আল্লাহ মহান, যাহা বলিব সত্য বলিব। নিশ্চিত থাকুন এ দেশ থেকে কেউ আমাকে বহিষ্কার করতে পারবে না_ এমন দম্ভ করেই ১৯৭৬ সালের ১১ জুলাই বাংলাদেশে পা রেখেছিলেন গোলাম আযম। মায়ের অসুস্থতার কথা বলে তিন মাসের ভিসা এবং পাকিস্তানি পাসপোর্ট নিয়ে এলেও আইন-কানুনের তোয়াক্কা না করে সেই তখন থেকেই থেকে গেছেন বাংলাদেশে। ১৯৭৯ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত অঘোষিতভাবে ছিলেন জামায়াতের আমির। কিন্তু '৯২ সালে জামায়াতের সম্মেলনে সরাসরি আমির হিসেবে নির্বাচিত হলে সর্বমহলে বিতর্কের ঝড় ওঠে।
প্রশ্ন ওঠে সরকারি ভূমিকা নিয়েও। ওই বছরেরই ২৪ মার্চ রাতে গোলাম আযমকে বিদেশি নাগরিক আইনের আওতায় গ্রেফতার করে ১ মাসের ডিটেনশন দিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রেরণ করা হয়। মেয়াদ শেষ হলে সরকার ২২ এপ্রিল আরও ৬০ দিনের আটকাদেশ দেয়। গোলাম আযম শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ফিরেও পান। উল্লেখ্য, ১৯৭৩ সালের ২১ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধ ও মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত গোলাম আযমসহ ৩৯ জনের নাগরিকত্ব বাতিল করে সরকার।
'৭৬ সালের ১১ জুলাই গোলাম আযম পাকিস্তানি নাগরিক হিসেবে বাংলাদেশে পা রেখেই প্রথম সংবাদ সম্মেলনে বলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত কিছু নয়, এটা চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। ১৯৭১ সালে শান্তি কমিটির কোনো লোক কাউকে হত্যা করেছে বলেও আমার জানা নেই। আলবদর, আলশামস ও রাজাকার বাহিনী গঠন করার দায় সম্পর্কে তিনি বলেন, এ বাহিনী গঠনের জন্য স্থানীয় সার্কেল অফিসার ও সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যানরা ঢোল পিটিয়ে লোকজন জোগাড় করেন। ড. মালিকের মন্ত্রিসভায় জামায়াতের আব্বাস আলী খান ও মাওলানা এ কে এম ইউসুফের নিযুক্তি সম্পর্কে গোলাম আযম বলেন, তারা জনগণকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। হত্যার চেষ্টা করেননি।
নিজের বাড়ি সম্পর্কে তিনি দাবি করেন, পৈতৃক সূত্রে পাওয়া এই বাড়ির খাজনা-ট্যাঙ্ আমি দিয়ে আসছি। ভোটার লিস্টে আমার নাম আছে। গত পৌর নির্বাচনে একজন প্রার্থী আমার ভোটের নম্বর ও ভোট কেন্দ্রের ঠিকানা জানিয়ে আমার কাছে চিরকুট পাঠিয়েছিলেন। '৭০ সালের নির্বাচনে ঢাকা-৭ আসনে গোলাম আযম (প্রাপ্ত ভোট ৩৪৩৬০) আওয়ামী লীগ প্রার্থী জহিরউদ্দীনের কাছে (প্রাপ্ত ভোট ১১৪৮০৯) হেরে গেলেও তিনি ইয়াহিয়ার প্রহসনের উপনির্বাচনে জয়ী হন। মুক্তিযুদ্ধকালীন ছিলেন জামায়াতের আমির।
সরকারের সঙ্গে অাঁতাত করে দেশে আসার অভিযোগ সম্পর্কে গোলাম আযম সংবাদ সম্মেলনে 'আমার জন্মগত নাগরিক অধিকার' প্রসঙ্গ শীর্ষক ১২ পৃষ্ঠার একটি পুস্তিকা পড়ে শোনান। নিজেকে বাংলাদেশের বৈধ নাগরিক হিসেবে দাবি করে তিনি বলেন, 'সম্পূর্ণ অন্যায়ভাবে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত হয়ে আমাকে পাকিস্তানি নাগরিক হিসেবে চিহ্নিত করে একতরফা মিথ্যাচার চালানো হচ্ছে। আমার নাগরিকত্বের