এক শব্দহীন শব্দের শাব্দিক অনুভূতি
বিবেক যখন কথা বলেনা
আমাদের পাড়ায় একটা পাগলি ছিলো। হঠাৎ করেই একদিন উদয় হলো। পুরোদস্তুর পাগল ছিলো, তার উপর ভরা যৌবন। কি কাপড়ে, কি আচরণে, কোন কিছুতেই তার কোন কিছু ঠিক ছিলো না। সব পাড়ার লোকেরা তাকে তাড়ানোর যথাসাধ্য চেষ্টা করলো।
কিন্তু কোন কাজ হলোনা। পাগলিটাকে
দেখামাত্রই লোকজন বিশেষ করে বাচ্চারা এদিক ওদিক ছুটাছুটি করতো। আমিতো এদিক ওদিক তাকিয়ে কোনদিকে যে ছুট দিবো তা ভাবতে ভাবতেই অনেক সময় পাথর হয়ে যেতাম। তবে পাগলিটা
কখনই কারোর কোন ক্ষতি করেনি। শুধু পাড়ায় পাড়ায় ঘুরে বেড়াতো আর বাজারে গিয়ে এর ওর দোকান থেকে খাবার খুঁজে নিয়ে আসতো।
ঝড়, বৃষ্টি, রোদে একাকার হয়ে ঐ আকাশের নীচেই পড়ে
থাকতো। কখনো ব্যস্ত রাস্তার পাশে, কখনো খোলা মাঠে সবুজ ঘাসের উপর নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকতো। আমি জানি না আমার মত আর কেউ এভাবে তাকে নিয়ে ভাবে কিনা !তবে আমার ভিতরে পাগলিটার সমস্ত কিছু প্রচন্ডরকমে নাড়া দিত। আমাকে ভাবিয়ে তুলতো চরমভাবে। এমনও কি হয় মানুষের জীবন? কোথায় তার আত্মীয়, পরিবার পরিজন ?কেউ কি তার কোন ব্যবস্থা করতে পারছেনা? কেউ কি তাকে একটু আশ্রয় দিতে পারেনা?এমনই অনেক জীবনপ্রশ্নের সম্মুখিন হতাম পাগলিটাকে দেখামাত্রই।
দুপুরে খাবারের পর আমাদের বাসায় নিয়ম ছিলো বিছানায় একটু গা এলিয়ে দেওয়া। আমিও শুঁইয়ে আছি কিন্তু ঘুম আসছেনা। হঠাৎ বাবা মায়ের আলাপ আমার কানে আসতে লাগলো। মা বাবাকে বলছেন,
---দেখেছো, পাগলিটার মধ্যে কেমন একটা পরিবর্তন আসছে?
---কেমন?
---কেমন যেন ফুঁলে-ফেঁপে যাচ্ছে, প্রেগনেন্ট ট্রেগনেন্ট হল কিনা !
মনে হল বাবা যেন একটু ভ্রু কুচকেই বললেন,
---কি যে বলোনা, কে করবে এমন কাজ !
মা'র বিরক্তিভরা খেদোক্তি একটু বেশি যেন কানে লাগলো আমার,
---পুরুষের আবার জাত-মাত, তাদের আবার রুচি-অরুচি আছে নাকি !যদি এমন কিছুই হয়--ছিঃ
ছিঃ ছিঃ। কী লজ্জা! ছেলেমেয়েদের সামনে এভাবে ঘুরে বেড়াবে--
বাবা মা'কে থামিয়ে দিয়ে বললনে,
---তুমি এমন করছো কেনো? ওতো একটা মানুষ, নাকি--
মা রাগতস্বরে একটু ক্ষেপেই বললেন,
---মানুষই যদি হবে তবে তার জীবন এমন হবে কেনো?
