আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তিউনিশিয়া মিশরের পর গণবিপ্লবের সামনে দাঁড়িয়ে লিবিয়া

চারিদিকে দেখো চাহি হৃদয় প্রসারি

প্রতিবাদে মুখর ইয়েমেন, বাহরিন, জর্ডন, ইরাণ... তিউনিশিয়া মিশরের পর গণবিপ্লবের সামনে দাঁড়িয়ে লিবিয়া তিউনিশিয়ার এক গ্রাজুয়েট হকার ছিলেন বৌয়াজিজি। তার ফল বিক্রির গাড়িটা অন্যায়ভাবে আটক করে পুলিশ। এমন জুলুমে তিউনিশিয়ানরা অভ্যস্ত অনেককাল। সে দেশে বেন আলির ২৩ বছরের দীর্ঘ শাসনকালে গণতন্ত্রর কন্ঠস্বর পুলিশ সেনার নিপীড়ণে যেভাবে রুদ্ধ ছিল, সেটাকেই অনেকে অভ্যাস করে নিতে শিখছিলেন। কিন্তু তরতাজা যুবক বৌয়াজিজির কাছে এটা সহজে মেনে নেওয়ার ব্যাপার ছিল না।

পুলিশি জুলুমের প্রতিবাদে গায়ে আগুন দেন বৌয়াজিজি। ৪ জানুয়ারী হাসপাতালে বৌয়াজিজির মৃত্যু হয়। বৌয়াজিজির প্রতীকী প্রতিবাদ ব্যাপক জনরোষের সঞ্চার করে। দুর্নীতি, মূল্যবৃদ্ধি আর ব্যাপক দারিদ্রর বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের জমা ক্ষোভ প্রতিবাদী বিস্ফোরণ হিসেবে ফেটে পড়ে। একটা গোটা সপ্তাহ জুড়ে জনতা পুলিশ খণ্ডযুদ্ধ চলে।

রাষ্ট্রপুঞ্জের হিসাব মতো শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। সর্বস্তরে ব্যাপক প্রতিবাদের পর শেষপর্যন্ত বেন আলি দেশ ছেড়ে পালাতে বাধ্য হন ১৪ জানুয়ারী। তিউনিশিয়ার দেখানো গণপ্রতিরোধ উদ্দীপ্ত করে মিশরকে। ৩০ বছর ধরে চলা মুবারক জমানার তানাশাহীর বিরুদ্ধে সেখানে পথে নামেন মানুষ। রাজধানী কায়রোর তাহরীর স্কোয়ারে লক্ষ লক্ষ মানুষের প্রতিবাদী জমায়েত হয়, বিক্ষোভ চলে লাগাতার।

গোটা মিশর বিক্ষোভে উত্তাল হয়। অনেক টালবাহানার পর গণপ্রতিরোধ শেষপর্যন্ত মুবারককে তখত ও দেশ ছাড়তে বাধ্য করে। তিউনিশিয়া ও মিশরে গণজাগরণ ও তানাশাহীর বিরুদ্ধে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সফল বিপ্লবের প্রেরণা ছড়িয়ে পড়ছে ‘মধ্যপ্রাচ্যের’ দেশে দেশে। লিবিয়া, ইয়েমেন, বাহরিন, জর্ডন – আরব দুনিয়ায় সর্বত্রই গণবিদ্রোহের ঢেউ। এর মধ্যে লিবিয়ার পরিস্থিতি সবচেয়ে উত্তপ্ত।

সেখানে গদ্দাফির চার দশকের তানাশাহী চলছে একটানা। ব্যাপক দুর্নীতি ও একনায়কতান্ত্রিকতার প্রতিবাদে মানুষ রাজধানী ত্রিপোলী সহ মিশরাটা, বেনঘাজি, আল বায়দা, আল দামিয়া, দামহা – সর্বত্র পথে নেমেছেন হাজারে হাজারে। আর উল্টোদিকে চলছে দমনের নৃশংসতম প্রদর্শনী। শয়ে শয়ে প্রতিবাদীকে নির্বিচারে হত্যা করছে সেনা আর গদ্দাফির জল্লাদ অনুচরবাহিনী। মৃতের সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে, আর বাড়ছে প্রতিবাদ, প্রতিরোধের মাত্রা।

