তোমাদের পাগল বন্ধু শেষবার যখন দেয়ালটা ভাঙ্গা হয়েছিল তখন সবে মাত্র ভার্সিটিতে ভর্তি হয়েছি আমি। গায়ে নতুন বাতাস লেগেছে। রাজনীতি, সমাজ, শাসন ব্যবস্থা- সব কিছু বদলে দেবো- এমন একটা বাতাস লেগেছে গায়ে। পাড়ার ফুটবল ক্লাবের হাফ প্যান্ট পরা হাফ ব্যাক থেকে হঠাত করেই যেন গায়ে পাঞ্জাবী, কাঁধে ঝোলা ব্যাগ, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি- চোখের মধ্যে দুনিয়ার নিয়ম কানুন পালটে ফেলা বিপ্লবীর চাহুনি। বয়সন্ধির হঠাত পরিবর্তনের চেয়েও এটা যেন আরো দ্রুত ঘটে গেল।
দু চারটে টিউশনির দমে বুকের হাড় জিরজিরে ছাতি এখন ইঞ্চি খানেক চওড়া, আগের শার্ট গুলোগায়ে দিতে গেলে ফিট হচ্ছে না! আত্নবিশ্বাসহীন মানুষ গুলো ভার্সিটি লাইফে ঢকার পর হঠাত করেই যেন আত্নবিশ্বাসের এভারেষ্টে চড়ে বসেছে। সবকিছুতেই বিপ্লবের গন্ধ। পারফিউম, বডি স্প্রের সুগন্ধ ছাপিয়ে বিপ্লবের গন্ধ আকাশে বাতাসে মোঁ মোঁ কবছে। সিগারেটের গন্ধে সেদিনের বমি করে ফেলা খোকা বাবুটি হঠাত করেই বড় মানুষ সাজার জন্য সিগারেট টানা শিখতে গিয়ে ঠোঁট পোঁড়াচ্ছে সমানে। মাঝে মাঝে ভাবের বসে ভূল করে বৃষ্টির মাঝেই সিগারেট বের করে আগুণ ধরাতে গিয়ে আবিষ্কার করেন- ধূমপান শিক্ষায় এখনো তিনি নার্সারীতে আছেন! ক্যাম্পাসের মামাদের দোকানের কিংবা ফেরি করা পিচ্চিদের চা ময়লা গ্লাসে খেতে খেতে সবার সঙ্গে আন্দোলনের কথা না বলতে পারলে রাতের খাবার খাদ্যনালীর পরিবর্তে শ্বাসনালী দিয়ে প্রবেশ করে ট্রাবেকিউলী- ব্রংকাসের মাঝে ঝড় বইয়ে দেয়!
আজকাল রাত জেগে ফোনে কথা বলাটা ম্যাচিউরিটির মানদ্বন্দ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যে যত বেশি রাত জাগবে সে তত বেশি ম্যাচিউর! সে হিসেবে আমাদের নিকটতম প্রতিদ্বন্দী তাহলে সিঁদেল চোরেরা। এ দাঁড়িপাল্লায় মাপলে বর্তমানে তারাই দেশের সর্বচ্চো পর্যায়ের ম্যাচিউর ব্যক্তি। দুর্ভাগ্যের বিষয় এই সর্বচ্চো পর্যায়ের বিজ্ঞ ব্যক্তিরা বিলুপ্তির পথে।
বাসার সমস্ত শাসন ব্যবস্থার বিরুদ্ধে আজকাল আমি বড়ই সোচ্চার। প্রতিদিন একটা করে পুরাতন আইন ভেঙ্গে নতুন আইন গড়ে বন্ধুদের কাছে গিয়ে বুকের ছাতি ফুলিয়ে নিজের নতুন বিপ্লবের জয়গাঁথা শোনাই।
এবং তাদের বিপ্লবের কথা শুনি। ইভ টিজিং নিয়ে মহা ক্ষিপ্ত ছেলেটিও ক্লাসের মাঝে কম বয়সী ম্যাডামদের ড্রেস পরা নিয়ে পেছন থেকে খোঁচাতে ছাড়ে না। আহা! চারিদিকে আত্ন রেনেসার সেকি জয়ধ্বনি!
