে জনপদ। মৃত মায়ের কোলে মৃতশিশু। ধানক্ষেতে ছড়ানো ছিটানো লাশ। কচি ধানের ক্ষেতে চিরশায়িত কিষান-কিষানী।

এ চিত্র সম্পর্কে সুলতানের ভাষ্য : কয়েক মাস আগে আমাদের উপকূলীয় অঞ্চলে ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাস হয়ে গেল। তো তার আগেই এ ছবি করেছি। বসে আছি, হঠাৎ যেন ভাবছি আমার কৃষকেরা ভেসে যাচ্ছে, মরে যাচ্ছে সব, আমি আতঙ্কিত। মায়ের কোলে মৃতশিশু, সব কিছু দেখছি। ধানক্ষেত ডুবে যাচ্ছে।

বেশ রাত। জানি না কেন এসব ভাবলাম। স্বপ্নে নয়, ঘুম পাড়িনি। জেগে জেগে যেন চোখের সামনে দেখছি। ক্যানভাসে এঁকে রাখলাম আমার চিন্তাভাবনা।

ছবিটি আঁকার চারদিন পর রাতেই জলোচ্ছ্বাসে ডুবে গেল আমার উড়িরচর, চরজব্বার, মনপুরা এসব এলাকা। না চারদিন আগে কোনো সতর্ক বার্তা ছিল না, নিম্নচাপের কোনো খবরও ছিল না। এই দেশের কৃষকের সঙ্গে সুলতানের আত্মিক সম্পর্ক ছিল। তিনি সবই জানতেন। বুঝতেন এই ব-দ্বীপের ভূমিপুত্রদের খবর তিনি ঠিকই রাখতেন।

তিনি ছিলেন প্রকৃতির সন্তান, প্রকৃত শিল্পী। আর প্রকৃত শিল্পী মানেই তো দ্রষ্টা। স্রষ্টা শিল্পীকে আগেভাগেই সবকিছু জানিয়ে দেন। সুলতান কৃষকের আন্তর-প্রকোষ্ঠের খবর রাখতেন। যার প্রতিফলন সুলতান দেখিয়েছেন তার তুলিতে, ক্যানভাসে।

শিল্পের নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও বহু পর্যটনের পর তিনি নড়াইলের কৃষিসমাজকেই কেন্দ্রভূমি করেন। সুলতানের কেন্দ্র ছিল নড়াইল, এখান থেকেই বিশ্বমানবতার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন। সুলতান বলতেন : নড়াইল আমাদের মাতৃভূমি। আমার ব্রাশে থাকবে নড়াইলের মুখ, তবে নড়াইলের সেই কাজগুলো হবে সারা বিশ্বের। নোবেল বিজয়ী জার্মান কবি ও ঔপন্যাসিক গুন্টার গ্রাস সুলতানকে অবহিত করেছেন এশিয়ার কণ্ঠস্বর, আর একটু এগিয়ে আমরা বলতে পারি, সুলতান সারা বিশ্বের বঞ্চিত নিপীড়িত মানুষের কণ্ঠস্বর।

সুলতানের চিত্রে আমরা পেশির প্রতীকময়তা দেখি। পেশির মানেই হলো ‘শক্তির প্রতীক’। কৃষিকর্ম ছাড়া অন্য কোনো জায়গায় কৃষকের শক্তি প্রদর্শনের স্থান নেই। এই পেশি ছাড়া বুর্জোয়াতন্ত্রে কৃষক টিকতে পারবে না। বুর্জোয়াদের চক্রান্তের কূটকৌশলে নিঃশেষিত হয়ে যাবে।

পুঁজিবাদী পণ্য উৎপাদন প্রক্রিয়ার মধ্যে কৃষক বৃত্তবন্দি হওয়ার ফলস্বরূপ প্রত্যেকটি কৃষক তার সামান্য মূলধনের ভিত্তিতে এক একটি ক্ষুদে বুর্জোয়ায় পরিণত হয়। এরপর পুঁজিবাদের অবশ্যম্ভাবী শ্রেণীবিভাজন প্রক্রিয়ার মধ্যে, কথিত ডারউইনীয় প্রতিযোগিতার তীব্রতায় একটা অংশ কৃষিক্ষেত্রে পণ্য উৎপাদক হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। আর এক অংশ জমিজমা মূলধন সব হারিয়ে ভূমিহীন কৃষিমজুর হয়ে বৃহত্তর শ্রমিক শ্রেণীর অঙ্গীভূত হয়ে যায়। বিভক্ত এ কৃষিসমাজের মধ্যে সমাজবদ্ধ কোনো স্বকীয় কৃষক চেতনার উত্থান সম্ভব নয়। পুঁজিবাদের আঁতুড়ঘর পশ্চিম ইউরোপের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে এরূপ ধারণা স্বাভাবিক।

ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রায় সব সমাজনীতিবিদ এবং বুর্জোয়া অর্থনৈতিক দর্শনের প্রবক্তারাও এরূপ ধারণা পোষণ করেন। পুঁজিবাদের ঐতিহাসিক অগ্রগতির ফলে সে সময়ে পশ্চিম ইউরোপে অন্তত ‘কৃষক’ নামক অভিহিত সামাজিক শ্রমের সুনির্দিষ্ট রূপটি বিলয়প্রাপ্ত হয়েছিল। অতএব প্রতিরোধ কর। সুলতানের ছবির মর্ম তাই। টিকে থাকুক কৃষক।

২. কৃষকরা রাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সব যুগেই ও সব শাসনেই কমবেশি শোষিত হয়েছে। আমরা যদি প্রাক-ঔপনিবেশিক সামন্তযুগের দিকে নজর দিই, দেখি সেখানে প্রভু-ভৃত্য সম্পর্ক বজায় ছিল। কিন্তু ঔপনিবেশিক পুঁজিবাদী উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায়, সামন্তযুগে গ্রামীণ অর্থনীতিতে পণ্য উৎপাদনের পরিমাণ ছিল খুবই কম। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় আমাদের সমাজে পণ্যের প্রবাহ যতই বৃদ্ধি পেয়েছে, আমাদের শান্তির সুখনীড় গ্রামীণ অর্থনীতিতেও তার আঁচড় লেগেছে। কৃষিজাত দ্রব্য প্রতিস্থাপিত হয়েছে পণ্যের রূপে।

গ্রামীণ অর্থনীতিতে ক্রমশ ক্ষমতার দম্ভধারী হয়ে ওঠে মুনাফালোভী ব্যবসায়ী ও মহাজন। আমাদের কৃষিব্যবস্থা অবশ্যম্ভাবীভাবে পণ্য আদান-প্রদানের বৃহত্তর অর্থনীতির সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়ায় কৃষির ক্ষেত্রেও দেখা দিয়েছে মুনাফাভিত্তিক পণ্য উৎপাদনের পুঁজিবাদী ব্যবস্থা। সামন্তবাদের আমলে কৃষকদের মধ্যে সামাজিক স্তরভেদ ছিল, সে-সঙ্গে ছিল প্রতিপত্তি কিংবা আয়ের তারতম্য। কিন্তু উৎপাদনের মূল লক্ষ্য পণ্য উৎপাদন না হওয়ায়, কৃষকসমাজের মধ্যে সুস্পষ্টভাবে শ্রেণীবিভাজনের কোনো প্রক্রিয়া সক্রিয় ছিল না। কিন্তু যে-মাত্র আমাদের কৃষি ব্যবস্থা পুঁজিবাদী পণ্য উৎপাদন ব্যবস্থার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে যুক্ত হয়ে গেল, তখন থেকেই কৃষকসমাজে শ্রেণীবিভাজন শুরু হলো।

কেননা পুঁজিতন্ত্রে প্রত্যেক কৃষকই এককভাবে এক একটি ক্ষুদ্র পণ্য-উৎপাদকে পরিণত হলো। এভাবে পুঁজিবাদী প্রক্রিয়ায় আমাদের যূথবদ্ধ কৃষকসমাজের স্তরভেদ সৃষ্টি হলো, নানাভাগে বিভক্ত হয়ে গেল। এ বিভাজনের ধরন হলো কৃষিপণ্য-উৎপাদন ব্যবস্থার একটি নির্দিষ্ট ও সুবিন্যস্ত রূপধারণ। এ ব্যবস্থার এক প্রান্তে থাকে পুঁজির মালিক কিছু ধনী চাষি, অন্য প্রান্তে অসংখ্য ভূমিহীন কৃষিশ্রমিক। বিভাজন প্রক্রিয়ার ঘটনাটি ঘটে ধীর লয়ে।

চলমানতায় কিংবা অসম্পূর্ণতার নির্দেশক হিসেবে আপৎকালীন এ দুই পরস্পরবিরোধী শ্রেণীর মধ্যে ছোট কৃষক, মাঝারি কৃষক প্রভৃতি স্তর দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু কৃষি উৎপাদনের ঐতিহাসিক গন্তব্য একটাই, তাহলো কৃষিসমাজে শ্রেণীবিভাজন, যার একপ্রান্তে বৃহৎ কৃষিপণ্য উৎপাদক আর অন্যদিকে ভূমিহীন কৃষিমজুর, এই দুই শ্রেণীর সংঘাত। সংঘাতে বিচ্ছিন্ন, হতবল কৃষক টিকতে পারে না। ফলে এ সামাজিক উৎপাদক জনগোষ্ঠী এর স্বরূপ হারায়, এর অবলুপ্তি ঘটে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.