আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মানুষখেকো



মানুষখেকোআধুনিক মানুষের সঙ্গে বন্য প্রাণীরা এখন আর পেরে ওঠে না। কিন্তু কখনো উল্টে যায় পাশার দান। হঠাৎ করেই মূর্তিমান যমদূত হয়ে যায় কোনো কোনো প্রাণী। একের পর এক মানুষ হত্যা করে সৃষ্টি করে ভয়াবহ আতঙ্ক। লেখা হয় অনেক গল্প।

এমনই কিছু মানুষ-শিকারি প্রাণীর গল্প। আঠারবেকীর ত্রাস সুন্দরবনের সাতক্ষীরা অংশের যমুনা আর রায়মঙ্গল নদীর মাঝখানের মৌজা আঠারবেকী। ঘটনার শুরু ১৯৬৬ সালের এক সকালে। তখন ৭টা-৮টার মতো বাজে। দুটি ডিঙ্গি নৌকায় চেপে আঠারবেকীতে গোলপাতা কাটতে এল ছয় বাওয়ালি।

ঘন হয়ে গোলপাতা জন্মেছে_এমন একটি স্থানের কাছে নৌকা বেঁধে গোলপাতা কাটতে লেগে গেল তারা। একজন দুটি গোলপাতা কেটে সবে তিন নম্বরটার গোড়ায় দা বসিয়েছে। এমন সময় ভয়ংকর গর্জন করে পাশের বন থেকে তার ওপর লাফিয়ে পড়ল একটি বাঘ। লোকটার সঙ্গীরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাকে মুখে নিয়ে আবার জঙ্গলে ঢুকে পড়ল বিশাল আকারের পুরুষ বাঘটা। শুরুতে ভড়কে গেলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই সাহস ফিরে পেল বাকি পাঁচ বাওয়ালি।

এক হাতে বৈঠা, আরেক হাতে দা নিয়ে হৈচৈ করতে করতে বনে ঢুকল। লতাপাতা ও মাটিতে লেগে থাকা ছোপ ছোপ রক্ত আর বাঘের তাজা পায়ের ছাপ ধরে অনুসরণ শুরু করল তারা। কিছুদূর গিয়েই খুঁজে পেল লাশ। সম্ভবত তাদের চেঁচামেচিতে বিরক্ত হয়েই দেহটা রেখে চলে গেছে প্রাণীটি। সাধারণত বাঘ এক দিনে দুটি শিকার করে না।

কিন্তু প্রথম শিকার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় ক্ষুব্ধ হয়েই কি না, রাতে আবার হামলা চালাল ওই বাঘ। প্রথম হত্যাকাণ্ডটা যেখানে ঘটেছে, তার চেয়ে মাত্র সিকি মাইল দূরে ফুলখালী খালে নৌকায় ঘুমাচ্ছিল চার বাওয়ালি। নৌকার বেশির ভাগ অংশই ছিল গোলপাতায় বোঝাই। ফুলখালী বেশ বড় খাল, চওড়ায় অন্তত ৪০ হাত। নৌকার ওপর চাটাই বিছিয়ে শুয়েছিল তারা।

দুজনের শরীর ছিল নৌকার ছইয়ের ভেতর। বাকি দুজনের মাথা ছইয়ের ভেতর হলেও পা বাইরে। খালে তখন ভরা জোয়ার। পানি ঠেলে এসে কোনো বাঘ নৌকায় আক্রমণ চালাবে, কল্পনায়ও ছিল না লোকগুলোর। কিন্তু দুরন্ত সাহসী এই বাঘটা জোয়ারের সব হিসাব-নিকাশের থোরাই কেয়ার করে।

