www.choturmatrik.com/blogs/আকাশ-অম্বর
১
‘বাপজান, দুইডা ট্যাকা দিবা? হারাডা দিন কিচুই খাই নাইক্কা। ’
শুধু দুটি টাকা মাত্র আর একটি বৃদ্ধলোকের সারাদিনের উপোস থেকে পরিত্রাণ। অতি সাধারণ এক দৃশ্য। বড় কোন মানবতাবাদী প্রেক্ষাপট নয়। নিত্য নৈমিত্তিক একটি ব্যাপার।
হরহামেশাই ঘটছে। দুটি টাকা আদৌ ক্ষুধা নিবারণযোগ্য কিনা সেই প্রশ্ন নয় এখানে। ধুঁকে ধুঁকে চলা এই সমাজের আর্থ-সামাজিক বৈষম্য নিয়েও নয় কোন প্রশ্ন। নিজস্ব মানবতার যতটুকু অবশিষ্ট আছে (যদি আদপে কিছু থেকেও থাকে) সেটুকু ঝেড়ে ফেলে প্রশ্ন হচ্ছে – অজানা-অচেনা, রক্তের সম্পর্কহীন, সমাজ নামক এক অরণ্যে যথেচ্ছ ঘুরে বেড়ানো এই বৃদ্ধের কাছে দুটি টাকা ‘নিঃস্বার্থভাবে’ বিলিয়ে দেয়ার কি আদৌ কোন মানে আছে?
অভুক্ত এক বৃদ্ধ-বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে নৃশংসভাবে চিন্তিত মনে কল্পনার পকেট হাতড়াতে থাকে ছেলেটি।
সে হাতড়াতে থাকুক।
এই ফাঁকে দর্শন-শাস্ত্র ও নীতিবিদ্যার অনেক পুরানো এক দ্বিধা এবং সমসাময়িক ইভ্যুলিউশনারী-সাইকোলজিষ্ট, সোসিওলজিষ্ট, ইভ্যুলিউশনারী-বায়োলজিষ্ট এবং ইথোলজিষ্টদের একটি আলোচনার এবং গবেষণার বিষয়বস্তুর অবতারণা করা যাক।
২
এ্যাল্ট্রুইজম (Altruism) কথাটার মানে হচ্ছে অপরের মঙ্গলের জন্য, কল্যাণের জন্য বা সমাজসেবার জন্য উদ্দেশ্যপ্রণোদিত ও সুচিন্তিত উপায়ে নিঃস্বার্থভাবে অগ্রসর হওয়া। অনেকটা ছোটবেলায় পড়া সম্প্রদান কারকের মত! ইহা এমন কিছু যাহা দান করিবার পর ফিরিয়া পাওয়ার আশা করা মোটেও উচিত নহে! আবার সমাজে এমন আজব প্রকারের লোক কি খুঁজে পাওয়া যায় না যারা এমনকি নিজের জীবনটাকেও অতি তুচ্ছ মনে করে সেটাও নির্বিকার চিত্তে বিলিয়ে দিতে চায় অপরের মঙ্গলের জন্য, কল্যাণের জন্য? নিজের অস্তিত্বের বিনিময়ে কোন কিছু পাওয়ার এই আশা এ্যাল্ট্রুইজমের এক চরম অবস্থা বলা যায়। কিন্তু কি সেই আশা? এবং কেনই বা এই অদ্ভুত আচরণ?
বিবর্তনের ফুলসজ্জায় একটি কণ্টক যেন এই এ্যাল্ট্রুইজম (Altruism)। কারণ যদি natural selection কেবল মাত্র ঐসব জিনদেরকেই প্রাধান্য দিয়ে থাকে যেগুলো কিনা সেইসব চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্ম দেয় যা কোন স্বতন্ত্র জীবের পুনরুৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে, তবে মিলিয়ন বছরের বিবর্তনে এইসব এ্যাল্ট্রুইষ্ট আচরণ তো এতদিনে হারিয়ে যাওয়ার কথা।
হ্যাঁ, টিকে থাকাই যেখানে লক্ষ্য, বেঁচে থাকাই যেখানে পরম আকুতি, সেখানে আত্মত্যাগ কি নেহায়েৎ পাগলামি ছাড়া আর কিছু? কিন্তু প্রকৃতি এই পাগলামি মেনে নিয়েছে কেন?
