আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ডিজিটাল দেশ গড়বে এনালগ ইঞ্জিনিয়ার……

,,,কুয়াশার আড়ালে লুকানো ঘটনা কুয়াশার চাদরে জড়ানো সকালের মোহনীয় রূপের মত নিস্পাপ, নিস্কলঙ্ক, নির্মোহ নয়,,,

ছেলেবেলায় যখন ‘তোমার জীবনের লক্ষ্য’ টাইপের রচনা লিখতে হত তখন বই লেখকের স্বপ্ন মুখস্থ করে কোন রকমে পরীক্ষার হলে উগরে দিয়ে আসতাম। একটু বড় ক্লাশে উঠে তিন-চারটা অপশন থেকে ডাক্তার পেশাটাকে আদর্শ ধরে রচনাটা মুখস্থ করে ফেলি। কারণ এতে ‘জীবনকে আর্ত মানবতার সেবায় উৎসর্গ করা’- টাইপের দু’একটা লাইন থাকায় নাম্বার পাবার সম্ভাবনাটা ছিল একটু বেশি। কিন্তু ইন্টারে উঠে ভাইকে দেখলাম বুয়েটের সেরা সাবজেক্টে ভর্তি হতে। আর তখন থেকেই ইঞ্জিনিয়ারিং এর প্রতি অন্যরকম একটা আকর্ষণ জন্মায়।

সেই থেকে চেষ্টা শুরু। পরবর্তীতে আম্মুর গুতোগুতি আর আল্লাহর অশেষ রহমতে আমিও ঢুকে যাই দেশের অন্যতম সেরা একটা প্রতিষ্ঠানে। আম্মুর মুখে শুনি- ছোটবেলায় আমার হাতে নাকি কোন খেলনা একদিনের বেশি টিকত না। যত দামী খেলনাই আমার হাতে দেয়া হত না কেন, সকালে এনে দিলে রাতের মধ্যে সেটার পোস্টমর্টেম করে ফেলতাম। খেলনা ভাঙ্গার জন্য আব্বু অর্ডার দিয়ে ক্ষুদে একটা হাতুড়ি বানিয়ে দিয়েছিল- যেটা এখনো আমার কাছে আছে।

কাজেই যে কোন মেশিনের ডিটেইল জানার অদম্য আগ্রহ আমার ছোটবেলা থেকেই ছিল। তাই ইঞ্জিনিয়ারিং পড়ে ইঞ্জিন পার্টস বাই পার্টস খুলে দেখব এটাই ছিল সপ্ন। কিন্তু কথায় আছে না- ‘স্বপ্নের চেয়েও মধুর আমার স্বপ্ন বোনার পালা’। আমার স্টাডি লাইফ যদি স্বপ্নের বাস্তবায়ন হয়, তবে তার চেয়েও মনোহর ছিল আমার ভার্সিটি ভতির আগের চিন্তাগুলো। মটরের ভেতর কিছু একটা ঘোরে এটা আমি ছোটবেলা থেকেই জানতাম, হয়তো আপনিও জানেন।

কিন্তু ক্লাশে মটর পড়ানোর সময় যখন সেই ঘূর্ণন সম্পকে স্পেসিফিকলি জানতে চাইলাম তখন স্যার শূন্যে হাত ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে বলতে লাগল- “মটরের ভিতর থাকে রোটর আর সেই রোটরটা শুধু ঘোরে। ” হায়রে কপাল! ডিটেইল ব্যাখ্যা চেয়ে শুধু ঘূর্ণায়মান অংশের নাম জানা ছাড়া আর কিছুই হল না। ভাবলাম সেশনাল অর্থাৎ ল্যাব ওয়ার্কের সময় মটরের জান দফারফা করে ফেলব। বহু আশা নিয়ে শুরু করলাম সেশনাল ক্লাস। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি অবস্থা পুরোই কেরোসিন।

সারি সারি মটর আছে কার্পেট বিছানো এয়ার কন্ডিশন্ড ল্যাবটাতে, কিন্তু সবই যে কাচের বাক্সে বন্দী। ওই বাক্সের মাঝ বরাবর একটা ফোকড় দিয়ে মটরটার ঘূর্ণনক্ষম অংশের অগ্রভাগ বেরিয়ে আছে টেকোমিটারের সাহায্যে স্পীড মাপার জন্য। আর গুটি কয়েক টার্মিনাল পোর্টের ছিদ্র আছে কারেন্ট সাপ্লাই দেবার জন্য। কারেন্ট সাপ্লাই দিয়ে আমরা শুধু আওয়াজ শুনি, আর দেখি কিছু একটা ঘুরছে। অতঃপর গোটাকয়েক রিডিং নিয়ে গ্রাফচার্টে বসাই।

