কিছু মানুষ ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখে। কিছু মানুষ স্বপ্নটা সত্যি করার জন্য ঘুম থেকে জেগে উঠে। জীবন আপনার কাছে সেভাবেই ধরা দিবে আপনি যেরকম থাকবেন।
- আই রিকশা যাবা? সিদ্ধেশরী।
- কয়জন যাবেন।
৩ জন নিতে পারবনা।
- তুমি সহ ৩ জন তো যাবা নাকি?
রিকশাওয়ালা হেসে দিল। খুব মজার কথা বলেছি কিনা যানিনা তবে সে মজা পেল।
- কত?
- ৫০ টাকা।
- ৫০ টাকা!! এক কাজ কর তুমি উপরে থাকো আমি রিকশা চালায় নিয়া যায়।
তাও দেখো কিছু কমাইতে পার কিনা।
- বেশি চাইনাই। কাকরাইল দিয়া যাইবার দেয়না। ঘুইরা যাইতে হবে। লং সাইডে সব সময় যাওয়া যায়না।
আমার সাথের জন প্রেসক্লাবেই নেমে গেল। রিকশা শম্বুক গতিতে চলছে। এত ধীরগতির রিকশাতে আগে চড়েছি বলে মনে হয়না।
- মামার রিকশাতে কি কোন সমস্যা আছে?
- রিকশা ঠিক আছে মামা শরীর দূর্বল। রিকশা চালাইলে কি আর শরীর ঠিক থাকে কন?
রিকশাওয়ালা বিড় বিড় করে কথা বলেই যেতে লাগল।
ততক্ষনে আমি হেডফোন কানে দিয়ে ফেললাম। আমার কোন তাড়া নেই। রিকশাওয়ালা চলুক আসতে আসতে। বাসায় পৌছানোর পর জটলা দেখতে পেলাম। একজন সৎ রিকশাওয়ালার কর্মকান্ড শুনলাম।
প্যাসেঞ্জার মোবাইল ফেলে গেছে। মহিলা প্যাসেঞ্জার। তার জামাইকে ফোন করা হয়েছে মোবাইল ফেরত দেওয়ার জন্য। ভদ্রলোক রিকশাওয়ালাকে ১০০ টাকা বখশিস দিল। আমার রিকশাওয়ালাও আমাকে নামিয়ে আমার সাথে তামাশা দেখতে লাগল।
তার বিড় বিড় তখনো কমেনাই। কত মাইনশে আমাদের গালি দেয়। আমাদের রাজপথ বন্ধ করে। আমরা যামু কই। আমাগো অন্য কাম দিক।
আমরা তো চুর না। আমরা খাইটাই যাইতে চাই। দ্যাখেন ঐ রিকশাওয়ালা কি মোবাইলটা রাইখা দিতে পারতনা।
আমার কি কিছু বলা উচিত কিনা বুঝলাম না। বললাম, সব ভাল কাজেরই একটা ভাল পরিণাম আছে।
রিকশাওয়ালাকে তখনো ভাড়া মিটাই নাই। রিকশাওয়ালা বলতে লাগল, শলিল দূর্বল তাই আপনাকে আগে আনতে পারিনাই।
আমি বললাম, আমার তো কোন তাড়া ছিলনা। আপনি কষ্ট করে আনছেন তাতেই খুশি। অন্য কোন রিকশা তো এই এলাকায় আসতেই চায়নায়।
বাসার লিফটের বাটনে টিপ দেওয়ার সাথে সাথে ২০ বছর আগে চলে গেলাম। গবর্নমেন্ট ল্যাবরেটরী স্কুলে ওয়ান-টুতে পড়ার সময়কার ঘটনা। তখন সরকারী গাড়িটা পাওয়া হয়নি। থাকতাম বেইলি রোড ছয়তালা কলনীতে। পরিবাগের আর ইস্কাটনের মাঝখানে দিয়ে তখন রিকশা যেত।
