আমার মনে হয় আমি হাত সাফাইয়ের কাজটা খুব ভালো পারি। গ্রামে যে দুই একটা চুরি হয় তার জন্য অবশ্য আমাকেই দায়ী করা হয়, এজন্য অবশ্য আমার মনে কোন রকমের দুঃখ নাই। এজন্য আমার গর্ব হয় যে সর্ম্পূণ গ্রামে শুধূ আমি একাই চোর। চোর হলেও আমার একটা ধর্ম আছে, আমি গরীব মানুষদের ঘরে সিদ কাটি না। বেঁচে বেঁচে বড়লোকদের ঘরে সিদ কাটি।
গ্রামের চেয়ারম্যানের বাসায় এ পর্যন্ত ছয়-সাত বার সিদ দিয়েছি। ধরা পড়িনি কোন বারও। প্রতিবারি আমার বিচার হয়েছে, প্রতিবারি শাস্তি পেয়েছি, কান ধরে তওবা করেছি আর চুরি করবো না। কিন্তু যেই রাত হয়ে আসে গায়ে সরিষার তেল মেখে আমি নেমে পড়ি আমার অভিযানে।
আমার ওস্তাদ আমারে শিখায় দিছে কিভাবে গায়ে তেল মাখলে ধরা পড়ার পরও পিছলে চলে আসা যায়।
যদি দরা পরেই যাই, তাহলে কিভাবে মার সহ্য করতে হবে তাও আমার ওস্তাদ আমাকে শিখিয়ে দিয়েছে। দম বন্ধ করে গা শক্ত করে রাখলে মার একটু কম লাগে, আর যে মারতে আসবে তার পা জড়িয়ে ধরলে সে ঠিকমত মারতে পারবে না, এতে মার খাওয়ার ঝুকি কম থাকে। একদিন আমি ওস্তাদকে প্রশ্ন করছিলাম- যদি এক সাথে অনেক মানুষ মারতে আসে তাহলে কি করবো? ওস্তাদ রেগে আমাকে বলছিল- তোমার গা পিছলা থাকবো, বেশি মানুষ তোমারে মারতে আসবো না, একজনই তোমারে ভালো করে পিটাবো, তখন তুমি এই পদ্ধতিগুলা কাজে লাগাবা।
অনেকদিন ধরে ভাবছি, গ্রামে অনেক চুরি করেছি আর না এবার শহরে যেতে হবে। রাতে বউয়ের কাছে এই কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে সে বললো- তোমার যদি মাথা খারাপ না হইয়া থাকে তাইলে যাও, এইহানে এই গ্রামে তুমি এত মার খাও আর শহরে গেলে তো তোমারে খুইজা পাওন যাইব না।
বউয়ের সঙ্গে রীতিমত ঝগড়া করে ঠিক হলো আগামী শুক্রবার আমি শহরে যাব।
আমি শহরে যাব এই কথা শোনার পর আমার মেয়ে অনেক আনন্দিত। সে শহর থেকে কি কি আনতে হবে তার একটা লিষ্ট বানাতে লাগলো। আমি যে শহরে চুরি করতে যাচ্ছি এটা আমার মেয়ে জানে না, জানলে হয়তো এত আনন্দিত হত না। আমার বাবাও আমার চুরি করা পছন্দ করেন না।
তিনিও শহরে যাওয়া নিয়ে তেমন আনন্দিত না। তার কথা গ্রামে থাকলে প্রতিদিন মাইর খায়া বাড়ি ফিরতো তা দেখতে পারতাম, এহন আবার মাথায় নতুন ভুত চাপছে শহরে যাইতে হব, হেইহানে মাইর খাইলে কেডা দেকবো। হাট বাজারে সবাই আমাকে নিয়ে আলোচনা করতে লাগলো, এতে আমার খুব গর্ব হচ্ছে। জোনাক পোকার মত গর্ব। জোনাক পোকা যেমন থেকে থেকে একটু একটু করে জ্বলে আবার নিভে যায় তেমন আমার গর্বটাও একটু আনন্দে ভরে উঠছে আবার একটু ভয়ে ভয়ে আছে।
গ্রামে আমার নামটাও একটু আলাদা। সবাই আমারে ডাকে চোরা রহমত বলে। চোরা রহমত বললে যে কেউ আমার বাড়ি দেখায় দিব। এই যে একনামে সবাই আমারে চেনে এটাও কি জীবনে কম বড় পাওয়া।
চাচা, তোমার দোকানে এক কাপ চা খেতে আসলাম।
হ, তুমি তো আসবাই। শুনলাম তুমি নাকি শহর যাইতেছ?