বাসায় ফিরে নেট ঘেটে রিলেটেড টপিকস কপি-পেস্ট করি, নতুবা ক্লাসের লেকচার না শুনে ল্যাবে দেখে আসা ঘূর্ণনক্ষম মটরের গুণকীর্ত্তন করে মোটাসোটা একটা ল্যাব রিপোর্ট বানাই। ব্যাস, শেষ হয়ে যায় মটরের চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার। অথচ আমার মাথার ভেতর পাক খাওয়া প্রশ্ন গুলোর উত্তর আমি পাই না। টার্ম পরীক্ষার আগে বাক্সবন্দী সেই মটরের কাল্পনিক পোস্ট-মর্টেম করে থিউরিটিক্যাল কথাবার্তার সাথে মিলিয়ে বোঝার চেষ্টা করি। কিছু বুঝি আর অধিকাংশ না বুঝে মুখস্থ করে পাশ করার আপ্রাণ চেষ্টা করি।

‘পাওয়ার সিস্টেম প্রোটেকশন’ ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এর অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটা সেশনাল। বিশেষ করে যেসব স্টুডেন্টরা মেজর হিসেবে পাওয়ার নেয় তাদের জন্য। কিন্তু অত্যাধুনিক এ ল্যাবের ভিতরেও ছিল একই অবস্থা। বিশাল বিশাল আলমারির মত বাক্স। একেকটার দাম ছিল কোটি টাকার উপরে।

আলমারির গায়ে রঙ্গিন দাগে আকা ছিল সার্কিট ডায়াগ্রাম। আর সেই ডায়াগ্রামের বিভিন্ন অংশে ছোট ছোট গর্ত- যেগুলোকে আমরা পোর্ট বলি। সেই পোর্টগুলোতে বিভিন্ন মানের পাওয়ার সাপ্লাই দিয়ে আমরা ভার্চুয়াল ফল্ট তৈরী করতাম আর ভিতর থেকে তৈরী হওয়া আওয়াজ বা লাইটিং সিগনালের মাধ্যমে আমরা সংকেত পেতাম যে ভিতরে ফল্ট হয়েছে। কিন্তু কিভাবে হচ্ছে, কোথায় এফেক্ট করছে, কার মাধ্যমে সিগনাল পাঠাচ্ছে সেটা জানার বা দেখার কোন উপায় নেই। কারণ ওটা যে কমপ্যাক্ট মডিউল, ওটার দাম যে কোটি টাকা।

স্টাডি লাইফের শেষ দিকে ল্যাবে যেয়ে দেখি ল্যাব মামাদের অন্যরকম ব্যস্ততা। জানতে পারি সত্তর লক্ষ্ টাকা দিয়ে নাকি একটা সফটওয়্যারের লাইসেন্স কেনা হচ্ছে, যেটা দিয়ে পুরো ল্যাবরেটরীর কাজ সিমুলেশনের মাধ্যমে করা হবে। থাকবে না আর আগত শিক্ষার্থীদের শত শত তার দিয়ে কানেকশন দেবার ঝামেলা। মাউস ক্লিক করলেই তৈরী হবে সিস্টেম ফন্ট আর পরবর্তী ক্লিকেই হবে ফল্ট ক্লিয়ার। এমনিভাবে আমাদের দেশে আধো সিমুলেশন আর আধো কল্পনার আশ্রয় নিয়ে পরগাছার মত জন্ম হচ্ছে একেকজন ইঞ্জিনিয়ারের।

ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মত একটা প্র্যাক্টিক্যল প্রফেশনে জয়েন করার জন্য ভার্চুয়াল ইনকিউবেটর থেকে বেরোচ্ছে আমার দেশের প্রকৌশলীরা। এ কারণেই আমাদের দেশের টেকনিক্যাল সল্যিউশনেরগুলোর জন্য ডাক পড়ে ভিনদেশী ইঞ্জিনিয়ারের, পাওয়ার প্লান্টের মেজর কোন ফল্ট ঠিক করতে আমন্ত্রণ জানাতে হয় বাইরের অভিজ্ঞদের। কারণ আমরা যে দেখেছি বাক্সবন্দী মটরকে, আমরা যে দেখেছি মাউস ক্লিকের মাধ্যমে অটোমেটিক ফল্ট ক্লিয়ার হয়ে যেতে। কিন্তু বাস্তব জীবনের ইঞ্জিনিয়ারিং প্রবলেম তো আর সিমুলেটেড নয়। এখানে তো আর মাউস ক্লিকে সমস্যার সমাধান করা যায় না।

