আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ছিনতাই ছিনতাই!



আমার মা-বাবা ৩ দিন আগে ২ জন মহিলা ছিনতাইকারী পাকড়াও করেছেন। ছিনতাইকারীর কবলে পড়াটা অবশ্য আমাদের জন্য নতুন কিছু নয়,এই বিষয়ে আমি,এবং আমার বাবাও, বিশেষভাবে অভিজ্ঞ, তবে এখানে নতুনত্ব হলো যে বাংলাদেশের নারীরাও যে নতুন দিনের স্লোগান তুলে এই মহান পেশায় এগিয়ে এসেছেন সেটার একটা হাতেনাতে প্রমাণ পাওয়া গেলো,আর একই সাথে,এই সৌভাগ্য সবার হয় না,হাতেনাতে এমন ঝানু দু'জন পেশাদারের হাতে হাতকড়া পরানোও গেলো। আমাদের কষ্টের সম্পদ নিজের ভেবে নিয়ে গেছে এমন ইতিহাস একদম কম নেই,সেই একদম ছোটবেলায় ঘরের তালা ভেঙে সাধের একমাত্র ক্যাসেট প্লেয়ারটা মেরে দিয়েছিল কোন এক মহাজন,পরের ১৫ বছরে আর গান শোনার একটা যন্ত্র কেনার সামর্থ্য হয়নি। আবার ঘরের ভেতর বাবা আর আমি ঘুমাচ্ছি,মা গেছেন ঘরের দরজা ভেজিয়ে পাশের দোকানে, সেই সুযোগে একদম বেডরুমে ঢুকে বাবার মানিব্যাগ ঘড়ি চার্জলাইট নিয়ে হাওয়া,এমনো হয়েছে। চোর অবশ্য পাশের বস্তিতেই বসবাস, এককালে বারান্দা থেকে ফুলগাছ চুরি করতো,পরদিন বাবা গিয়ে চোরের বাড়ির পাশ থেকেই সেটা তুলে নিয়ে আসতেন,তবে ফুলগাছ চুরি করতে করতেই চোরবাবাজি বন্দুকবাজ হয়েছে,কোমরে পিস্তল নিয়ে ঘোরে,কাজেই সেই ব্রহ্মাস্ত্রখানা আমাদের না দেখিয়ে চুপচাপ ঘরের জিনিস তুলে নিয়ে গেছে,আমরা তাতেই খুশি।

কিন্তু এই ছিনতাই, বা টান দেয়া, সোজা কথায়, জানিয়ে শুনিয়ে নিয়ে যাওয়ার মাঝে কেমন যেন একটা অপমানবোধ আছে, নিজেকে কখনো অক্ষম,কখনো বেকুবও মনে হয়। একারণেই ঠিক নিশ্চিত হতে পারিনি আমার পিতৃদেবকে ঠিক কতবার ছিনতাইয়ের শিকার হতে হয়েছে, যে ২-১ বার বেঁচে গেছেন জানমাল খোয়ানোর হাত থেকে, সেগুলো জানা আছে,বাকি ২-১ টা চোখে দেখা, অন্যগুলো? বুঝে নিয়েছি আরকি। একবার যেমন, তখনো আমি ছোট, আমাকে ট্রেনে উঠাচ্ছেন,চরম ভিড়,টের পেলেন পকেট থেকে কেউ মানিব্যাগটা মেরে দিচ্ছে। ছেলেকে তো ছেড়ে দিতে পারেন না, মানিব্যাগটাই ছেড়ে দিলেন। পরের ঘটনা নিউমার্কেটে,ফুটপাথ থেকে ফল কিনে দাম দেয়ার জন্য ৫০০ টাকার একটা নোট বের করেছেন,ভিড়ের মাঝ থেকে গুলির মত একটা ১২-১৩ বছরের ছেলে বের হয়ে এসে নোট টা টান দিয়ে ভিড়ের মাঝেই হাওয়া,কিছু বুঝে ওঠার আগেই।

