I am student
মেহেদী হাসান জুয়েল
কিছু সূর্যরশ্মিকে আটকে বিশ্ব উষ্ণায়ন রোধের বিজ্ঞান বা 'ভূ-প্রকৌশল' জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সর্ববিধ সংকট মোচনের একমাত্র হাতিয়ার হয়ে পড়েছে। বিজ্ঞানীরা গবেষণা করে দেখেছেন এই অভিগমণ কৃষি এবং পরিবেশের উপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে এবং গ্রিন হাউস ইফেক্টের ক্ষতিকর প্রভাবকেও বাঁধা দিতে ব্যর্থ হবে। দুইজন বিখ্যাত জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ২০০৬ সালে 'ভূ-প্রকৌশলের' সম্ভাবনা উলেস্নখ করেন এবং আশাবাদ ব্যক্ত করেন এই বলে যে পৃথিবীর তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে এই বিজ্ঞান জরুরি এবং ক্ষতিকর বিকিরণ, খরা এবং সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতাকে মোকাবেলা করবে। ২০০৯ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে যে কয়লা, তেল এবং প্রাকৃতিক গ্যাস, বা জৈবজ্বালানি থেকে কার্বন ডাই অক্সাইডের রূপান্তরের তুলনায় 'ভূ-প্রকৌশলের' পিছনে বছরপ্রতি মাত্র দুই বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলার করে খরচ পড়বে। কিন্তু 'অ্যাটমোসফেরিক সাইন্স লেটারস'-এর এক ধারাবাহিক প্রতিবেদনে চোরাগলির সন্ধান মিলেছে।
এশিয়ার মৌসুমি জলবায়ু সবচেয়ে বড়ো হুমকির সম্মুখীন যা ঊষ্ণ ভূমি এবং শীতল সমুদ্র দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। এক পরিকল্পনায় দেখা গেছে যে প্রতি বছর যুদ্ধ বিমানগুলো পৃথিবীতে পাঁচ মেগাটন সালফার ডাই অক্সাউড গ্যাস নির্গমণ করে। এই গ্যাস স্ট্র্যাটোসফিয়া েপানির সাথে মিশে সালফেট অ্যারোসল নামের অতি ক্ষুদ্র পদার্থে পরিণত হয় যা ভূপৃষ্ঠে আসার পূর্বেই সূর্য রশ্মিকে বিক্ষিপ্ত করে দেয়।
কিন্তু ভূমির তাপমাত্রা কমানোর থেকে সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রা কমানো বেশি কঠিন। যেহেতু সূর্য ক্ষুদ্র তরঙ্গ দৈর্ঘের বিকিরণ নির্গমন করে তাই উষ্ণ ভূমিকে উষ্ণ সমুদ্র অপেক্ষা শীতল করা কঠিন-এমনই অভিমত রুটজারস বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়াবিদ অ্যালান রোবোকের।
ভূমি এবং সমুদ্র পৃষ্ঠের তাপমাত্রার এই পার্থক্যই এশিয়া এবং আফ্রিকা অঞ্চলের গ্রীষ্মের মৌসুমি বায়ুকে দুর্বল করে দেবে। ফলে এই এলাকার যে সকল কৃষক তাদের ফসলের জন্য মৌসুমি বৃষ্টির উপরর নির্ভর করে তাদের উপর যে কোনো হুহূর্তে মহাবিপর্যয় নেমে আসতে পারে। ইংল্যান্ডের 'ব্রিটিশ মেট অফিস'-এর বিজ্ঞানী অলিভার বাউচার বলেন- বিপরীতভাবে ভূ-প্রকৌশন বৈশ্বিক উষ্ণায়নের সর্বাধিক ক্ষতিকর কিন্তু পরিণতিকে জোরদারও করতে পারে। তিনি এমন একটি পরিকল্পনার কথা বলেন যার মাধ্যমে সমুদ্রে জাহাজের মাধ্যমে উপরে লোনা পানি সপ্রে করা হবে যা বাষ্পীভূত হয়ে 'সি সল্ট অ্যারোসল' লেয়ার তৈরি করবে। ফলে সমুদ্রের উপর মেঘ অধিক উজ্জ্বল হবে এবং সূর্য রশ্মিকে বিকিরিত করে পৃথিবীপৃষ্ঠে ফেরত পাঠাবে।
