মধ্য বাংলাদেশে পদ্মা নদীর পাড়ের একটি জেলা ফরিদপুর। এই শহরের দুর্গ সদৃশ বিরাট জনাকীর্ন এবং নোংরা বেশ্যালয়ে রয়েছে প্রায় ৮০০ বালিকা। এরকম মুসলিম শহরে কি করে বেশ্যালয় রয়েছে এ প্রশ্নে দোভাষী জানালেন, এই বেশ্যালয়গুলো বৃটিশের সময়কার তৈরী - ১৮ শত এবং ১৯ শত শতকের। এই পতিতালয়ে পৌছাতে অনেক গুলো সরু ধূলিময় এবং কাচা রাস্তা পেরোতে হল, যার দুই পাশে হরেক রকমের দোকান। কিছুটা আনন্দের কারন ছিল এজন্যে যে, ফরিদপুরে পশ্চিমা মানুষ খুব পরিচিত নয়।
আমরা পৌছুলেম। অন্ধকার সরু করিডোর ধরে এগিয়ে যেতেই কয়েকটি মেয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষন করল যাদের বয়েস আমার মনে হল ১৫ এবং ১৭ হবে। প্রায় আমার মেয়েরই সমবয়েসী। আমার মেয়ের মতই তারা অনেকক্ষন সময় ধরে সাজগোজ ও পোশাক নির্বাচনে ব্যস্ত। তাদের চেহারায় আমি দেখছিলাম উজ্জ্বলতা এবং তারুন্যের দীপ্তি যা আমি প্রতিদিন আমার বাড়ীতে দেখে থাকি।
তুলনা অবশ্য এখানেই শেষ হয়ে যায়, কারন এরা যৌনকর্মী। যাদের প্রতিদিন ১০০ টাকার বিনিময়ে চার পাচজন পূর্ন বয়স্ক পুরুষের শয্যাসঙ্গী হতে হয়। এই উপার্জনে বেশীর ভাগ বালিকারই কোন অংশীদারত্ব নেই কারন এরা তাদের পরিবার কর্তৃক বিক্রিত হয়েছে এই শর্তে যে দুই/তিন বছর সর্দারনীরা এদের সমস্ত অর্থ রেখে দিতে পারবে। এইসব বালিকারা ছুকরী নামে পরিচিত। সেখানে প্রচুর দরজা রয়েছে এবং প্রতিটি দরজার পেছোনে একটি জানালা সমেত ছোট্ট ঘর, যাতে দুই শয্যার একটি বিছানা রয়েছে।
এ বিছানায় দুটি মেয়ে ঘুমায়। একটি মেয়ের খদ্দের আসলে অন্যটি মেয়েটি অন্য কোথাও চলে যায়। এদের খদ্দেরদের বেশীর ভাগই ইটের ভাটার শ্রমিক, বাকীরা ট্রাক ড্রাইভার। ফরিদপুর একটি গুরুত্ববহ ট্রেড এলাকা, ঢাকা থেকে লরিবাহী ফেরি এখানে ভিড়ে।
পতিতালয়ের সর্বত্রই রয়েছে যৌনতার শব্দ, গন্ধ ও অনুভূতি।
এক জোড়া ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে তো আরেক দরজা দিয়ে ঘর্মাক্ত বদনে বের হয় আরেকজন। ঘরের একপাশে একগাদা ব্যবহৃত জন্ম নিয়ন্ত্রন সামগ্রী।
এরকম একটি করিডোরে আমি সেই দুজন মেয়েকে দেখি। এরা আমার সাথে কথা বলতে বেশী চাইছিল না ভাষাগত পার্থক্যগত কারনে। এমন সময় তৃতীয় একটি মেয়ে বের হয়ে আসে যাকে দেখে আমি বেশ অবাক হই।
এও প্রায় আমার তৃতীয় মেয়ের সমান, যার বয়েস বার হবে। আমি ফটোগ্রাফারের কাছে বললাম, "জিজ্ঞেস করুন ওর বয়েস কত?" মেয়েটি বলল, "বাইশ। " আমরা হেসে উঠলাম কারন মেয়েটি একেবারে উঠতি বয়েসের।
এই ২০১০ এ এত কম বয়েসের মেয়েদের এরকম যৌন দাসত্ব নিন্দনীয়, আর এখানকার এই জনাকীর্ন কুৎসিত পরিবেশ যেন অচিন্তনীয়। এই সবের মাঝে নূতন এক উপদ্রব শুরু হয়েছে, যা এসব মেয়েদের ভবিষ্যত একেবারে ধ্বংস করে দিতে পারে।