হ, চাচা, তোমরা যেন ভালো থাক সেই জন্যই শহর যাইতেছি।
হ ,বাবা তুমি গেলে গ্রামটা একটু শান্তি পাইব।
দোয়া কইরো চাচা, গ্রামের মত শহরেও যেন আমার নাম হয়।
আচ্ছা বাবা দোয়া করবো।
কি গো চোরা রহমত, শুনলাম তুমি রাকি শহরে যাইতেছ?
হ, শুক্রবার ইনশাআল্লাহ রওনা দেব।
যাও। তুমি গেলে আমরা বাচি।
আমার যাওয়ার দিন গ্রামে রীতিমত একটা আনন্দের আমেজ তৈরী হলো। সবাই যেন আমারে বিদায় দিতে পারলেই বাঁচে।
আমি চোর হইলেও গ্রামে যে আমার একটা মর্যাদা আছে, সেটা আজ বুঝতে পারলাম। সবাই চায় আমি গ্রাম ছাড়ি, আমি সবার মনে আশা পূরণ করার জন্যই শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলাম। আমার বউ বাঁিশ কান্না কানতাছে। বাঁশি কান্না হচ্ছে হুঁ হুঁ করে কান্না। মাইয়া মানুষদের এই ধরণের কান্না আমি পছন্দ করি না, আমার বউ এইটা জানে।
জানার পরও সে আমার সামনেই এই কান্না কানতাছে। আমার মেয়ে মহা আনন্দে আমার পিছু পিছু আসতেছে। তার ধারণা তার বাবা অনেক বড় কিছু একটা করতে যাইতেছে। সে একেকবার একেকটা জিনিষের নাম বলতেছে আর বলতেছে বাবা এইটা আনতে ভুইলো না কিন্তু। আমার বাবা অবশ্য এই সমস্ত কাজে নাই, তিনি সকাল বেলাতেই বলে দিছেন আমার এই সমস্ত ঢং দেখার জন্য তিনি থাকতে পারবেন না।
বাবার কদমবুচি না নিয়াই আমি শহরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইলাম। মনটা যেন কেমন করছে আমার ওস্তাদ বলছে যে কোন কাজ করতে যাওয়ার আগে অবশ্যই বড়দেও কদমবুচি কইরা যাইতে। তাই আবার বাড়িতে ফিরে সোজা বাবার ঘরে ঢুকলাম।
আব্বা, আপনের পা দুইটা একটু দেন দেখি
কি করবা?
কদমবুচি।
তোমর কদমবুচি আমি নিতে পারবো না।
আপনে নিয়েন না। আমি আপনের পা ধইরা কদমবুচি কইরা চইলা যাব। শহরে যাইতেছি তাই, নইলে কদমবুচি করতাম না। ওস্তাদ বলছে গুরুজনদের সম্মান করতে, তাই ফিইরা আইছি।
তুই আমার সামন থইকা ভাগ, আমি তোরে কদমবুচি করতে দিব না।
আপনে যদি মনে কইরা থাকেন কদমবুচি না করলে আমি বাড়ি থইকা বাইর হইব না, তাইলে ভুল করতাছেন। আমি দুর থাইকা আপনের পা কদমবুচি কইরা চইলা যাব। আমার বউ এখনও আমার পাশে দাড়ায়া বাঁশি কান্না কানতাছে- শোন বউ আমার পাশে দাড়ায়া বাঁশি কান্না কানবা না, যাও ভিতর যাও মাইয়ারে ঠিক মতো দেখা শোনা কইরা রাখবা।
০২.
কি গো রহমত রওনা দিলা?
হ, দোয়া রাইখ।
দোয়া তো অবশ্যই করি, তুমি গেলেই তো আমাদের গ্রামের লোকেরা একটু শান্তি পায়।
জীবনে কখন ঢাকা যাইনাই বুঝছো। ভাবতাছি ঢাকা যাইয়া চুরি চামারী আর করবো না। সেখানে গিয়া ভাল কিছু করার চেষ্টা করবো। কালকা রাতে আমি একটা লাল ¯^cœ দেখছি।
লাল ¯^cœ মানে?
