দেলোয়ার জাহিদ
কুমিল্লা থেকে পালিয়ে ব্রাক্ষণবাড়ীয়া, আশুগঞ্জ, ও ভৈরব বাজার সংলগ্ন লালপুর খেয়াঘাট পার হয়ে তদানীন্তন রায়পুরা থানা’র সররাবাদ গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নেই। পাক হানাদার বাহিনী তখন ভৈরব বাজার দখলের জন্য তখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। পদাতিক বাহিনী স্থলপথে ভৈরবের দিকে এগিয়ে আসছে এবং বিমান বাহিনী আকাশপথে তাদের কভার করছে।
ডাক পড়লো নুরুল হক নুরুর। ভৈরব হাজী আসমত কলেজে’র একজন ছাত্রলীগ কর্মী বা মধ্য সারির নেতা ।
কুমিল্লা থেকে নারায়নপুর এসে ’৬৯ এর ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়েছি বেশ ক’বার। দুঃসাহসী নুরু এলাকায় বাঘা নুরু হিসাবে ছিলো পরিচিত। ভৈরবে ঢোকার আগেই পাক সেনাদের প্রতিহত করতে হবে। নুরু’র আহ্বানে পুলকিত হলাম, তারপর ও দ্বিধা নিয়ে প্রশ্ন করলাম।
কি দিয়ে? কি দিয়ে প্রতিহত করবো?
ঘরে বল্লম আছে একটা বেছে নাও।
শীঘ্র!
এভাবে প্রতিরোধের সংকল্প নিয়ে প্রথম একটি দেশিয় অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলাম। যা ছিলো গ্রামীণ জং লড়া’র একটি ধারালো বল্লম। নুরু একজন অকুতভয় যুবক। তারই নেতৃত্বে বল্লম হাতে ছুটে গিয়েছিলাম পাক সেনাদের প্রতিহত করতে। পাক সেনারা তখন রেললাইনে অবস্থান করছে।
অগ্রসর হচ্ছে ভৈরব বাজারের দিকে।
নুরু হামাগুড়ি দিয়ে রেল লাইন অব্দি যাবার এবং পাকসেনাদের আক্রমণ করার এক আত্মঘাতি পরিকল্পনা নিলো। আমি বাধা দিয়ে বুঝাতে চেষ্টা করলাম যে এভাবে সসস্ত্র পাকসেনাদের কাছে পৌছা যাবে না। যে কোন ভাবেই হোক অস্ত্র জোগার করে পাকসেনাদের মোকাবেলা করতে হবে। সেদিন নুরুকে নিভৃত করা গেলেও কাপুরুষ আখ্যা পেয়ে ছিলাম।
অনেকের কাছে এটা যুদ্ধের একটা কৌশল মনে হলেও মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে কখনোই কৌশলী হতে পারিনি নুরু।
প্রচণ্ড গোলগুলি’র মধ্যে রামনগর গাঁয়ের ভিতর দিয়ে ভৈরবপুরে পৌছলাম। পুলিশ, আনসার সহ সবাই পালাচ্ছে এদিক, ওদিক। আমরা পরিত্যক্ত কটি অস্র পেলাম। বহন করার অসুবিধার কারনে দু’জনে মাত্র দুটি রাইফেল ও কিছু গুলি তুলে নিলাম।
নিরাপদ পথে ব্রক্ষপুত্র নদীর কিনারে এসে পৌছলাম। সেখানে হাজার হাজার নারী পুরুষ ওপার যাবার অপেক্ষায়। ঘাটে একটি মাত্র মালবহন করার বড় নৌকা অপেক্ষমান। মাঝি লোক পারাপারে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। নুরু লাফিয়ে নৌকায় উঠলো এবং মাঝিদের সাথে বচসায় লিপ্ত হল।
আমি রাইফেল নিয়ে নৌকায় উঠলে পরিস্থিতি পালটে গেল। লোক পারাপার শুরু করে আমরা ক্লান্ত, শ্রান্ত হয়ে নুরুদের বাড়ী ফিরে এলাম। সবে খেতে বসেছি, খবর এলো পাকবাহিনীর ব্রাশ ফায়ারে অগনিত মানুষ ব্রক্ষপুত্র ঘাটে মারা গেছে। দৌড়ে গিয়ে গ্রামবাসীদের সাথে আহতদের উদ্ধার কাজে অংশ নিলাম।
নুরু ও আমি গ্রামে একজন অবসরপ্রাপ্ত সৈনিকের নিকট থেকে রাইফেল চালনা শিখে নিলাম।
ডামি রাইফেলে স্কাউট হিসাবে পূর্বেই আমার এসব প্রশিক্ষণ ছিলো।
বিকেলে ভৈরব বাজার ব্যাংক লুটের সমস্ত অর্থ-কড়ি নিয়ে হাজির হলেন ওসি কুতুবুর রাহমান। ঠিক হলো নুরুকে নিয়ে রাতের আঁধারে সীমান্ত পাড়ি দেবেন ওসি কুতুবুর। ওরা দু’জন স্বাধীন বাংলা সরকারের কাছে পৌছে দেন ব্যাংক লুটের সমস্ত অর্থ-কড়ি। যাবার কালে আমার কাছ থেকে এক প্যাকেট বিড়ি চেয়ে নেন কিংবদন্তির নায়ক ওসি কুতুবুর।
