আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিপ্লবী মহানায়ক হুগো শ্যাভেজ ! লাল সালাম তোমায় ।

স্বাধীনতা, সে তো আমার প্রিয় মানুষের এক সাগর রক্তের বিনিময়ে কেনা হুগো শ্যাভেজ । এই মহান নামটি ইতিহাসের কোন মহানায়কের তা আর কারো অজানা নয়। বিশ্বে আনেক দেশ, অনেক প্রেসিডেন্ট বা প্রধানমন্ত্রী কিন্তু ক’জনের নাম আমরা জানি তাও যদি আবার হয় তৃতীয় বিশ্বের কোন প্রেসিডেন্ট? হুগো শ্যাভেজ এমনই একজন যিনি স্বমহিমায়, নিজ যোগ্যতায় উঠে এসেছিলের এক শ্রমিক পরিবার থেকে। তার নামের আলো ছড়িয়েছেন সারা বিশ্বে । হুগো শ্যাভেজ নিজেই তার শৈশবকাল বর্ননা করেছিলেন এভবে..”আমরা ছিলাম গরীব ।

অপমান, দারিদ্রতা, কষ্ট ছিল আমাদের নিত্যসঙ্গী এবং এমনও দিন গেছে যেদিন আমরা কিছুই খেতে পারেনি। ” আর তিনি এর কারন হিসাবে বৈষম্য ও অবিচারকে দায়ী করেন। সেই শিশুকাল থেকেই যিনি পৃথিবীর অনায়, অবিচার বিলোপের স্বপ্ন দেখতেন তিনি কি পারেন অন্য দশটা ছা পোষা মানুষের মত চলতে ? ক্যারিয়ার জীবন শুরু করেছিলেন সেনা অফিসার হিসাবে। কিন্তু সেখানেও তিনি থেমে থাকেন নি গোপনে গঠন করেছিলেন Bolivarian Revolutionary Army-200 (EBR-200) যা ক্রমান্বয়ে বলিভারিয়ান মুভমেন্ট নামে পরিচিতি পায়। তিনি যুক্তরাস্ট্রের মদতপুষ্ট স্বৈরশাসক কার্লস অ্যান্দ্রেজ পেরেজের বিরুদ্ধে এক ব্যার্থ অভ্যত্থানে নেতৃত্ব দিয়েছিলন ।

ফলস্বরুপ তাকে জেলে যেতে হয়েছিল। ২ বছর পর জেল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর তিনি ১৯৯৮ সালে মিলিটারী অ্যাকশন বাদ দিয়ে প্রেসিডেন্ট নিবার্চনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং বিপুল ভোট পেয়ে তিনি প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন । শ্যাভেজ তার বিপ্লবের নাম দেন ’বলিভারিয়ান বিপ্লব ও ২১ শতকের সমাজতন্ত্র । ’এবার তিনি পুরো মনযোগী হোন তার বিপ্লবী চিন্তা বাস্তবায়নে। সংশোধন করেন সংবিধান।

সেনা সহকর্মীদের সাথে সৈনিক শ্যাভেজ শ্যাভেজ শুরু থেকেই সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নীতি গ্রহন করেছিলেন। তিনি বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফের ছিলেন কঠোর সমালোচক। তো স্বভাবতই তাকে সাম্রাজ্যবাদী রাস্ট্রগুলো তাকে পছন্দ করবে না এবং এটাই স্বাভাবিক। যুক্তরাস্ট্র বার কয়েকবার চেষ্টা করে শ্যাভেজকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের এবং এ লক্ষ্যে একবার মিলিটারী ক্যু হয়েছিল ২০০২ সালে কিন্তু শ্যাভেজের সমর্থনে লাখ লাখ জনগণ সেদিন রাস্তায় নেমে এসেছিল । পরে ৩ দিনের মাথায় সেনাবাহিনী শ্যাভেজের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিতে বাধ্য হয়।

যাইহোক, শ্যাভেজ যে বিপ্লবের সুচনা করেছিলেন সেই বিপ্লব ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ে সমগ্র ল্যাটিন আমেরিকায়। আজকে ল্যাটিন আমেরিকা যুক্তরাস্ট্রের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে বলা যায় শ্যাভেজের কারনেই । অবশ্য শ্যাভেজের গুরু ফিডেল ক্যাস্ট্রের অবদানও কম নয় । তবে শ্যাভেজ ক্ষমতায় আসার পর পরই তিনি ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলিকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াস নেন এবং বলা যায় শ্যাভেজের বলিভারিয়ান বিপ্লবের প্রভাবে আজকে বলিভিয়া, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, নিকারাগুয়া, ইকুয়েডরসহ মোটামুটি সব রাস্ট্রই বামদের নিয়ন্ত্রনে। যে ল্যাটিন আমেরিকা একসময় যুক্তরাস্ট্রের নিয়ন্ত্রনে ছিল সেই ল্যাটিন আমেরিকাকে তিনি যুক্তরাস্ট্র বিমুখ করেন ।