তা হল ওরাডেক্সন নামের একটি ড্রাগ যা গরুকে মোটাতাজা করে থাকে। মেয়েদেরকে আরো স্বাস্থ্যবান এবং খদ্দেরদের কাছে আকর্ষনীয় করতে এই ড্রাগ সর্দারনীরা মেয়েদের খাওয়াচ্ছেন। এর আরেকটি সুবিধা হল মেয়েদেরকে বড় দেখাচ্ছে যার ফলে পুলিশি ঝামেলা এড়ানো সম্ভব কারন ১৮ এর নীচের মেয়েদের পতিতাবৃত্তি আইনত নিষিদ্ধ। অথচ এই পতিতালয় ১৮ এর নীচের মেয়ে দিয়ে পূর্ন। একশন এইডের মতে এই ড্রাগ নিয়ে থাকে ১৫ থেকে ৩৫ বছরের মেয়েরা।
একশন এইডের নাহার বলেন, "আমি যখন এই মেয়েদের দেখছিলাম তখন ভাবছিলাম এরা কি করে এত মোটা হল। পরে জানলাম ওরাডেক্সন নামের ড্রাগ এজন্যে দায়ী। " এই মেয়েরা এই ড্রাগের কাছে বন্দী হয়ে যায়। যার ফলে ছাড়তে গেলে মাথা ব্যথা, পেট ব্যথা, ক্ষুধা মন্দা সহ নানা উপসর্গ দেখা যায়। এইসব উপসর্গ নিয়ে এখানে কাজ করা সম্ভব নয়।
খাবার এবং বাসস্থানের জন্যে এদের কাজ করতেই হয়।
১৯ বছরের আশা এই পতিতালয়ে রয়েছে দুই বছর ধরে। "আমি আশা, এটাই আমার একমাত্র নাম। আমি নিজেই এই পেশা বেছে নিয়েছি। কেউ আমাকে বাধ্য করেনি।
" কিন্তু আমাকে বলা হয়েছে যে সবাই একই কথা বলবে কারন তাদের সর্দারনী তাদের নির্দেশ দিয়েছে তাদের পরিবার কিংবা মালিকের বিরুদ্ধে কোন অভিযোগ না তুলতে।
এখানকার মেয়েদের অনেককেই সৎমা কিংবা নিজের মা বিক্রি করে দিয়ে যায়। অনেকে আবার দ্বিতীয় জেনারেশনের যৌন কর্মী। পতিতা মা এবং অজানা বাবার সন্তান। আশা জানায়, সে এক বছর ধরে এই ওষুধ খাচ্ছে এবং এখন দিনে দুটো করে খায়।
অন্যদের মত তার সর্দারনী তাকে এ ওষুধ দেয়। অনেকে খেতে চায়নি কিন্তু তাদের বাধ্য করা হয়। এটা খেলে সুন্দর দেখাবে। আশা জানায়, এটা খেলে তাকে মোটা দেখাবে। খদ্দেররা তাদের মোটা দেখতে চায়।
আশা তার অভিজ্ঞতায় জানায়, "আমি কি করে এ জায়গার ভাল থাকব? আমি মাঝে মাঝে বাইরে যাই, অনেকে সে বাইরেও যেতে পারেনা। "
আশা তার ভবিষ্যৎ নিয়ে একেবারে আশাবাদী নয়। সে জানায়, মনে হয় না আমার বিয়ে হবে কিংবা সন্তান হবে। কেউ আমাকে বিয়ে করবে না। করলেও দুই তিন দিন পরে আবার বিক্রি করে দিয়ে যাবে।
অনেক মেয়েই স্বপ্ন দেখতে ভালবাসে যারা মনে করে হঠাৎ একদিন একজন নাইট এসে হাজির হবে, তাকে বিয়ে করবে এবং পরিত্যাগ করবে না।
ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী না হলেও আশা মাত্র এক বছর ধরে ওষুধ খাচ্ছে বলে তার শরীর এখনও মোটা সোটা হয় নি। জুয়াইনা বেগম পাচ বছর ধরে ওষুধ খাওয়ার ফলে মেশ মোটাসোটা হয়েছে। সে নিজে তার বয়স জানে না তবে আনুমানিক ত্রিশোর্ধ্ব। পতিতালয়ের ভাষায় এটা পাহাড়ের উপর।