বাবা মা'র উচ্চ-বাচ্য শুনে আমার বুকের ভিতর ধড়াস করে উঠলো।
সত্যিই কি তাই? সত্যিই কি পাগলিটা প্রেগনেন্ট?কে করলো এ কাজ? এখন কি হবে পাগলিটার? ওতো নিজেই চলতে পারেনা। তাহলে? এমনই অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতে আমি কেমন যেন অস্থির হয়ে উঠলাম।
আমার হঠাৎ করে মনে পড়ে গেলো ছোটবেলার একটা ঘটনা। প্রতিদিনই কিছুনা কিছু ভিক্ষুক আসতো আমাদের বাড়িতে। তাদের মধ্যে নিয়ম করে কিছু ভিক্ষুক আসতো।
যাদের আমরা একেবারে খালি হাতে বিদায় দিতামনা। এমনই এক মাঝবয়সী ভিক্ষুক ছিল,যাকে সবাই বলে পাগল। যদিও দেখলে তাকে পাগল মনে হবেনা। খুবই ভদ্রধরনের অর্থাৎ কাপড়ে চোপড়ে মার্জিত ছিল। কথা খুব একটা বলতোনা শুধু ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকা ছাড়া।
আমার মা'য়ের তা দেখে খুব মায়া হত। তাই যখনই সে
আসত তখনই তাকে কিছু খাবার বা কিছু ভিক্ষা দিয়ে বিদায় দিতেন। তেমনি সেদিনও পাগলটা এলো। মা আমাদের বাসায় ছোট্ট একটা কাজের মেয়ে ছিল, যার নাম মিনা, বয়স বারো কি তেরো,মেয়েটিকে মা রেখেছিলেন শুধু তার সাথে কথা বলার জন্য আর ছোট খাটো ফরমায়েশ খাটানোর জন্য, আবার মেয়েটিকে একটু আধটু লেখা-পড়াও করাতেন। তাকে বললেন ভিক্ষা দিয়ে আসতে।
মিনা বাইরের গেইট খুলে যখনি ভিক্ষা দিতে গেলো তখনই পাগলটা মিনার কাছে এসে মাথায় হাত রাখলো। আমি দোতালার বারান্দায় বসে এই দৃশ্য দেখছিলাম। মিনার মাথা থেকে
পাগলের হাতটা ধীরে ধীরে নীচে নামতে লাগলো, মুখ হয়ে ঘাড়, গলা ছুঁয়ে বুকের কাছে গিয়ে থেমে থেমে নীচে আরো নীচে নেমে যেতে লাগল। আমিতো অবাক কি করছে পাগলটা?মিনাও চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। কী অবাক কান্ড !হচ্ছেটা কী!পাগলের হাতটা নীচে নামতে নামতে মিনার
নিতম্বে এসে থেমে গেলো, ঐ অবস্থায় কিছুক্ষণ থেকে মিনা ছিটকে দূরে সরে গেলো।
আর আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে রইলাম এক প্রস্ত পাথরের মত। আচমকা মায়ের চিৎকারে সম্বিৎ ফিরে পেলাম। মা মিনাকে ডাকছেন ভিক্ষে দিতে গিয়ে এত দেরী করছে দেখে।
আমি যে ওভাবে কতক্ষন বসেছিলাম দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ঠিক বলতে পারবোনা। কেবলই দৃশ্যটা ছোখে ভাসছে।
আমরা সবাই জানি লোকটা পাগল। যার বাছ-বিচার, ভালো-মন্দ নিরূপন করার ক্ষমতা নেই। মাথায় যার গন্ডগোল সেই পাগল। এই বলে সমাজ তাকে চিহ্নিত করে। আর চিহ্নিত করেই তাদের কোনঠাসা করে রাখে, বঞ্চিত করে সমাজের সবরকম সুযোগ সুবিধা আর মানবিক চাহিদা থেকে।
এই কী মনুষ্য সমাজের শিক্ষিত সুস্থ চিন্তাভাবনার প্রতিফলন?তারাও তো মানুষ !আমার ক্ষুদ্র মস্তিষ্কে কোন বোধের উদ্রেক হয়না এসব দৃশ্যের কথা মনে
করে আর আজকের এই পাগলিটার কথা শুনে।
রাতে এক ফাঁকে সুযোগ পেয়ে আমি মিনাকে ডেকে আনলাম আমার ঘরে। জিজ্ঞেস করলাম,
---এই পাগলটা তোকে কি করছিলোরে?এভাবে ধরে ধরে?
মিনা হেসে বললো,
---আমারে দোয়া দিলো। কি জানি পড়লো আর ফুঁ দিলো।
আমি একটু রেগেই বললাম,
---ঐ, এভাবে দোয়া দেওয়া বলে? তোরে ধইরা ধইরা এইডা কিসের দোয়া?
