হ্যা আমি সেই সত্যবাদীকে সত্যবাদী মনে করি View this link
আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. থেকে বর্ণিত, একবার রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে ‘দব’ খাওয়া না খাওয়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি বললেন, আমি নিজে তা খাই না তবে তা খাওয়া হারামও বলি না ...। ইমাম তিরমিযি রহ. বলেন, ...আহলে ইলমের মাঝে ‘দব’ খাওয়া না-খাওয়া নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। অনেক আহলে ইলম সাহাবী ও পরবর্তী ফকীহগণ তা খাওয়ার অনুমতি দিয়েছেন। অনেকে তা খাওয়া মাকরূহ বলেছেন।
আর হযরত ইবনে আববাস রা. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দস্তরখানে ‘দব’ খাওয়া হয়েছে। তিনি ঘৃণার কারণে তা খাননি।
অনেকেই হাদীসে বর্ণিত ‘‘ضب’’ শব্দের অর্থ করে থাকেন গুইসাপ। আর তা খাওয়া যাবে কি যাবে না বা তা মাকরূহে তাহরিমি না তানযিহি এ নিয়ে ইমামদের মাঝে মতপার্থক্য রয়েছে।
এখন বিষয় হল, আমাদের দেশের গুইসাপ এবং দব কি একই প্রাণী? যদি একই হয় তাহলে এরকম একটি ইতর, হিংস্র ও বিষাক্ত প্রাণী খাওয়া না-খাওয়া নিয়ে মতপার্থক্য হবে কেন? অথচ সকল ফকীহ এ বিষয়ে একমত যে, সব ধরনের বিষাক্ত ও হিংস্র প্রাণী খাওয়া হারাম।
গুইসাপ দেখলেই ঘৃণা ও ভয় লাগে; খাওয়া তো দূরের কথা।
আর যদি দব ও গুইসাপ এক না হয় তাহলে আমাদের জানতে হবে ‘দব’ নামক প্রাণীটি কী এবং গুইসাপের সাথে তার মিল-অমিল কোথায়?
‘দব’ মূলত আরবের মরুভূমির একটি প্রাণী । সুতরাং আরবী অভিধান থেকে আমরা ‘দব’ এর পরিচয় জেনে নিতে পারি।
প্রসিদ্ধ আরবী অভিধান ‘আল মুজামুল ওয়াসীত’-এ ‘দব’ এর পরিচয় দেয়া হয়েছে এভাবে-
الضب حيوان من جنس الزواحف من رتبة العظاء، غليظ الجسم خشنة، و له ذنب عريض حرش أعقد، يكثر في صحراء الأقطار العربية.
‘দব’ হলো সরীসৃপজাতীয় বুকে ভর দিয়ে চলা একটি প্রাণী। যার শরীরের চামড়া পুরু ও অমসৃণ।
তার লেজ চওড়া যা রুক্ষ, খসখসে ও অতি গিটবিশিষ্ট। আরব মরুভূমিতে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। -আল মুজামুল ওয়াসীত পৃ.৫৩২
আর আমরা যাকে গুইসাপ বলি তা আরবী ورل (ওয়ারাল) নামক প্রাণীর বর্ণনার সাথে হুবহু মিলে, ضب (দব)এর সাথে নয়। আরবী অভিধানে ‘ওয়ারাল’ এর পরিচয় দেয়া হয়েছে এভাবে-
الورل حيوان من الزحفات طويل الأنف والذنب دقيق الخصر، لا عقد في ذنبه كذنب الضب، و هو أطول من الضب أقصر من التمساح، يكون في البر و الماء، يأكل العقارب و الحيات و الحرابي و الخنافس، و العرب تستخبثه و تستقذره فلا تأكله.
