[পর্ব ১ ; ২ ; ৩]
আগের পোস্টগুলোতে উদাহরণসহ আলোচনা করেছিলাম কীভাবে একটি জীবগোষ্ঠীর মধ্যে মিউটেশনের মাধ্যমে বৈচিত্র্য বৃদ্ধি পায় আর প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে অধিক যোগ্য ভ্যারিয়েন্টগুলো টিকে থাকে। স্পেসিয়েশন বা প্রজাতি সৃষ্টিরও উদাহরণ ছিল সেখানে। আজ বিবর্তনের একটি জীবন্ত উদাহরণ নিয়ে আলোচনা করবো। সাথে আরো কিছু মৌলিক বিষয়।
বিবর্তনের সময়কাল: সময়কাল অনুসারে বিবর্তনকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়
১. মাইক্রো-ইভোল্যুশন: কয়েক প্রজন্ম পরেই জীবের জেনেটিক কোডে যে পরিবর্তন দেখা যায় তাই মাইক্রো-ইভোল্যুশন।
এই পরিবর্তন ল্যাবরেটরীতে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। সাধারণত, একই প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত জীবদের মধ্যে বৈচিত্র্য সৃষ্টি হয় মাইক্রো-ইভোল্যুশনের মাধ্যমে।
২. ম্যাক্রো-ইভোল্যুশন: কয়েক লক্ষ বা মিলিয়ন বছর ধরে মাইক্রো-ইভোল্যুশনের সমস্টি ম্যাক্রো-ইভোল্যুশন। অনেকটা গণিতের ইন্টিগ্রেশনের মত। অল্প অল্প করে সামান্য পরিবর্তন মিলিয়ন বছর পরে অনেক বড় পার্থক্য সৃষ্টি করতে পারে।
প্রজাতি তৈরী হয় ম্যাক্রোভোল্যুশন প্রক্রিয়ায়।
বৈচিত্র্যের প্রকারভেদ:
বিবর্তনের মাধ্যমে যে ভ্যারিয়েশন তৈরী হয় সেটা সময় ও স্থান দুই দিকেই বিস্তৃত। সময়ের সাথে সাথে কোন জীবগোষ্ঠীতে যে বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায় তাকে টেম্পোরাল ভ্যারিয়েশন বলে। সময়ের সাথে সাথে কোন প্রজাতির রঙ, ঠোঁটের দৈর্ঘ্য পরিবর্তন এধরণের ভ্যারিয়েশনের উদাহরণ। আবার একই সময়ে পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে জীবগোষ্ঠির মধ্যে ভ্যারিয়েশন থাকে।
পৃথিবীর বিভিন্ন স্থানে আলাদা আলাদা বসবাসকারী একই প্রজাতির দুটি জীবগোষ্ঠিতে যে ভ্যারিয়েশন থাকে তাকে স্পাশিয়াল ভ্যারিয়েশন বলে।
রিং স্পেসিস: স্থানিক বৈচিত্র্যের মাধ্যমে আলাদা প্রজাতি তৈরী হওয়ার উদাহরণ।
আগের পোস্টে রিং স্পেসিস নিয়ে কিছু আলোচনা করেছিলাম। রিং স্পেসিস হচ্ছে স্থানিক বৈচিত্র্যের (স্পাশিয়াল ভ্যারিয়েশন) উদাহরণ।
যে কোন প্রজাতির মধ্যে অনেক ভ্যারিয়েশন থাকতে পারে।
আমাদের মানবজাতির মধ্যেও অনেক স্পাশিয়াল ভ্যারিয়েশন রয়েছে। নর্ডিক, জার্মান, রোমান, তুর্কি, আরব, কোরিয়ান, মঙ্গোলিয়ান, ইথিওপিয়ান প্রভৃতি নৃতাত্ত্বিক জাতিগুলোর মধ্যে জেনেটিক কিছু পার্থক্য রয়েছে, যদিও তা খুবই সামান্য। তাহলে কী মানবজাতি আলাদা আলাদা প্রজাতিতে বিভক্ত? অবশ্যই নয়। কারণ যেকোন দুটি নৃতাত্ত্বিক জাতির সদস্যদের মধ্যে সফল প্রজনন সম্ভব। ভবিষ্যতেও কি আলাদা প্রজাতিতে পরিণত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে? সেটাও খুব একটা নেই।
আলাদা প্রজাতিতে পরিণত হওয়ার শর্ত হচ্ছে, দুটি ভ্যারিয়েন্টকে বহুদিন প্রজনন হতে বিরত থাকতে হবে, অর্থাৎ তাদের মধ্যে জিন-ফ্লো চলতে পারবে না। কিন্তু মানবজাতির ভ্যারিয়েন্টগুলো কোন কালেই প্রজননগতভাবে আলাদা ছিল না। আর আধুনিক যুগে তো বিভিন্ন জাতির মধ্যে জিন আদান-প্রদান আরো বেড়ে গিয়েছে। কারণ আমরা খুব সহজেই একে অপরের কাছে পৌছতে পারছি। কিন্তু যদি কয়েক মিলিয়ন বছর ধরে কিছু মানুষ আলাদা হয়ে থাকে, তবে পরিবর্তন বেড়ে গিয়ে আলাদা প্রজাতি তৈরী হতেই পারে।