রাত ১২টার দিকে সাঁতরে নদী থেকে প্রায় ১৫ হাত দূরে নৌকায় গিয়ে উঠল ওটা। তারপর ছইয়ের বাইরে শোয়া একজন বাওয়ালির ঘাড় কামড়ে ধরে নেমে পড়ল পানিতে। লোকটা কেবল একবার ক্যাঁক শব্দ করত পারল। অন্য বাওয়ালিদের চিৎকার-চেঁচামেচিকে মোটেই পাত্তা না দিয়ে খালপাড় হয়ে বনে ঢুকে গেল বাঘটি। সকালে বেশ কয়েকজন বাওয়ালি একত্র হয়ে বনের গভীর থেকে উদ্ধার করে লাশ।

ইতিমধ্যে মড়ির মৃতদেহ বেশির ভাগই খেয়ে ফেলেছে বাঘটি। আর এভাবেই শুরু সুন্দরবনের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকরতম মানুষখেকোগুলোর অন্যতম 'আঠারবেকীর বাঘ'-এর রাজত্ব। আঠারবেকীর সীমানার মধ্যে একের পর এক জেলে আর বাওয়ালি যেতে লাগল বাঘের পেটে। ওই বাঘ এমনই আতঙ্ক সৃষ্টি করল যে, অনেক বাওয়ালি গোলপাতা কাটাই বন্ধ করে দিল। জেলেরা বন্ধ করে দিল মাছ ধরা।

বন বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা-শিকারি বাঘের পিছু লাগলেন। তাঁদের মধ্যে আছেন সুন্দরবনের বিখ্যাত মানুষখেকো বাঘ শিকারি পচাব্দী গাজীও। কিন্তু কোনোভাবেই বাঘের নাগাল আর পান না তাঁরা। তবে বেশ কয়েকবার ওটার পায়ের ছাপ দেখলেন পচাব্দী। বলতে গেলে, তাঁদের নাকের ডগা দিয়েই একের পর এক মানুষ নিয়ে যেতে লাগল বাঘটা।

দেখতে দেখতে মৃতের সংখ্যা দাঁড়াল ২৩-এ। শেষ শিকারটাও ছিল একজন বাওয়ালি। আঠারবেকী খালের কাছে গোলপাতা কাটার সময় তাকে ধরে নিয়ে যায় বাঘ। মানুষখেকোটার পায়ের ছাপ আর রক্তের চিহ্ন অনুসরণ করে বেশ কিছুদূর এগোতেই বনের মধ্যে লোকটার লাশ খুঁজে পেলেন পচাব্দী গাজী। মড়ির বেশ কিছুটা খাওয়া তখনও বাকি।

অর্থাৎ আবার আসবে বাঘ। অনেক বলে-কয়ে নিহতের আত্মীয়স্বজনকে লাশটা সন্ধ্যা পর্যন্ত সেখানে রাখতে রাজি করালেন। বাওয়ালিদের একজনও তাঁর সঙ্গে থাকতে রাজি হলো। তখন বিকেল ৩টা। শিকারির আশা, সন্ধার আগেই বাঘটা পদধূলি দেবে।

তবে সমস্যা হলো, আশপাশে ৬০-৭০ গজের মধ্যে বসার মতো বড় কোনো গাছ নেই। উপায়ান্তর না দেখে দারুণ একটা ঝুঁকি নিয়ে ফেললেন পচাকী। খালের ঢালের মধ্যে শুয়ে পড়লেন সঙ্গীসহ। শুধু মাথা রইল ওপরে, শরীরের বাকি অংশ ঢালে। বাওয়ালি শুয়ে পড়ল তাঁর বামে।

সামনের দিক থেকে কোনো বিপদ এলে সতর্ক করে দিতে পারবে সে। বেশ কিছুটা সময় পার হওয়ার পর পূর্ব দিক থেকে ভয়ার্ত স্বরে ডেকে উঠল একটি বানর। মিনিট দশেক পরেই এল বাঘটা। সরাসরি ওটার ঘাড়ে গুলি করলেন পচাব্দী গাজী। গুলি খেয়ে পড়ে গেল বাঘটা।

