রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে তাল রেখে কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসগুলোতেও চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী ও দখলদারদের যে পালাবাদল ঘটে, সে খবর আমাদের কাছে নতুন নয়। কিন্তু যে দুয়েকটি ক্যাম্পাসে এখনো এই দখলদারিত্ব পুরোপুরি কায়েম করা যায়নি, এখনো দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের চেয়ে তুলনামূলকভাবে কম সন্ত্রাসপ্রবণ যে প্রতিষ্ঠানটি, সেই বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এখন শিক্ষার পরিবেশ ও গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নে এক গুরুতর সংকটের সম্মুখীন। বুয়েটে ৫ মার্চ ২০১১ থেকে ঘটতে থাকা ছাত্রলীগের তান্ডব, সন্ত্রাস ও চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সোচ্চার ছাত্র-রাজনৈতিক কর্মীদের ওপর ধারাবাহিক হামলা, রুম ভাঙচুর, লুটপাট এবং সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের নির্লজ্জ দায়িত্বহীন ও সন্ত্রাসীদের প্রশ্রয়দানকারী ভূমিকায় বুয়েটের সাবেক শিক্ষার্থী এবং শিক্ষা ও গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নে সচেতন নাগরিক হিসেবে আমরা ভীষণ উদ্বিগ্ন বোধ করছি।
মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরপরই সারা দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ ক্যাম্পাসগুলোতে হলদখল, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি অর্থাৎ ক্ষমতার হিস্যা বুঝে নেওয়াকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগের যে তান্ডব দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে, বুয়েট যে একেবারে তার আওতামুক্ত ছিল তাও নয়। বিভিন্নমাত্রায় ছোট-বড় বিভিন্ন তৎপরতা ঠিকই চলছিল।
নজরুল হল ক্যান্টিনে চাঁদাবাজির ঘটনা, মাসিক ১০ হাজার টাকা চাঁদা না দেয়ায় একপর্যায়ে নজরুল হল ক্যান্টিন বন্ধ করে দেওয়া, (যেটা ছাত্রলীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দলেই সামনে চলে আসে পত্রপত্রিকায়, প্রথম আলো, ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০১০), পিক-আপ ভ্যান আটকে সেটার পার্টস খুলে বিক্রি করা, হল ক্যান্টিনগুলো লিজ দেওয়ার সময় প্রভাব বিসত্মার করা, মাসিক চাঁদা আদায়, ফ্রি খাওয়া, নির্মাণাধীন বুয়েট শপিং কমপ্লেক্সে দোকান পাইয়ে দেওয়ার নামে অর্থ নেওয়া, ক্যাম্পাসে বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের প্রচারণা থেকে চাঁদা নেওয়া, পলাশির মোড়ের দোকানগুলো থেকে চাঁদা আদায় এবং এরকম আরো অসংখ্য ঘটনার কথা ক্যাম্পাসের সবারই জানা। যেগুলো হয়তো সারা দেশের মানুষের কাছে বিশ্বাসযোগ্যই হয় না। পাল্টা প্রশ্ন আসে- ‘সত্যিই বুয়েটের ছেলেরা এসব করছে?’ কিন্তু প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে এইসব ঘটনা ঘটেছে। এসব অপতৎপরতা অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে ক্যাম্পাসে একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখায় প্রশাসনের যে ভূমিকা থাকতে পারত, সে ভূমিকা তো নেই-ই, বরং আশকারা দিয়ে এগুলোকে আজ মহীরুহতে পরিণত করা হয়েছে- যার ফলাফল ছাত্রলীগের সাম্প্রতিক তান্ডব।
