'জীবন' হলো এক কাপ গরম চা আর একটা জ্বলন্ত বেনসনের মতো। গরম চা একসময় জুড়িয়ে যাবে, বেনসনের তামাকও পুড়ে শেষ হয়ে যাবে।
বছর দুয়েক আগের কথা। অফিসে বসে কাজ করছিলাম। এমন সময় মগবাজার এলাকা থেকে এক লোক এসে জানালেন তাঁর সিএনজি অটোরিকশাটি পাওয়া যাচ্ছে না।
চালক ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। চালক সংজ্ঞাহীন থাকায় কিছুই জানতে পারছেন না। তিনি তাঁর সিএনজি অটোরিকশা উদ্ধার ও জড়িতদের শাস্তি কামনা করেন।
এ অভিযোগ পাওয়ার পর আমরা তদন্তে মাঠে নামলাম। সমস্যা হলো, চালক সংজ্ঞাহীন থাকায় কোনো ক্লু পাওয়া যাচ্ছিল না।
কিভাবে অটোরিকশাটি চুরি বা ছিনতাই হয়েছে তা জানার চেষ্টা করতে থাকলাম। চার দিন পর চালকের জ্ঞান ফেরে। আগেই অটোরিকশার মালিককে বলে রেখেছিলাম জ্ঞান ফেরার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে জানাতে। তিনি জানানোর পর চালকের সঙ্গে কথা বললাম। চালক জানালেন, উত্তরা এলাকায় দাড়িওয়ালা এক লোক তাঁকে মতিঝিলে যাওয়ার কথা বলে।
চালক তাকে নিয়ে যাবেন তাও ঠিক হয়। কিন্তু দাড়িওয়ালা লোকটি কুরিয়ার সার্ভিসে তার মাল আসার কথা বলে সময়ক্ষেপণ করতে থাকে। মাল এলেই তাঁকে নিয়ে চলে যাবে বলে চালককে জানায়। চালককে এ-ও বলে, কুরিয়ার সার্ভিস থেকে জানানো হয়েছে, কয়েক মিনিটের মধ্যেই মাল পেঁৗছে যাবে। এ কথা বলে লোকটি চালকের সঙ্গে ভাব জমিয়ে ফেলে।
একপর্যায়ে ওই লোকটি একজন চা বিক্রেতার কাছ থেকে চা পান করে এবং তাকেও চা খেতে বলে। চালক চা খেতে রাজি হন। চা খাওয়ার পর থেকে আর কিছু জানেন না তিনি। জ্ঞান ফিরলে বুঝতে পারেন, তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে।
এ ঘটনা শোনার পর বুঝতে পারলাম, এটি অজ্ঞান পার্টির কাজ।
কিন্তু কারা করেছে সেটা জানার জন্য বিভিন্ন সোর্সের মাধ্যমে সন্দেহভাজন কিছু লোকের নাম তালিকা করলাম। এর মধ্যে উত্তরা এলাকায় কাজ করে এমন এক অজ্ঞান পার্টির সদস্যের সঙ্গে নাম-পরিচয় গোপন রেখে যোগাযোগ শুরু করলাম। সিএনজি অটোরিকশা ছিনতাইয়ের পর আরেক শ্রেণী রয়েছে যারা মধ্যস্বত্বভোগী হিসেবে কাজ করে। এক কথায় দালাল। তাদের সঙ্গে অটোরিকশা ছিনতাইকারীদের রয়েছে দহরম-মহরম।
তারা মালিক পক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকার বিনিময়ে গোপনে অটোরিকশা ফেরত দিয়ে দেয়। আমাদের লোকজন সেই পরিচয় দিয়ে সিএনজি চুরির লিডার হাফেজ বাবুলের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করে। একপর্যায়ে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে একটি সিএনজি অটোরিকশা ফেরত দিতে রাজি হয়। অটোরিকশার নম্বর জেনে নিশ্চিত হওয়া যায়, ঠিক জায়গায়ই নক করা হয়েছে। একপর্যায়ে হাফেজ বাবুল নির্দিষ্ট স্থানে টাকা নিতে এলেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রথমে সে কিছুই জানে না বলে ঘটনাটি অস্বীকার করে যেতে থাকে। এরপর যখন ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হয়, তখন সে অটোরিকশা ছিনতাইয়ের কথা স্বীকার করে। পরে তার আস্তানা থেকে ছিনতাই করা আরো দুটি অটোরিকশা উদ্ধার করা হয়। বাবুল জানায়, সে কোরআনে হাফেজ। টাকার লোভে এ রাস্তায় নেমেছে।
