একবার আপনারে চিনতে পারলে রে , যাবে অচেনা রে চেনা
কিডনীর অসুখ, কিডনী বিকল, বর্তমান বিশ্ব এবং বাংলাদেশ
বিশ্বজুড়ে সময়ের সাথে সাথে অসুখ বিসুখের ধরনধারন ও পাল্টে যা"েছ । গত শতাব্দীতেও বেশীর ভাগ মানুষ মারা যেত জীবানু সংক্রমন জনিত অসুখ বিসুখে। আর এ শতাব্দীতে মানুষ মারা যা"েছ অসংক্রামক বা ননকম্যুনিকেবল ডিজিজেই বেশী। এই তালিকার একেবারে ওপরের দিকে আছে কিডনী বিকল ও কিডনী সংক্রান্ত অন্যান্য অসুখ বিসুখ। কিডনী রোগের এই অশুভ বিস্তারের প্রধান কারন বিশ্বজুড়ে ডায়বেটিসের মহামারী এবং উ"চরক্তচাপের উ"চহার।
সেই সাথে আছে অস্বাস'্যকর জীবনাচারণ ,খাদ্যাভ্যাস, পরিবেশ দূষণ,খাদ্যে ভেজালের মত কিছু কারন।
পরিসংখ্যানে জানা যায় বর্তমান বিশ্বের ১ মিলিয়নেরও বেশী মানুষ কিডনী ফেইলিউরের কারনে ডায়ালাইসিস করে চলেছেন। বিশেষজ্ঞদের ধারনা আগামী পঁচিশ বছরে এই সংখ্যা দ্বিগুনে পৌঁছুবে। তা সচেতন হওয়াটা খুব জরুরী। কিডনীর অসুখের সাথে সাথে বেড়ে যায় হৃদরোগের ঝুঁকি।
তাই বিশ্ব কিডনী সচেতনতা দিবস উপলক্ষে এবছরের প্রতিপাদ্য “কিডনি বাঁচান, হার্ট বাঁচান”।
কিডনি ও তার কাজ: কিডনী বা বৃক্ক আমাদের পেছনের দিকে মেরুদন্ডের দুপাশে অবসি'ত এক জোড়া অতি দরকারী অঙ্গ।
কিডনির কাজ মূলত -
১। মূত্র তৈরী ও তার মাধ্যমে শরীরের অপ্রয়োজনীয় বর্জ্য(যেমন ইউরিয়া, ক্রিয়েটিনিন ইত্যাদি) পদার্থ বের করে দেয়া,
২। শরীরের অতিরিক্ত পানি ও অপ্রয়োজনীয় মৌল (যেমন সোডিয়াম,ক্লোরাইড) বের করে দিয়ে এদের ভারসাম্য রক্ষা করা,
৩।
জরুরী কিছু হরমোন তৈরী করা। যেমন: ইরাইথ্রোপোয়েটিন নামক বিশেষ একটি হরমোন যা রক্তের হিমোগ্লোবিন তৈরীতে বিশেষ প্রয়োজনীয় তা কিডনী থেকেই উৎপাদিত হয়।
৪। ভিটামিন ডি ও ক্ষুদ্র কিছু আমিষের বিপাক ঘটানো। ভিটামিন ডি শরীরে যে অবস'ায় ক্রিয়া করে তা রূপানতরে কিডনির বিশেষ ভুমিকা আছে।
কিডনীর যত অসুখ বিসুখ: কিডনি তে অনেক ধরনের অসুখ হতে পারে। তারমধ্যে গ্লোমারুলো নেফ্রাইটিস , নেফ্রোটিক সিনড্রোম, কিডনীর ইনফেকশন , কিডনীতে পাথর এবং কিডনী ফেইলিউর বা কিডনী বিকল ই প্রধান।
কিডনী বিকলঃ কিডনি যখন তার স্বাভাবিক কাজ গুলি করতে ব্যর্থ হয় তখন রেনাল ফেইলুর হয়েছে বলে ধরে নেয়া হয়। মূলত দুইধরনের কারনে হয়ে থাকে। যেমন,আকস্মিক কিডনী বিকল বা একিউট রেনাল ফেইলিউর এবং ধীর গতির কিডনী বিকল বা ক্রনিক রেনাল ফেইলিউর।
আকস্মিক কিডনী বিকল বা একিউট রেনাল ফেইলিউর ঃ
