বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মার্কিনিদের বিরোধিতা ও সমকালীন প্রসঙ্গ
ফকির ইলিয়াস
==========================================
আমাদের মহৎ কর্মগুলোর অগ্রগতি বারবারই পিছিয়ে যায়। এবারের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা প্রদানকারী বিদেশি বন্ধুদের সম্মানিত করার কথা ছিল। খবরে জানা গেছে, ঢাকায় এ অনুষ্ঠানটি হচ্ছে না। এর কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, বর্তমান বিশ্বের কিছু প্রতিকূল অবস্থা বিবেচনা করে তা পেছানো হয়েছে। বিশেষ করে লিবিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যে অশান্ত পরিস্থিতি, জাপানে ভয়াবহ ভূমিকম্প এবং সুনামির জন্য তা সম্ভব হচ্ছে না বলে জানিয়েছে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
বলা হয়েছে, আগামীতে কোন এক সময়ে এ অনুষ্ঠান আয়োজন করে মহান মুক্তিযুদ্ধের বন্ধুদের হাতে সম্মাননা তুলে দেয়া হবে। এটা খুবই পরিতাপের বিষয়, বাংলাদেশ গেল ৪০ বছরে এ কাজটি করেনি। করতে পারেনি। অথচ এমন একটি মহতী অনুষ্ঠানের আয়োজন করা মোটেই কষ্টসাধ্য ছিল না। মোট কথা হচ্ছে, উদ্যোগ নেয়া হয়নি।
কেন নেয়া হয়নি, সে প্রশ্নটি বারবার আসছে এবং আসবে।
বাংলাদেশে এই যে উদ্যোগ নেয়ার অভাব, সেটাই উন্নয়নের বিভিন্ন ধাপকে পিছিয়ে দিয়েছে নানা পর্যায়ে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তপনা, চোরাকারবারিদের দাপট, দুর্নীতিবাজদের দৌরাত্ম্য, দলীয় স্বার্থ রক্ষার নামে সন্ত্রাস, অবিচার নিষ্পেষণ। যে চেতনা নিয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত হয়েছিল, তা এক ধরনের সামন্তবাদী শক্তির হাতে বারবারই হয়েছে প্রতারিত, লাঞ্ছিত।
সবচেয়ে দুঃখজনক অধ্যায় হচ্ছে, বাংলাদেশের একশ্রেণীর রাজনীতিক মিথ্যাশ্রয়ী।
তারা মহান স্বাধীনতার অনেকগুলো অধ্যায়কে স্বীকার করতে এখনো নানাভাবে নারাজ। এরা ব্যস্ত খলনায়কদের নায়ক বানাতে। অথচ কে খলনায়ক আর কে মহানায়ক তা ইতিহাসের সত্যস্তম্ভগুলোর দিকে তাকালেই কারও না বুঝার কথা নয়।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য জীবন বাজি রেখে যারা যুদ্ধ করেছিলেন, তারা কী চেয়েছিলেন? এ প্রশ্নটির উত্তর বাংলদেশে সব দলের রাজনীতিকের (শুধু আলবদর, রাজাকারচক্র বাদে) না জানার কথা নয়। শোষিত, নিষ্পেষিত মানুষের অধিকারের জন্যই ছিল সেই রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম।
কিন্তু তারপর কী হলো? সেই অধিকার কড়ায়-গন্ডায় বুঝে না পেয়েই দিন গুজরান করতে হচ্ছে আপামর মানুষকে।
বাংলাদেশের রাজনীতিকদের মাঝে যে প্রবণতাটি প্রকট তা হচ্ছে_ ব্যর্থতার দায় না নেয়ার মানসিকতা। ব্যর্থতা স্বীকার করলেই কোন রাজনীতিক যে জীবন থেকে খারিজ হয়ে গেলেন, এমনো কোন কথা নেই। তারপরও জুড়ে বসে থাকার রাজনৈতিক সংস্কৃতি দেশের মানুষকে বীতশ্রদ্ধ করে তুলছে। যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান সেক্রেটারি অব স্টেটাস হিলারি ক্লিনটন ইতোমধ্যে ঘোষণা করেছেন তার এবারের মেয়াদ শেষ হলেই তিনি রাজনীতি থেকে অবসর নেবেন।
হিলারি বলেছেন, 'আমি জানি আমেরিকার জনগণ আমাকে ভালোবাসেন। কিন্তু সবিনয়ে বলি, সব কাজ থেকেই তো অবসর নিয়ে প্রজন্মের জন্য দরজা অবারিত করে দিতে হয়। '
এই যে প্রজন্মের জন্য সুযোগ সৃষ্টির প্রত্যয়, বিশ্ব মানবতার কল্যাণের জন্য তা খুবই অপরিহার্য বিষয়। তা না থাকলে একটি রাষ্ট্র কখনোই শক্ত মেরুদ- নিয়ে দাঁড়াতে পারে না।
বিভিন্ন ইস্যুতে মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের বিভিন্ন মুখপাত্রের সঙ্গে আমার মাঝে মধ্যে ফোনালাপ হয়।
জানতে চাই বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব। এসব মুখপাত্রের প্রায় সবাই একটি কথা বেশ জোর দিয়ে বলেন। আর তা হচ্ছে- সমস্যাটি যে ভূখন্ডের সেই ভূখন্ডের মানুষকেই এর সমাধান করতে হবে।
কিন্তু আমি বিষয়টিকে ভাবি ভিন্নভাবে। কূটনৈতিক স্নায়ু যুদ্ধের এ চলমান সময়ে যারা পরাক্রমশালী তারা এখন স্বার্থরক্ষা করতে চায় বিশ্বের সর্বত্র।
সর্বভুক এ মানসিকতা যারা ধারণ করেন, তাদের লক্ষ্য একটিই সেই দেশের মানুষের মাধ্যমে নিজেদের স্বার্থরক্ষা করা। উদাহরণ হিসেবে লিবিয়া আক্রমণের কথাই বলা যায়। মিসরের হোসনি মোবারককে ক্ষমতাচ্যুত করতে রক্তপাতের প্রয়োজন পড়েনি। কিন্তু লিবিয়ার একনায়ক গাদ্দাফি যে ক্ষমতা সহজ পন্থায় ছাড়বেন না, তা পাশ্চাত্য দেশগুলো আগেই জানত। তাই সামরিক অভিযানের জন্য তারা তৈরিই ছিল।
পাশ্চাত্যের দেশগুলো বলছে, লিবিয়ার মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে তারা সম্মিলিতভাবে।
প্রশ্নটা সেখানেই আসে। একাত্তরে বাংলাদেশের মানুষও তো পশ্চিমা হায়েনাদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল নিজেদের স্বাধীনতার জন্য। মুক্তি সংগ্রাম করেছিল। সেই মুক্তি সংগ্রামকে নিক্সন-কিসিঞ্জার শাসকগোষ্ঠী সমর্থন করেনি কেন? বাংলাদেশ নামক ভূখ- থেকে তাদের কোন স্বার্থ রক্ষা হবে না বলে?