একটু অপেক্ষা করার পর নিশ্চিত হওয়ার জন্য আরো একবার গুলি করলেন_এবার বুকে। আর কোনো মানুষ মারবে না আঠারবেকীর ভয়ংকর ওই বাঘ। চম্বাবতের ভয়াল থাবা পৃথিবীর সবচেয়ে ভয়ংকর মানুষখেকোগুলোর তালিকা করলে অনায়াসে এতে জায়গা করে নেবে চম্পাবতের বাঘিনীটা। উনিশ শতকের শেষ দিকে নেপালের হিমালয় ঘেঁষা একটি এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে এ মানুষখেকো। বাঘিনীটা এতই চতুরতার সঙ্গে একের পর এক মানুষ মারতে লাগল যে, স্থানীয় অধিবাসীরা বিশ্বাস করতে শুরু করল, এটা রক্ত-মাংসের কোনো প্রাণী নয়; ঈশ্বরেরই পাঠানো যম।

কেউ আবার মনে করল, মৃত কোনো মানুষের অতৃপ্ত আত্মা ভর করেছে ওটার ওপর। চম্পাবতের বাঘটি মানুষখেকো হয়ে ওঠার পুরো দায়ভার একজন আনাড়ি শিকারির। তার গুলিতে ওই বাঘিনীর দুটো স্বদন্ত গুঁড়িয়ে যায়। ফলে বাঘিনীটির পক্ষে আর স্বাভাবিক শিকার ধরা সম্ভব ছিল না। যার ফলে জন্ম হয় এক মানুষখেকোর।

একপর্যায়ে এর হাতে নিহত মানুষের সংখ্যা গিয়ে ঠেকল ২০০-তে। একের পর এক শিকারি বাঘিনীটিকে হত্যা করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়ে ফিরতে লাগল। প্রাণীটি এতই ধূর্ত যে, হত্যা করা তো দূরের কথা, বেশির ভাগ শিকারি এর দেখাও পেল না। পরিস্থিতি এমন একপর্যায়ে ঠেকল যে, নেপালের রাজা এটাকে মারতে সেনাবাহিনী পাঠাতে বাধ্য হলেন! হাঁফ ছেড়ে বাঁচল সবাই। যত চালাকই হোক, এবার নিশ্চয়ই আর পালিয়ে বাঁচতে পারবে না বাঘিনীটা।

কিন্তু কোথায় কী! মানুষখেকোটাকে পাকড়াও করতে পুরোপুরি ব্যর্থ হলো সেনারা। তবে লাভ অবশ্য একটা হলো। বিরক্ত হয়ে সীমানা পার হয়ে ভারতের চম্পাবত এলাকায় আস্তানা গাড়ল বাঘিনীটি। এখানে এসে আরো সাহসী আর ধূর্ত হয়ে উঠল ও। এমনকি দিনের আলোতেও মানুষ তুলে নিয়ে যেতে লাগল।

ভয়ে বাড়ি থেকে বের হওয়া বন্ধ করে দিল লোকজন। তবে শেষতক হার মানতেই হলো। কারণ, ততদিনে এর পিছু নিয়েছেন বিখ্যাত শিকারি জিম করবেট। প্রাণীটির শেষ শিকার একটি কিশোরী মেয়ের রক্তের চিহ্ন ধরে বাঘিনীটিকে অনুসরণ করে সেটাকে শেষ হত্যা করলেন করবেট। সময়টা ছিল ১৯১১ সাল।

ততদিনে ওটার হাতে প্রাণ খুইয়েছে ৪৩৬ ব্যক্তি। সাভোর মানুষখেকো তবে শুধু বাঘ কিংবা চিতা নয়, কখনো নরখাদক হয় সিংহও। ১৮৯৮ সালের ঘটনা। কেনিয়ার সাভো এলাকায় রেললাইন তৈরির কাজে হাত দেয় ব্রিটিশ সরকার। এ সময় হঠাৎ রেললাইন তৈরির সঙ্গে জড়িত শ্রমিকরা দুটি সিংহের আক্রমণের শিকার হতে থাকে।