হঠাৎ কিডনী বিকল হওয়ার পেছনে কিছূ কারন আছে যেমন, ডায়রিয়ার কারনে অতিরিক্ত পানিশূন্যতা ঠিক সময়ে পুরণ না করা , বিশেষ কোন ঔষধ সেবন যা কিডনীর জন্য ক্ষতিকর, কোন কারনে কিছু সময়ের জন্য কিডনিতে রক্তপ্রবাহে বাধার সৃষ্টি ইত্যাদি। এ সমসত কারনে কিডনী বিকল হলে তাকে আমরা আকস্মিক কিডনী বিকল বা একিউট রেনাল ফেইলিউর বলি। একিউট রেনাল ফেইলিউর অনেক সময় এমনিতেই ঠিক হয়ে যায়। ক্ষেত্র বিশেষে কয়েক সেশন ডায়ালাইসিস দিলে কিডনী কয়েকদিন পর তার স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা ফিরে পায়।
ধীর গতির কিডনী বিকল বা ক্রনিক রেনাল ফেইলিউর ঃ
ধীর গতির কিডনী বিকল হওয়ার অনেক কারনের মধ্যে প্রধানতম কারনগুলি হ"েছ ক্রনিক গ্লোমারুলোনেফ্রাইটিস (দীর্ঘ দিন ধরে চলতে থাকা কিডনি প্রদাহ), দীর্ঘ দিনের অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস এবং দীর্ঘদিনের অনিয়ন্ত্রিত উ"চরক্তচাপ।
এসব কারনে যখন দুটো কিডনী বিকল হয়ে যায় তখন রক্তশূন্যতা এবং ভিটামিন ডি এর অভাব পুরন ছাড়া উপরে উল্লেখিত কিডনীর অন্যান্য স্বাভাবিক কাজগুলো, বিশেষ করে শরীরের অপ্রয়োজনীয় এবং ক্ষতিকর বর্জ্যপদার্থ নির্গমন এবং ইলেকট্রোলাইটের পরিমান স্বাভাবিক মাত্রায় রাখার জন্য ডায়ালাইসিস নামের বিশেষ একটি পদ্ধতির শরনাপন্ন হতে হয়।
ডায়ালাইসিস মূলত দুই রকমের হেমোডায়ালাইসিস এবং পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস।
হেমোডায়ালাইসিস ঃ
হেমোডায়ালাইসিস এমন একটি পদ্ধতি যেখানে বিশেষ মেশিনের সাহায্যে শরীরের অপরিশোধিত রক্ত শরীর থেকে বের করে এনে ডায়ালাইজার এর মধ্যে চালনা করা হয়। ডায়ালাইজার একটি ছোট্ট যন্ত্রের মতো যা কৃত্রিম কিডনী রুপে কাজ করে এবং ছাকনির মাধ্যমে শরীরের ক্ষতিকর অপ্রয়োজনীয় দ্রব্যগুলো দুরীভূত করে বিশুদ্ধ রক্ত শরীরে পুনরায় ফিরিয়ে দেয়।
হেমোডায়ালাইসিস এর পুরো প্রক্রিয়া একসেশনে সাধারনত তিন থেকে চার ঘন্টা চালানো হয়।
যে সমসত কারনে দুটো কিডনী বিকল হয়ে সারা জীবন ডায়ালাইসিস এর প্রয়োজন হয় সেক্ষেত্রে সপ্তাহে দুই থেকে তিনদিন চারঘন্টা করে ডায়ালাইসিস এর পরামর্শ প্রদান করা হয়ে থাকে।
পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস ঃ
পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস নামক আরেকটি বিশেষ পদ্ধতিতে কৃত্রিম ভাবে কিডনীর কাজ করানো সম্ভব। যার মধ্যে উন্নতবিশ্বে যে পদ্ধতিটি এখন অনুসরন করা হ"েছ তার নাম কন্টিনিউয়াস এ্যম্বুলেটরি পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস (সিএপিডি) । এ পদ্ধতিতে রোগীর স্বাভাবিক চলাফেরায় কোন সমস্যা হয় না এটি একটি বিশেষ সুবিধা । তবে এ পদ্ধতিতে যে ডায়ালাইসিস ফ্লুইড ব্যবহার করা হয় তা বেশ ব্যায় বহুল।
আমাদের মতো গরীব দেশে অন্য এক ধরনের পেরিটোনিয়াল ডায়ালাইসিস দেয়া হয় যে পদ্ধতিতে পেটের মধ্যে ক্যাথেটার প্রবেশ করিয়ে টানা চব্বিশ থেকে বাহাত্তর ঘন্টা পর্যায়ক্রমে ডায়ালাইসিস ফ্লুইড প্রবেশ কারিয়ে আধঘন্টা থেকে একঘন্টা রেখে পুনরায় বের করে আবার নতুন ডায়ালাইসিস ফ্লুইড দেয়া হয় । টানা বাহাত্তর ঘন্টা পর ক্যাথেটার খুলে এ কার্যক্রম বন্ধ হয় । এ পদ্ধতিতে সাময়িক ভাবে রোগীর চিকিৎসা দেয়া সম্ভব কিন' দীর্ঘ মেয়াদে এই পদ্ধতি কার্যকর নয়।
কিডনী বিকলের আরেকটি চিকিৎসা হলো কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন। অর্থাৎ একজন ডোনারের শরীর থেকে একটি সুস' কিডনী অপারেশনের মাধ্যমে রোগীর শরীরে প্রতিস'াপন করা।
আমাদের দেশে কিডনি ডোনার পাওয়া খুব একটা সহজ নয়। তাছাড়া এই চিকিৎসার যা ব্যায় তা এদেশের ৯৫ শতাংশ লোকের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়।
কিডনি রোগ প্রতিরোধের উপায়
এটা পরীক্ষিত যে, এসিই-ইনহেবিটরস এবং এআরবি জাতীয় উচ্চ রক্তচাপের ওষুধ কিডনি রোগ প্রতিরোধে খুবই কার্যকর। ঠিক তেমনি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখা মাইক্রো-অ্যালবুমিন ধরা পড়লে জরুরীভিত্তিতে চিকিৎসা করা প্রয়োজন। এছাড়া নিয়মিত ব্যায়াম, ফাস্টফুড না খাওয়া, চর্বি জাতীয় খাবারের প্রতি নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা গেলে কিডনি রোগ প্রতিরোধ সম্ভব।
এছারাও ক্ষেত্রবিশেষে চর্বি নিয়ন্ত্রণকারী ওষুধ খেলে, ধুমপান না করলে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা যায় এবং এর সঙ্গে সম্পর্কিত হৃদরোগ থেকেও রেহাই পাওয়া যায়।
প্রস্রাব প্রদাহ কিডনীর একটি সাধারন রোগ হলেও শিশুদের ক্ষেত্রে মারাত্বক হতে পারে।
কিডনী রোগ প্রতিরোধে আরো কিছু তথ্যঃ
►শতকরা ৩০-৪০ ভাগ ডায়াবেটিস রোগী কিডনি রোগে ভুগে থাকে।
►উচ্চ রক্তচাপের কারণে ২০-৪০ ভাগ রোগীর কিডনি অকেজো হতে পারে।
►ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখুন এবং কিডনি রোগ থেকে বাঁচুন।
►শুধুমাত্র রক্তচাপ, প্রস্রাব পরীক্ষা এবং রক্তের ক্রিয়েটিনিন ও সুগার পরীক্ষা করেই জানা যায় কিডনি রোগ আছে কিনা ?