লাঠি দিয়ে, গুলি দিয়ে গণ আন্দোলন দমন করা যায় না, যাবে না – ইতিহাসের এই সাধারণ সত্যকে আরেকবার প্রমাণ করছেন লিবিয়ার নির্ভীক গণতন্ত্রপ্রেমী জনগণ। গদ্দাফির এক সন্তান রাষ্ট্রীয় টিভি চ্যানেলে বক্তৃতায় হুমকি দিয়েছেন লিবিয়ায় গণপ্রতিবাদ বন্ধ না হলে গৃহযুদ্ধ হবে। নির্ভীক জনগণ প্রতিবাদকে তীব্রতর করেই এই হুমকির জবাব দিয়েছেন। ২১ফেব্রুয়ারী মধ্যরাতে এই লেখার সময় খবর পাওয়া যাচ্ছে ত্রিপোলীতে যুদ্ধবিমান থেকে বোমা বর্ষণ করে নারকীয় গণহত্যা চলছে। গত এক সপ্তাহে পাঁচশোরও বেশী মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

কিন্তু নৃশংস দমননীতি সত্ত্বেও লিবিয়ার বেশিরভাগ শহরই প্রতিবাদী জনগণের দখলে এসে গেছে। ক্রমশই তীব্র হচ্ছে লিবিয়া সরকারের দমননীতির বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের চাপ। আরব দুনিয়ার একের পর এক দেশে বিদ্রোহের ঢেউ। ‘মধ্যপ্রাচ্যের’ ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্র বাহরিনএ রাজতন্ত্র উচ্ছেদের দাবীতে গণক্ষোভ ব্যক্ত হচ্ছে। এই দেশটি আমেরিকার নৌবাহিনীর ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ায় তার বিশেষ রাজনৈতিক গুরুত্ব রয়েছে।

বাহরিনে শিয়া সম্প্রদায়ের রাজনৈতিক স্বাধীনতা ও সমানাধিকারের দাবীতেই প্রথমে শুরু হয়েছিল বিক্ষোভ। সুন্নিদের তুলনায় তাদের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার অনেকটাই কম বলে তাদের মধ্যে রয়েছে এক দীর্ঘলালিত ক্ষোভ। ১৭ ফেব্রুয়ারী মানামায় প্রতিবাদের ওপর দমননীতি নামায় তার মাত্রা বৃদ্ধি পায় এবং দাবী ওঠে রাজতন্ত্রের পূর্ণ বিলোপের। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য বাহরিনে নির্বাচিত সংসদের ক্ষমতা নেহাৎই সামান্য। ‘ন্যাশানাল অ্যাকশন চার্টার অব বাহরিন’ এর দশম প্রতিষ্ঠা বার্ষিকী উপলক্ষ্যে বাহরিনের যুবসমাজ সিদ্ধান্ত নেয় শান্তিপূর্ণভাবে প্রতিবাদের মধ্য দিয়ে বাহরিনের নতুন সংবিধান রচনার দাবী তোলা হবে।

জনগণের হাতেই অর্থনৈতিক রাজনৈতিক সামাজিক অবিচার, সরকার ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতি ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দমনপীড়ণের তদন্তভার তুলে দেবার দাবী জানানোর কথা হয়। মিশর ও তিউনিশিয়ার বিপ্লবের কাছে তাদের প্রেরণার কথাও তারা ঘোষণা করে। ১৪ ফেব্রুয়ারী বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষোভকারীদের সাথে সরকারী বাহিনীর সংঘর্ষ হয়। পুলিশ বিক্ষোভ দমনে কাঁদানে গ্যাস ও রবার বুলেট ছোঁড়ে। কয়েকজন আহত হন ও একজনের মৃত্যু হয়।

মৃতদেহ নিয়ে শোভাযাত্রার সময় পুলিশ গুলি চালায়। বিক্ষোভকারীদের সংখ্যা বাড়ে। বাহরিনে প্রধান রাজনৈতিক দল আল ওয়েফাক প্রত্যক্ষভাবে বিক্ষোভে যোগ দেয়। রাজধানী মানামার পার্ল রাউন্ড অ্যাবাউট এর দখল নেয় বিক্ষোভকারীরা। টেন্ট খাটিয়ে সেখানেই তারা থাকতে শুরু করে।