আজকাল বাসায় ফেরা নিয়েও বিপ্লব আমাত। কখন ফিরবো, কোথায় যাচ্ছি- বলতে হবে কেনো? আমি কি সেই কঁচি খোকাটি আছি নাকি? স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলে গেছেন-
“ সাত কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী
রেখেছো বাঙ্গালী করে, মানুষ করনি। ”
নিজেকে মানুষ করার জন্য হলেও বিপ্লব দরকার।
আগে নিজের ঘরে ক্ষুদ্র পরিসরে বিপ্লব, তারপর ব্যাপ্ত পরিসরে।
ইদানীং ঘরে ফেরার পর মায়ের যে কোনো প্রশ্নেই মহা ক্ষিপ্ত হই! খাবার টেবিলে বসে বাবা যখন পত্রিকা পড়েন তখন তাচ্ছিল্য ভরা মুখে বলি; “ওসব ছাই পাস পড়ে কি লাভ বাবা, খবর সব আমাদের কাছ থেকে নেবে। সাংবাদিক গুলোর মাথায় তো গোবর পোড়া। না জেনে না বুঝে গাঁজাখুরি লেখে দেয়, পত্রিকা ওয়ালারাও টাকার জন্য দেয় ছেপে। আর পাবলিক টপাটপ গেলে সব।
”
এভাবেই একজন বিপ্লবীর উত্থান ঘটে। বিপ্লব নিয়ে মহা ব্যস্ত বিপ্লবী ছাত্র সেমিস্টার ড্রপ খেয়েও মুখ বাঁকিয়ে সবাইকে বলে বেড়ায়- “আন্দোলনের জন্য পরীক্ষা বর্জন করেছি। তোরা ত আর এসব জিনিষ নিয়ে ভাবিস না। শুধু “আম্মু আম্মু” করে বেড়াতে পারিস। আমাদের মত সেক্রিফাইস তো আর করতে পারিস না।
”
বিপ্লবী ভদ্রলোকের ত্যাগের মহীমা অসাধারণ। গার্লফ্রেন্ডের বিয়েতে গিয়ে পোলাও খেয়ে আসতে পারেন নির্দিধায় এবং এক পর্যায়ে আবেগাপ্লুত হয়ে বলেও ফেলেন, “আমি দেশটাকে বেছে নিয়েছি, পিছুটান রাখার মত সংকীর্নতা আমার মাঝে নেই(!)”
আমাদের এই বিপ্লবী সাইনবোর্ডের গায়ে জং ধরে কর্ম জীবনে এসে। বসের ঝাড়ি আর কলিগদের বাঁকা কথা শোনার জন্য কান দুটোকে পোক্ত করার প্রক্রিয়া চলে পরবর্তী জীবনে। চা বাগানের বৃক্ষ জাতীয় “চা গাছ”কে ছাটাই করে গুল্ম জাতীয় ঝোঁপে পরিণত করার মত এই জীবনে এসে সব বিপ্লবীদেরই সমস্ত ডালপালা ছাটাই করে গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদে পরিণত করা হয়।
বিয়ের পিঁড়িতে বসে এই বিপ্লবী জীবনের ইতি টানেন বর্তমান বিপ্লবীরা।
এবং বলতে ভোলেন না, “সংসারের দায়িত্ব কাঁধে চেপে বসায় সব ফেলে আসতে হল। কিন্তু এই নতুন জীবনটাও আরেকটা বিপ্লবের শুরু। ”
দীর্ঘ দিন পর পরিচিত এক প্রাক্তন বিপ্লবীর সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। কুশল জিজ্ঞেস করতেই বললেন, “ভাইরে...... আমি একটা পরাধীন রাষ্ট্র। আমার ভূখন্ড (বাসা) আছে, জনসংখ্যা (তিনি, তার স্ত্রী ও সন্তান) আছে, এমনকি সরকারও (তিনি) আছে! কিন্তু সার্বভৌমত্ব নাই।
” দীর্ঘশ্বাস চাপলেন বিপ্লবী ভদ্রলোক। স্ত্রীর Autocracyতে তার সরকার ও রাষ্ট্র সার্বভৌমত্ব বিসর্জন দিয়েছে!
আসুন, যার যার দেয়ালের সামনে দাঁড়িয়ে এসব অনাগত ও বিগত বিপ্লবীদের সম্মানে কিছুক্ষন নীরবতা পালন করি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।