[সিরাজ সিকদারকে নিয়ে এ পর্যন্ত কম লেখা হয়নি। বেশীরভাগ লেখাই মনে হয়েছে, কোনো দলীয় স্বার্থ পূরণের জন্য। আবার ব্যক্তি সিরাজের জীবন নিয়ে ঘাঁটাঘাটি করে অনেকে তার বিপ্লবীত্বকে খাটো করেছেন। তারা আসলে তার আত্নত্যাগকেই কটাক্ষ করেছেন। প্রচলিত এই সব দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে বলে ধারাবাহিকের শিরোনামে 'অন্য আলোয় দেখা' কথাটি যুক্ত করা হয়েছে।
আর এটি মোটেই সিরাজ সিকদারের সংক্ষিপ্ত জীবনী বা তার কর্মকাণ্ডের সামগ্রীক মূল্যায়ন নয়। বরং এটি ভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে নির্মোহভাবে এই শহীদ দেশপ্রেমিক বিপ্লবীকে দেখার একটি ছোট্ট প্রয়াস। ]
তৃতীয় পর্ব
কোনো কোনো মৃত্যু আছে তাই পাহাড়ের ওজনের চেয়েও ভাড়ি; কোনো কোনো মৃত্যু আছে বেলে হাঁসের পালকের চেয়েও হালকা...মাওসেতুং।
কোথায় আজ সিরাজ সিকদার?
সাতের দশকের নকশাল নেতা আজিজ মেহের বলছেন, ১৯৭৩ ও ১৯৭৪ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের দিনে সর্বহারা পার্টি সারাদেশে হরতালর ডাক দেয়। পার্টির মুখপত্র 'স্ফুলিঙ্গ' ও প্রচারপত্রে বলা হয়, ১৬ ডিসেম্বর হচ্ছে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী শক্তির কাছে মুজিব সরকারের আত্ন সমর্পণ দিবস।
একমাত্র জনযুদ্ধের মাধ্যমেই জনগণের বিপ্লবী সরকার প্রতিষ্ঠা করে প্রকৃত বিজয় আসতে পারে। মাওবাদীদের বিরুদ্ধে মুজিব সরকারের ব্যপক দমন-পীড়ন, হত্যা-নির্যাতনের প্রতিবাদে সর্বহারা পার্টি ঢাকায় হরতাল আহ্বান করলে সন্তোষ থেকে মওলানা ভাসানী বিবৃতি দিয়ে একে সমর্থণ করেন। হরতাল সফল হয়। ...সশস্ত্র কার্যক্রমের মুখে মুজিব সরকার নকশাল ও সর্বহারা পার্টি নিধনে ব্যপক তৎপর হয়। সর্বহারা নেতা সিরাজ সিকদার পার্টির অন্তর্দ্বন্দ্বে ধরা পড়েন।
মুজিব সরকার তাকে বন্দী অবস্থায় গুলি করে হত্যা করেন। ...এটি ছিলো ১৯৭২-৭৫ এ মাওপন্থী নিধনযজ্ঞের একটি ধারাবাহিকতা মাত্র।
এদিকে বিশ্বখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনী মাসকেরেনহাস ১৯৮৬ সালে 'বাংলাদেশ: আ লিগেসি অব ব্লাড' নামক প্রামান্য গ্রন্থে তুলে ধরেন সিরাজ সিকদার হত্যার বিস্তারিত দিক। এর আগে মুজিব সরকারের পতনের পর ১৯৭৬ সালে সাপ্তাহিক বিচিত্রায় এ সংক্রান্ত কিছু সাক্ষাতকারভিত্তিক তথ্য প্রকাশিত হয়।
বলা ভালো, মাসকেরেনহাসই প্রথম সাংবাদিক যিনি ১৯৭১ সালে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে গিয়ে লন্ডনের দি সানডে টাইমস পত্রিকায় তখনকার বাংলাদেশ ভূখণ্ডে পাক-বাহিনীর নির্মম হত্যাযজ্ঞের চিত্র তুলে ধরে ধরেন।
তার সেই নিবন্ধ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক প্রামান্যগ্রন্থ 'দ্যা রেইপ অব বাংলাদেশ' সারা বিশ্বে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করে, মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে জনমত তৈরিতে গুরুত্পূর্ণ ভূমিকা রাখে। দীর্ঘ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন এই সাংবাদিকের ছিলো একে ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দীন, শেখ মুজিবুর রহমান, জিয়াউর রহমানসহ শীর্ষ স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ।
