:-)
দৃশ্যপটঃ ১
আমাদের বাসা। আমার ছোট্ট ঘরে আমি। রাত প্রায় সাড়ে আটটা বাজে। আমার সামনে আমার টেবিলে মোটা মোটা বই,খাতা,কালার পেন্সিল আর ইন্টারনেটের প্যাঁচিয়ে থাকা তারের স্তূপ। আমার অনেক কাজ জমে আছে কিন্তু আমি কাজের কাজ কিছুই করছিনা।
শুধু মাথার মধ্যে হাজারটা চিন্তা নিয়ে সন্ন্যাস ধরছি টাইপ ভাব নিয়ে বসে আছি আর মাঝে মাঝে বিশাল হাই তুলছি। আমার মাথার মধ্যে যেসব চিন্তা পোকার মত কিলবিল করছে সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলঃ
কালকে প্যাথলজী item—হে খোদা! এত বড় টপিক শেষ করব কখন?
মেডিসিন ওয়ার্ডে মুসা স্যার পড়া ধরবেন বলেছেন না? ভুলেই তো গেছিলাম! পড়বো কখন? আমার তো এখনি ঘুম চলে আসছে।
এখনো আজকের মাইক্রোবায়োলজী লেকচারটাতে চোখ বুলানো হলনা! কি হবে আমার?
আমি চিন্তা থামিয়ে নিবিষ্ট চিত্তে প্যাথলজী পড়ায় মন দিলাম। কিছুক্ষণ পরে পড়া থামিয়ে আবার ও ভাবতে লাগলাম—“আচ্ছা! যেদিন অনেকগুলো কাজ একসাথে জমে যায়,সেদিন কেন কোনকিছুই আমি ঠিক ভাবে শেষ করতে পারিনা?”
দৃশ্যপটঃ ২
আমার নানী রাগী রাগী চেহারায় আমার ঝিমিয়ে পড়া ঘরটাতে ঢুকলেন। তারপরেই শুরু হল মধুর (!) বাণী বর্ষণ।
“সারাদিন হয় বই আর না হলে ল্যাটপ্যাট (ল্যাপটপ) এর সামনে বসে থাকা! একটু লড়াচড়া (নড়াচড়া) না করলে কি হয় নাকি? আস ভাত খাবা। "
আমার মা জননী কখন ঘরে এসেছেন জানিনা। তিনিও বাণী বর্ষণ করা শুরু করলেন।
“এই বয়সে আমরা কত কাজ করেছি,কাপড় ধুয়েছি,ঘর মুছেছি—আর তাদের একটু পড়তে না পড়তেই কাহিল দশা। কি যে করবে জীবনে এরা!”
এই দুই মহীয়সী নারীর কথা অমান্য করার সাহস আমার কোনদিন ও হয়না।
তাই আমি চুপচাপ ভাত খাওয়ার জন্য পড়ার টেবিল ছেড়ে উঠলাম। এমনিতেও ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে—কলেজ থেকে ফিরে চা আর দুইটা বিস্কুট ছাড়া কিছু খাওয়া হয়নি। ডাইনিং রূমে যেয়ে আড়চোখে ভয়ে ভয়ে ঘড়ির দিকে তাকালাম ( যেদিন আমার অনেক কাজ থাকে সেদিন ঘড়ি দেখতে ভয় লাগে)। পৌনে এগারটা বাজে। আমি শুধু প্যাথলজী পড়া শেষ করতে পেরেছি।
এখনো কত পড়া বাকি! আমি আরাম করে বসে ভাত খেতে পারিনা। আমার কান্না আসে! কখন পড়া শেষ হবে? কখন? কখন আমি বিছানায় শুয়ে কোলবালিশটা জড়িয়ে আরাম করে ঘুমাব? কতদিন হয়ে গেল আমি শান্তি মত ঘুমাতে পারিনা! ভাল মত চোখ বুঁজে ঘুমানোর আগেই আমার মুঠোফোনের অ্যালার্মটা কর্কশ সুরে বেজে উঠে জানিয়ে দেয়, "ভোর হল,দোর খোল! খুকুমনি উঠরে!”