স্কুল শুরু হত সকাল ৭ টা বেজে ১৫ মিনিট। তবে ছোটবেলায় ফার্স্ট বেঞ্চে বসার ব্যাপারে আগ্রহ ছিল অনেক বেশি। এটা একটা মজার ব্যাপার। ভার্সিটিতে যেখানে আগে যেতাম পরে বসার জন্য। স্কুলে তার উলটা।
দুনিয়ার সব কিছুর জয় যেন সামনে বসার ক্ষেত্রে। সামনের বেঞ্চে বসা চাইই চাই। এ ক্ষেত্রে পরাজয় বাঞ্চনীয় নয়। স্কুলে যেতাম আবিরের সাথে। আবিরের মা কর্মজীব্বী মহিলা।
তিনি আমাকে আর আবিরকে স্কুলে দিয়ে আসতেন। ফেরত নেওয়ার কাজটা করতেন আমার আম্মা। সকালে উঠেই অস্থির হয়ে যেতাম কারন আগে যাওয়া চাইই চাই। এর মাঝে আবিরের মা একটা কাজ করে ফেললেন। আমরা সকালে যেখান থেকে রিকশায় উঠতাম সেখানে একজন বুড়া মত রিকশাওয়ালা ছিল।
সব সময় দৌড়ে আমি অন্য রিকশা ঠিক করার চেস্টা করতাম যাতে তারটাতে উঠা না লাগে। তার রিকশায় উঠা মানে অবধারিত ভাবে শেষ বেঞ্চে বসা। আবিরের মা মানে আন্টি সেই রিকশাটাকে বললেন সব সময় যেন সে থাকে আমাদের নিয়ে যাওয়ার জন্য। বড় মানুষরা ছোটদের জালা যন্ত্রনা বুঝবেনা সেটাই স্বাভাবিক। আন্টির এহেন কর্মকান্ডে আহত হলাম।
কারন এখন আর ফার্স্ট বেঞ্চে বসা হয়না। খুবই বিরক্তিত ভাবে দিন কাটাই। এর মাঝে একদিন অতি বিরক্ত হলাম। সেই ধীরগতির রিকশার কারনে ৭ টা ২০ এ পৌছালাম। এসেম্বলীতে আলাদা ভাবে শাস্তি দেওয়া হল।
পরেরদিন আবার সেই রিকশায় যাচ্ছি। রিকশাওয়ালা কিন্তু সব সময়েই দেখা যায় সকালে আমাদের জন্য বসে আছে। রিকশাওয়ালা চালানোর সময় তাকে বললাম আপনি এত আসতে চালান কেন? আপনার কি শক্তি নেই? রিকশাওয়ালার জবাব নেই। আন্টি বললেন হয়ত রিকশাতে সমস্যা আছে। আমি বললাম দূর রিকশা ঠিক আছে।
গায়ে শক্তি নেই। রিকশা আমাদের নামিয়ে দিল।
পরের দিন কোন কারনে অনেক সকালে গেলাম রিকশা ঠিক করতে। আবিরকে এবং আন্টিকে এক ধরনের বাগড়া দিয়েই নিয়ে গেলাম যাতে অন্য রিকশা ঠিক করা হয়। গিয়ে দেখলাম আজকে খালি ঐ রিকশাটাই আছে।
কাজেই আবারো সেই রিকশাতে উঠতে হল। মেজাজও খারাপ। বুঝতে পারলাম আজকে রিকশাওয়ালা অনেক জোরে চালানোর চেস্টা করছে। লাভ অবশ্য হচ্ছেনা। রিকশাওয়ালা চুপচাপ ধরনের কিন্তু আজকে সে যেন কি বলল,
- বাজানের নাস্তা করতে সমেস্যা হয়নায় তো।
- না হয়নায়। সকালে বুয়া ডিম পোজ করে দেয়।
