সৃষ্টির রহস্য খুজছি
শহরের ব্যস্তময় জীবন আর পড়াশোনার ফাঁকে একটু বিনোদনের জন্য শুক্রবার গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের এলামনাই এসোসিয়েশনের উদ্যোগে আমারা গিয়েছিলাম রিভার ক্রুসে। আমার মত অনেকের কাছে এটি ছিল নতুন অভিজ্ঞতা। নদী ভ্রমনের সুযোগও ছিল অনেকের কাছে নতুন।
১৯৬২ সালে প্রতিষ্ঠার পর এই বিভাগের অনেক পুরাতন শিক্ষার্থী যোগ দিয়েছিলেন এই রিভার ক্রুসে। আর বর্তমান শিক্ষার্থীরাত আছেই।
বিশেষ করে বিভিন্ন গণমাধ্যমের প্রবীন-নবীন সাংবাদিকদের নিয়ে রিভার ক্রুসটি একটি মিলন মোলায় পরিণত হয়। সাংবাদিকতা বিভাগের প্রায় ৬০০ সদস্য অংশগ্রহণ করে এই মিলন মেলায়। পূর্ব নির্ধারিত সময় অনুযায়ী সকাল ৮টার মধ্যে সবার সদরঘাটে যাবার কথা ছিল। যারা সদরঘাটের জটলা পরিবেশের সাথে পরিচিত নন কিংবা লঞ্চে ওঠার অভিজ্ঞতার স্বাদ এখনও পাননি, তাদের জন্য বিষয়টি ছিল রীতিমত ঝামেলার এবং রোমাঞ্চকর। সদরঘাট টার্মিনালের অনেকগুলো পথ।
সবাইকে মসজিদের গলি দিয়ে লঞ্চে উঠতে বলা হলেও অনেককেই সেখানে পৌঁছাতে ঘাম ঝাড়াতে হয়েছে। যারা নদী ভ্রমনে পরিচিত নন তাদের অনেকেই লঞ্চে উঠে রীতিমত হতবাক, এতবড় বিলাশবহুল লঞ্চ হতে পারে! আমার সহপাঠী আবু সালেহ্ কোনদিন লঞ্চে ওঠেনি। ওর মত অনেকের কাছে আমাদের এই রিভার ক্রুস ছিল স্বপ্নের মত।
বারবার বলা সত্ত্বেও অনেকের লঞ্চে উঠতে দেরি হওয়ায় আমাদের সদরঘাট ছাড়তে হয়েছে সাকাল সাঢ়ে ৯টা নাগাত। সদরঘাট ছাড়ার সাথে সাথে যে বিষয়টির সাথে সবাই প্রথমেই ধাক্কা খায় সেটি হল বুড়িগঙ্গার দুর্গন্ধ ও কালো কুচকুচে পানি।
যার এই বিষয়টিতে শুধুমাত্র পত্রিকার পাতা কিংবা টেলিভিশনের পর্দায় সীমাবদ্ধ ছিলেন তাদের কাছে এটি ছিল প্র্যাকটিকাল। অনেককেই নাকে রুমাল দিয়ে কিংবা কেবিনের জানলা দরজা আটকে থাকতে হয়েছে অনেকটা সময়।
যারা রিভার ক্রুসের দায়িত্বে ছিলেন তাদের সকাল হয়েছিল আরও আগে। সকাল ৬টার দিকে টিএসটি থেকে খাবার পিকআপে করে সদরঘাটে নেয়া হয়। দুপুরের খাবার তুলতে হয় লঞ্চে।
আমি যখন সকাল সাড়ে ছয়টায় টিএসসিতে যাই তার আগেই আলমগীর ভাই সেখনে উপস্থিত। রবিন ভাইয়ের জন্য তার ওই অপেক্ষা।
লঞ্চ ছাড়ার পর সকালের নাস্তা দেয়া হয়। দীর্ঘ লাইন ধরে নাস্তা নিতে সময় লাগলেও সবাই সেটাকে উপভোগ করেছে। ডিম, পাউরুটি, কমলা আর মিষ্টি দিয়ে সাজানো সকালের নাস্তাটা বেশ উপভোগ করেছে সবাই।