কিন্তু গুচ্ছ মেঘের ক্ষেত্রে এই শীতলীভবন প্রক্রিয়া সংঘবদ্ধভাবে ঘটানো সম্ভব না। এটা আমাজনে গ্রিনহাউস-প্রভাবিত শুষ্কায়ন প্রক্রিয়াকে নিবিড়তর করতে পারে। ফলে ওই জঙ্গনের নানা জাতের চারাগাছ যেমন বিপন্ন হয়ে পড়বে, তেমনি এদ্ধান্তীয় অঞ্চলের বনের কার্বন ডাই অক্সড শোষণের ক্ষমতা কমিয়ে দেবে।
ভূ-প্রকৌশল উত্তরমেরু অঞ্চলের ঊষ্ণায়ন প্রক্রিয়াকে রোধ করতে পারবে বলে মনে হচ্ছে না আর এটিই বিজ্ঞানীদের জন্য সব চেয়ে বড়ো বিস্ময়। 'এই অঞ্চলে তাপমাত্রা অল্প করে হলেও বাড়বে এবং আমরা গ্রিন হাউস প্রভাব রোধ করতে এখনো সক্ষম হই নি', এভাবেই বলেন বাউচার।
সমস্যা হলো সামুদ্রিক বরফগলা পানির উচ্চ চাপীয় স্তর ক্রান্তীয় বায়ু প্রবাহকে দমন করবে এবং শীতের বায়ু প্রবাহকে দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত করবে। আমেরিকা এবং ইউরোপে শীতের সময়ে তুষারপাত আঘাত হানবে এবং এই অঞ্চলের সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি পাবে। সব চেয়ে চিন্তুার বিষয় হলো ভূ-প্রকৌশল কীভাবে টেলিতরঙ্গকে ব্যাহত করবে। এই তরঙ্গগুলোর মাধ্যমে পৃথিবীর এক প্রান্তের জলবায়ু পরিস্তিতির খবর অপর প্রান্তে থেকেই জানা সম্ভব। সর্বাধিক পরিচিত টেলিতরঙ্গ হলো এল নাইনো/ দক্ষিণীয় স্পন্দন যা প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বাঞ্চলের ঊষ্ণ জলোপ্রবাহ পূবর্ীয় বিষুবরেখা অভিমুখি বায়ু প্রবাহকে দুর্বল করে দেয়।
এতে পেরু এবং আমেরিকার দক্ষিণ অঞ্চলে হবে- জলোচ্ছ্বাস আর ইন্দোনেশিয়া এবং অষ্ট্রেলিয়ায় খরা। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আবহাওয়াবিদ পিটার ব্রেসিক বলেন- এলাইনানোর শক্তি এবং ক্ষমতা 'ভূ-প্রকৌশল' দুনিয়ায় বিপস্নব আনতে পারে। প্রয়োজনীয় রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক সহযোগিতা পাওয়ার পরও বিজ্ঞানীরা মূল প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে অজ্ঞাত। আমাদের ক্রমাগত কার্বন ডাইঅক্সাইড নির্গমনের ফলে পৃথিবী যদি সূর্য রশ্মিকে বায়ুমন্ডলে বিকিরণ করতে না দেয় তাহলে আমরা যেখান থেকে শুরু করেছিলাম পরিস্থিতি তার থেকেও খারাপ হতে পারে।
বিশৃঙ্খল জলবায়ুর জন্য কি বৈশ্বিক ঊষ্ণায়ন দায়ী?
বিশ্বব্যাপী অস্বাভাবিক আবহাওয়া বিরাজমান গত এক বছর যাবত।
২০০৭ সালের সেপ্টেম্বরে কানাডার টরেন্টো অঙ্গরাজ্যে ঘটে যাওয়া টর্নেডো সেখানকার মানুষদেরকে বিস্মিত করেছিলো। গত একশো বছরে সেখানে এটিই প্রথম টর্নেডো। গত শীতের মৌসুমে উত্তর গোলার্ধে তুষারপাতের সাথে সাথে তাপমাত্রা রেকর্ড পরিমাণ কম ছিলো এবং দক্ষিণ গোলার্ধে রেকর্ড পরিমাণ বেশি ছিলো। সিউলে গত বছর স্মরণকালের সব চেয়ে ভারী তুষারপত ঘটে। পাকিস্তান, অষ্ট্রেরিয়া এবং ব্রাজিলে ব্যাপক বৃষ্টিপাতের কারণে ভয়ংকর বন্যা দেখা দেয়।
ফ্লোরিডায় অস্বাভাবিক ঠান্ডা সেখানকার সাইট্রাস ফসলের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে এবং ২০১০ সালে আমেরিকায় অস্বাভাবিক গরম অনুভূত হয়। তাহলে এটি কি বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফসল নাকি কিছু মানুষের মতানুযায়ী এটিই নিয়তি!
