নির্বাচন কমিশনকে এই রায় বাস্তবায়ন থেকে বিরত রাখতে দ্রুত রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ দরকার জামায়াতের। তা না হলে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনসহ সামনের কোনো নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবে না তারা।
এই দুঃসময়ে জামায়াত মূলত নিঃসঙ্গ, বন্ধুহীন।
পাকিস্তানের অখণ্ডতার জন্য জামায়াত নিজ দেশের জনগণের বিরুদ্ধে ভয়াবহ নৃশংসতার ষড়যন্ত্র ও যুদ্ধ করলেও আজ তারাও এই ইসলামী দলটির ব্যাপারে নিজেদের হাত গুটিয়ে নিয়েছে। পাকিস্তানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলেছে, ‘জামায়াত নিয়ে যা ঘটছে তা বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়’।
এর মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশে যে নৃশংসতা হয়েছে তার পক্ষে দাঁড়াচ্ছে না পাকিস্তানের বর্তমান সরকার। তাই জামায়াতকে তার নিয়তির ওপর ছেড়ে দিচ্ছেন নওয়াজ শরীফের সরকার। তিনি নিজেও পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ব্যাপারে খুব স্বাচ্ছন্দ্য নন, ১৯৯৯ সালে সেনাবাহিনীর হাতেই ক্ষমতাচ্যুৎ হয়েছিলেন তিনি। এছাড়া সন্ত্রাসবাদ বিরোধী লড়াইয়ে পশ্চিমের গুরুত্বপূর্ণ মিত্র থাকতে চাওয়ায় একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের পক্ষে নিজেদের সম্পৃক্ত করতে চায় না তারা। কারণ এটা পাকিস্তানের জন্য আন্তর্জাতিক মহলে খারাপ প্রচারণা হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে।
নওয়াজ শরীফ হয়তো এখনো একাত্তরের ঘৃণ্য বর্বরতার জন্য বাংলাদেশের কাছে ক্ষমা চাওয়ার কথা ভাবছেন না। কারণ তাতে সেনাবাহিনীর মধ্যে আবারো বৈরী মনোভাব তৈরি হতে পারে, যা তিনি সামাল দিতে সক্ষম নাও হতে পারেন। জামায়াতের পক্ষে কেন দাঁড়াবে! তারা বাংলাদেশে খুব একটা জনপ্রিয় নয় এবং কখনো নিজেদের একার পক্ষে ক্ষমতায় আসারও সম্ভাবনা নেই। তাহলে পাকিস্তানকে অজনপ্রিয় করা কেন, জামায়াতের পক্ষে দাঁড়ালে যা তৈরি হতে পারে বাংলাদেশে। এ বিষয়ে যথাযথ সিদ্ধান্ত নেয়ার যথেষ্ট বিবেচনা বোধ সম্পন্ন নওয়াজ।
এবার আসা যাক জামায়াতের অভ্যন্তরীণ মিত্রদের বিষয়ে। ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে প্রচারণার অংশ হিসেবে বিএনপি ও তার শীর্ষ নেতারা বাংলাদেশে বিচার ব্যবস্থা নিয়ে কথা বলতে পারেন।
কিন্তু বিএনপির জন্য এমন বড় কোনো কারণ নেই যে, তারা জামায়াতে সমর্থনে এগিয়ে আসবে এবং তার নিবন্ধনের জন্য লড়াই চালাবে।
১৯৯১ সালে বাংলাদেশ সামরিক শাসন মুক্ত হয়ে গণতন্ত্রে ফিরে আসার পর থেকে নির্বাচনে জয় পেতে জামায়াতকে দরকার হয়েছে বিএনপির। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের সময়কার জামায়াতের বিতর্কিত অবস্থান বিএনপির জন্যও একটা বড় ধরনের বোঝা, যেহেতু এমন একটি দেশে তারা ক্ষমতার লড়াইয়ে আছে যেখানে ১৯৯১ সালের পর থেকে প্রতিবারই ক্ষমতাসীনরা হেরেছে।