এরপর তারাহুরো শুরু হয় কেবিন দখলের। যদিও এখেত্রে পুরোনোরাই বেশি অগ্রাধিকার পায়। বিশাল লঞ্চের নিচতলায়, দোতলায়, তিনতলায়, ছাদে শরু হয় আড্ডা, গান গাওয়া, নাচা, ছাবি তোলা। ছবি তোলার ক্ষেত্রে ভিন্ন মাত্রা যোগ করে নদীর দুই পাশের দৃশ্য। পুরোনো বন্ধু বা সহপাঠীকে পেয়ে অনেকেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিলেন।
বাসসের রাজীব ভাইকে দেখে মনে হয়েছে তিনি পাগল হয়ে গেছেন। লঞ্চের মাস্তুলে বা ছাদে গিয়ে অনেকেই টাইটানিকের নায়ক নায়িকা হতে ভুল করেননি। এবিসির রাজু ভাইতো আমাদের এক সহপাঠীকে নিয়ে টাইটেনিকের হিরো বনে চলে গেলেন, তাও আমাদের সামনে!
লঞ্চের দ্বীতিয় তলার পেছনের দিকে বসানো হয় অনুষ্ঠানের মুল মঞ্চ। লঞ্চ ছাড়ার সাথে সাথে মিউজিকের তালে অনেকেই এলোপাতারি নাচতে শুরু করল। বেচারারা প্রথমেই এনার্জি লচ করায় শেষ দিকটায় নাচে ভাল করতে পারেনি।
আমাদের সাথে কয়েকজন সংগীত শিল্পি এসেছিলেন। তারা সংগীত পরিবেশন শুরু করেন। পুরোনো বন্ধুদের পেয়ে অনেকেই তাসের আড্ডায় বসে গিয়েছিলেন। একটি গ্রুপতো রীতিমত গেঞ্জিতে তসুরে গ্রুপ লিখে সবার নজর কাড়ল।
আমাদের রিভার ক্রস জমেছিল দুপুরের খাবারের পরে।
দুপুরের খাবার খাওয়াটাও ছিল অনেকের কাছে নতুন অভিজ্ঞতা। আমাদের সাথে নামিদামি অনেকেই ছিলেন যার যখন খাবার খান তখন অলাদা ব্যবস্থা করাতে হয়। কিন্তু রিভার ক্রুসে নবীন-প্রবীণ সবাই একাকার হয়ে গিয়েছিলাম আমরা। সাবাইকে লঞ্চের নিচতলায় স্টেডিয়ামের মত ফাঁকা যায়গায় লাইনে দাড়িয়ে খাবার নিতে হয়েছে। খাবার খাওয়াটাও ছিল সবার কাছে উপভোগ্য।
বন্ধুরা গোল হয়ে চাটাইতে বা লঞ্চের কার্ণিশে বসে খাবার খেয়েছেন। সবার খাওয়া দেখে মনে হচ্ছিল ছ্রাদ্দের কোন বিশাল আয়োজনে আমন্ত্রিত পূন্যার্থিরা খাচ্ছেন। খাবার সময় অনেকেই বন্ধুদের খাবার নিয়ে চালাকি করতে ভুলেননি।
আমাদের যাত্রা বিরতি হয়েছিল চাঁদপুরের মতলবে। সেখানে এক নতুন অভিজ্ঞতার সম্মুখিন হই আমরা।
আখেরাতের পুলসিরাতের কথা এতদিন যারা শুনেছেন, বাস্তবে তার স্বাদ অনেকেই পেয়েছেন সেখানে। আমাদের লঞ্চ যে জেটিতে থামানো হয়েছিল তার অবস্থান তীর থেকে বেশ কিছুটা দূরে। জেটি থেকে বাশ দিয়ে তৈরি করা সাকো দিয়ে সবাইকে যেতে হয়েছে তীরে। সেটি পার হতে রীতিমত ঘাম ছাড়তে হয়েছে অনেককে। আবার অনেকের একপা আগাই তো তিন পা পেছোই এ রকম অবস্তা।