আর আজকে ল্যাটিন আমেরিকার সম্পদের নিয়ন্ত্রন ল্যাটিন আমেরিকার জনগণের হাতেই । এরকম একজন জনপ্রিয় নেতা বছরের পর বছর যুগের পর যুগ যুক্তরাস্ট্রের নাকের ডগায় বসে ক্ষমতায় থাকবে যুক্তরাস্ট্র তা সহ্য করে কিভাবে ? শ্যাভেজ যা করেছেন তা যুক্তরাস্ট্র ও ইসরায়েলের জন্য মোটেই সুখকর নয় । যখন ২০০৮ সালে ইসরায়েল গাজায় গণহত্যা চালায় তখন এই শ্যাভেজই ইসরায়েলের সাথে কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেন সেই গণহত্যার প্রতিবাদে যা তুরস্ক, জর্ডান ও মিশরের মত দেশগুলি তা করতে সাহস পায়নি । শুধু তাই নয় শ্যাভেজ যুক্তরাস্ট্রের শত্রুরাস্ট্রগুলির সাথেও সম্পর্ক প্রভূত উন্নয়ন করে তিনি যুক্তরাস্ট্রের মাথা ব্যাথা আরো বাড়িয়ে দেন। যেমন কিউবা, ইরান, রাশিয়া ও সিরিয়ার মত দেশগুলির সাথে তিনি সম্পর্ক যথেস্ট উন্নত করেন।

ইরানের সাথে সম্পর্ক এত গভীরতায় নিয়ে যান ইরানের প্রেসিডেন্ট আহমাদিনেজাদ শ্যাভেজকে ডেকেছিলেন ভাই হিসাবে। শ্যাভেজ ইরানকে প্রতিশ্রতি দিয়েছিলেন যে যুক্তরাস্ট্র যদি ইরান আক্রমন করে তাহলে তিনি এর প্রতিবাদে যুক্তরাস্ট্রে তেল সরবরাহ বন্ধে পদক্ষেপ নিবেন। যখন যুক্তরাস্ট্রের নেতৃত্বে সমগ্র বিশ্ব গ্রহন করেছিল সাদ্দাম বিরোধী ভূমিকা এবং ইরাক হয়েছিল কঠোর অবরোধে জর্জরিত তখন এই শ্যাভেজই পাশে দাড়িয়েছিলেন ইরাকের । ইরাকে বিমান উড্ডোয়নে নিষেধাজ্ঞা থাকায় তিনি বাসে করে ইরাক ভ্রমন করে সাদ্দামের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন যুক্তরাস্ট্রের রক্তচক্ষুকে পরোয়া না করেই । আহমাদিনেজাদের সঙ্গে শ্যাভেজ ২০০৩ সালে যুক্তরাস্ট্র যখন ইরাক আক্রমন করে তখন এই শ্যাভেজই ছিলেন সেই হামলার কঠোর সমালোচক।

তিনি এজন্য যুক্তরাস্ট্রের তুলোধুনো করতে পিছপা হননি। তাইতো তিনি জাতিসংঘে সাধারন পরিষদে ভাসন দিতে গিয়ে বুশকে উদ্দেশ্য করে বলেন, ”এখানে ২৪ ঘন্টা আগে এক শয়তান এসেছিল ভাসন দিতে এবং এই লোকটির শরীর থেকে সালফারের গন্ধ বের হচ্ছে। আমি সেই গন্ধ এখনো পাচ্ছি । আমার হাতের এই বইটিও অপবিত্র হয়ে গেছে। ” যাইহোক, শ্যাভেজ ছিলেন গণমানুষের নেতা ।

তিনি কাজ করেছেন গরীবদের জন্য, কাজ করেছেন খেটে খাওয়া মানুষদের জন্য । যে ভেনেজুয়েলা ছিল একসময় গরীব দেশ সেই ভেনেজুয়েলা হয়েছে ল্যাটিন আমেরিকার জন্য এক আদর্শ । গরীব মানুষদের জন্য তিনি শিক্ষা, চিকিৎসা, বাসস্থানসহ তাদের সব মৌলিক চাহিদা পুরণ করেছেন। যাদের বাড়ি ছিল না তাদের বাড়ি করে দিয়েছেন , বেকারদের কর্মের ব্যবস্থা করেছেন, প্রাথমিক থেকে পিএইচডি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক করেছেন, বিনা মূল্যে চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছেন । তেল থেকে অর্জিত আয় ব্যায় করেছেন গরীবদের কল্যাণে।