সিংহগুলো গায়ে-গতরে ছিল বিশাল। ওই এলাকার বেশির ভাগ পুরুষ সিংহের মতো সেগুলোরও কেশর ছিল না। গোড়ার দিকে রাতের আঁধারে শ্রমিকদের তাঁবুতে হামলা চালিয়ে তাদের তুলে নিয়ে যেত সিংহ দুটি। তারপর কোনো জঙ্গলের ভেতরে নিয়ে চুকাত খাওয়ার পাট। কিন্তু মানুষ খুন করতে করতে একসময় এরা এতটাই ভয়ংকর হয়ে উঠল যে, মানুষ ধরে তাঁবুর আশপাশেই খেতে লাগল।

এদের ধূর্ততা, বিশাল আকার আর ভয়াবহতা লোকজনের মনে জন্ম দিল নানা রকম কুসংস্কার। কেউ বলল, এরা আসলে সিংহ নয়, নরক থেকে উঠে আসা সাক্ষাৎ শয়তান। কেউ আবার বলল, সাভোর আশপাশের এলাকার মৃত রাজারা ব্রিটিশ দখলদারদের তাড়ানোর জন্য ফিরে এসেছে সিংহের বেশে। আতঙ্কিত শ্রমিকরা কাজ ছেড়ে দল বেঁধে পালাতে লাগল। সাভোর রেল প্রজেক্টের দায়িত্বে থাকা চিফ ইঞ্জিনিয়ার জন হেনরি প্যাটারসন বুঝতে পারলেন, মানুষখেকোগুলোর কবল থেকে রেহাই পাওয়ার একমাত্র উপায় হলো এগুলোকে পৃথিবী থেকে চিরতরে বিদায় করে দেওয়া।

জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিকারে নামলেন। একবার অল্পের জন্য নিজেই সিংহগুলোর খোরাক হওয়ার হাত থেকে বেঁচে গেলেন। শেষ পর্যন্ত ১৮৯৯ সালের ডিসেম্বরে একটি সিংহ মারা পড়ল তাঁর হাতে। সপ্তাহ দুয়েক পর শিকার করলেন দ্বিতীয়টাকে। কিন্তু ইতিমধ্যে প্রাণ হারিয়েছে ১৪০ ব্যক্তি।

সাভো নদীর তীরে এক গুহায় নরখাদক দুটোর আস্তানাও খুঁজে পেলেন কর্নেল প্যাটারসন। এখানে বেশ কিছু মানুষের অর্ধভুক্ত মড়িও আবিষ্কার করলেন; এবং পেলেন তাদের ছেঁড়া কাপড়চোপড় আর নানা অলঙ্কার। মহীশূরের ভল্লুক বাঘ ও সিংহের গল্প শুনলেন। এবার শুনবেন ভয়ংকর এক ভল্লুকের কাহিনী। ভারতের বিভিন্ন স্থানে ভল্লুকের হাতে বিপুল সংখ্যক মানুষ মারা গেলেও এরা শিকারের মাংস খায় কমই।

সত্যি কথা বলতে কি, মাংসের প্রতি তাদের আগ্রহ খুবই কম। মধু, ফল আর পোকামাকড়ের দিকেই তাদের নজর। আর সেই ভল্লুক কিনা একের পর এক মানুষ মেরে চলেছে_এমনটাও খুব একটা ঘটে না। কিন্তু মহীশূরের ভল্লুকটা ছিল অন্যগুলোর চেয়ে আলাদা। এটা কেন এতটা মানুষবিদ্বেষী হয়ে উঠল, তা নিয়ে প্রচলিত আছে বেশ কয়েকটি গল্প।

কথিত আছে, ভল্লুকটা একবার তার সঙ্গী বানানোর জন্য একটি মেয়েকে তুলে নিয়ে গিয়েছিল। পরে গ্রামবাসী তাকে উদ্ধার করে নিয়ে এলে খেপে গিয়ে নরহত্যা শুরু করে ও। আবার কারো কারো মতে, ওটা ছিল একটা স্ত্রী ভল্লুক। তার বাচ্চাগুলো মানুষের হাতে মারা পড়লেই ভয়ংকর হয়ে ওঠে ও। তবে বিশেষজ্ঞের মতে, মানুষের হাতে আহত হয়েই এমন হিংস্র হয়ে যায় ভল্লুকটা।