বৈশ্বিক ঊষ্ণায়ন শুধু অস্বাভাবিক গ্রীষ্মেই সীমাবদ্ধ নয়। বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন, পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে আরো অনেক কিছুই প্রভাবিত হবে। সমুদ্রপৃষ্ঠের তাপমাত্রার এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতার পবিবর্তনের ফলে বৃষ্টির ধরণ থেকে শুরু করে বাতাসের দিক পর্যন্ত পরিবর্তিত হয়ে যাবে। সামপ্রতিক বছরগুলোতে আমরা ক্রমবর্ধমান অস্বাভাবিক আবহাওয়ার সম্মুখীন হয়েছি।
জলবায়ু পরিবর্তনের বৃহৎ অংশ হতে বিভিন্ন ঋতুকে পৃথক করতে হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে একটি প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখেই বৈশ্বিক উষ্ণায়ন সম্পর্কে সিদ্ধান্তে আসা সম্ভব নয়।
কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা অনুযায়ী গত শীতের মৌসুমের অস্বাভাবিক তুষারপাত দুই আবহাওয়ামন্ডলের মধ্যে সংঘাতের বা প্রাকৃতিক পাগলামির ফল, বিশ্ব ঊষ্ণায়নের লক্ষণ নয়। ব্রুকলিনের টর্নেডো নিঃন্দেহে একটি বড়ো প্রাকৃতিক বিপর্যয় যা একটি অস্বাভাবিক সময়ে এবং আস্বাভাবিকভাবে সংগটিত হয়। কিন্তু ঢালাওভাবে এর জন্য পরিবেশ বিপর্যয়কে দায়ী করা যায় না।
একইভাবে হঠাৎ তুষারপাত বা পাকিস্তানের বন্যার জন্যও জলবায়ুর পরিবর্তনকে দায়ী করা ঠিক হবে না। কারণ দীর্ঘ এক যুগ বা এর কাছাকাছি সময় ধরে কোনো অস্বাভাবিক প্রাকৃতিক পরিবর্তনের লক্ষণ দেখা না গেলে তাকে জলবায়ু পরিবর্তনের আওতায় ধরা যায় না। অপরদিকে গত ৫০ বছর ধরে ভারতে মৌসুমি বায়ুর ফলে ব্যাপক বৃষ্টিপাত রেকর্ড করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
যাহোক সামপ্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে যে অন্তত কিছু ক্ষেত্রে পরিবর্তিত আবহাওয়ার ধরণকে বিশ্ব ঊষ্ণায়নের লক্ষণ হিসেবে ধরা যায়। ডিউক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমপ্রতি প্রকাশিত এক রিপোর্টে দেখা গেছে যে গ্রীষ্মে আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের ঘটনার জন্য এই কারণটিই দায়ী।
গত ৩০টি গ্রীষ্মের মধ্যে ১১ টিতেই আমেরিকার দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের আবহাওয়া অস্বাভাবিক শুস্ক অথবা আদর্্র ছিলো। সমগ্র পূর্ব আমেরিকা, পশ্চিম ইউরোপ এবং উত্তর আফ্রিকার আবহাওয়া প্রবাবিত হয়েছে 'নর্থ আটলান্টিক সাবট্রপিকাল হাই' বা ঘঅঝঐ এর প্রভাবে যেটি গত ৬০ বছর ধরে ০.৯ জিওপটেনশিয়াল মিটার হারে তীব্রতর হওয়া একটি উচ্চ চাপীয় প্রক্রিয়া।
সুত্র: দৈনিক ইত্তেফাক
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।