দৃশ্যপটঃ ৩
রাত দুইটা। আমি কিছুক্ষণ আগে খাপছাড়া ভাবে সব পড়া শেষ করেছি। এখন একটু শান্তি লাগছে। ঘাড় ঘুরিয়ে আমি বিছানায় ঘুমন্ত আম্মুর দিকে তাকালাম।
কি নিষ্পাপতা আর সারাদিনের ক্লান্তি মিশে আছে ওই মুখে! আমাকে কয়েকবার ঘুমানোর জন্য বলে বেচারা নিজেই ঘুমিয়ে গেছে। বড্ড মায়া লাগে আমার! আম্মুর চোখে আলো পড়ছে। আমি লাইটটা অফ করে মুঠোফোনটা দেখলাম—কখন যেন বীথির এসএমএস এসে বসে আছে,টের পাইনি—“কিরে ফেইসবুকে আসিস না কেন তুই অনেকদিন ধরে? মিসিং ইউ!”
আমি লম্বা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমি মাত্র চারদিন ফেইসবুকে যাইনি। ব্লগে যাইনি।
ল্যাপটপ-ই খোলার সময় পাইনি,নেটে ঢুকব কিভাবে? সেই চারদিন-ই পাগলিটার কাছে অনেকদিন মনে হচ্ছে! এই প্রিয় মানুষগুলোর এত ভালবাসা কি আমাকে বারবার ঋনী করে দেয়না? আমার খুব মন খারাপ লাগে। বড় বেশি যান্ত্রিক হয়ে গেছি আমি ইদানীং! বন্ধুদের-ও খোঁজ নিতে পারিনা! তারা যে কিভাবে আমাকে মনে রাখে! আর কেন-ই বা মনে রাখে?
আমার ঘুমে চোখ বন্ধ হয়ে আসছিল তবুও একটু সময় পাওয়া গেছে আজকে- ভেবে নিয়ে ল্যাপটপ অন করে সোজা ফেইসবুকে চলে গেলাম। অনেকগুলো নোটিফিকেশন জমা হয়ে আছে। আমার এত ক্লান্ত লাগছে যে একটা নোটিফিকেশন ও পড়তে ইচ্ছা করছেনা। আমি ফেইসবুক বন্ধ করে ব্লগে গেলাম।
লগ-ইন করে দেখি ৭টা অদেখা মন্তব্য!
আমি মাথার মধ্যে প্রচন্ড চাপ অনুভব করতে থাকি—সকাল বেলা কলেজ যেয়ে পরীক্ষা দেওয়ার চাপ,নোটিফিকেশন একটা একটা করে পড়ার চাপ,ব্লগে মন্তব্যগুলো পড়ে সহব্লগারদের ধন্যবাদ দেওয়ার চাপ!
আমার কেন জানি মনে হয় বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের মত আমিও যদি সবাইকে বলতে পারতাম—“আমি চাপে ভেঙ্গে পড়েছি। তাই আমি পরীক্ষা পড়া ঠিকভাবে পড়িনি,ফেইসবুকে যেতে পারিনি,ব্লগে মন্তব্য দেখিনি,নতুন লেখা দেইনি। আমার চাপ ছাড়া কোন অজুহাত নাই। সবাই আমাকে ক্ষমা করে দিও”!
দৃশ্যপটঃ ৪
সকাল ৯টা। সাড়ে সাতটায় কলেজ এসে প্যাথলজী item দিয়েছি।
এখন মনটা একটু ফুরফুরে। ক্যান্টিনে চা খেয়ে দৌড় দিলাম ওয়ার্ডে। ওয়ার্ড থেকে ফিরে এসে আবার ও বারটায় লেকচার ক্লাস। এয়ারকন্ডিসনের ঠান্ডা হাওয়া মিশ্রিত লেকচার রূমে বসে আমার ঘুম পেতে থাকে। ম্যাডাম টানা লেকচার দিয়ে যাচ্ছেন।
আর আমি চিন্তা করছি—“বাসায় যেয়ে একটা ঘুম দিব। নাহ! আজকে তো ঘুমানো যাবেনা! ঘরটা গুছাতে হবে একটু! ঝুল জমে গেছে দেখলাম না? জানালার শিক গুলাও মুছা দরকার। আম্মু কালকে মনে হয় বলল নিউমার্কেট যাবে? কখন যাওয়া যায়? বিকালে? আজকে বিকালে যেভাবেই হোক নেটে বসব। কালকে তো কোন আইটেম নাই? শান্তি!”
কেন যে লেকচার ক্লাসেই আমার চিন্তারা ডানা মেলে দেয় আমি বুঝিনা!