সে বলছিল, "আমার প্রতিদিন দুই/তিনজন কাস্টমার আসে। এটা নির্ভর করে আমি কতটা সুন্দর তার উপরে। কি হবে, আমি যদি অসুন্দর হয়ে যাই। আমি কি করে বেচে থাকব। "
জুয়াইনা জানায় ওষুধ তাকে সুন্দর করেছে।
"পতিতালয়ে থাকতে হলে এ ওষুধ খেতেই হবে। সবাই খায়। এটা খেলে সুন্দর দেখাবে, না খেলে কুৎসিত দেখাবে। আমি এই ওষুধে এডজাস্ট হয়ে গিয়েছি। না খেলে খারাপ লাগে।
"
জুয়াইনা অনেক বছর ধরে এখানে রয়েছে। মাঝে এক লোকের সাথে চলে গিয়েছিল। আবার ফিরে আসার পরে এ ওষুধ আর খেতে চায় নি। কিন্তু সর্দারনী বাধ্য করেছে। "এখন আমি নিজে থেকেই এ ওষুধ খাই।
আমি আর এখন অন্য জীবনের স্বপ্ন দেখি না। আমি এখন যা চাই তা হল মৃত্যু। আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি আমাকে নিয়ে যাবার জন্যে। আমি আমার পরিবার, আমার সন্তান চেয়েছিলাম। আমাকে কেউ ভালবাসে না, এখানে আমার কোন বন্ধুও নেই।
"
জুয়াইনার বড় বড় দুঃখ ভরা দুই চোখ কান্নায় ভরে যায়, তার চমৎকার স্কার্ফ দিয়ে তা মুছে ফেলে। এরপরে সে আমাকে তার কথিত ঘরে নিয়ে যায়, মাছিতে ভর্তি ছোট একটি কক্ষ। এই ঘরে কোন জানালা নেই, দরজা বন্ধ করলে মোমবাতির আলো ছাড়া সব অন্ধকার। দাড়ানোর জায়গা নেই: একটি ছোট টেবিল, বিছানা, কিছু জামা কাপড়, হাড়িকুড়ি এসব। এটা কোন জীবন নয়, জুয়াইনা তা জানে।
ট্রাজেডি হল, যে আজকের আশা সে কালকের জুনাইনা। বাংলাদেশের পতিতালয়ে এরকম হাজার হাজার নারী রয়েছে। পায়েল নাম্নী ১৫ বছরের মেয়ে এই ওরাডেক্সন কয়েক মাস ধরে সেবন করছে। সে বলছিল যে সে কখনই স্কুলে যায় নি এবং সে পরবর্তী প্রজন্মের যৌন কর্মী - একজন পতিতার সন্তান। সে ১২ বছর থেকে কাজ করছে এবং অন্য একটি পতিতালয় থেকে এসেছে।
সে বলছিল, "এই জায়গাটা আগের চেয়ে ভাল। বাতাস বেশ পরিষ্কার। গতকাল ছিল বাজার এবং তার মোট দশজন কাস্টমার ছিল। " পায়েল আমার মেয়েদের সম্পর্কে জানতে চেয়েছিল, "তারা দেখতে কেমন? লন্ডনে কি করে বড় হচ্ছে?" যাবার সময়ে পায়েল আমাকে হাত ধরে এগিয়ে দিচ্ছিল, আমি তার চমৎকার স্পর্শে বিমোহিত হচ্ছিলাম। আমি গুড বাই বলার জন্য ফিরে তাকাচ্ছিলাম, কিন্তু হঠাৎই সে যেন অদৃশ্য হয়ে গেল।
একজন বলল, "তুমি পায়েলকে খুজছ? সে নেই, তাকে চলে যেতে হয়েছে। "
আমি পথের দিকে চেয়ে রইলাম। এই চমৎকার মেয়েটিকে পেছন থেকে দেখছিলাম। একটি পুরুষ তার সাথে হাটছিল, সম্ভবত ট্রাক ড্রাইভার। একসময় পায়েল আমার দিকে ফিরল : হাসল এবং ঘাড় নাড়ল।
যেন বলতে চাইল,"এই তো আমার জীবন। " এক সময় সে তার ক্লায়েন্টকে নিয়ে ঢুকে গেল বেশ্যালয়ে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।