একটা দেশের টেকসই উন্নতির জন্য টেকনোলজির প্রয়োগ আধুনিক বিশ্বে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। আর সহজলভ্য, সুলভ টেকনোলজি সাধারণ মানুষের হাতে একমাত্র প্রকৌশলীদের মাধ্যমেই পৌছানো সম্ভব। অথচ আজ ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার যুদ্ধ আহব্বান করা হয়েছে পূথীগত বিদ্যাধারী অথর্ব প্রকৌশল যোদ্ধাদের সাথে নিয়ে- যাদের থেকে শুধু পরামর্শই আশা করা যায় কিন্তু ইম্পলিমেন্টেশন করানো যাবে না। এ দায়ভার কাদের? অবশ্যই তাদের যারা এই ধরণের অথর্ব সিলেবাস প্রণয়ন করেছেন, যেখানে এ+ পেতে স্যারের লেকচার সিটের হুবুহু কপি-পেস্টই মুখ্য। হতে পারে চল্লিশ বছর আগে বুয়েট প্রতিষ্ঠাকালে এই সিলেবাস ছিল বিশ্বমানের।

কিন্তু পৃথিবী’ তো আর সময়ে আটকে থাকেনি। দিন যত গড়িয়েছে প্রকৌশল বিদ্যা ততই প্র্যক্টিক্যাল ওরিয়েন্টেড হয়েছে। অথচ আমাদের দেশে বোধহয় গ্রেডিং পদ্ধতির সামান্য পরিবর্ত্ন ছাড়া আর কিছুই হয়নি। আমার ভার্সিটি লাইফে গ্রুপ স্টাডির অন্যতম সহযোদ্ধা রিয়াদ। যে বিষয়টা ও একবার ধরত সেটা যে করেই হোক বুঝেই ছাড়ত।

কত ঘন্টা বা কত দিন লাগবে সেটা ওর কাছে কোন ব্যাপার ছিল না। আমরা মাঝেমধ্যে ওর উপর বিরক্ত হয়ে যেতাম, বলতাম- ‘ধূর বেটা, এইটা নিয়া এতক্ষণ সময় নষ্ট না করে মুখস্থ করে ফেল। সামনে পরীক্ষা। সময় কিন্তু বেশি নাই। ’ কিন্তু বেচারা কোন কিছু না বুঝে মুখস্থ করতে পারত না।

তাই প্রতিবারই পরীক্ষার আগে আমাদের সিলেবাসের পড়া আমরা বুঝে-না বুঝে মুখস্থ করে জোড়াতালি দিয়ে শেষ করে ফেললেও রিয়াদের অর্ধেক সিলেবাসও কম্পলিট হত না। কারণ আমাদের দেশের শিক্ষা ব্যবস্থায় বিদ্যা গলধঃকরণের যথেষ্ঠ সময় থাকলেও জ্ঞান অর্জনের সময় দেয়া হয় না। ফলাফল যা হবার তাই- অন্তঃসারশূন্য এই আমাদের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রীতে সি.জি.পি.এ উপরের দিকে থাকলেও খুটিনাটি ব্যাপারে প্রকৃত জ্ঞান অর্জনকারী রিয়াদের সি.জি.পি.এ যারপরনাই কম। এতটাই মকম যে, বেচারা স্কলারশীপের জন্য এখন কোথাও অ্যাপ্লাইও করতে পারছে না। একটা কথা প্রচলিত আছে- “জানার কোন শেষ নাই জানার চেষ্টা বৃথা তাই” এই পংক্তিদ্বয় কিন্তু জ্ঞানার্জনকে নিরুঃসাহিত করার জন্য সৃষ্টি হয়নি।

বরং নিয়ত অর্জিত জ্ঞানের পথে চলে সিড়ি বেয়ে আরো উপরে ওঠার আহব্বান জানানো হয়েছে। আশা করি আমরা সবাই হাটব সে পথে। কিন্তু বৃহত্তর জ্ঞানার্জনের প্রথম সিড়ি ভাঙ্গার রাস্তায় যে আমরা দেখে এসেছি প্রচুর ধূলো-ময়লা। সেই রাস্তাটি যদি পরিষ্কার না করা হয় তবে হয়তো আমার বন্ধু রিয়াদের মত অনেক শুচিবায়ু জ্ঞান পিপাসু জ্ঞানার্জনের পরবতী সিড়ির দিকে আর পা বাড়াবে না। (আমার এই লেখাটি আমার শ্রদ্ধেয় শিক্ষক-শিক্ষিকা গণের চোখে পড়ার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে।

কিন্তু কেউ যদি পড়েই ফেলেন তবে আপনাদের এই অধমূর্খ ছাত্রটিকে বরাবরের মত ক্ষমা করে ধন্য করবেন। )

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.