'বাংলাদেশ: আ লিগেসি অব ব্লাড' গ্রন্থে মাসকেরেনহাস মুজিব হত্যা, তিন জাতীয় নেতা হত্যা, জিয়উর রহমান হত্যাসহ যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশের নানা নাটকীয় ঘটনা নিজস্ব অনুসন্ধান থেকে বর্ণনা করেন। এ জন্য তিনি শাতাধিক সাক্ষাৎকারও নিয়েছিলেন।
মাসকেরেনহাস বলছেন: ঘটনাচক্রে মাওপন্থী সিরাজ সিকদার ১৯৭৪ সালে ডিসেম্বরের শেষ দিকে চট্টগ্রামের কাছাকাছি এক এলাকা থেকে (টেকনাফ) শেষ পর্যন্ত পুলিশ কর্তৃক গ্রেফতার হলেন।
জাকারিয়া চৌধুরির (সিরাজ সিকদারের ছোটবোন, ভাস্কর শামীম সিকদারের স্বামী) মতে, তাকে পাহারা দিয়ে ঢাকায় আনা হলো শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করানো জন্য। শেখ মুজিব তাকে তার আয়ত্বে আনতে চাইলেন। কিন্তু সিকদার কোনো রকম আপোষ রফায় রাজী না হলে মুজিব পুলিশকে 'প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা' গ্রহণ করতে বলে দিলেন।
জাকারিয়া বললো, সিরাজ সিকদারকে হাতকড়া লাগিয়ে চোখ-বাঁধা অবস্থায় রমনা রেস কোর্সের পুলিশ কন্ট্রোল রুমে নিয়ে আসা হয়। তারপর (২ জানুয়ারি ১৯৭৫) গভীর রাতে এক নির্জন রাস্তায় নিয়ে গিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।
এই সময় সরকারি প্রেসনোটে বলা হয় যে, 'পালানোর চেষ্টাকালে সিরাজ সিকদারকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
সিকদারের বোন, জাকারিয়ার স্ত্রী শামীম জানায়, সিরাজের দেহের গুলির চিহ্ন পরিস্কার প্রমাণ করে যে, স্টেনগান দিয়ে তার বুকে ছয়টি গুলি করে তাকে মারা হয়েছিলো।
সিরাজ সিকদারকে, শেখ মুজিবের নির্দেশেই হত্যা করা হয়েছে বলে সারাদেশে রটে গেলো।
১৯ বছরের যুবতী শামীম তার ভাইয়ের হত্যার প্রতিশোধ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলো।
সে আমাকে বলেছিলো, আমি সর্বহারা পার্টির কাছ থেকে একটা রিভলবার পেয়েছিলাম এবং এই হত্যাকারীকে হত্যা করার সুযোগের সন্ধান করছিলাম।
শামীম বাংলাদেশের শ্রেষ্ঠ ভাস্করদের একজন। গত বছরই কেবল সে তার ভাস্কর্যের প্রেসিডেন্ট পুরস্কার লাভ করে। তার ধারণা, সে নিশ্চয়ই মুজিবকে গুলি করার দূরত্বে পেয়ে যাবে।
শামীম মুজিবের সঙ্গে দেখা করার জন্য বহুবার আর্জি পেশ করেছে। কিন্তু কোনো ফল হয়নি।
প্রতিবারই প্রত্যাখ্যাত হয়েছে সে। তারপর সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালযের কলা বিভাগে তার এক প্রদর্শনীতে শেখ মুজিবকে আমন্ত্রণ জানালো। মুজিব আমন্ত্রণ গ্রহণ করলেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি সেখানে উপস্থিত হতে ব্যর্থ হলেন।
সে স্মৃতিচারণ করে বললো, আমি ভায়নক বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলাম। আমি শত চেষ্টা করেও তাঁকে (শেখ মুজিব) আমার গুলির আয়ত্বে আনতে পারলাম না।