প্রশ্নটি রহস্যজনকভাবে অদ্যাবধি ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। ' তিন মাসের ভিসা নিয়ে আসা গোলাম আযম '৭৯ সালের মে মাসে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন আইডিএলের ব্যানারে। '৭৬ সালে সরকার ঘোষণা করেন যে, পূর্ববর্তী সরকার যাদের বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করেছে তারা এখন সরাসরি স্বরাষ্ট্র সচিবের বরাবরে নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য আবেদন করতে পারবেন।
তখন গোলাম আযম পাকিস্তানি পাসপোর্ট জমা দিয়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্বের আবেদনও করেন। কিন্তু সরকার এ ব্যাপারে হ্যাঁ বা না কোনো নীতিই অনুসরণ করেনি। '৭৮ সালের ১৬ ডিসেম্বরের মধ্যে দেশ ত্যাগের নির্দেশ দেওয়া হয়। তখন গোলাম আযম লিখিতভাবে রাষ্ট্রপতিকে এক আবেদনে লিখেন, আমার পক্ষে দেশ থেকে চলে যাওয়া সম্ভব নয়। এর জবাব আমি সরকারের কাছ থেকে পাইনি।
' '৮৬ সালের মে মাসে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাগরিকত্ব বহাল করার জন্য সুপারিশ করে রাষ্ট্রপতির কাছে পাঠান। গোলাম আযমের নিজের ভাষ্য অনুযায়ী তিনি '৭৭ সালের জানুয়ারিতে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের কাছে আবেদন করেন। '৭৮ সালেও রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কাছে আবারও দরখাস্ত করেন। গোলাম আযম তখন বলেন, আমার বৃদ্ধা অসুস্থ মায়ের আবেদনে সাড়া দিয়ে রাষ্ট্রপতি আমাকে বাংলাদেশে আসার সুযোগ দেন। জামায়াতকে ব্ল্যাকমেইল করার জন্যই আমার নাগরিকত্ব ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে।
গোলাম আযম আরও বলেছিলেন, বাংলাদেশকে আলাদা করার জন্য ভারত যে সাহায্য করেছে তা সৎ নিয়তে করেনি। নিজেদের স্বার্থেই করেছে। এ দেশের জনগণ জানে ভারত তাদের কতটুকু বন্ধু। বাংলাদেশকে পাকিস্তানের সঙ্গে যুক্ত করার কোনো ষড়যন্ত্রে আমি লিপ্ত নই। তখনই তা মেনে নিয়েছি।
অতিরিক্ত কোনো চিন্তা আমার মগজে নেই। ষড়যন্ত্র করলে আজও কেন ধরা পড়ছি না? এমন প্রশ্ন করে গোলাম আযম বলেন, আমার বহু লেখনি ও বই প্রকাশিত হয়েছে। কোনোটিই বেআইনি ঘোষিত হয়নি।
'৭৬ সালের ২৩ জুলাই রাজনৈতিক দলবিধি নিয়ন্ত্রণ আইন এবং '৭৭ সালের ১৬ মে সংবিধানে ইসলামী নীতিমালা সংযোজনকেও তিনি স্বাগত জানান। সংবিধানে রাষ্ট্রপতির '৭২ সালের ৮ নম্বর আদেশ বাতিল সাম্প্রদায়িক রাজনীতি পুনর্বাসিত হলে তিনি আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠেন।
এদিকে '৯৩ সালের ২২ এপ্রিল সুপ্রিমকোর্টের হাইকোর্ট বিভাগের বিশেষ বেঞ্চে বিচারপতি আনোয়ারুল হক চৌধুরী গোলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিলের আদেশ অবৈধ ঘোষণা করেন। ২৫ এপ্রিল গোলাম আযমের নাগরিকত্ব মামলায় হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত রাখার জন্য আপিল বিভাগে ১টি আবেদনপত্র পেশ করা হয়। ১৯৯৩ সালের ২৪ জুলাই গোলাম আযমের আটকাদেশ সুপ্রিমকোর্ট অবৈধ ঘোষণা করেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।