সমাজে ধনী শ্রেণীর লোকজন শ্যাভেজকে পছন্দ করতেন না ঠিক কিন্তু তিনি এই খেটে খাওয়া ও গরীব মানুষদের ভোটেই বার বার নির্বাচিত হয়েছেন। তাইতো তারা তাকে চতুর্থ বারের মতও বিপুল ভোটে নির্বাচিত করেছিলেন কিন্তু এ যাত্রা তিনি দায়িত্ব পালন করতে পারলেন না । পারেননি শপথও নিতে। হাসপাতালের বেডে শুইয়ে পত্রিকা হাতে দুই মেয়ের সাথে হাস্যজ্জ্বল চিকিৎসাধীন শ্যাভেজ। তিনি কখনো তার আদর্শের সাথে আপোস করেননি।

পুরো দু’বছর ক্যান্সারের সাথে অসম লড়াই করলেন তবুও ক্যান্সার হওয়ার পরেও যাননি যুক্তরাস্ট্র বা ইউরোপের কোন উন্নত দেশে চিকিৎসা নিতে। যাননি চিকিৎসা নিতে যুক্তরাস্ট্রের কোন মিত্রও দেশেও। তিনি জাতিসংঘে বার কায়েক আহবানও জানিয়েছিলেন যুক্তরাস্ট্র থেকে জাতিসংঘের সদর দপ্তর উঠিয়ে অন্য কোন দেশে নিয়ে যেতে। শ্যাভেজ ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার প্রথমদিকে অভিযোগ করেছিলেন তার শরীরে ক্যান্সারের সংক্রমন ছড়িয়েছে যুক্তরাস্ট্রই । কথাটা কতটুকু সত্য জানা নেই তবে অনেক বিশ্লেষক ধারণা করতেছেন যে ক্যান্সার সংক্রমন করিয়েছেন যুক্তরাস্ট্রের সিআইএ ।

শ্যাভেজ মারা যাওয়ার আগ মুহুর্তেই তার ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো আবারো সেই অভিযোগের পূনরাবৃত্তি করেছেন। তাছাড়া যুক্তরাস্ট্র তো কিউবার ফিডেল ক্যাস্ট্রোকে হত্যার চেষ্টা করেছিল ৬৩৮ বার !!! সেখান থেকে যুক্তরাস্ট্র হয়তো শিক্ষা নিয়ে অন্য কোন পথে পা বাড়িয়েছে। আরো লক্ষনীয় বিষয় যুক্তরাস্ট্র যখন নিশ্চিৎ যে শ্যাভেজ আর বাঁচবেন না তখন যুক্তরাস্ট্রের দুতাবাসের অ্যাটাচি ভেনেজুয়েলার কতিপয় সেনা কর্মকর্তার সাথে গোপন বৈঠকই প্রমান করে যুক্তরাস্ট্র শ্যাভেজের ক্যান্সার সংক্রমনের সাথে জড়িত। ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরো যুক্তরাস্ট্রের অ্যাটাচিকে দেশ থেকে বহিষ্কার করেছেন। লাল সালাম তোমায় ।

শ্যাভেজ বুঝতে পেরেছিলেন, তিনি যুক্তরাস্ট্রের সাথে লড়াই করে জিতলেও তিনি মনে হয় আর পারবেন না ক্যান্সারের সাথে অসম লড়াইয়ে জিৎতে। তাইতো চতুর্থ বারের মত ক্যান্সার অপারেশনের জন্য কিউবা যাওয়ার প্রাক্কালে দেশবাসীর উদ্দেশ্য পরিচয় করিয়ে দেন তার নিজ হাতেই গড়া ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোকে পরবর্তী নেতা নিসাবে নির্বাচিত করার জন্য। নিকোলাস মাদুরো নিকট অতীতে ছিলেন একজন বাস চালক । শ্রমিক ইউনিয়নের সাথে জড়িত ছিলেন । আশা করি তিনিই হবেন শ্যাভেজের যোগ্য উত্তরসুরী ।

জনগণ এখন কি সিদ্ধান্ত নেয় তা সময় বলে দিবে আর নিকোলাস মাদুরো কি পারবেন শ্যাভেজের অসমাপ্ত বিপ্লব সম্পন্ন করতে ? পারবেন শ্যাভেজের আদর্শে চলতে ? কতটুকু পারবেন তা সময় বলে দিবে । আমরাও আশাবাদী হয়ে থাকলাম তা দেখার । উৎসর্গ : প্রেসিডেন্ট হুগো শ্যাভেজ ও ভেনেজুয়েলার জনগণের উদ্দেশ্যে নিবেদিত।  ।

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।