have miles to go... যুদ্ধদিনের গান
(হিরোশিমা-নাগাসাকি স্মরণে)
ভূমিকা ও অনুবাদঃ মাহমুদ টোকন
......................................................................................................
বিজ্ঞান পত্রিকায় কাজ করার সুবাদে বহু বিজ্ঞান বিষয়ক আন্তর্জাতিক জার্নাল, ম্যাগাজিন, বই এমনকি গল্প উপন্যাসও পড়া হয়েছে। পত্রিকার লাইব্রেরিতে ইংল্যান্ডে প্রকাশিত ৭০ দশকের একটি রিডার ডাইজেস্ট আমার হাতে আসে। কলেজ জীবন থেকেই রিডার ডাইজেস্ট পড়ার অভ্যাস শুরু। নতুন রিডার ডাইজেস্ট কেনার সামর্থ না থাকায় নীলক্ষেত থেকে পুরোনো ডাইজেস্ট কিনতাম। তবে পত্রিকায় কাজ করার সুবাদে প্রতিনিয়তই রিডার ডাইজেস্ট পড়েছি।
নতুন, পুরোনো। আজও আমি রিডার ডাইজেস্ট পড়ি, পড়ার সময় না পেলেও কিনি নিয়মিত। ৭০ দশকের সেই বিশেষ সংখ্যায় প্রার্থনা শিরোনামে অসাধারণ একটি লেখা পড়ি। যা সঙ্গে সঙ্গে অনুবাদ করে ফেলি।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের পরে নোবেলজয়ী ঔপন্যাসিক রিউমার গডেন একটি কনভেন্টে স্বেচ্ছাসেবকের কাজ করেন।
বিশ্বখ্যাত মানবতাবাদী বহুব্যক্তি এসময় এরকম স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে এগিয়ে এসেছিলেন। সরাসরি কাজ থেকেও তাদের আন্তরিক উপস্থিতিই যুদ্ধের ভয়ংকর ধ্বংসাবশেষ ও বিভীষিকা থেকে মানুষকে নতুন করে জীবন প্রতিষ্ঠায় উদ্বুদ্ব করে। একদিন গডেন কনভেন্টে এক নান-এর সঙ্গে একটি আলমারি পরিষ্কার করছিলেন। এ সময় তিনি আবিষ্কার করেন একটি পুস্তিকা। এতে মুদ্রিত কিছু ছোট ছোট কবিতা।
বইটি বেনেডিকটাইন অ্যাবে থেকে মূদ্রিত এবং লেখকের নাম ডি. গ্যাসল্ড। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের ভয়ংকর দিনগুলোতে লেখক এ কবিতাগুলো রচনা করেন। এটি পড়ে গডেন আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। ঔপন্যাসিক-কবি মিস গডেন মুগ্ধ হয়ে কবিতাগুলো ইংরেজিতে অনুবাদ করেন। পরবর্তীতে ছোট কবিতাগুলো অভূতপূর্ব বিষয় বৈচিত্রের কারণে রিডার ডাইজেস্ট পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
অপূর্ব এ কবিতায় পরোক্ষভাবে আর্তভাবে যুদ্ধবিরোধী আবেদন ফুটে ওঠে। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এই লেখাগুলো প্রাণীদের প্রার্থনা বিষয়ক ছোট্ট কবিতা। এতে কবি প্রাণীদের প্রার্থনার মধ্যে দিয়ে পরোক্ষভাবে মুক্তির কথাই বলতে চেয়েছেন।
পুস্তিকাটিতে মোট ২৭টি ক্ষুদ্র কবিতা স্থান পেয়েছে। এতে ষাঁড়, মোরগ, প্রজাপতি, বেড়াল ইঁদুর প্রভৃতি প্রাণীদের বাঁচার আকুলতা প্রকাশে পেয়েছে।