মোট ৩৬ জনকে আক্রমণ করেছিল ও। স্বগোত্রীয় অন্যদের মতোই ধারালো বিশাল নখ দিয়ে শিকারের নাক-মুখ তুলে ফেলত ভল্লুকটি। ওটার হাতে প্রাণ হারায় ১২ জন। তিনজন মানুষকে খেয়েও ফেলেছে প্রাণীটি। শেষ পর্যন্ত এটাকে শিকার করতে আসেন বিখ্যাত শিকারি কেনেথ এন্ডারসন।

তাঁর হাতেই মারা পড়ে ওটা। সেই সঙ্গে সমাপ্তি ঘটে মহীশূরের ইতিহাসের একটি ভয়াল অধ্যায়ের। নীল আতংক এতক্ষণ যে ভয়ংকর প্রাণীগুলোর কথা বললাম, তার প্রতিটিই বিদায় নিয়েছে পৃথিবী থেকে। তাদের ঘটনাগুলো এখন কেবল অশুভ এক স্মৃতি। কিন্তু এখন যার কথা বলব, সে মোটেই কোনো স্মৃতি নয়, বরং জলজ্যান্ত এক বিভীষিকা।

আফ্রিকার যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ বুরুন্ডিতে আপনি দেখা পাবেন বর্তমান সময়ের সবচেয়ে ভয়াবহ মানুষখেকোর। ১৮ ফুট লম্বা আর এক টনের মতো ওজনের একটি নীল কুমির ওটা। স্থানীয় অধিবাসীরা এবং অনেক বছর ধরেই প্রাণীটিকে পাকড়াওয়ের চেষ্টাকারী প্যাট্রিক ফে নামের এক ফরাসি ভদ্রলোকের মতে, এখন পর্যন্ত তিন শতাধিক মানুষ মারা পড়েছে এর হাতে। ফে'র পক্ষ থেকে 'গুস্তাভ' নাম পাওয়া কুমিরটি ইতিমধ্যে স্থান পেয়েছে জীবন্ত কিংবদন্তির তালিকায়। স্থানীয়রা বলে, শুধু খাবারের জন্য নয়, রক্তের নেশায়ও হত্যা করে থাকে ভয়াবহ প্রাণীটি।

কোনো জায়গায় হামলা চালিয়ে সেখানে কয়েকজন মানুষকে মেরে কয়েক মাস, এমনকি বছরের জন্য সেখান থেকে চম্পট দেয় গুস্তাভ। আস্তানা গাড়ে নতুন কোনো জায়গায়। তার খাবারের মেন্যুরও নেই কোনো ঠিক-ঠিকানা। একবার আস্ত একটা জলহস্তী মেরে খেয়ে ফেলে কুমিরটি। বন্য প্রাণী মানুষের কোনো ক্ষতি না করলেও মানুষ তাকে মারে।

আর এমন ভয়ংকর একটি প্রাণীকে মারার চেষ্টা করা হবে না, তা কি হয়? অনেক শিকারিই গুস্তাভকে মারার চেষ্টা করেছেন। একে হত্যার মিশন হাতে নিয়েছিল গোটা একটি সেনাদলও। কিন্তু ঠিকই কোনো না কোনোভাবে বেঁচে যায় প্রাণীটি। ফে নিজেও একে ধরার জন্য পানির নিচে বিশাল এক ফাঁদ পেতেছিলেন। ওই বেলায় কুমিরটি চেহারা দেখিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু ফাঁদটার ধারে ঘেঁষেনি।