১৭ ফেব্রুয়ারী পার্ল রাউন্ড অ্যাবাউট এ পুলিশী নিপীড়ণ নামানো হয়। অন্তত ২৩০ জন ভালো রকম যখম হন। আহতদের চিকিৎসাতে ডাক্তারদের বাধা দেওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ উঠেছে। ১৮তারিখ পুলিশের গুলিতে ৫জন মারা যান ও ষাট জন আহত হন। কিন্তু বিক্ষোভকারীরা পার্ল রাউন্ড অ্যাবাউট এ তাদের দখলদারী বজায় রেখে তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন ও গোটা দেশ ক্রমশ উত্তাল হয়ে উঠছে।

ইয়েমেন এর রাষ্ট্রপতি আলি আবদুল্লা সালে ক্ষমতায় রয়েছেন প্রায় ৩২ বছর। বেকারত্ম, জল ও তেলভাণ্ডারের সংকটময় অবস্থা, উত্তর ও দক্ষিণ প্রান্তে নিয়মিত অশান্তির নানা সমস্যায় দেশটি বিদীর্ণ। আলি আবদুল্লার পদত্যাগের দাবীতে সে দেশের রাজধানী সানাতে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ। সানা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনহাজার ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে বিক্ষোভ মিছিল শুরু করেন। বিক্ষোভের ওপর গুলিও চালানো হয়।

দেশের দক্ষিণের ইব শহরে চলে হাজার হাজার প্রতিবাদী জমা হয়েছেন, তাদের হাতে আলির পদত্যাগ চেয়ে লেখা পোস্টার, ব্যানার। তাইজ শহরে একই দাবীতে চলছে ধর্ণা অবস্থান বিক্ষোভ। প্রতিবাদীদের ওপর দমনপীড়ণ ও পালটা প্রতিরোধে এখনো অবধি পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। জর্ডনের প্রধানমন্ত্রী সামীর রিফাই এর পদত্যাগের দাবীতে জর্ডনে শুরু হয়েছে বিক্ষোভ। মূল্যবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি ও বেকারত্মর বিরুদ্ধে, শাসননীতি পরিবর্তনের দাবীতেই এই প্রতিবাদ।

ইসলামিক অ্যাকশন ফ্রন্ট, বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন ও বামপন্থী সংগঠন এই আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। জর্ডনে সংসদের ক্ষমতা নেহাৎই নিয়মতান্ত্রিক। রাজা আবদুল্লাই প্রকৃতপক্ষে রাজনৈতিক ক্ষমতা নিয়ন্ত্রণ করেন। তিনি ডিক্রি জারী করে সংসদ এবং মন্ত্রীসভা ইচ্ছেমতো তৈরি বা ভাঙার ঘটনার অধিকারী। প্রতিবাদীরা সংবিধান পরিবর্তন ও জনগণের আরো ক্ষমতায়নের দাবী তুলেছেন।

বিভিন্ন সংঘর্ষে এখনো অবধি বেশ কিছু বিক্ষোভকারী আহত হয়েছেন। আরব দুনিয়ার এই বিক্ষোভ বিশ্ব রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে নতুন দিশা হাজির করছে। বিক্ষোভের কেন্দ্রবিন্দু এই দেশগুলি হয় রাজতান্ত্রিক বা একনায়কতান্ত্রিক। দুই তিন বা চার দশক ধরে সেখানে চলছে তানাশাহী। দেশের মধ্যে ব্যাপক অসাম্য, দুর্নীতি, মূল্যবৃদ্ধির সমস্যা আর স্বৈরাচারী শাসনের প্রকোপ।

অন্যদিকে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষে তারা আমেরিকার স্বার্থরক্ষাকারী ও মদতপুষ্ট। এ সবের বিরুদ্ধেই পথে নেমেছে জনগণ। সর্বত্রই শাসকেরা আশ্রয় নিচ্ছেন নানামাত্রিক দমননীতির। কিন্তু তিউনিশিয়া, মিশরে এই দমননীতিকে পরাস্ত করে ইতোমধ্যেই জনগণ তানাশাহীর আবসান ঘটাতে সমর্থ হয়েছেন। অন্যত্রও জনগণের ঐক্য, সাহস ও সংকল্প বজায় আছে।