লাল ¯^cœ মানে বড়লোক হওয়ার ¯^cœ, আর সাদা ¯^cœ মানে হইলো গিয়া গরীবদের ¯^cœ| এতদিন সাদা ¯^cœ দেইখা আসছি, কাল রাতে যখন লাল ¯^cœ দেখছি, তখনই মনে হইছে আমি এবার বড়লোক হব।
তোমরা দোয়া কইরো।
তুমি মিয়া মানুষটা বদলাইলা না। আল্লাহ তোমার ¯^cœUv পুরণ করুক এইডাই দোয়া করি। চল তোমারে বাস পর্যন্ত তুইলা দিয়া আসি।
আসো।
বাসস্টান্ডে অনেকখন দাড়ায় থাকার পর ঢাকার বাস আসলো। বাসের সিটে বসে ভাবতে লাগলাম লাল ¯^‡cœi মতো আমি যেন সত্যি সত্যি অনেক বড়লোক হইতে পারি। ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমায় পড়ছি এইডা মনে নাই। গাড়ী থাইমা গেছে। অনেক রাত।
এত রাতে গাড়ী থাইকা নাইমা আমি কই যাব। হাটতে হাটতে দেখলাম রাস্তার ধারে অনেকে ঘুমায় রইছে। ওদের দেখা দেখি আমিও রাস্তায় শুইয়া পড়লাম।
ওই মিয়া এইহানে শুইছ ভাড়া দিছ।
খোলা আকাশের নিচে শুইলেও ভাড়া দিতে হয়?
নয়া পাবলিক, এইডা জানো না।
কই থাইকা আইছ?
দুয়ারীপাড়া।
কাম করবা?
কামের জন্যই তো এইহানে আসছি।
গ্রামে কি কাম করতা?
চুরি।
ওস্তাদ আমাগো দলের লোক। তাইলে তোমারে নতুন কইরা শিখাইতে হইব না।
শোন আমরা চুরি করি না, তবে এর থাইকাও বড় কাম করি। আমরা ছিনতাই করি। ছিনতাই করতে পারবা?
গ্রামে একবার চেষ্টা কইরা মাইর খাইছি।
মাইর এইখানেও খাইতে হইব। রাজি থাকলে কাইল থাইকা কামে লাইগা যাইবা।
যা ছিনতাই করাবা তার অর্ধেক আমাদেও দিয়া দিতে হইব, আর রাতে এখানে থাকনের জন্য ১০ টাকা ভাড়া দিতে হইব।
ছিনতাইয়ের অর্ধেক তোমাগো দিব কেন?
পাবলিক ধইরা যখন মরাব, তখন তোমারে বাচাইব কেডা? আইজকা প্রথম ফ্রি ঘুমাও। কাইল থাইকা কাম করবা ভাড়া দিয়া থাকবা।
০৩.
রহমত ওই লোকটার পিছন পিছন যা, ওই বেটার কাছে নগদ অনেক টাকা আছে। ফাঁক মত পাইয়া টাকাগুলা নিয়া দৌড় দিবি, পিছনে আমি থাকবো ব্যাগটা আমার দিকে দিয়া তুই অন্য পথে চইলা যাবি, তাড়াতাড়ি যা।
লোকটার পরনে সাদা শার্ট, হাতে একটা ব্যাগ। অনেকক্ষন ধইরা চেষ্টা করতাছি ব্যাগটা নিয়া দৌড় দিবার ফাঁকা জায়গা পাচ্ছি না। যখন দেখলাম ফাঁকা জায়গা নাই তখন ভিড়ের মধ্যেই রোকটার ব্যাগ নিয়া দে দৌড়। আমি দৌড়াচ্ছি, আমার পিছনে সেই লোকটা আর তার পিছনে শত শত লোক, ব্যাগটা কোন রকমে সেলিমের হাতে দিয়া আমি অন্য দিকে দৌড় দেওয়ার জন্য যখনই ঘুরবো সেলিম আমারে টান দিয়া রাস্তায় ফালায় দিল। আমারে লোকগুলো ধইরা ফেলছে, আমি জানি আমার এখন কি হবে।
আমি সেলিমের দিকে তাকায় আছি আর শত শত লোকের হাতে মাইর খাচ্ছি।
ওরা ইচ্ছামত আমারে মারতাছে। আমার মনে হচ্ছে আমি আর কিছুক্ষন বাঁইচা থাকতে পারবো। শেষবারের মত আর একবার চোখ খুইলা দেখি সবাই আমারে লাথি মারতাছে। চোখ বন্ধ করার আগে একবার শুধু বাবার মুখটা দেখতে চাইলাম।
আর চোখ বন্ধ করে সত্যি সত্যি আমি বাবারে দেখলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।