ফে এখন আর একে মারতে চান না, বরং মানুষের হাত থেকে বাঁচিয়ে নিরাপদ কোনো বেষ্টনীর মধ্যে রেখে দিতে চান। নেকড়ে মানব এটা ইতিহাসের সবচেয়ে বিখ্যাত মানুষখেকোগুলোর একটি। একই সঙ্গে সবচেয়ে রহস্যময় প্রাণীও বটে। ফরাসি উপনিবেশ গেভুয়াডেনবাসীকে ১৭৬৪ থেকে ১৭৬৭ সাল পর্যন্ত আতঙ্কের মধ্যে রাখে এই প্রাণীটি। বিশাল একটি নেকড়ে হিসেবে চিহ্নিত করা হলে আসলে এটা কী ছিল, তা আজও এক রহস্য।

গায়ে-গতরে সাধারণ নেকড়ের চেয়ে সে ছিল অনেক বড়, শরীর লালচে, দাঁতগুলো বিশাল। গবাদি পশুর প্রতি কোনো লোভ ছিল না তার। মোট ২১০ জনকে আক্রমণ করে সে, যার মধ্যে মারা যায় ১১৩ জন। আর এদের মধ্যে ৯৮ জনকে খেয়ে ফেলে প্রাণীটি। অনেক শিকারিই প্রাণীটিকে মারার চেষ্টা করেন।

সফল হন জ্যা চেস্টেল নামের স্থানীয় এক শিকারি। কিংবদন্তি আছে, রুপার একটি বুলেট দিয়ে প্রাণীটিকে মারেন তিনি। দুই আঙুলে টম বিশাল এই অ্যালিগেটরটা মানুষ মেরে বেড়াত আমেরিকার ফ্লোরিডা আর আলবামা উপকূলে। তবে টমকে নিয়ে এত বেশি কাহিনী ডালপালা ছড়িয়েছে যে, এর কোনটি সত্য আর কোনটি মিথ্যা, তা বলা মুশকিল। বাম হাতের দুটি আঙুল ছাড়া বাকি সব আঙুল হারায় অ্যালিগেটরটি।

বলা হয়, লোহার একটি ফাঁদ থেকে বের হতে গিয়ে আঙুলগুলো হারায় প্রাণীটি। আর তাই কাদামাটিতে বিশেষ ছাপ ফেলে যেত ওটা। তাই তার নাম হয়ে যায় দু'আঙুলে টম। গরু, ঘোড়া আর মানুষ মেরে-খেয়ে চরম আতঙ্ক সৃষ্টি করে সে। এর শিকার বেশি হতো মহিলারা, কাপড় ধুতে গিয়ে।

অতিষ্ঠ হয়ে এটাকে মারার তোড়জোড় শুরু করে স্থানীয় কৃষকরা। কিন্তু বুলেট খুব কমই প্রভাব বিস্তার করে এর ওপর। এমনকি একবার ডিনামাইট মেরেও লাভ হয়নি। তবে এই গল্পের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে, গত শতাব্দির বিশের দশকে এই আক্রমণ শুরু হওয়ার পর মাঝখানে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যায় দু'আঙুলে টম। এরপর অনেক বছর বিরতি দিয়ে আশির দশকে হঠাৎ একই চেহারার একটি কুমির ফিরে এসে মানুষ মারতে থাকে।

সবার ধারণা, এটাই সেই হারিয়ে যাওয়া দু'আঙুলে টম। পানারের মানুষখেকো গায়ে-গতরে জ্ঞাতি ভাই বাঘদের চেয়ে অনেকই ছোট চিতারা। কিন্তু ধূর্ততা আর হিংস্রতায় এরা বাঘেরও এক কাঠি সরেশ। বিশ শতকের গোড়ার দিকে ভারতের কুমায়ুন এলাকায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে মানুষখেকো চিতাটি। পানার এলাকায়ই ওর গতিবিধি ছিল বেশি।

তাই 'পানারের মানুষখেকো' নামেই বেশি পরিচিতি পায় ও। বলা হয়, এক শিকারির গুলিতে আহত হয়ে স্বাভাবিক শিকার ধরতে অক্ষম হয়ে পড়ে প্রাণীটি। এর পর হয়ে যায় মূর্তিমান বিভীষিকা। ওর হাতে মারা যায় ৪০০ মানুষ। ১৯১০ সালে ওটাকে হত্যা করেন বিখ্যাত শিকারি জিম করবেট।