৫ মার্চ দুপুর ১১টায় চাঁদাবাজি-টেন্ডারবাজি-দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে আন্দোলনরত সমাজতান্ত্রিক ছাত্রফ্রন্টের নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায় ছাত্রলীগ।
বুয়েট ক্যাফেটেরিয়ায় চালানো এ হামলায় আহত হয় ছাত্রফ্রন্টের গৌতম কুমার দে, মামুন মোর্শেদ খান, মুনিম বিন গণিসহ আরো অনেকে। এরপর দুপুর ২টার দিকে রশীদ হলের ৪০০৬ নং, নজরুল ইসলাম হলের ৩২৯ নং, সোহরাওয়ার্দী হলের ১০১২ নং এবং তিতুমির হলের ৩০০২ নং রুমে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট চালায় ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীরা। পরদিন ৬ মার্চ সকালে আবারও হামলা করে গৌতম, মামুন, নাজমুলকে আহত করে ছাত্রলীগ। একপর্যায়ে সন্ত্রাস-চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে দাঁড়ানো ছাত্রদের ক্যাম্পাস ছাড়তে বাধ্য করা হয়। এরপর ৭ মার্চ রাতে ভিসি ও ছাত্রকল্যাণ পরিচালকের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে ছাত্ররা হলে উঠলে রাত ১০টা ৩০ মিনিটে বহিরাগত সন্ত্রাসীদের সঙ্গে নিয়ে ছাত্রলীগ আবারো হামলা করে আহসানুল্লাহ হলের ক্যান্টিনে আহাররত গৌতম- মামুনের ওপর।
সন্ত্রাসীরা গৌতমকে মাটিতে ফেলে লোহার রড, হকিস্টিক দিয়ে মারতে থাকে এবং একপর্যায়ে অজ্ঞান করে মৃতপ্রায় অবস্থায় ফেলে রেখে চলে যায়। গৌতম আজ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভাঙা দুই হাত, পা আর মাথার জখম নিয়ে কাতরাচ্ছে।
এভাবে লাগাতার হামলা চলতে থাকলেও আজ পর্যমত্ম অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে কোনো পদপেই নেয়নি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। ক্যাম্পাসে চলছে ছাত্রলীগ সন্ত্রাসীদের স্বশস্ত্র মহড়া। প্রশাসন এখনো নির্বিকার।
২০০২ সালে সনি হত্যাকান্ডের আগেও ঠিক এরকমই একটা পরিস্থিতিতে ছোট ছোট অপরাধ, চাঁদাবাজি, হামলা-নির্যাতন ইত্যাদি করে পার পেয়ে যেতে থাকা ছাত্রদলের সন্ত্রাসীদের হাতে একপর্যায়ে সনি হত্যাকান্ড ঘটে। প্রতিবাদে বুয়েটের ছাত্রসমাজ যে তীব্র আন্দোলন গড়ে তুলেছিল তার ফলে হত্যাকারীদের বিচার হয়েছে, পুরো সন্ত্রাসীচক্র পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু যে তাজা প্রাণ ঝরে গেল, তা ফেরানো তো আর যায়নি।
শুধু বুয়েট না, দেশের অন্য যেসব কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রনামধারী সন্ত্রাসীদের অভায়ারণ্যে পরিণত হয়েছে, সেখানেও একইভাবে ছোটছোট সন্ত্রাস-চাঁদাবাজি ও দখলদারিত্বের আশকারা প্রদান এবং একই সঙ্গে ছাত্র-অধিকার আদায়ের রাজনীতিকে স্তব্ধ করে দেওয়ার মধ্যে দিয়েই তা সম্ভব হয়েছে। কাজেই আরো দেরি হয়ে যাওয়ার আগেই শিক্ষা ও গণতান্ত্রিক পরিবেশ বজায় রাখার স্বার্থে, বুয়েট প্রশাসন ও সরকারের কাছে আমাদের দাবি, অবিলম্বে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসী-চাঁদাবাজি বন্ধের পদপেক্ষ নিন এবং চাঁদাবাজি প্রতিরোধকারীদের ওপর লাগাতার হামলাকারী সন্ত্রাসীদের উপযুক্ত বিচার ও শান্তি নিশ্চিত করুন।
আমরা সনির মতো আর কাউকে হারাতে চাই না।
--শরীফ হাসান,তমাল পাল,কল্লোল মোস্তফা,অনুপম সৈকত শান্ত, মাহবুব রূবাইয়াৎ
লেখাটি সাপ্তাহিক বুধবারের চলতি সংখ্যায় প্রকাশিত
http://budhbar.com/?p=4600
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।