দৃশ্যপটঃ ৫
তিনটার সময় ক্লাস শেষ হওয়া মাত্র আমি বাস ধরার জন্য দৌড় দিলাম। শাহবাগের রাস্তা পাড় হওয়া আমার কাছে পৃথিবীর পাঁচ নাম্বার কঠিন কাজ মনে হয়।
সেই কঠিন কাজ টা সফল ভাবে করে আমি ফুটপাত ধরে প্রায় দৌড়াতে লাগলাম ভারি ব্যাগটা নিয়ে। একটু দেরি হলেই আবার অনেকক্ষন দাঁড়িয়ে থাকতে হবে বাসের জন্য। বাসষ্ট্যান্ডে আসলে প্রতিবার আমার একটা কথাই মনে হয়—“ব্যস্ত মানুষগুলো যেন কিছুটা সময়ের জন্য স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কোন কিছুর অপেক্ষায়! লাইন ধরে কিছুক্ষণ থেমে থাকা এই ব্যস্ত নগরীতে!”
টিকেট কেটেই তাড়াহুড়ো করে “রাজধানী”-তে ঊঠে পড়লাম। বাসে দাঁড়ানোরও জায়গা নাই। এত দ্রুত এসেও বাস ফাঁকা পেলাম না।
আমি বাদুরঝোলা হয়ে ঝুলে আছি। এক আপু দয়াপরবশ হয়ে একটু চেপে বসে আমাকে বসতে দিলেন। বাসের ভাঙ্গা কাঁচ ওয়ালা জানালা দিয়ে ধূলোমাখা বাতাস ভেসে আসছে। আজ মনে হয় বৃষ্টি হবে। জানালা দিয়ে দেখলাম,দুটো ছোট্ট উদাম ছেলে এলিফ্যাণ্ট রোডের ফুটপাতে বসে খেলছে।
আমি হঠাৎ উদাস হয়ে গেলাম। আমার মনটা আবার ও এলোমেলো চিন্তায় ভরে ঊঠতে থাকে। এবার আর ব্যস্ত চিন্তা না,চাপ্ ওয়ালা চিন্তা না—আমি ফুরফুরে মনে ভাবতে থাকি—“একদিন আমাকে আর একা রাস্তা পার হতে হবেনা। আমার সাথে চশমা পড়া দার্শনিক টাইপ কেউ নিশ্চয়-ই থাকবে। আমাকে সাথে নিয়ে রাস্তা পার করে দিবে।
আমার পাশে বসে থাকবে বাসে আসার সময়। কিংবা একদিন আমি ডাক্তার হব। আব্বু,আম্মু,নানা আর ভাইয়া সেদিন নিশ্চয়ই খুব খুশি হবে।
আমি ডাক্তার হওয়ার পর আব্বু,আম্মু,নানা,ভাইয়ার হাসি মাখা মুখ চিন্তা করে আমার আনন্দে চোখে পানি চলে আসে। প্রিয় বন্ধুদের কথা মনে পড়ছে কেন জানি।
আমার আদরের পিচ্চি কাজিন জাহিন বাবুটার আধো আধো বোলে মিষ্টি “আপ্পু” ডাকের কথা মনে পড়ে। তাহমিনা ম্যাডামের কথা মনে পড়ে। মায়ের মত যে ম্যাডাম একদিন আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলেন,"আমার মেয়ে দুইটা যেন তোমার মত হয়”। ভাঙ্গা কাঁচওয়ালা বাসের জানালার কোনায় বসে আমি তাদের গভীর ভালবাসাটুকু অনুভব করতে থাকি। যে ভালবাসা আমাকে চির ঋনী করে দিয়েছে।
আমি স্বপ্ন দেখতে থাকি ঐ ভিড় আর গরমে বদ্ধ বাসটার মধ্যে বসে। ব্যস্ত জীবন থেকে সম্পূর্ন আলাদা স্বার্থপর কিছু স্বপ্ন! কাছের মানুষগুলোকে নিয়ে,আমার খুব প্রিয় মানুষগুলোকে নিয়ে ভাললাগা কিছু স্বপ্ন! যে স্বপ্নগুলো বেঁচে আছে বলেই আমি রোবট হয়ে যাইনি! এই ছোট্ট ছোট্ট স্বপ্নগুলোর জন্য-ই আমি মানুষ হয়েই বেঁচে আছি!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।