মিনা ভয় পেয়ে কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো,
---আমি বুঝছি নাকি, পাগলডা আমারে এইভাবে ধরবো!
আমি রেগে কমান্ডের স্বরে বললাম,
---আর কখনো ঐ পাগলের সামনে যাবিনা।
---ঠিক আছে।
সেদিনের পাগলের দোয়া দেওয়ার দৃশ্য আর আজকের পাগলির কাহিনী শুনে আমার আর কোন কিছুই ভালো লাগছেনা। বাবা মায়ের আলাপচারিতায় আমি কেমন যেন হতভম্ব হয়ে যাই। সত্যিই তো , এই
পাগলিটার এখন কি হবে?কে ওকে দেখা শুনা করবে? ও নিজেই তো পথের মানুষ। সময় ঠিকই গড়িয়ে যেতে লাগলো।
আর পাগলিটার পরিবর্তনও ঘটতে লাগল অতিদ্রুত। সবার দৃষ্টিতে আবিষ্কার হয়ে
গেলো পাগলিটা প্রেগনেন্ট। এ নিয়ে মহিলা মহলে বেশ কানাঘুষা চলতে লাগলো। অবশ্য পুরুষ মহলে এ নিয়ে কি রকম আলোচনা হতো তা বলতে পারবোনা। তবে একটা বিষয় বেশ লক্ষ্য করেছিলাম মহিলাদের সামনে পুরুষরা এ ব্যাপারে কোন কথাই বলতোনা।
কেমন যেন একটা ভাব,
তারা যেন কোন কিছু জানে বা বুঝেনা। এ লজ্জা যে পুরুষের তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে !
এমনই এক ঝড়ের রাত, কাল বৈশাখীর রাত। প্রচন্ড ঝড়ের আলামত চারিদিকে। ঝড়ের তান্ডবলীলায় সবাই জড়ো সড়ো হয়ে আছে যে যার ঘরে। দরজা জানালা খুলে দেখার জো নেই বাইরের কি অবস্থা।
ঝড়ের গতিবেগ এত বেশী ছিল যে সবরকম যোগাযোগ ছিন্নভিন্ন হয়ে যায়। ইলেকট্রিসিটি চলে যায়, অন্ধকারে সব কিছু কেমন ভূ্তুরে মনে হচ্ছিল। বাইরে আম কাঠাল আর সুপারি নারিকেল গাছের ভয়াবহ আছড়ে পড়ার বিকট শব্দে আমরা সবাই আতঙ্কে জবুথবু হয়ে পড়ে রইলাম। আর ভাবছিলাম আহারে আজ কতজনের ঘর বাড়ি উড়ে যাচ্ছে। পাশের ঘরে মা জায়নামজে বসে নফল নামাজ পড়ছেন।
ঝড় যাতে থেমে যায় এই বলে বড় করে মোনাজাত ধরলেন। এমনি অবস্থায় কখন যে ভোর হলো বুঝতে পারিনি।
আমার বাবা ফজরের নামাজ পড়ার জন্য মসজিদের দিকে যাচ্ছিলেন। তখনি দেখলেন সেই হৃদয়বিদারক দৃশ্য। বাবা বাসায় ফিরে এসে শুধু দীর্ঘ নিঃশ্বাসই ছাড়লেননা,কেমন যেন দম মুখ খিঁচে পাথরের মত পড়ে রইলেন।
পাগলিটা সেই রাতে এক পুত্র সন্তানের জন্ম দিল ঠিকই, তবে
মা ও ছেলে দু'জনেই পরপারে চলে যায় এই পৃথিবীর জরা-যন্ত্রণাকে উপেক্ষা করে। পরে পুলিশ এসে তাদের সৎকারের ব্যাবস্থা করে।
আমাদের পাড়া এখন শান্ত। কারো মুখে কোন কথা নেই। সবার চোখে মুখে এক নীরব কঠিন যন্ত্রণার ছায়াপাত।
কারন বিবেক যে আর কথা বলেনা, আমরা যে সবাই বধির বিবেকের কাছে বন্দি !!!!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।