মোবাইল যুগ আসার পরেও ছিনতাইকারির সাথে তার মোলাকাতের ভাগ্য হয়েছে, সেলফোনটা গেছে একবার, আবার পরেরবার টাকাপয়সা না পেয়ে সৌভাগ্যক্রমে অক্ষত ছেড়েও দিয়েছে,এমনো হয়েছে। সেদিক থেকে,আমার নিজের অভিজ্ঞতা কিছুটা ভীতিজনক,বেশ কিছু অস্ত্রদর্শন হয়ে গেছে এর মাঝেই। তখন ভার্সিটিতে পড়ি,প্র্যাকটিক্যাল সার্ভে চলছে,রাত ৮টা পর্যন্ত কাজ করে রিপোর্ট দিয়ে ফিরছি,ব্যাগে আর হাতে একগাদা যন্ত্রপাতি,ড্রইং,হাবিজাবি। মৌচাক মোড়টার পরেই পত্রিকার স্ট্যান্ডটার কাছে হঠাৎ করেই পাশ থেকে একটা রিকশা ওভারটেক করে চাপিয়ে দিল আমার রিকশাটার ওপর, একজন লাফিয়ে নেমে এল,পাশ থেকে দেখি আরেকজন আমার পাশে উঠে বসেছে। বেশ অমায়িক হেসে জানালো,তারা পাড়ার ছেলে, মিষ্টি খেতে চায়, যদি কিছু খুশি হয়ে দিই তো তার কোমরের যন্ত্রটা বের করার দরকার হয় না।

যন্ত্রটার চেহারাও দেখিয়ে দিল শার্ট তুলে,কালো রঙের একটা পিস্তল, আসল না নকল সেটা যাচাই করার দরকার দেখলাম না, কারণ পাশে উঠে বসা ছোকরার হাতে একটা ক্ষুর, সেটা যে আসল তাতে সন্দেহ নেই। জায়গাটা অন্ধকার, ঝামেলা করার প্রশ্নই আসে না, কারণ পাশে আরো ২ জন ততক্ষণে চলে এসেছে,নিজেরাই ব্যাগ হাতিয়ে ২০০ টাকা আর মোবাইলটা নিয়ে নিল, ভাংতি টাকা বাদ দিয়ে। মিনমিন করে জানালাম, সিমটা তো কাজে লাগবে না, দিয়ে গেলে উপকার হয়। পিস্তলওয়ালা খানিক তাকিয়ে সিমকার্ডটা খুলে দিলো, তারপর আস্তে করে পাশের গলিতে হাওয়া হয়ে গেল, আমি দীর্ঘশ্বাস ফেলে সামনে হাঁটা ধরলাম, রিকশাওয়ালাটাও ভেগেছে। পরের বারের কাহিনী আরেকটু চমকপ্রদ, বখশিবাজারের কাছে রাতের খাবার খেয়ে হলে ফিরছি ৩ বন্ধু,রাস্তাটা নির্জনই বলা যায়, হঠাৎই রাস্তার পাশে থামানো ট্রাক থেকে হুড়মুড় করে লাফিয়ে নামলো ৫ জন, হাতে রামদা আর চাপাতি।

গলার কাছে ঐ জিনিস দেখে বাহাদুরি করার শখ উড়ে গেল, মোবাইল গুলো নিয়ে ট্রাকে উঠেই হাওয়া। একটু দূরেই টহল পুলিশ,ট্রাক ছাড়তেই হইহল্লা শুরু করলাম,কিন্তু পুলিশদের নড়াচড়ার বিশেষ উৎসাহ দেখা গেল না, তাদের সামনে দিয়েই ট্রাক দিব্যি চলে গেল। (পরে একি জায়গায় আরো কয়েকটা ছিনতাইয়ের ঘটনার পরে বোধহয় তেনাদের টনক নড়ে, হলের সামনে এবং মোড়গুলোতে পুলিশের সংখ্যা বাড়ানো হয়, এখনো আছে কিনা কে জানে। ) তো,সেই আমরাই এবার দুটো ছিনতাইকারী, হোক মহিলা, ধরতে পেরে বেশ দিলখুশ। ঘটনা বাসার সামনেই,মা আর বাবা রাস্তা পার হচ্ছেন,আইল্যান্ডে ওঠার পরেই দুজন, মা'র বর্ণনামতে,২০-২২ বছরের মেয়ে,মাথায় গলায় ওড়না দেয়া,আইল্যান্ডে তাঁর পাশে উঠে পড়ে।

একজনের কোলে বাচ্চা, সে জানায়,বাচ্চা কোলে নিয়ে রাস্তা পার হতে খুব সমস্যা হচ্ছে,একটু হাত ধরে পার হয়ে যাবে। সন্দেহ করার কিছু নেই,রাস্তাটা আসলেই বেশি ব্যস্ত,কাজেই মা ঐদিকে বেশি মনোযোগ দেননি। যখন হাত ধরে রাস্তা প্রায় পার হয়েই গেছে,তখন বাবার চোখে পড়ে মায়ের গলার চেইনটা,আমার নানীর দেয়া শখের জিনিস,নেই। চেইন কোথায়,বলার সাথে সাথেই মায়েরও খেয়াল হয়,পাশে এই দুজন ছাড়া কেউ নেই,কাজেই দুই মহিলা,যারা এখনো হাত ছাড়েনি,তাদের একজনের হাত চেপে ধরেন,বাবা আরেকজনের টা,ধরে রাস্তা পার। পরিচিত এলাকা,হইচই শুনে লোকজন জমে গেছে,টহল পুলিশও চলে এসেছে,যদিও মহিলা দুজন নির্বিকার,তাদের বক্তব্য হলো,তারা কিছু জানে না।