- বাজান ডিম খাও!! ডিম খাইলে বাজান গায়ে শক্তি হয়। আমি তো ছুডবেলায় খাইবার পারিনাই। আমার পোলাগোরে মাঝে মাঝে খাওয়াই।
স্কুলে টিফিন নিয়ে যেতাম। কোন কারনে টিফিনেও আজকে ডিম ছিল স্যান্ডুইচ টাইপ কিছু একটা বানানো হয়েছে ডিম দিয়ে। এত অল্প বয়স আমার তারপরেও বুঝলাম বুড়া রিকশাওয়ালাকে মনে কষ্ট দিয়ে ফেলেছি। ঐদিন টিফিনে ডিম কামড় দেওয়ার সময় তার কথা মনে পড়ল।
পড়ের দিন মমতাজ বুয়াকে বললাম টিফিনে আজকে দুইটা ডিম দিবেন।
মমতাজ বুয়া বলেন, খালাম্মায় মাইর দিব। দিলে দিক। আপনি দুইটা ডিম দিবেন। ডিম খেলে শক্তি হয়। আমাদের সমাজ বইয়ে আছে প্রতিদিন দুধ ডিম খেতে হয়।
নাইলে শক্তি হয়না। বুয়াকে বলিনি যে একটা ডিম আমি রিকশাওয়ালার জন্য নিয়ে যাচ্ছি। তখন আমি একদম বাচ্চা। বাচ্চারা এমনই চিন্তা করে।
তাড়াতাড়ি করে গেলাম।
আমি। আবির আর আন্টি। অবাক করা ব্যাপার। গত একমাসে যেই রিকশাতে করে প্রতিদিন দেরী করে স্কুলে যাই সেই রিকশা আজকে নাই। সেই বুড়ামত রিকশাওয়ালাকে আজকে পাওয়া যাচ্ছেনা।
এর পর থেকে পরের এক সপ্তাহে সেই রিকশাওয়ালাকে দেখলাম না। আস্তে আস্তে ভুলে গেলাম। অনেক তাগড়া তাগড়া রিকশাওয়ালা এখন ঝড়ের বেগে আমাদের স্কুলে নিয়ে যায়। ফার্স্ট বেঞ্চে বসা শুরু হয়েছে আবার। প্রায় এক মাস পর জানতে পারলাম ঐ রিকশাওয়ালা মারা গিয়েছে।
কিভাবে জানলাম? বেইলী রোড কলনীর পিছনেই তখন রমনাতে বস্তির মত একটা জায়গা ছিল। সেখানে কয়েকজন রিকশাওয়ালাই থাকত। তারাই সকালে সবার আগে খ্যাপ পাওয়ার জন্য স্কুলে যাওয়া ছাত্র ছাত্রী ধরতে কলনীতে বসে থাকত। খবরটা দিলেন আবিরের মা মানে আন্টি। ওই বস্তির মত জায়গায় ছুডা বুয়ারাও থাকত।
সেখান থেকে খবর আসছে সেই বুড়ামত রিকশাওয়ালাটা মারা গিয়েছে।
বড় হওয়ার পর একটা জিনিস খুব চেস্টা করি। কোন ভাবেই বুড়ামত কোন রিকশাওয়ালার রিকশাতে যেন উঠতে না হয়। আমার ৯২ কেজি ওজনের দেহটাকে একজন বুড়া রিকশাওয়ালা অসহায়ের মত টেনে নিয়ে যাচ্ছে দেখতে আমার খুব ভাল লাগেনা। মনের ভেতরটা সায় দেয়না।
আর রিকশা চালালে কি আর শরীর থাকে?
কিন্তু ছোটবেলার পরিবেশ পরিচিতি বইয়ে যে লেখা আছে? দুধ, ডিম নিয়মিত খেলে শক্তি হয়।
তারা তো আর আমাদের মত প্রতিদিন দুধ ডিম খেতে পারেনা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।