নেফরেদিতি আপুতো রীতিমত লাফালাফি শুরু করে দিয়েছিলেন ভয়ে। গ্রামের ছেলে হওয়ায় এটি আমার জন্য ছিল সাধারন ব্যাপার। তবে সাকোতে উঠে আমার জীবনে আরোকটি বিষয় যুক্ত হয়। সাকোতে আমার সামনেই ছিলেন ফাহমিদ স্যার। তিনি তার মেয়েকে নিয়ে পার হচ্ছিলেন, আর তার ছেলেকে নিয়েছিলাম আমি।
সাকোর একটি যায়গায় তার মেয়েটি যখন ভীত হয়ে চিৎকার দিচ্ছিল তখন স্যার তাকে বিষয়টিকে এডভেঞ্চার হিসেবে নেবার জন্য বললেন এবং সাথে আরও কিছু কথা। তার মেয়েটি শান্ত হয়ে গেল এবং উপভোগ করল বিষয়টি। অন্য বাবা হলে হয়ত মেয়েটিকে দাবার দিতেন। সন্তানের সার্বিক বিকাশের জন্য শিক্ষিত এবং সৃজনশীল বাবা-মা কত যে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করতে পারেন তা এই ছোট্ট বিষয় থেকেই বোঝা যায়।
আমরা পুলছিরত পার হয়ে নদীর তীরে একটি পিকনিক স্পটে যাই।
তার পাশেই বিশাল মাঠ। আমাদের সাথে যে ফুটবলটি আনা হয়েছিল তা খুজে না পাওয়ায় টেনিস বল দিয়েই শুরু হল ফুটবল। সুবিধা না হওয়ায় ওটি দিয়ে শুরু হয়ে বোমবাস্টিক খেলা। আরেফিন স্যার সহ যারা আমাদের সাথে ভিআইপি হিসেবে এসেছেন তারা স্থানীয় গণ্যমান্য কয়েকজনের সাথে কথা বললেন।
কিছুক্ষনের মধ্যে জজ ভাইয়ের ভারী কন্ঠ ভেসে আসল, ‘এখনই আবার লঞ্চে উঠতে হবে’।
সবাই আবার সেই পুলছিরাত পার হবার জন্য প্রস্তুত হল। এবার কিন্তু রেহাই হল না। অনেক মানুষ একসাথে ওঠায় সাকোর একটি জায়গায় হঠাৎ করেই ভেঙ্গে গেল। দুর্ভাগ্যক্রমে সেখানে আমিও ছিলাম। আমার সহপাঠী জিতুতো কাদাপানির মধ্যে পড়ে গেল।
থমকে গেল সবার লঞ্চে ওঠার পথ। কয়েকজন মাঝির সহযোগিতায় আবার সেই সাকো ঠিক করা হল। অনেক চারাই উৎরাইয়ের পর সবাই লঞ্চে উঠল। বিকেলের নাস্তা খাবার পর শুরু হল মূল অনুষ্ঠান। শাহেদ ভাই এবং নেফরিদিতি আপুর ভারাট কন্ঠে শুরু হয় অনষ্ঠান।
অনুষ্ঠানের মধ্যমনি হয়ে আসলেন আমাদের সবার প্রিয় আরেফিন সিদ্দিক স্যার, দৈনিক আমাদের সময়ের সম্পাদক নাঈমুল ইসলাম খান। গান গাইলেন নতুন পুরাতন অনেকেই। সুরের মুর্ছনা, বাতসের বেগ সৃষ্টি করল অন্যরকম এক উৎসবের আমেজ। ছাদে, ব্যালকনিতে, ক্যাবিনে কিংবা কার্ণিশে যে যেখানেই ছিল আস্তে আস্তে মিলিত হল অনুষ্ঠানে। উদ্দেশ্য একটাই রেফেল ড্র।