হকিয়াডোর কান্না জাপানের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর ভল্লুকের আক্রমণের মুখোমুখি হয় হকিয়াডোর সানকেবেসতো গ্রামের অধিবাসীরা। ঘটনাটি ঘটে ১৯১৫ সালে। যখনকার কথা বলছি, তখন সবে নতুন গড়ে ওঠা একটি গ্রাম সানকেবেসতো। বিশাল এলাকার মধ্যে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে কয়েকটি পরিবার বাস করে। গ্রামটির আশপাশের পাহাড়-জঙ্গলে বেশ কিছু ভল্লুক বাস করে।

এদের মধ্যে বিশাল একটি পুরুষ ভল্লুক গ্রামের লোকদের কাছে পরিচিত 'কেসাজাগে' নামে। মাঝেমধ্যেই সানকেবেসতোর ফসলের ক্ষেতে আক্রমণ চালাত ওটা। একদিন দুজন শিকারির গুলিতে আহত হয়ে পাহাড়ে পালিয়ে যায় কেছাজাগে। সবাই ভাবল, আপদ বোধহয় বিদায় হয়েছে। কিন্তু ক্ষিপ্ত ভল্লুকটা আবার ফিরে আসে ১৯১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর।

ওতো নামের এক ব্যক্তির বাড়িতে হামলা চালিয়ে তার ছোট ছেলে ও বউকে মেরে ফেলে। গ্রামের লোকেরা তাড়া করেও খুব একটা সুবিধা করতে পারল না। দুই দিনের মধ্যে এর হাতে মারা যায় ছয়জন। শেষ পর্যন্ত পরিস্থিতি সামাল দিতে আসে বিখ্যাত এক শিকারি। ১৪ ডিসেম্বর ওটাকে গুলি করে মারেন তিনি।

জমবির খুনে একটি দুটি নয়, তাঞ্জানিয়ার জমবি এলাকায় নরহত্যায় নেমেছিল সিংহের গোটা একটি দল। বিখ্যাত শিকারি জি জি রাশবি আর তাঁর সঙ্গীদের হাতে শেষ সিংহটা মারা পড়ার আগ পর্যন্ত এদের হাতে প্রাণ হারায় দেড় হাজার মানুষ। স্থানীয়রা বলত, এগুলো সাধারণ কোনো সিংহ নয়। বরং এদের নিয়ন্ত্রণ করতো মাতামুলা মাঙ্গেরা নামের এক ওঝা, ডাকিনিবিদ। তাকে তার পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ায় প্রতিশোধ নেওয়ার জন্যই সিংহগুলোকে পাঠিয়েছেন তিনি।

মজার ঘটনা হলো, সিংহগুলোকে মারার পরও মানুষের ধারণা ছিল, মাঙ্গেরাকে তার আগের পদ ফিরিয়ে দেওয়ায় সিংহগুলোর হাত থেকে মুক্তি পাওয়া গেছে। প্রশ্ন জাগতে পারে, বাঘ বা চিতা কেন মানুষখেকো হয়? মানুষ তো আর এদের খাবার নয়। মজার ঘটনা হলো, অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কোনো বাঘ বা চিতা মানুষখেকো হওয়ার পেছনে মূল ভূমিকা রাখে মানুষই। শিকারির গুলিতে মারাত্মক আহত বাঘ বা চিতাবাঘের পক্ষে স্বাভাবিক শিকার ধরা সম্ভব হয় না। তখন বাধ্য হয়েই এরা ঝুঁকে পড়ে সহজ শিকার মানুষের দিকে।

আবার অনেক বুড়ো বাঘও মানুষ মারতে শুরু করে। আবার অনেক সময় মানুষের হাতে সঙ্গীর মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ হয়ে নরহত্যায় নেমেছে, এমন নজিরও আছে। আর বাঘ একবার নরমাংসের স্বাদ পেলে সাধারণত অন্য কোনো প্রাণী শিকারে আগ্রহী হয় না।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।