ভাগ্যই মুজিবকে বাঁচিয়ে দিয়েছিলো। শামীম জাকারিয়ার প্রেমে পড়ে যায়। শেষে তাদের বিয়ে হলে স্বামীর সঙ্গে শামীম বিদেশে চলে যায়।
এদিকে ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি সংসদ অধিবেশন বসে। সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী পাস করানোর পর তার দ্বিতীয় বিপ্লব, বাকশাল প্রসঙ্গে শেখ মুজিব অধিবেশনে বলেন , স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর যারা এর বিরোধীতা করেছে, যারা শত্রুর দালালী করেছে, কোনো দেশেই তাদের ক্ষমা করা হয় নাই।
কিন্তু আমরা করেছি। আমরা তাদের ক্ষমা করে দিয়ে বলেছি, দেশকে ভালোবাসো। দেশের স্বাধীনতা মেনে নাও। দেশের কাজ করো। কিন্তু তারপরও এদের অনেকে শোধরায়নি।
এরা এমনকি বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে বিদেশ থেকে টাকা নিচ্ছে। ওরা ভেবেছে, আমি ওদের কথা জানি না! একজন রাতের আঁধারে মানুষ মেরে যাচ্ছে, আর ভাবছে তাকে কেউ ধরতে পারবে না। কোথায় আজ সিরাজ সিকদার? তাকে যখন ধরা গেছে, তখন তার সহযোগীরাও ধরা পড়বে। ...
এরপর মুজিব, জিয়া ও এরশাদ সরকারের দমননীতির ভেতর সর্বাহারা পার্টি বহু ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়ে। এর বেশীরভাগ উপদলই আদর্শহীন সন্ত্রাসী বাহিনীতে পরিনত হয় মাত্র-- সে ইতিহাস সবার জানা।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে নিরাপত্তা বাহিনীর হেফজতে মৃত্যু/বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড/ক্রসফায়ার/এনকাউন্টার/ বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার প্রশ্নে সিরাজ সিকদারই প্রথম রাজনৈতিক নেতা কি না, যিনি স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম এমন রাষ্ট্রীয় খুনের শিকার হলেন--এ বিষয়টিও এসে যায়।
তাই আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও বাংদেশের সঠিক ইতিহাস রচনায় শুধু শেখ মুজিব, চার জাতীয় নেতা বা জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের বিচারই শুধু যথেষ্ট নয়, শহীদ দেশ প্রেমিক বিপ্লবী সিরাজ সিকদার, কর্নেল তাহের, চলেশ রিছিলসহ সব রাজনৈতিক হত্যার বিচার হওয়া জরুরি।
অ্যান্থনী মাসকেরেনহাস তার ওই বইটির শেষ বাক্যে যেমন বলেন, দুরাভিসন্ধী আর হত্যা, বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকেই চলে আসছে। এক হত্যা আরেক হত্যাকে তরান্বিত করেছে, দেশকে আবদ্ধ করেছে এক রক্তের ঋণে। ...
আর সবার আগে চাই '৭১ এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, এর আবশ্যিকতা সব প্রশ্নের উর্দ্ধে।
।
(শেষ)
---
তথ্যসূত্র: স্মৃতি শুধু স্মৃতি নয়, আজিজ মেহের, শোভা প্রকাশ, ২০০৪।
বাংলাদেশ: রক্তের ঋণ, অ্যান্থনী মাসকেরেনহাস, অনুবাদ- মোহাম্মাদ শাজাহান, হাক্কানী পাবলিশার্স, চতুর্থ মূদ্রণ-জুলাই ২০০৬।
---
ছবি: সিরাজ সিকদার, আন্তর্জাল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।