গত কয়েক বছরে অনেকগুলো ভবনধসের ঘটনা আমরা দেখছি। বিশেষ করে, ঢাকা মহানগরের আশপাশে অনেকগুলো শিল্পপ্রতিষ্ঠানের ভবন ধসে কয়েক শ মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। আহত হয়েছেন হাজার হাজার। প্রতিটি ঘটনা বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখব যে প্রায় সব ক্ষেত্রেই ভবনের মালিকপক্ষ বা কারখানার মালিকের গাফিলতিই দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। বাংলাদেশে ভবন তৈরিসংক্রান্ত ‘ইমারত নির্মাণ বিধিমালা’ নামে যে আইন আছে, অনেক ক্ষেত্রেই তা মানা হচ্ছে না।
২৪ এপ্রিল সাভারের রানা প্লাজা নামের ভবনটি ধসে এখন পর্যন্ত প্রাণহানির সংখ্যা ২০০ ছাড়িয়ে গেছে। আহত হয়েছেন হাজারের অধিক মানুষ, যাঁদের অনেককে সারা জীবনের জন্য পঙ্গুজীবন কাটাতে হবে। বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদ ও চিত্র দেখে এটা যে কেউ-ই বুঝতে পারবেন, এ ভবনটি বানানোর ক্ষেত্রে ভবন নির্মাণ ও ব্যবহারের যে আইন ও নীতিমালা রয়েছে, তা এখানে মানা হয়নি।
আমরা জানতে পেরেছি, ভবনটি নির্মাণের জন্য সাভার পৌরসভা থেকে অনুমোদন নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ঢাকা মহানগর ইমারত বিধিমালা ২০০৮-এ রাজউকের আওতাধীন এলাকাগুলো চিহ্নিত করে যে মানচিত্র ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে, তাতে এটা পরিষ্কার, সাভার পৌরসভা এ অনুমোদন দেওয়ার ক্ষমতাপ্রাপ্ত কর্তৃপক্ষ নয়।
ফলে রাজউকের অনুমোদন ছাড়া এ ভবন নির্মাণকাজ শুরু করা অথবা ব্যবহার করার কোনো সুযোগ নেই। ফলে রানা প্লাজার নির্মাণ ও ব্যবহারের বিষয়টি সম্পূর্ণ বেআইনিভাবে হয়েছে ও হচ্ছিল।
দ্বিতীয়ত, পত্রপত্রিকা ও গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী জানা গেছে, সাভার পৌরসভা কর্তৃপক্ষ একটি ছয়তলা ভবন নির্মাণের অনুমতি দিয়েছিল। কিন্তু আমরা দেখছি যে রানা প্লাজা একটি নয়তলা ভবন। ছয়তলা ভবনের কাঠামোর ওপর আরও তিনতলা কীভাবে তৈরি হলো, তা অবশ্যই তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
রানা প্লাজার এ ট্র্যাজেডির আরেকটি দিক হলো, ভবনটি ধসে পড়ার আগের দিন ফাটল দেখা যাওয়ায় কর্মরত সব শ্রমিককে ভবনের বাইরে যাওয়ার জন্য বলা হয়। গণমাধ্যম সূত্রে আমরা জানতে পেরেছি, স্থানীয় শিল্প পুলিশ ও বিজিএমইএর পক্ষ থেকে বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলীদের দ্বারা পরীক্ষা-নিরীক্ষা ছাড়া ভবনটি ব্যবহার না করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু আগের দিনের এ সতর্কবার্তা উপেক্ষা করে ভবনের মালিক এবং কারখানাগুলোর মালিক জোর করে শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বাধ্য করেন। ফলে তাঁরা জেনেশুনে কয়েক হাজার মানুষের জীবনকে এক বিরাট ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দেন। এ ঘটনা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় হিটলারের নাৎসি বাহিনী যেভাবে হাজার হাজার বন্দীকে গ্যাস চেম্বারে ঢুকিয়ে হত্যা করেছিল, সে কথাই আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে।
আমাদের দুর্ভাগ্য হলো, গত কয়েক দশকে বিভিন্ন ভবনধসের ঘটনার পর এক বা একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হলেও তার বেশির ভাগের প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়নি। প্রকাশ করা হলেও সুপারিশমালায় উল্লিখিত দায়ী ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের ঘটনা না ঘটে, তার জন্য কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি।