এবার পুলিশকে নামতে হলো ময়দানে, দেখা গেল পুলিশি ধমকের জোর আছে,কিছুক্ষণের মাঝেই স্বীকার গেল,তারাই নিয়েছে,চেইনটা বেরও করা গেল। হাজার হোক মহিলা,কাজেই প্যাঁদানি দেয়ার শখ থাকলেও লোকজন নিজেদের সামলে নিল, ফলাফল হলো,পুলিশের সাথে বাবাকে থানায় গিয়ে মামলা লিখিয়ে তবে চেইন আনতে হলো। ঘটনা এখানেই শেষ হবার কথা,কিন্তু দেখা গেল বিষয়টা এত সরল নয়। বাসায় এসে জানা গেল পাশের বাড়ির ভদ্রমহিলাকেও ক'দিন আগে একইভাবে রাস্তা পার হবার সময় ঐ আইল্যান্ডের উপর থেকেই মোবাইল মেরে দিয়েছে,বেশ একটা দলবল আছে এদের। বিকেল দিকে বাবার মোবাইলে ফোন,এক লোক জানালো যাদের ধরা হয়েছে একজন তার বৌ,সে কিছুই জানে না,সাথের জনই আসল ছিনতাইকারী।

বিশ্বাস করার প্রশ্নই আসে না,কিন্তু মোবাইল নম্বর কোথায় পেয়েছে জিজ্ঞাসা করতে জানালো থানা থেকে। থানায় ফোন করতে ডিউটি অফিসার জানালেন তিনি কিছু জানেন না,কেউ হয়তো পয়সা খেয়ে খাতা থেকে নম্বর টা দিয়ে দিয়েছে। মেজাজ খারাপ হলো,কিছু করার নেই,ঝামেলা এড়াতে মোবাইলটা বন্ধ করে রাখা হলো। রাত ১০টার দিকে আরেক ফ্যাকড়া,পুলিশের ২ সাবইন্সপেক্টর এসে হাজির। কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করতে জানালো,আমরা যে জনসেবার স্বার্থে ছিনতাইকারীদের থানায় সোপর্দ করেছি এজন্য তারা খুবই কৃতজ্ঞ,তবে কিনা,মামলাটা লেখায় একটু ভুল হয়ে গেছে।

কিরকম? না,বাবা লিখেছিলেন ঠিকই যে জনতা ধরে পুলিশের হাতে দিয়েছে,তবে থানাতে যে মহিলা ডিউটি অফিসার ছিলেন তিনি ভুল করে(?) লিখে রেখেছেন যে পুলিশ হাতেনাতে ধরেছে। তো সমস্যা কি? না,পুলিশ যদি নিজেই গ্রেপ্তার করে থাকে সেক্ষেত্রে উদ্ধারকৃত বস্তু পুলিশের জিম্মায় রাখতে হবে আদালতে অপরাধী চালান না হওয়া পর্যন্ত। লে বাবা,জনসেবা করতে গিয়ে একি দুর্গতি! কি আর করা,পড়েছি পুলিশের হাতে,মামলা করতে হবে সাথে। রাত ১১টায় সেই চেইন বের করে আবার সোনার দোকান খুঁজে ওজন নিয়ে মহাশয়রা চলে গেলেন চেইন নিয়ে,জানালেন,পরের দিনই ফেরত পাবেন। পরের দিন গেলো,ফোন করতে জানালেন,এখনো ব্যবস্থাধীন।

তার পরের দিন? না খবর নেই,শুক্রবার পেয়ে যাবেন,আইনের জটিলতা,বোঝেনই তো! বেশ,আজ শুক্রবার। ফোন করতে জানা গেল,ওসি সাহেব এখনো বাইরে,তিনি ফিরলেই আশা করা যায় একটা ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আমরা ব্যবস্থার আশায় আছি,ছিনতাইকারীর হাত থেকে তো চেইন উদ্ধার হলো,পুলিশের হাত থেকে কে উদ্ধার করবে? তারপরেও আমরা আশায় আছি,আমরা আশাতে থাকি,এরাই তো আমাদের সেবাদাতা সংস্থা, আমাদের আশা না করে উপায় কি?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।