আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

কে ঘুমাতে দেয় না আমায়??

সত্যের কাছে মিথ্যে চিরকালই পরাজিত

কাঠবিড়ালীর কবিতা পড়েছি, কখনো দেখিনি আগে, জানালা দিয়ে তাকিয়ে গাছের ডালগুলোয় কাঠবিড়ালীর ছুটোছুটি দেখছি অপলক চোখে। কখন যে চোখ আকাশের দিকে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছে টের পাইনি। তারাগুলোয় চোখ ফিরে ফিরে চেনা আকাশ খুঁজে পেলো। অচেনা এক পরিবেশে সব কিছু যখন অপরিচিত তখন ঐ দূরের আকাশ টা কেই খুব কাছের মনে হচ্ছে। দখিনা জানালা দিয়ে, কখন ও বা বারান্দায় বসে অসীম আকাশের সীমানা খোঁজার চেষ্টা করে কখনই ক্লান্ত হইনি।

যখন বিদ্যুত চলে যেত বারান্দায় বসে চাঁদের স্নিগ্ধ আলো গায়ে মাখার সেই সময় গুলো মনের মাঝে দোলা দিয়ে যাচ্ছে বারবার। এখানে জানালার গ্রিল নেই, কাচেঁর ঘরে বন্দী বলে মনে হচ্ছে। সেই দখিনা বাতাস নেই। ঘরে এসি চলছে, গরমের বালাই নেই। অন্ধকার রাত্রিতে খালি গায়ে বাতাসের স্পর্শ নেয়ার চেষ্টা করতে হচ্ছে না।

দখিনা ঘর ছিলো আমার। পূর্বে আর দক্ষিনে খোলা জানালা। তৃতীয় তলায় থাকি বলে বাতাস ও আসতো প্রচুর। পূর্ব দিকের জানালা দিয়ে নিচে তাকালেই চোখে পড়তো সেই মানুষগুলোকে, নিত্যকার যুদ্ধ যাদের জীবনে। ঝুপড়ী ঘর বললে হয়তো বুঝানো যাবে না।

৮ফুট-৮ফুট মাপের একেকটা ঘর, চতুর্দিকে টিনের বেড়া, কোন ও ফাঁক ফোকর নেই যে একটু বাতাস ঢুকতে পারে। যখন ঘরগুলো তৈরী হচ্ছিলো তখন গাঁ শিউরে উঠেছিলো,মনে হচ্ছিলো কেউ এই ঘরে থাকতে চাইবে না, কিন্তু না অতিদ্রুতই ঘর গুলো জনপূর্ন হয়ে গেল। এটা ছিলো এক ৬তলা বাড়ির পেছনের বাগান , যেখানে বাড়ির মালিকেরই এই বস্তি এখন। সন্ধ্যা হওয়ার সাথে সাথে সারাদিনের ক্লান্তি শেষে মানুষগুলো ঘরে ফিরতে শুরু করেছে। বিদ্যুত নেই তাই যে যার ঘরের দুয়ারে বসে একটু বাতাস খোঁজার চেষ্টা করছে।

বারান্দায় বসে আছি, এর ই মধ্যে তাদের গল্প করার আওয়াজ কানে বাজতে শুরু করেছে, কিছুক্ষনের মধ্যে তুমুল ঝগড়া লেগে গেলো। শুনে বুঝতে পারছি, কারো একজনের ১০/১১ বছরের ছেলেকে অন্য একজন সিগারেট খেতে দেখে শাসন করতে চেয়েছে, ওই ছেলের মায়ের যুক্তি "আমার পোলা টাকা কামাই করে, যা খুশি খাইবো তাতে আপনের লাগে কা"। এভাবেই এক কথায় দু কথায় বিরাট ঝগড়া বেধেঁ গেলো। ঘন্টা খানেক চললো। এভাবেই প্রতিদিন ছোট বড় ঝগড়া লেগেই থাকে।

কখনো পাওনাদার, কখনো সুদখোর মহিলাদের সীমা ছাড়ানো কুৎসিত গালিগালাজ, সেই থেকে বড় রকমের ঝগড়া। কখনো দুই মহিলার ঝগড়া, কেউ কাউকে বটি নিয়ে তেড়ে যাচ্ছে। কখনো স্বামী স্ত্রীকে চুলের মুঠি ধরে যেভাবে মারছে তাতে মনে হয় তার অল্প উপার্জনের জন্য, সন্তানের চিৎকারের জন্য, বিদ্যুত না থাকার জন্য, অসহ্য গরমে ঘুমাতে না পারার জন্য সেই দায়ী? জানালা দিয়ে অক্ষম মানুষের মত ঘাপটি মেরে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখেছি। কেউ হয়তো বলতে পারেন উপভোগ করেছি!! এর ই মাঝে উপরতলা থেকে কেউ একজন খাবারের উচ্ছিষ্ট ছুড়ে ফেলেছে তাদের টিনে অমনিতেই উচ্চস্বরে গালিগালাজ শুরু হয়ে গেছে, অবাক হয়ে দেখলাম সবগুলো মানুষ এক হয়ে কিভাবে ধীক্কার দিচ্ছে সেই উপরতলার মানুষ গুলোকে। কখনো উপরে এসে শাঁসিয়ে যাওয়ার সাহস দেখিয়েছে।