যে পাকিস্তানিদেরকে, সেদিন তারা যাদের সমর্থন দিয়েছিল, এরা ছিল মূলত অসভ্য।
গাদ্দার। তারা গণতন্ত্রে বিশ্বাস কখনই করেনি। যদি করত তবে তাদের নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলা ভাষাভাষী জাতি বাঙালির ভাষাকে উপেক্ষা করে বলতে পারতেন না- 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা'। মাকির্নি ইতিহাসবেত্তারা যাই বলুন না কেন, আমি খুব দৃঢ়চিত্তে বলতে পারি মার্কিনি শাসকগোষ্ঠী একাত্তরে পাক হায়েনাচক্রকে সমর্থন করে ভুল করেছিল। কারণ এই সেই পাকিস্তান, এই সেই পাকিস্তানিরা, যারা গণতন্ত্রের নামে এখনো মূলত মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ, কট্টরবাদীকেই পৃষ্ঠপোষকতা করছে।
পাকিস্তান এখন মাকির্নিদের দ্বারাই জঙ্গিবাদীদের স্বীকৃত চারণভূমি।
অথচ বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি একটি সভ্য জাতি হিসেবে ওঠে দাঁড়ানোর নিরন্তন চেষ্টা করছে। পাক তমদ্দুনপন্থি বিএনপি-জামাতিদের খপ্পর থেকে বেরিয়ে একটি মননশীল জাতি হিসেবে দাঁড়ানোর নিরন্তর চেষ্টা করছে।
পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মাঝে বর্তমান পার্থক্য কী, সেটাও মার্কিনি নীতি-নির্ধারকদের এখন আর অজানা নয়। ৪০ বছরের ব্যবধানে বাংলাদেশ এখন পশ্চিমা অনেক শক্তিধরের পরিচিত, প্রিয় ভূমিতে পরিণত হয়েছে।
হ্যাঁ, বলতে দ্বিধা নেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে দখলদারির মনোভাবও দেখাচ্ছে মাঝে মধ্যে।
এই যে দখলদারিত্বের রক্তচক্ষু, তা কেন দেখাচ্ছে ওরা? তার কারণও আমাদের দেশের রাজনীতিকদের অদূরদর্শিতা। বুর্জয়ারা সব সময়ই শোষকশ্রেণীর স্বার্থ রক্ষা করে। তা নিজ দেশেই হোক আর প্রতিবেশী দেশেই হোক। এটা কে না জানে, হাজার হাজার মাইল দূরে থেকেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখন প্রায় গোটা বিশ্বকেই তাদের সর্বগ্রাসী ফিতা দিয়ে বেঁধে ফেলেছে।
এ বন্ধন থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রজন্মকে সমকালীন বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দক্ষ জনশক্তি হিসেবে গড়ে উঠতে হবে।
বাংলাদেশের একশ্রেণীর বুদ্ধিজীবী আছেন, যারা কথায় কথায় একাত্তরে মার্কিনি শাসকগোষ্ঠীর বিরোধিতার ধুয়া তোলে বাংলাদেশে এখন মার্কিনবিরোধী জিগির তোলেন। অথচ দেখেছি এরা নিজেরা অথবা তাদের পোষ্যরা নানাভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের মদত নিচ্ছেন। রসদ খাচ্ছেন। তাদের এসব আচরণ নেহায়েতই ভন্ডামির মধ্যে পড়ে।
বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামে মার্কিনি জনগণের সিংহ ভাগেরই বাঙালি জাতির প্রতি 'মর্যাল সাপোর্ট' ছিল। সমর্থন ছিল মিডিয়ারও। তৎকালীন শাসকগোষ্ঠীর বিরোধিতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আটকাতে পারেনি। একাত্তরের সেই চেতনা নিয়ে বাংলাদেশকে এখনো দাঁড়াতে হবে। আর এ জন্য প্রয়োজন কূটনৈতিক বিচক্ষণতা ও রাজনৈতিক প্রজ্ঞা।
নিউইয়র্ক, ২৩ মার্চ ২০১১
--------------------------------------------------------------------------------
দৈনিক সংবাদ/ ঢাকা / ২৫ মার্চ ২০১১ শুক্রবার প্রকাশিত
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।