ওয়ারাল হল সরীসৃপজাতীয় একটি প্রাণী, যার নাক ও লেজ সুদীর্ঘ। কোমর সরু ও চিকন।
দবের লেজের মত তার লেজে কোনো গিট নেই। তার দেহের দৈর্ঘ্য দবের চেয়ে বড়, কুমিরের চেয়ে ছোট। এরা জল ও স্থল উভয়স্থানে চলাচল করে (উভচর প্রাণী)। এরা বিচ্ছু, বিষাক্ত কীট-পতঙ্গ, সাপ, গিরগিটি, গোবরপোকা ইত্যাদি আহার করে থাকে। আরবরা ওয়ারালকে ঘৃণা করে এবং নিকৃষ্ট মনে করে এবং তা খায় না।
-আল মুজামুল ওয়াসীত পৃ.১০২৭
আরবী বিভিন্ন অভিধানে ‘দব’ এবং ‘ওয়ারাল’ দুটো প্রাণীরই ছবি দেয়া আছে। তা দেখলেই স্পষ্ট বোঝা যায় যে, ‘দব’ এবং ‘ওয়ারাল’ দুটো আলাদা প্রাণী। এছাড়া এ দুই প্রাণীর পরিচয় থেকেই স্পষ্ট হয়ে যায় যে, দুটো ভিন্ন ভিন্ন প্রাণী।
আরবী ভাষার সুপ্রাচীন ও নির্ভরযোগ্য অভিধান ‘লিসানুল আরব’-এ আল্লামা ইবনে মানযুর রহ. বিষয়টি আরো স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন। তিনি লিখেছেন-
(ضب) الضب دويبة من الحشرات معروف وهو يشبه الورل ... قال أبو منصور : الورل سبط الخلق طويل الذنب كان ذنبه ذنب حية ورب ورل يربي طوله على ذراعين، وذنب الضب ذو عقد وأطوله يكون قدر شبر والعرب تستخبث الورل وتستقذره ولا تأكله. وأما الضب فإنهم يحرصون على صيده وأكله.
দব একটি ছোট প্রাণী, যা দেখতে ওয়ারালের মত।
... আবু মানসূর বলেন, ওয়ারাল হল সুগঠিত দেহের অধিকারী একটি প্রাণী। তার লেজ লম্বা; দেখতে সাপের লেজের মত। কোনো কোনো ওয়ারাল দুই হাতেরও বেশি লম্বা হয়। আর দবের লেজ গিটবিশিষ্ট এবং তা সর্বোচ্চ এক বিঘত লম্বা হয়। আরবরা ওয়ারালকে ঘৃণা করে ও নিকৃষ্ট মনে করে।
ফলে তা খায় না। আর দব শিকার করতে ও খেতে পছন্দ করে। (দ্র. লিসানুল আরাব, খ.৮ পৃ.৮ মাদ্দা: ضبب)
আরো দেখুন- তাজুল আরূস খ.১ পৃ.৩৪৩ (فصل الضاد،باب الباء), হায়াতুল হায়াওয়ান খ.২ পৃ. ৬৩৬।
আরবী অভিধানের পাশাপাশি হাদীসের বিভিন্ন ব্যাখ্যাগ্রন্থের ভাষ্যমতেও ‘দব’ ও ‘ওয়ারাল’ দুটি ভিন্ন প্রাণী।
সহীহ বুখারীর ব্যাখ্যাগ্রন্থ ফাতহুল বারীতে আল্লামা ইবনে হাজার আসকালানী রহ. বলেন-
قوله "باب الضب" هو دويبة تشبه الجرجون، لكنه أكبر من الجرجون، ...، و يقال للأنثى ضبة،....و يقال لأصل ذكر الضب فرعين، و لهذا يقال له ذكران.
و ذكر ابن خالويه أن الضب يعيش سبعمائة سنة، و أنه لا يشرب الماء، و يبول في كل أربعين يوما قطرة، و لا يسقط له سن، و يقال بل أسنانه قطعة واحدة، و حكى غيره أن أكل لحمه يذهب العطش، و من الأمثال "لا أفعل كذا حتى يرد الضب" يقوله من أراد أن لا يفعل الشيء، لأن الضب لا يرد بل يكتفي بالنسيم و برد الهواء، و لا يخرج من جحره في الشتاء. (راجع فتح الباري جـ ٩ صـ ٥٨٠)
হাদীসের বিখ্যাতব্যাখ্যাগ্রন্থগুলোতেও একই বর্ণনা পাওয়া যায়।
দেখুন-উমদাতুল কারী; হাশিয়াতুস সিন্দী আলা সহীহিল বুখারী; তুহফাতুল আহওয়াযী; আওনুল মাবুদ (‘দব’’ অধ্যায়)
মোটকথা, উপরের আলোচনা থেকে এ কথা স্পষ্ট যে, আরবের দব এবং আমাদের দেশের গুইসাপ দুটি ভিন্ন প্রাণী। আর আমরা আগেই বলেছি যে, ওয়ারালের সাথে আমাদের দেশের গুইসাপের মিল রয়েছে। উপরে দব ও ওয়ারালের মাঝের কিছু পার্থক্য উল্লেখ করা হয়েছে। এর সাথে আরো কিছু মৌলিক পার্থক্য লক্ষ্য করলেই বিষয়টি দিবালোকের ন্যায় স্পষ্ট হয়ে যায়। যেমন-দব একটি ছোট প্রাণী, যার লেজ সর্বোচ্চ এক বিঘত লম্বা হয় এবং তার লেজ গিটবিশিষ্ট।