এবারও দেখলাম, একাধিক তদন্ত কমিটি কার্যক্রম শুরু করেছে। কিন্তু অতীতে আমাদের যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে আমার আশঙ্কা, এবারও এ প্রতিবেদনগুলো প্রকাশ বা দোষীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হবে না।
হলেও আইনের ফাঁকফোকর গলে তাঁরা বেরিয়ে যাবেন ও নির্বিঘ্নে জীবনযাপন করবেন।
ধ্বংসপ্রাপ্ত ভবনটির ছবি দেখে এবং গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদ দেখে আমার মনে হয়, এ ভবনের নকশায় যেমন ত্রুটি ছিল তেমনি অত্যন্ত নিম্নমানের, বিশেষ করে ইস্পাত ও কংক্রিট ব্যবহূত হয়েছে। এ ছাড়া বাংলাদেশ বিল্ডিং কোড অনুসারে এ ধরনের বহুতল ভবনে বিম বা কলামের সংযোগে যে ধরনের এনফোর্সমেন্ট ব্যবহার করার কথা, তা করা হয়নি।
এবার আসি উদ্ধারকাজ প্রসঙ্গে। উদ্ধারকাজ পরিচালনায় সামরিক বাহিনী ও ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স কর্মীদের নিয়োজিত করা হয়েছে।
তাঁরা দুর্ঘটনার পর থেকে নিরলসভাবে উদ্ধারকাজ পরিচালনা করে যাচ্ছেন। প্রায় আট বছর আগে সরকার আমাকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করেছিল। যে কমিটির উদ্দেশ্য ছিল ধসে পড়া ভবনের ভেতর থেকে উদ্ধারকাজের জন্য কী ধরনের যন্ত্রপাতি ক্রয় করা প্রয়োজন, তার সুপারিশমালা তৈরি করা। আমাদের কমিটি একটি তালিকা করে দিয়েছিল। সরকার কিছু যন্ত্রপাতি ক্রয় করেছিল।
এ যন্ত্রপাতির কিছু অংশ সেনাবাহিনীকে দেওয়া হয়েছিল আর বাকি অংশ দেওয়া হয় ফায়ার সার্ভিসকে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল কংক্রিট কাটার যন্ত্র ও ধসে পড়া ভবনে কেউ জীবিত আছে কি না, তা দূর থেকে নিরূপণ করার যন্ত্র। রানা প্লাজায় উদ্ধার কার্যক্রমে এ ধরনের কোনো যন্ত্র ব্যবহার করতে দেখা যাচ্ছে না। এ ছাড়া বাংলাদেশ জাতিসংঘ উদ্ধারকারী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল সার্চ অ্যান্ড রেসকু অ্যাডভাইজরি গ্রুপ (আইএনএসএআরএজি) মাধ্যমে আমাদের পাশের দেশ থেকে উদ্ধারকাজ পরিচালনার জন্য সহায়তা চাইতে পারত। প্রসঙ্গত, ভারতে ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স (এনডিএফ) ইতিমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং তাদের একটি দল কলকাতায় রয়েছে।
আরেকটি দিক উল্লেখ করতে চাই, প্রায় প্রতিটি ভবন নির্মাণে বা কারখানা পরিচালনায় অর্থায়নে কোনো না কোনো ব্যাংক জড়িত থাকে। সেসব ব্যাংকের অর্থায়নের আগে যদি সেসব ভবনের যথাযথ কর্তৃপক্ষের অনুমোদন রয়েছে কি না অথবা বিল্ডিং কোড অনুযায়ী ডিজাইন ও নির্মাণ করা হচ্ছে কি না, তাহলে এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা এড়ানো সম্ভব হবে।
মালিকপক্ষের গাফিলতির সঙ্গে সরকারি যেসব প্রতিষ্ঠানকে আইন অনুযায়ী ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, দায়িত্ব পালনে তাদের অবহেলা রয়েছে। আমাদের সরকারগুলো অনেক সময় অনেক প্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের ক্ষমতা দেয় কিন্তু তা প্রয়োগের জন্য যে ধরনের যথাসংখ্যক শিক্ষিত ও প্রশিক্ষিত জনবলের প্রয়োজন, তার জন্য অর্থায়ন করে না। এ অজুহাতে বিভিন্ন সংস্থা তাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ পাচ্ছে।
আমি মনে করি, রানা প্লাজা ধসের ঘটনার একটি বিচার বিভাগীয় তদন্ত হওয়া প্রয়োজন।
জামিলুর রেজা চৌধুরী: প্রকৌশলী ও নগর পরিকল্পনাবিদ। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।