সে দিকে তাকিয়ে আছে গোটা বিশ্ব। আমেরিকা মৌখিকভাবে কোথাও কোথাও গণ আন্দোলনের প্রতি শাসকদের সহানুভূতিপ্রবণ হওয়ার আহ্বান জানালেও এই শাসকদের প্রতি তাদের দীর্ঘদিনের মদত সবার কাছে দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। গণজাগরণের মুখে নিজেদের পছন্দের একনায়কদের অপসারণ বাধ্যতামূলক হলেও আমেরিকা তাদেরই কোনও আস্থাভাজনকে ক্ষমতায় রাখতে আগ্রহী। জনগণের লড়াই আমেরিকার প্রভাবকে কতটা মেনে নেয়, তা বিশ্বরাজনৈতিক ক্ষমতা ভারসাম্যের প্রশ্নে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এটা অনেকটাই নির্ভরশীল গণ আন্দোলনের নেতৃত্বকারী শক্তির রাজনৈতিক দিশার ওপর।

সাধারণভাবে আরব দেশগুলির এই গণ আন্দোলনে বড় ভূমিকা রয়েছে ছাত্রযুবদের। সেইসঙ্গে বিভিন্ন দেশে শ্রমিকশ্রেণির ঐক্যবদ্ধ লড়াই, ট্রেড ইউনিয়নগুলির সক্রিয়তাও বিশেষভাবে চোখে পড়ছে। মধ্যবিত্ত ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে শিক্ষক আইনজীবীদের রাস্তায় নামতে দেখা গেছে। দেশের গণতান্ত্রিক মানুষের দীর্ঘদিনের আশা আকাঙ্ক্ষারই প্রতিফলন ঘটছে এই আরব বিপ্লবে। বিশ্ববাসীর একাংশ মূলত পশ্চিমী প্রচারমাধ্যমের ক্ল্যাসেস অব সিভিলাইজেশন তত্ত্ব অনুসারে আরব দুনিয়াকে যেভাবে সংরক্ষণশীল মানসিকতার দেশ হিসেবে ভেবেছিল, স্থাপন করেছিল বুর্জোয়া উদারনৈতিকতার নেতিবাদী বিপ্রতীপে – এই আরব বিপ্লব তারই বলিষ্ঠ প্রতিবাদ হিসেবে দুনিয়াজোড়া গণতান্ত্রিক লড়াইয়ের কেন্দ্রে নিশ্চিতভাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করছে।

পঞ্চাশ ষাট সত্তর দশকে গোটা বিশ্বে যে গণতান্ত্রিক লড়াই হয়েছিল তাতে প্রত্যক্ষ ঔপনিবেশিকতা বা সামন্তবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় গণমুক্তি ও সমাজতন্ত্রে স্বপ্ন ছিল মূল প্রেরণা। বিশ শতকের শেষ দশক বা একুশ শতকের প্রথমে লাতিন আমেরিকার দেশে দেশে উত্তর আমেরিকার অর্থনৈতিক আগ্রাসণ ও আগ্রাসী পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে লড়াই ভেনেজুয়েলা, বলিভিয়া, ব্রাজিল, ইকুয়েডরে প্রেরণা হিসেবে দেখা দেয়। আরব ভূখণ্ডের নিজস্ব ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য ও রাজনৈতিক ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে সেখানে যে গণতান্ত্রিক বিপ্লব ঘটছে তা অতীতের কোনও আন্দোলন বৈশিষ্ট্য নিয়ে আত্মপ্রকাশ করবে – এমন ধারণা বাস্তবোচিত নয়। আরব বিপ্লব শেষপর্যন্ত কোন পরিণতি ধারণ করবে আর তা বিশ্ব রাজনীতিকে কোন নতুন অভিমুখ দেবে, তা এখনো স্পষ্ট নয়। কিন্তু গণতন্ত্রের এই লড়াই ও তার সৈনিকদের কুর্ণিশ জানিয়ে আমরাও এই লড়াই থেকে নিশ্চিতভাবে প্রেরণা ও শিক্ষা গ্রহণ করব।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।