কিন্তু আশ্চর্যভাবে লক্ষণীয় যে যুদ্ধে মানব সমাজ সবচে’ বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সেই মানুষেরই কোনো প্রার্থনা নেই। এতে স্পষ্ট বোঝা যায় যে লেখাগুলো রচনার সময়ে যুদ্ধ চলছিলো এবং লেখক যুদ্ধবাজদের চোখ এড়াতে কিংবা আতঙ্কের কারণেই মানুষের মুখ থেকে এই আর্তি উপস্থাপন করেননি। বরং মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে মানুষের আশপাশের ভালোবাসার বিভিন্ন প্রাণীগুলোর মুখ থেকে শান্তির পক্ষে ঈশ্বরের হস্তক্ষেপ প্রার্থনা করেন।
অধিকাংশ যুদ্ধ কেবল হিংস্রতারই জন্ম দেয়। এটি মানুষসহ সকল সৃষ্টির জন্য নিয়ে আসে দুর্ভোগ, বেদনা, অশান্তি।
আশ্চর্যের বিষয় যাদের কারণে যুদ্ধ সংগঠিত হয় অর্থাৎ যে শয়তান মানুষগুলো যুদ্ধের সূচনা করে তারা চিরকালই সুফলভোগী। গুটি কয়েক মানুষের, প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষার জন্যই পৃথিবীতে বেশিরভাগ যুদ্ধ সংগঠিত হয়েছে। আর এর দুর্ভোগ বহন করে অধিকাংশ সাধারণ মানুষ। প্রতিটি যুদ্ধ মানেই ধ্বংস, হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, নির্যাতনের ইতিহাস। ক্রন্দন আর দীর্ঘশ্বাসের ইতিহাস।
বিশ্বব্যাপী মানুষের কাছে আগস্ট একটি দুঃখের মাস, পৃথিবীর ইতিহাসে কলঙ্কজনক অধ্যায়। এ মাসেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকা জাপানের হিরোসিমা এবং নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা ফেলে। এতে হতাহত হয় অসংখ্য মানুষ। ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ মানুষকে বিমূঢ় করে ফেলে। আমেরিকা ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট জাপানের হিরোশিমা শহরে প্রথম বোমাটি ফেলে।
এর নাম লিটলবয়। ৩দিন পরে ৯ আগস্ট ফ্যাটম্যান নামের দ্বিতীয় বোমাটি ফেলে নাগাসাকিতে। এই বোমা ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ সাধন করে। বোমা ফেলার সময় থেকে ৪ মাসের মধ্যে হিরোশিমায় ৯০,০০০-১৬৬,০০০ এবং নাগাসাকিতে ৬০,০০০-৮০,০০০ লোক মৃত্যুবরণ করেন। এর অর্ধেকই মারা যায় তাৎক্ষণিকভাবে।
হিরোশিমা স্বাস্থ্য বিভাগের মতে এই মৃত্যুর ৬০% ঘটে আগুনের তাপ ও শিখায় দগ্ধীভূত হয়ে। ধ্বংসস্তুপের আঘাতে ও নিচে পড়ে মারা যায় প্রায় ৩০% এবং বাকি ১০% ধ্বংসজনিত অন্যান্য কারণে। পরবর্তী মাসগুলোতে বহুলোক মারা যায় পুড়ে যাওয়া, তেজস্ক্রিয়তা এবং ক্ষতের কারণে।
মৃত ব্যক্তিদের প্রায় সবাই ছিলেন সাধারণ জনগণ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে আজও অনেকে সেই অ্যাটমবোমার তেজস্ক্রিয়তার যন্ত্রণা বহন করছেন।
