আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মাদক গ্রাস করছে পথশিশুদের



বিমানবন্দর এলাকায় হাজী ক্যাম্প মার্কেটের সামনে ৮-১০ বছর বয়সী শিশু জনি, মান্নান, রুবেল এবং লাদেন জুতার আঠা শুঁকে নেশা করছিল। এই আঠা শুঁকলে মাথা ঝিমঝিম করে ঘুম আসে। এ ধরনের নেশা করার কারণ জানতে চাইলে ওদের প্রত্যেকেই এ প্রতিবেদককে জানায়, বাবা-মা হারানোর কষ্ট ভুলে থাকতে এবং ময়লা-আবর্জনা কুড়ানোর সময় দুর্গন্ধ আর সে সময় হাত-পা কেটে গেলে শরীরে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। ব্যথার সে অনুভূতি না হওয়া এবং কষ্ট ভুলে থাকতে তারা নেশা করে। এসব ভুল ধারণা তোমাদের কে দিয়েছে—প্রতিবেদকের এমন প্রশ্নের জবাবে এসব শিশু প্রত্যেকেই একসঙ্গে জানায়, যে মহাজনের কাছে তারা কুড়ানো জিনিস বিক্রি করে, সে মহাজনই তাদের এসব নেশা করতে উত্সাহিত করেছে।

৯ মার্চ বিকালে কারওয়ান বাজারে কাঁচাবাজারের সামনে জবুথবু হয়ে শুয়ে আছে কয়েকটি শিশু। পথচারীদের কেউ ওই পথ দিয়ে হেঁটে গেলে তাদের কাছে দু’এক টাকা চেয়ে নিচ্ছে তারা। পাশেই কয়েকজন দোকান কর্মচারী শিশুগুলোকে টাকা দেয়ায় প্রতিবাদ করেন। শিশুদের টাকা দিতে বাধা দেয়ার কারণ জানতে চাইলে দোকান কর্মচারীরা বললেন, টাকা পেলে এসব শিশু ‘ডান্ডি’ খাবে। কিন্তু সবুজ, রাজীব ও শুক্কুর নামের ওই শিশুদের বক্তব্য হচ্ছে ওরা ‘ডান্ডি’ খায় না।

ডান্ডি কী জানতে চাইলে ওরা বলে—‘নেশা’। পলিথিনের ভেতর সল্যুশন ঢুকিয়ে নাকে-মুখে তার গন্ধ নিলে এতে নেশা হয়। রাজধানীর প্রায় প্রতিটি পথশিশুই ‘ডান্ডি’ নামের নেশার সঙ্গে পরিচিত। সাধারণ মানুষ দেখলে বুঝবে না পলিথিন মুখে লাগিয়ে শিশুগুলো কী করছে। হয়তো তাদের মনে হবে পলিথিন দিয়ে শিশুগুলো খেলছে।

আসলে এগুলো দিয়ে তারা নেশা করছে। রাজধানী ঢাকাসহ অনেক এলাকায় ইয়াবা নামের ভয়াবহ মাদকের ব্যবহার ব্যাপক আকার নিয়েছে। চলতি বছরের ২৪ জানুয়ারি থেকে ১২ মার্চ পর্যন্ত রাজধানীতেই র্যাবের হাতে গ্রেফতার হয়েছে ১৪৪ ইয়াবা বিক্রেতা। মাদকবিরোধী সংগঠনগুলোর দেয়া তথ্যমতে, বিক্রি ও বহনের পাশাপাশি ইয়াবা সেবন শুরু করেছে শিশুরাও। প্রথমে বহন, তারপর ইয়াবা সেবনে পথশিশুরাও জড়িয়ে পড়ছে।

তাদের দিয়ে ইয়াবা বিক্রিও করা হচ্ছে। মাদক নিরাময় কেন্দ্র ‘আপন’-এর ট্রিটমেন্ট ম্যানেজার হাসিবুর রহমান শাহী জানান, ইয়াবা সেবনকারী চার শিশুকে বর্তমানে এখানে চিকিত্সা দেয়া হচ্ছে। তাদের বয়স ১১-১২ বছরের মতো। এসব শিশুর প্রত্যেকেই এ প্রতিবেদককে জানায়, ইয়াবা খেলে শরীরে অন্যরকম অনুভূতি হয়। ফলে চুরি করে ধরা পড়ে মার খেলেও খুব বেশি ব্যথা পাওয়া যায় না।