►কিডনি সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে গেলে ডায়ালাইসিস অথবা কিডনি সংযোজনই হল বেঁচে থাকার একমাত্র উপায়।
►শিশুদের টনসিলাইটিস, প্রস্রাবে প্রদাহ ও চর্মরোগের তাৎক্ষণিক চিকিৎসা করুন।
কিডনি রোগীদের সচেতন করে এবং প্রাথমিক পর্যায়ে এ রোগ সনাক্তকরণের সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসার ব্যবস'া করলে লক্ষ লক্ষ কিডনি রোগীর কিডনি সম্পূর্ণ নষ্ট হওয়া থেকে অনেকাংশে রক্ষা পাবে। পাশাপাশি কিডনি অকোজো রোগীরা ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজনের বিশাল খরচ থেকে মুক্তি পাবে।
প্রেক্ষাপট বাংলাদেশঃ
পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশে বর্তমানে প্রায় ২০ মিলিয়ন লোক বিভিন্নরকম কিডনীর অসুখে ভুগছেন।
তার মধ্যে ৪০ হাজার লোক প্রতিবছর মারা যা"েছন । এদেশের মাত্র ৬ শতাংশ কিডনী রোগী চিকিৎসার আওতায় আসেন। বাকীরা মারা যান বিনা চিকিৎসায়।
কিডনী বিকল রোগে আক্রান্ত হলে বেঁচে থাকার দুটি উপায়- ডায়ালাইসিস ও কিডনী প্রতিস্থাপন। এ চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল এবং সুযোগও সীমিত।
এ কারণে অধিকাংশই এ রোগের চিকিৎসা করাতে ব্যর্থ হয়। সারা দেশে সরকারি- বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মিলিয়ে হেমোডায়ালাইসিস যন্ত্র আছে সাড়ে পাঁচশ’র কিছু বেশী, যা দিয়ে সর্বসাকুল্যে তিন হাজার রোগীর ডায়ালাইসিস করা সম্ভব। কিডনী বিকল হওয়া রোগীদের বাঁচিয়ে রাখার অপর বিকল্প হচ্ছে কিডনী প্রতিস্থাপন বা ট্রান্সপ্লান্ট। প্রতিস্থাপন আরও ব্যয়বহুল। সাধারণত রোগীর আত্মীয় স্বজন এ অবস্থায় কিডনী দান করে থাকেন।
সরকারী প্রতিষ্ঠানে এক লাখ ও বেসরকারী প্রতিষ্ঠানে সর্বোচ্চ আট লাখ টাকার মতো খরচ হয়ে থাকে।
তবে এদেশের সরকারী হাসপাতালের পাশাপাশি বেসরকারী হাসপাতালগুলিও যদি এগিয়ে আসে ,বিশেষ করে নিয়মিত ডায়ালাইসিস করতে হয় এমন রোগীর ক্ষেত্রে যদি বিশেষ ছাড় দেওয়া হয় তাহলে হয়তো অনেকটাই সহজ হতো।
ঋণ স্বীকারঃ
১. অধ্যাপক হারুন আর রশিদ
সভাপতি, কিডনি ফাউন্ডেশন ও বাংলাদেশ রেনাল এসোসিয়েশন
২.ডাঃ রানা মোকাররম হোসেন
সহযোগী অধ্যাপক,
কিডনী বিভাগ,
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
৩.ডাঃ গুলজার হোসেন উজ্জ্বল
সিএমও এন্ড ইনচার্জ,
ডায়ালাইসিস ও নেফ্রোলজী ইউনিট
আয়েশা মেমোরিয়াল হাসপাতাল,মহাখালী,ঢাকা
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।