আর গুইসাপ বেশ বড়। কোনো কোনোটা ৯০ সেন্টিমিটারেরও বেশী লম্বা হয় এবং তার লেজ মসৃণ, দেখতে সাপের লেজের মত। দব মরুভূমিতে বাস করে। পানির ধারে কাছেও যায় না। আর গুইসাপ জলে স্থলে ঝোপে জংগলে ও ডোবায় থাকে।
দব ফড়িং, পঙ্গপাল, পিপড়া, তাজা ঘাস ইত্যাদি আহার করে।
পক্ষান্তরে গুইসাপ বিষাক্ত কীট-পতঙ্গ, সাপ, বিচ্ছু, গিটগিটি ইত্যাদি ভক্ষণ করে। গুইসাপ দেখলেই ঘৃণা ও ভয় লাগে, খাওয়া তো দূরের কথা। আর আরবরা দব শিকার করতে ও খেতে পছন্দ করে।
দব ও গুইসাপের মাঝে এ জাতীয় আরো অনেক পার্থক্য রয়েছে, যা থেকে প্রতীয়মান হয় যে, হাদীসে বর্ণিত দব নামক প্রাণীটি আর যাই হোক গুইসাপ নয়।
এখন দবকে বাংলায় কী বলে সেটা জানা প্রয়োজন। আরবী থেকে বাংলা বা উর্দূ থেকে বাংলা লোগাতগুলোতে দব অর্থ গুইসাপ লেখে, যার সাথে দব নামক প্রাণীটির কিছু মিল আছে তবে গুইসাপ যে দব না তা দবের বিস্তারিত পরিচয় থেকে স্পষ্ট। হাঁ, আমাদের দেশে মাঝে মধ্যে হকারদের কাছে ষান্ডা নামক একটি প্রাণী দেখা যায় দবের বর্ণনার সাথে যার অনেক মিল আছে।
আমাদের উস্তাযে মুহতারাম হযরত মাওলানা মাকবুল আহমাদ ছাহেব দামাত বারাকাতুহুম তিরমিযীর দরসে যেদিন ‘দব’ এর আলোচনা এল, বললেন, ‘‘এ বিষয়টি আমার কাছে অস্পষ্ট ছিল। তারপর আমি যখন হজ্বের সফরে গেলাম তখন একদিন বাদ মাগরিব মসজিদে নববীর সেহেনে বেশ কয়েকটি ইলমী মজলিস দেখতে পেলাম।
আমি রওজায়ে আতহারের ঠিক সন্নিকটে উপবিষ্ট একটি মজলিসে গিয়ে বসলাম। সেখানে একটি আসনে বসে আছেন একজন শায়েখ। সকলে তাঁকে তিলাওয়াত করে শুনাচ্ছে। একপর্যায়ে আমিও তিলাওয়াত করলাম। শায়েখ শুনে খুশি হলেন ও প্রশংসা করলেন।
এই সুযোগে আমি আমার পরিচয় দিলাম এবং শায়েখকে দব সম্পর্কে প্রশ্ন করলাম।
তিনি বললেন, তুমি ‘দব’ প্রাণীটি দেখেছ?
বললাম, অবশ্যই। আমাদের দেশে এর সংখ্যা অনেক। আমরা সচরাচরই এই প্রাণী দেখে থাকি।
তিনি আমার কথা শুনে আশ্চর্য প্রকাশ করে বললেন, কী বলছো তুমি?! এই প্রাণী তোমরা কী করে দেখবে? এই প্রাণী তো বাস করে মরুভূমিতে।
বিশেষ করে আরব মরুভূমিতে। এগুলো নিয়ে আমাদের শিশুরা খেলা করে। মক্কার বাজারে এগুলো প্রচুর পরিমাণে দেখতে পাবে। আর তুূমি যার কথা বলছো তাকে ‘ওয়ারাল’ বলা হয়, ‘দব’ নয়। সেখান থেকে আমি মক্কার বাজারে গেলাম।
এবং সচক্ষে প্রাণীটি দেখলাম। ’’
শেষ কথা, দব ষান্ডা বা অন্য যাই হোক দবকে গুইসাপ বলা ঠিক নয়। সুতরাং এর সঠিক বাংলা না জানা পর্যন্ত দবকে দব বলাই বোধ হয় উত্তম।
মূল লেখাটি মাওলানা মুহাম্মাদ রফিকুল ইসলাম লিখেছেন,
গবেষণামূলক উচ্চতর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান মারকাযুদ্ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা-এর মুখপত্র মাসিক আলকাউসার
ফেব্রুয়ারি ২০১৩, রবিউল আওয়াল-রবিউস সানী ১৪৩৪ সংখ্যাতে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।