শাহেদ ভাই এবং নেফরিদিতি আপু একে একে ঘোষনা করতে লাগলেন পুরষ্কার বিজয়ীদের নাম। যারা পুরষ্কার পাচ্ছেন তার হই হুল্লোর কিংবা লাফাতে লাফাতে স্টেজে আসলেন। যখন তৃতীয়, দ্বীতিয় এবং প্রথম পুরষ্কার ঘোষণা করা হবে তার আগে পুরষ্কৃত করা হল আরেফিন স্যার এবং তার স্ত্রী, ছালাম স্যার এবং তার স্ত্রী, নাইমুল ইসলাম খান এবং তার স্ত্রীকে। যতই ঘোষনার লিষ্ট ছোট হতে থাকল ততই উত্তেজনা বাড়তে লাগল। তৃতীয় পুসষ্কারটি পেল নাঈমুল ইসলাম খানের মেয়ে।
যখন প্রথম পুরষ্কার ঘোষনা করা হবে তখন টান টান উত্তেজন। কারন প্রথম পুরষ্কার হিসেব ২১ইঞ্চি রঙ্গিন টেলিভিশন দেয়া হবে। সব জল্পনা কল্পনার, অপেক্ষার অবসান ঘটিয়ে প্রথম পুরষ্কার জিতে নিলেন আমাদের বিভাগের প্রক্তন এক ছাত্র রাইসুল ইসলাম। গত বছর আমরা পিকনিকে গিয়েছিলাম কুমিল্লা বার্ডে। সেবার অধিকাংশ পুরষ্কার পেয়েছিল বিভাগের বর্তমান শিক্ষার্থীর।
কিন্তু এবার অধিকাংশ পুরষ্কার পেলেন বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থীরা। অনেকেই তিন-চারটি টিকিট কেটেও কিছু না পেয়ে বেজায় মন খারাপ করেছেন।
তবে সব উবে যায় ডিজেতে এসে। সাংষ্কৃতিক অনুষ্ঠান শেষ হবার পর শুরু হয়ে আউলা-ঝাউলা নাচ। যে কোনদিন কোমর বাকিয়ে দেখেননি নাচ কাহাকে বলে, সেও নেচেছেন।
এনজেল ভাইতে নাচে মাতাল হয়ে গিয়েছিলেন। সিনিয়র-জুনিয়র, ছেলে-মেয়ে, ছাত্র-শিক্ষক কোন কিছুই বাধা আসেনি। নাচতে না জানায় অনেকেই হাসার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন। সব চেয়ে ভাল লেগেছে আরেফিন স্যার সহ সবাই ডিজে অনুষ্ঠান উপভোগ করেছেন।
সন্ধ্যার কিছুক্ষন আগে আমাদের লঞ্চ যখন ঢাকার উদ্দেশ্যে আসছিল তখন ছাদে যারা ছিলেন তারা যেন অন্য ভূবনে চলে গিয়েছিলেন।
পশ্চিমের আকাশে সূর্য যখন ছুই ছুই তখন এক অভাবনীয় দৃশ্যের অবতরণ হয়। অনেকেই তার ছাবি তুলতে ভুল করেননি।
আমরা যে সদরঘাট বা ঢাকার খুব কাছে তার টের পেয়েছিলাম সেই বুড়িগঙ্গার পঁচা পানির গন্ধ পেয়ে। আটটা নাগাত আমরা ঢাকায় পৌছালাম। আবার সেই যান্ত্রিক ঢাকা।
ক্লাস, চাকরি কিংবা অফিস। যান্ত্রিক জীবনেরে এই আনন্দ অনেকের কাছে স্মরণীয় হয়ে থাকবে, অন্তত আমার কাছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।