এ কারণেই ইয়াবা শিশুদের কাছে এত জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। মাদক নিয়ে কাজ করা সংগঠনগুলোর মতে, দরিদ্রতার সুযোগ নিয়ে পথশিশুদের কাজে লাগাচ্ছে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা। ইয়াবা সরবরাহে তাদের ব্যবহার করা হচ্ছে। শিশুরা প্রথমে ইয়াবা বিক্রি করে টাকা পায়। তারপর নিজেরাই সেবনে অভ্যস্ত ও বিক্রির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এবং ইয়াবায় আসক্ত হয়ে পড়ে।

জনি, রুবেল, লাদেন, মান্না, সজীব, রাজীব ও শুক্কুরের মতো পথশিশুদের অধিকাংশই মাদকাসক্ত। মা-বাবা, আপনজন থেকে বিচ্ছিন্ন জীবনযাপন করায় সহজেই তারা বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্যে আসক্ত হয়ে পড়ছে। এসব শিশুর অধিকাংশই মাদকের ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে জানে না। আর যখন তারা মাদকের ভয়াবহতা সম্পর্কে জানতে পারে, তখন আর ফেরার পথ থাকে না। ততদিনে মাদক পথশিশুদের জীবন পুরোপুরি গ্রাস করে ফেলে।

পথশিশুরা সাধারণত গাঁজা, হেরোইন, ঘুমের ওষুধ, ডান্ডি, পলিথিনের মধ্যে গামবেল্ডিং দিয়ে এবং পেট্রোল শুঁকে নেশা করে। ফেনসিডিলের দাম বেশি হওয়ায় নেশার এই দ্রব্যটি তারা কিনে খেতে পারে না। ঢাকা শহরে কমপক্ষে ২২৯টি স্পট রয়েছে যেখানে ৯ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুরা মাদক সেবন করে। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম, টিএইচ নেদারল্যান্ড ও পদক্ষেপ মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্রের যৌথ উদ্যোগে ২০০৭-এ পরিচালিত একটি জরিপ কার্যক্রমে এ তথ্য পাওয়া যায়। তাদের প্রতিবেদন অনুযায়ী ২১টি স্পটে সুঁচের মাধ্যমে মাদক গ্রহণ, ৭৭টি স্থানে হেরোইন সেবন এবং ১৩১টি স্থানে গাঁজা ও গ্লোসিন সেবন করা হয়।

ঢাকা শহরের ২৮টি থানার ৪১০ মাদকসেবী শিশু চিহ্নিত করে নির্দিষ্ট প্রশ্নমালার উত্তরের সাহায্যে প্রতিবেদনে তথ্য সংগ্রহ করা হয়। তবে মোট কত শিশু মাদকাসক্ত, তার সঠিক সংখ্যা নিরূপণ করা যায়নি বলেও এতে উল্লেখ করা হয়। কেবল ঢাকা শহরেই মাদকের এই মরণ নেশা থাবা বিস্তার করছে তা নয়। মাদক বিক্রি ছড়িয়ে পড়ছে নগর-মহানগর, মফস্বল শহর থেকে গ্রাম-গঞ্জের হাটবাজার ও দেশের আনাচে-কানাচে। উদ্বেগজনক বিষয় হলো, মাদক সেবনকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক শিশু-কিশোর এবং কিশোরীও রয়েছে।

মাদকাসক্ত পথশিশুদের মাদকের ভয়াবহতা থেকে রক্ষা করার জন্য সরকারের কোনো কার্যক্রম নেই। সরকারের ৪০ শয্যাবিশিষ্ট মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে পথশিশু এবং নারীদের চিকিত্সা দেয়ার কোনো ব্যবস্থা নেই। এমনকি মাদকাসক্ত পথশিশুদের মাদক সেবন থেকে ফিরিয়ে আনার জন্য সরকারের কোনো কাউন্সেলিং এবং সচেতনতামূলক কার্যক্রমও নেই। পথশিশুদের সুরক্ষার জন্য বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা এনজিও আপন, পদক্ষেপ, আহ্ছানিয়া মিশনের ড্রপিং সেন্টার থাকলেও পথশিশুদের মাদক থেকে দূরে রাখার জন্য ধারাবাহিক কোনো কার্যক্রম নেই। |


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.