রাত ১২ টা। সবাই ঘুমাতে চলে গেছে, আমি সবসময় ই ১২ টার আগেই ঘুমাতে যাই। কখন ই দরজা জানালা লাগিয়ে ঘুমাতাম না, সবসময় খোলা থাকত। হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে গেলো প্রচন্ড হাসির শব্দে! শুয়ে শুয়ে শুনতে পেলাম বাংলা সিনেমার দিলদারের কন্ঠ। কিছুক্ষন পর পর ই হাসিতে ফেটে পড়ছে ঘরের ভেতরের মানুষ গুলো।

নিঝুম রাত তাই শব্দ টা একটু বেশী ই কানে বাজছে। উঠে বসলাম, জানালা দিয়ে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম কোন ঘরটা তে আলো জ্বলছে? এ তো সেই ঘর যে ঘরের পুরুষ লোকটি কিছুক্ষন আগে অন্যের সাথে না পেরে নিজের বউকে চুলের মুঠি ধরে শরীরের প্রচন্ড শক্তি দিয়ে টেনে হিচঁড়ে ঘরের ভেতরে নিয়ে গেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে ভাবছি কতগুলি মানুষের সশব্দ হাসি আমাকে ঘুমাতে দিচ্ছে না কেন? এর মধ্যে আবার হাসির শব্দ কানে এল, তাকাতেই দেখি সেই কিশোরী যার মায়ের সাথে একটু আগেই এদের ঝগড়া লেগেছিলো। অপার বিস্ময়ে তাকিয়ে আছি, আর ভাবছি এদের জীবনের সবটুকুই তো স্বার্থক? জীবনের প্রতিটা ক্ষন এরা উপভোগ করছে, জীবনের রঙ এ এরা রঙ্গীন। এরা জীবনের এত উচ্ছলতা পায় কি করে? উত্তর নিজের কাছেই পেলাম।

এরা রস আস্বাদন করতে জানে। ওরা বাংলা সিনেমার আনন্দের দৃশ্য দেখে উদ্বেলিত হয়, আমরা নাক সিটকাই অমুকের অভিনয় ভালো হইছে তমুকের টা হয় নাই? কষ্টের দৃশ্য দেখে অশ্রু সংবরন করে না, বয়ে যেতে দেয় আপনমনে, আমরা জানি এটা অভিনয় তাই মন কে নাড়া দেয় না? তীব্র ক্ষোভে প্রিয়জন কে প্রচন্ড আঘাত করতে জানে, জানে পরম মমতায় আলিঙ্গন করতে, আমরা খুব সহজেই প্রিয়জন কে দূরে ঠেলে দিয়ে নতুন প্রিয়জন খুঁজে নিতে জানি? জানে প্রতিবেশীর অন্যায়ে প্রতিবাদ করতে, আবার সুখগুলোকে ভাগ করে নিতে কার্পণ্য করে না এতটুকু, আমরা জানি না পাশের বাড়ীতে বা পাশের ফ্ল্যাটে হয়তো খুন হয়েছেন কারো প্রিয়জন? কিছুদিন আগেই এই বস্তিতে একটা বিয়ে হয়েছে, কোন বিজলী বাতি ছিল না, ছিল না কোন সাজসজ্জা। দুপুরে শুয়েছি মাত্র, অমনি গ্রামের সেই বিয়ের গান ভেসে আসলো এক মহিলার কন্ঠ থেকে, যে গান ছোট বেলায় গ্রামের বাড়িতে ফুপুর বিয়েতে শুনেছিলাম, নানী দাদীদের মুখে। চেয়ে দেখলাম, প্রতিটা ঘর থেকে একেকজন একেক কিছু নিয়ে এসে বাজনা বাজাচ্ছে আর কোমর দুলিয়ে নাচছে। এভাবেই এদের জীবন বয়ে চলে কখন ও শান্ত নদীর মত, কখন ও অস্থির তরঙ্গের মত।

এসব ভাবতে ভাবতেই আবার ঘুম চলে এল। হঠাৎ আবার ঘুম ভেঙ্গে গেল!চারটা বাজে। ভোর হতে এখনো অনেক দেরি। টিউবয়েলের পানি তোলার শব্দ কানে আসছে। দিনের বেলা পানি পাওয়া যায় না তাই অনেক রাতে পানির জোগাড় করে রাখতে হয়।

টিউবয়েলের শব্দে কানে তালা লেগে যাবার জোগাড়, আস্তে আস্তে অবশ্য একটা ছন্দে রুপ নিল এই শব্দ। বিরক্তি কমে গেল। কাত হয়ে শুয়ে পড়তেই কানে ভেসে এলো সুমধুর শব্দ "আস-সালাতু খাইরুম মিনান নাউম".-----"ঘুম হইতে নামাজ উত্তম"। এভাবেই কেটেছে জীবনের অনেক রাত। সেই রাতগুলো ভেবে এখন ও নিদ্রা কেটে যায় আমার, শত সহস্র মাইল দূরের সেই মানুষ গুলো জানতে ও পারেনা, তাদের সুখ দুঃখ এখন ও ঘুমোতে দেয় না প্রাসাদে থাকা মানুষ গুলোকে।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।