এই বোমা বর্ষণের পূর্বেই জাপান আত্মসমর্পন করতে সম্মত হয় তথাপিও আমেরিকা এই অ্যাটমবোমার আঘাত হানে। মানুষের ইতিহাসে এই নির্মম হিংস্রতা সর্বাগ্রে সবসময় ঘৃণিত হয়ে থাকবে। আমরা যুদ্ধকে ঘৃণা করি। ঘৃণা করি প্রতিবছর সারাবিশ্বে মানুষের খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থান, পরিবেশ প্রভৃতি বিষয়গুলোকে উপেক্ষা করে সমরাস্ত্র ও সামরিক খাতে অধিক ব্যয়কে। সারাবিশ্ব জুড়ে খাদ্য, শিক্ষা, পরিবেশ তথা সমাগ্রিক মানবোন্নয়নে অজস্র ক্ষেত্রে কাজ করা প্রয়োজন।
এখনো অধিকাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে, অসংখ্য শিশু ও মা প্রতিবছর মারা যাচ্ছে পুষ্টিহীনতা, চিকিৎসা ও খাদ্যাভাবে। ক্লাইমেটচেঞ্জ ও পরিবেশ দূষণের কারণে পৃথিবীতে প্রতিনিয়ত নানারকম বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। শিক্ষা ও মানবিকাধিকারের বাইরে থাকছে অগুনতি মানুষ। কিন্তু বিশ্বের প্রায় সকল দেশই যুদ্ধ জুজুর ভয়ে সমরাস্ত্র ও সামরিক খাতে অযথাই ব্যয় করছে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার। এমনকি দরিদ্র দেশগুলোও।
আমরা যুদ্ধ চাই না। আমরা শান্তি চাই- এই স্লোগানকে সামনে রেখে অসামান্য এই ছোট ছোট কবিতাগুলো যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ সকল মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা ও ভালোবাসায় এবং হিরোশিমা নাগাসাকি দিবসকে স্মরণ করে ও পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপের প্রতি ঘৃণা জানিয়ে কয়েকটি কবিতা পাঠকের জন্য উপস্থাপন করা হলো।
:: প্রার্থনা মূল: ডি. গ্যাসল্ড
………………………………………………………………….
:: ষাঁড়ের প্রার্থনা
প্রিয় প্রভু
সময় দাও; মানুষেরা বড্ড অস্থির
বোঝাও তাদের।
আমার এতো তাড়া নেই
আমাকে খাবার সময় দাও
দাও ধীরে চলার
ঘুমুতে সময় দাও চিন্তা করার।
:: মোরগের প্রার্থনা
প্রভু, ভুলোনা-
আমার ডাকে সূর্যোদয়
তোমার ভৃত্য আমি তাই
আমার ডাকের মর্যাদায়
প্রয়োজন কিছু ঔজ্জ্বল্যের।
তবুও তোমার ভৃত্য আমি
শুধুমাত্র ভুলে যেও না
আমি-ই দিন ডেকে আনি।
:: প্রজাপতির প্রার্থনা
প্রভু, কোথায় ছিলেম আমি?
সুন্দর এ পৃথিবী, ধন্য তোমায়
এই ফুল এই সূর্য, গোলাপসুবাস
শিশির গড়িয়ে পড়ে পদ্ম পাতায়।
চলে যেতে হবে
জানি না কোথায়।
ভর করেছে পাখায় মিথ্যে বাতাস,
কোথায় ছিলেম আমি?
এবং তোমাকে-আমাকে আমার কিছু বলার ছিল প্রভূ!
:: বেড়ালের প্রার্থনা
প্রভু, অধম বেড়াল আমি
না, আমার কোনো প্রশ্ন নেই
তবু-
গোলাঘরে একটি ছোট্ট সাদা ইঁদুর এবং এক বাটি দুধ
কেউ হয়তো উপভোগ করছে।
তুমি কি একদিন কুকুর জাতিকে-
দগ্ধ করবে অভিশাপে?
যদি তাই হয় তবে আমি তোমাকে বলবো প্রভূ…
:: ইঁদুরের প্রার্থনা
ক্ষুদ্র ধূসর আমি।
কিভাবে আমাকে তুমি মনে রাখো প্রভু?
তুমি আমাকে বানালে
বললে, লুকিয়ে থেকে জীবন বাঁচাতে।
খাদ্য দিও আর বাঁচিও-
শয়তানের চোখ আর হিংস্র থাবা থেকে!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।