১লা এপ্রিল ১৯৭১, ভৈরব বাজারে নুরুর সাথে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে আমার অংশ গ্রহন। ভারতে সংক্ষিপ্ত গেরিলা প্রশিক্ষন শেষে নুরু কিছু হ্যান্ড গ্রেনেড, এক্সক্লোসিভ ও রিভলবার নিয়ে মুক্তাঞ্চলে ফিরে আসে। তৎকালে মেজর (বর্তমানে মেজর জেনারেল) মঈন এ চৌধুরী, নুরুর দায়িত্বার্পন পত্র লিখেন। প্রথমে আমি নুরুর সাথে তার দলে যোগ দেই।
পাক বাহিনী কর্তৃক ভৈরব বাজার দখল করে নেয়ায় সেখান থেকে সরে আসা মুক্তিযুদ্ধাদের আমরা নুরুর নেতৃত্বে সংগঠিত করতে শুরু করি এবং প্রতি সপ্তাহে উৎসাহী তরুণরা ভারতে প্রশিক্ষনে যেতে শুরু করে।
আমিও অধিকতর সামরিক প্রশিক্ষনের জন্য ভারতের নরসিংঘর হয়ে কাঁঠালিয়া ক্যাম্পে যাই। ভারতে ও বাংলাদেশে প্রায় দেড় মাসাধিক্কাল সামরিক প্রশিক্ষন নেই।
এফ, এফ ও বিএলএফ এর স্থানীয় সমন্বয়কারী হিসাবে কাজ করার জন্য ভারত থেকে নির্দেশ পাই এবং ৩নং সেক্টর কমান্ডারের অনুমোদন ক্রমে ৩নং সাব-সেক্টর কমান্ডার গয়েস আলী মাস্টারের বাহিনীতে যোগ দেই।
বাংলাদেশে’র মুক্তিযুদ্ধে ৩নং সেক্টরের ৩নং সাব-সেক্টর ছিলো বহুল আলোচিত একটি যুদ্ধক্ষেত্র। রাজধানী ঢাকা এবং ভারতের মধ্যবর্তী সংযোগস্থলে রায়পুরা ও নারায়ণপুরে’র অবস্থান।
মুক্তিযুদ্ধাদের যাতায়ত ও অস্র নিয়ে ভিতরে ঢোকার অন্যতম প্রবেশপথ হিসাবে এ অঞ্চলের গুরুত্ব ছিলো অপরিসীম।
নারায়ণপুর বাজার মুক্তাঞ্চলে এফ, এফ ও বিএলএফ এর যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়া হয়। কারন সেখানে এক ধরনের রাজনৈতিক অস্থিরতা ছিলো। ভৈরব বাজার এলাকার রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা এ মুক্তাঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতা জিল্লুর রাহমানের নিকটাত্মীয় কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগ নেতা ফয়সল আলম ও আমার সাথে সাংগঠনিক কর্মকান্ডে যোগ দেন।
আমরা যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সৎ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করি এবং জনমত সংগঠিত করি। এর ফলে মুক্তিযুদ্ধাদের কাজের মধ্যে যে সমন্বয়হীনতা ছিলো তা অনেকাংশেই দূর হয়।
৪ঠা জুলাই, ১৯৭১-রোববার সকাল ১১টায় সহযোদ্ধা নূরু, আতিক, মোহন ভৈরব বাজারে এক দুঃসাহসী অভিযান পরিচালনা করে এবং কুখ্যাত দালাল মমতাজ পাগলা এবং পাকসেনা সহযোগিদের হত্যা করে। আতিক ঘটনাস্থলে শহীদ হন এবং নুরু মারাত্মক আহতাবস্থায় পাক সেনাদের হাতে ধরা পরে। তাকে আশুগন্জ নিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
নুরু আতিকের মর্মান্তিক মৃত্যুতে শোকাবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় এবং নেতৃত্বশুন্যতা দেখা দেয়। আমি ফয়সল আলমের অনুপ্রেরনায় ও ওয়ালী উল্লাহ’র সহযোগিতায় সেখানে যৌথ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করি।
আঞ্চলিক যুদ্ধ পরিচালনা ইউনিটের সংগঠক হিসাবে বেলাব, দৌলতকান্দি, নারায়নপুর এবং ১২ই ডিসেম্বর কালিকা প্রসাদে সন্মুখ সমরে অংশ নেই। ক’জন পাকসেনা ও সহযোগিদের আমরা ধরে আনি নারায়ণপুরে। সে সময় আমার এক সহযোদ্ধা সিরাজুল হক দুলা মিয়া গুলিবিদ্ধ হয়ে মারাত্মক আহত হয়।
স্থানীয়ভাবে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য সার্জেন্ট কাদের, নসা কাজী, সুরুজ মিয়া, হান্নান, ওয়ালীউল্লাহ, ও পন্ডিত সোবহান কে নিয়ে আমরা একটি পর্ষদ গঠন করি এবং কিছু বিশিষ্ট ব্যক্তিকে আমাদের সাথে যুক্ত করি।
’৭২ সালে ভৈরব বাজারে আয়োজিত এক বিশাল স্মরণসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং জনাব জিল্লুর রহমান আমাদের যুদ্ধ পরিচালনা কৌশল ও সফলতার ভুয়সী প্রশংসা করেন। সেদিনের সে স্মৃতিগুলো আজো স্মৃতিপটে অম্লান।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।