উত্তরা এলাকা থেকে কথায় ভুলিয়ে সন্ধ্যা থেকে রাত পর্যন্ত আটকে রাখে ওই চালককে। তারপর কৌশলে চায়ের সঙ্গে অ্যাটিভান ট্যাবলেট দিয়ে দেয়। সেটি খেয়েই অজ্ঞান হয়ে পড়েন চালক। পরে তারা চালককে নিজেরাই ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে ভুয়া নাম-ঠিকানা দিয়ে ভর্তি করে দেয়। ওই সময় তাকে প্রশ্ন করেছিলাম, চালককে হাসপাতালে নিয়ে গেলে কেন? তখন বেরিয়ে এল আরেক মর্মান্তিক কাহিনী।
যেন কেঁচো খুঁড়তে বেরোল সাপ। সে জানাল, চালককে মেরে ফেলার জন্য তারা এই কাজ করে না। কিন্তু এ ঘটনার আগে গাজীপুর এলাকায় তাদের হাতে একজন মারা গেছে। এ কারণে এই চালককে হাসপাতালে নিয়ে যায়। কথা শুনে অবাক হচ্ছিলাম।
বললাম গাজীপুরের কাহিনীটি বলার জন্য। তখন সে জানাল, উত্তরা থেকে সে তার দলের এক নারী ও এক পুরুষ সদস্যকে নিয়ে গাজীপুরের কাপাসিয়া যাওয়ার জন্য একটি সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া নেয়। অটোরিকশাচালক সঙ্গে নারী থাকায় অবিশ্বাস করেনি। একপর্যায়ে গ্রামের এক রাস্তা দিয়ে যেতে বলে অটোরিকশাচালককে। পরে নির্দিষ্ট স্থানে দাঁড়ানোর নির্দেশ দেয়।
দাঁড়ানোর পরই অ্যাটিভান ট্যাবলেট মেশানো জুস খেতে দেয় চালককে। চালক খায়। খাওয়ার পর প্রাকৃতিক কাজ সারতে চালক নিচে নামে। তখন সে সংজ্ঞা হারানোর পথে। কোন দিকে যাচ্ছিল খেয়াল করতে পারেনি।
ফলে পড়ে যায় একটি কুয়ায়। সেখানেই মারা যায় চালক। ওই সময় তারা দ্রুত সিএনজি অটোরিকশাটি নিয়ে পালিয়ে যায়। তার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হতে পারে ওই ভয়ে গাজীপুর থেকে ছিনতাই করা সিএনজি অটোরিকশাটি ফেরত দিতে কারো সঙ্গে আলোচনা করেনি।
শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, শুধু টাকার জন্য কত নির্দয় হতে পারে এরা! যাই হোক, একটি ঘটনা উদ্ধার করতে গিয়ে বেরিয়ে এল আরো একটি বড় ঘটনা।
নিহত মানুষটির পরিবার জানতে পারল কিভাবে মৃত্যুবরণ করেছে তাদের স্বজন। এ ছাড়া আইনও তাদের শাস্তি দিতে পারবে।
সেদিন বাবুলের কথা অবাক করেছিল আমাকে। বাবুল বলছিল, স্যার, আমরা কখনো চালককে অ্যাটিভান ট্যাবলেট মেশানো খাবার খাওয়ানোর পর গাড়ি চালাতে দিই না। কারণ ওই চালক তখন অ্যাঙ্েিডন্ট করবে।
এতে নিজেদের জীবনও বিপন্ন হবে। হাফেজ বাবুলের কথা শুনছিলাম আর ভাবছিলাম, নিজের জীবনকে যারা এত মূল্যবান মনে করে তারা কি না অন্যের জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলে।
লেখক : পুলিশ কর্মকর্তা
সূত্র: কালের কণ্ঠ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।