রিং স্পেসিস হচ্ছে এভাবে নতুন প্রজাতি তৈরী হওয়ার একটি উদাহরণ। ধরুন, একটি প্রজাতির তিনটি প্রকরণ রয়েছে, 'ক, খ, ও গ'। ক এবং খ পাশাপাশি বাস করে। খ এর একপার্শ্বে ক আরেক পার্শ্বে গ বাস করে। ক এর সাথে খ এর মাঝেমাঝেই দেখাসাক্ষাৎ হয় কওখ এর মধ্যবর্তী এলাকায়।
তাই তাদের মধ্যে জিন আদান প্রদান হয়। খ ও গ এর মধ্যেও প্রায় নিয়মিত জিনের আদান-প্রদান হয়। কিন্তু ক ও গ ভৌগোলিক দূরত্বের কারণে জিন আদান প্রদান করতে পারে না। এখন, তিনটি প্রকরণের মধ্যেই পার্থক্য আস্তে আস্তে বাড়তে থাকবে। ধরি, পার্থক্যের পরিমাণ ১০ অতিক্রম করলেই তারা আলাদা প্রজাতিতে পরিণত হবে।
এমন এক সময় আসতে পারে, যখন ক ও খ এর মধ্যে পার্থক্য ৭, খ ও গ এর মধ্যে পার্থক্য ৭। কিন্তু ক ও গ এর মধ্যে পার্থক্য প্রায় ১৪। তাহলে, কওখ একই প্রজাতিভুক্ত, খওগ একই প্রজাতিভুক্ত, কিন্তু কওগ একই প্রজাতিভুক্ত নয়। এটা প্রজাতির সংজ্ঞা নির্ধারণে একটি ডায়লেমা। কওখ নিজেদের মধ্যে সফল প্রজনন করতে পারে, খওগ নিজেদের মধ্যে সফল প্রজনন করতে পারে, কিন্তু কওগ নিজেদের মধ্যে প্রজনন করতে পারে না।
কিন্তু মধ্যবর্তী খ এর মাধ্যমে তাদের মধ্যে কম হারে হলেও জিনের আদান-প্রদান সম্ভব। এই ধরণের অবস্থাকে বিজ্ঞানিরা রিং স্পেসিস অভিহিত করে তিনটি প্রকরণকেই একই প্রজাতিভুক্ত করেন। কিন্তু হঠাৎ যদি কোন কারণে প্রকরণ খ বিলুপ্ত হয়ে যায়, তবে কওগ এর মধ্যে জিনের আদান-প্রদান চিরতরে বন্ধ হয়ে যাবে, অর্থাৎ তারা আলাদা প্রজাতিতে পরিণত হবে।
সবুজাভ ওয়ার্বলার (Phylloscopus trochiloides) হচ্ছে এমনই একটি রিং স্পেসিস। হিমালয়ের দক্ষিণ প্রান্তে উদ্ভুত এই প্রজাতিটি প্রথমে পূর্ব ও পশ্চিমে ছড়িয়ে পরে।
তৈরী হয় বিভিন্ন প্রকরণ। এরপর হিমালয়ের শেষ প্রান্ত পৌছে পাখিটি উত্তর দিকে ছড়িয়ে পরতে থাকে। তিব্বতের মালভুমি এড়িয়ে উভয় দিক থেকেই পাখিটি পৌছে যায় সাইবেরিয়ায়। বহু-প্রজন্ম ধরে চলতে থাকে এই বিস্তৃতি, আর চলতে থাকে প্রকরণ সৃষ্টি। যখন অনেক প্রজন্ম পরে সাইবেরিয়ায় পূর্ব দিক থেকে আগত ও পশ্চিম দিক থেকে আগত দুটি ভ্যারিয়েন্ট একসাথে মিলে, দেখা যায় যে তারা নিজেদের মধ্যে সফল প্রজনন করতে পারে না।
কিন্তু তারা মধ্যবর্তী প্রকরণগুলোর সাথে প্রজনন করতে সক্ষম।
সাইবেরিয়ায় বসবাসকারী Phylloscopus trochiloides plumbeitarsus প্রজনন করতে পারে চীনে বসবাসকারী Phylloscopus trochiloides obscuratus এর সাথে। চীনে বসবাসকারী obscuratus আবার প্রজননে সক্ষম ভুটান ও নেপালের পশ্চিমাঞ্চলে বসবাসকারী Phylloscopus trochiloides trochiloides এর সাথে। trochiloides প্রকরণের সদস্যরা সফল প্রজনন করে উত্তর-পশ্চিম ভারত ও মধ্য এশিয়ায় বসবাসকারী ludlowi এর সাথে। ludlowi প্রজনন করতে পারে মধ্য এশিয়া ও সাইবেরিয়ায় বসবাসকারী Phylloscopus trochiloides viridanus এর সাথে।
কিন্তু সাইবেরিয়ায় বসবাসকারী plumbeitarsus ও viridanus নিজেদের মধ্যে প্রজনন করতে পারে না।
এখন, মধ্যবর্তী প্রজাতিগুলো ধ্বংস হয়ে গেলে এই দুটি ভ্যারিয়েন্টের মধ্যে জিন আদান-প্রদানের আর কোন মাধ্যমই বজায় থাকবে না। তাই কার্যত তারা আলাদা প্রজাতিতে পরিণত হবে।
ওয়ার্বলারের মত লারুস গাঙচিল এবং উত্তর আমেরিকার সালামান্দার ও রিং স্পেসিসের উদাহরণ।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।