নিবন্ধন হারিয়ে জামায়াত যদি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে না পারে তাহলে কী ঘটবে? জামায়াতের ভোটাররা কি আওয়ামী লীগকে ভোট দেবে! সম্ভবত কখনো তা হবে না। জামায়াতের ভোটারদের সামনে বিএনপিকে ভোট দেয়া ছাড়া কোনো বিকল্প থাকবে না।
তাই ‘সরকার বিচার বিভাগকে প্রভাবিত’ করছে- এই সাধারণ সমালোচনার বাইরে জামায়াতের নিবন্ধনের জন্য বিএনপি বড় ধরনের কোনো হট্টগোল সৃষ্টি করবে না বলে ধারণা করা যায়।
ব্যক্তিগতভাবে অনেক বিএনপি নেতা, বিশেষত যারা মুক্তিযোদ্ধা তারা হয়তো জামায়াতের নিবন্ধন বাতিলে খুশি হয়েছেন। বিতির্কিত মিত্রকে ছাড়া বিএনপি এখন আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে নিজেদের মতো করে লড়তে পারবে।
অন্য সব ইসলামপন্থী দল, যাদের সাধারণত জামায়াতের সহোদর হিসেবে দেখা যায় তাদের বিষয়ে দৃষ্টি দেয়া যাক। হেফাজতে ইসলামসহ তাদের অনেকে এতে সন্তুষ্ট হতে পারে। কারণ এতে জামায়াত এতোদিন কট্টরপন্থী ইসলামী রাজনীতির যে প্রতিনিধিত্ব করতো তার সেই সীমিত গণ্ডি থেকে বেরিয়ে আসতে পারে এই রাজনীতির পরিসর।
জামায়াত দৃশ্যের বাইরে চলে গেলে কট্টরপন্থী রাজনীতির জায়গা অন্যদের জন্য উন্মুক্ত হবে এবং তাদের এটাকে কাজে লাগানোর সুযোগ তৈরি হবে। প্রকৃতপক্ষে হেফাজতের মতো কিছু গ্রুপ এ সুযোগকে কাজে লাগাতে পারে।
সত্যি বলতে, যুদ্ধাপরাধের বিচার নতুন প্রজন্মের কাছে জামায়াতের আসল চেহার উন্মুক্ত করেছে। গণমাধ্যমে বিচার প্রক্রিয়ার খবর প্রকাশ হওয়ায় তা জাতির ঘৃণ্য ইতিহাসকে এই প্রজন্মের সামনে তুলে এনেছে। লাখো মানুষের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ স্বাধীনতা যে কোনো গর্বিত বাংলাদেশি তার রক্তের শেষ বিন্দু দিয়ে রক্ষা করতে চাইবে। ইতিহাসের বিপরীতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতের ভূমিকার জন্য দলটি কখনো এদেশের মানুষে হৃদয়ে স্থান করে নিতে পারবে না। এমনকি যারা কট্টরপন্থী ইসলামী রাজনীতির সমর্থক তারাও একাত্তরে জামায়াতের ভূমিকাকে বাইরে রেখে ওই রাজনীতি করতে চায়।
এদের মধ্যে জামায়াতের নতুন প্রজন্মও রয়েছে, যারা এমন একটি দল চান- সম্ভবত নতুন একটি- যাতে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ তাদের সঙ্গী হবে না।
এদিকে জামায়াত নিবন্ধন হারালে তাতে আওয়ামী লীগ ও তার মিত্রদের জন্য একটি সুযোগ তৈরি হবে ধর্ম নিরপেক্ষ জাতীয়তাবাদী চেতনার জাগরণ ঘটানোর, যা কিছুটা থমকে পড়েছে সরকারের পক্ষ থেকে শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ ভেঙে দেয়ার মধ্য দিয়ে। কারণ ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে জনমনে যে বিতৃষ্ণা তৈরি হয় তা দূর করার গুরুত্বপূর্ণ পথ হতে পারে এই চেতনার জাগরণ।
তাই জামায়াত এখন নিজেকে নিঃসঙ্গ ও বন্ধুহীন অবস্থায় দেখছে। এই দলটি কি এখন আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে একটি সন্ত্রাসী দলে পরিণত হবে, দীর্ঘদিন ধরে যে আশঙ্কা রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্যান্য পশ্চিমা দেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মধ্যে।
এ প্রশ্নের উত্তর কেবল সময়ই দিতে পারবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।