প্রকৃতি কিন্তু শুধু মেনেই নেয় নি, সে ভালোবাসায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছে এই আবেগ তার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। মানুষের মত জন্তু ছাড়াও প্রকৃতিতে এই পাগলামি আরও দেখা যায় কিছু প্রজাতির কুকুরের মধ্যে যখন তারা অনাথ বেড়াল, কাঠবিড়ালী অথবা হাঁসকে দত্তক হিসেবে নেয়, লালন পালন করে। কিছু ডলফিনের মধ্যে যখন তারা সাহায্যে নেমে পড়ে অসুস্থ অথবা জখমপ্রাপ্ত অন্য কারও জন্য, ঘন্টার পর ঘন্টা সাঁতার কেটে যায় ওদের নিচে আর ধাক্কা দিয়ে দিয়ে উপরে তোলে শ্বাস-প্রশ্বাসের সুবিধা তৈরী করে দিতে। যখন কিছু নেকড়ে অথবা বন্য কুকুর শিকার করা মাংস ফিরিয়ে নিয়ে আসে ওদের পালের এমন সদস্যদের জন্য যারা শিকার করতে পারে নাই, টিকে থাকার উপযোগী নয়। যখন একটি বোনোবো (শিম্পাঞ্জীর এক প্রজাতি) অসুস্থ ও অক্ষম আরেক বোনোবোকে সাহায্য করে, সেবা শুশ্রূষা করে।
যখন রক্তচোষা এক সফল ভ্যাম্পায়ার হতভাগ্য আরেক ভ্যাম্পায়ারকে নিজের গিলে খাওয়া রক্ত বের করে খাওয়ায়। যখন কিছু প্রজাতির পাখি অন্য এক পাখিকে তার বাসস্থান বানাতে সাহায্য করে, এমনকি সম্পর্ক নেই এমন পাখির বাচ্চাকেও ভয়ংকর শিকারীর হাত থেকে বাঁচায়। যখন কোন এক ভারভেট বানর শিকারীর উপস্থিতিতে চিৎকার করে সঙ্গীদের সতর্ক করতে যেয়ে নিজেই দৃষ্টি আকর্ষণ করে ফেলে শিকারীর। যখন কিছু কিছু উইপোকা তাদের গলার একটি গ্রন্থিকে সজোর আঘাতে ছিন্ন করে কি এক আঠালো পদার্থ বের করে আনে হামলাকারী পিপীলিকার হাত থেকে দলকে বাঁচাতে। এ্যারাবিয়ান ব্যাব্লার নামের পাখিরা যখন নিজেদেরকে বাক-বিতণ্ডায় জড়াতে পিছপা হয় না অন্য এক ব্যাব্লারের স্বার্থে; করে থাকে উপহার আদান-প্রদান অন্য ব্যাব্লারের সাথে।
প্রকৃতিতে রয়েছে এইরকম আরও অনেক নিদর্শন।
তবে সবচেয়ে মজার ব্যাপারটা ঘটছে ইউসোস্যাল (Eusocial) জীবদের ক্ষেত্রে। ইউসোস্যাল জীব তাদেরকেই বলা হয় যাদের সমাজব্যবস্থায় শ্রমের ভেদাভেদ থাকবে (পুনর্জননে অক্ষম জাত থাকুক বা না থাকুক), থাকবে এক বংশধর হতে আরেক বংশধরের অধিক্রমণ বা ওভারল্যাপিং এবং দলগতভাবে স্বল্পবয়স্কদের লালন-পালনের প্রবৃত্তি। সহজভাবে, এদের মধ্যে পুরোহিততান্ত্রিক শ্রেণীবিন্যাস (Hierarchical Classification) বিদ্যমান। পোকামাকড়দের ভেতর পিঁপড়া, মৌমাছি, ভিমরুল (Hymenoptera বর্গ) এবং উইপোকা (Isoptera বর্গ) অন্যতম ইউসোস্যাল জীব।
অনেক সমাজবিজ্ঞানী মানবজাতিকেও ইউসোস্যাল বলতে চান।
কি ঘটছে এদের বেলায়? হ্যাঁ, কর্মঠ কিন্তু প্রজননে অক্ষম (Sterile) একদল সেনানীর অপূর্ব দক্ষতার সাথে নিরলস পরিশ্রম তাদের রাণীর স্বার্থে। নিজের প্রজনন ক্ষমতার প্রতি মধ্য-আঙ্গুল দেখিয়ে অন্যের বাচ্চা লালন-পালন। এই রাণীকে বাঁচাতেই বিষাক্ত বহিঃআক্রমনের সামনে নিজের আত্মত্যাগ। বিবর্তন কেন মেনে নিয়েছে যুগ যুগ ধরে প্রজননে অক্ষম একটি শ্রেণীর জন্ম?
ডারউইন কিন্তু সম্যক্ অবগত ছিলেন তার মতবাদ প্রতিষ্ঠায় এ্যাল্ট্রুইজমের এই ক্রূর চাহনির ব্যাপারে, যেটা আসলেই ছিলো তার জন্য এক সমস্যা।
বিশেষভাবে প্রকৃতির কিছু কিছু প্রজাতির পোকামাকড়ের আত্মত্যাগের এই প্রবণতা নিয়ে তিনি ছিলেন চিন্তিত। On the Origin of Species’এ তিনি বলছেন, ".....একটা বিশেষ ঝামেলা, যেটা প্রথম প্রথম আমার কাছে অনতিক্রম্য মনে হয়েছিলো, এবং আসলে পুরো মতবাদের কাছে ছিলো মারাত্মক একটা ব্যাপার .....। "
‘নিকট কাউকে সাহায্য করার এইসব আচরণ তাদের জীনদের অপ্রত্যক্ষ ভাবে সাহায্য করে থাকে’ – তথাকথিত এই ব্যাখ্যার মূলে রয়েছে Kin Selection তত্ত্ব। W. D. Hamilton ১৯৬৩ সালে এই ধারণার আনুষ্ঠানিক রূপ দেন। বলা হচ্ছে, যেহেতু একই পরিবার বা আত্মীয়দের মধ্যে প্রায়ই একই প্রকারের জীনের সমাহার থাকে, তাই নিজের প্রজনন থামিয়ে একই পরিবারের নির্দিষ্ট কারো প্রজনন ও বংশবিস্তারে সাহায্য করার প্রবণতা ঐসব প্রজনন-অক্ষমদের জীনের বিস্তারে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে না।
সর্বোপরি, এটাও নাকি বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে নির্দিষ্ট কারো প্রজনন ও বংশবিস্তারে সাহায্য করার এই প্রবণতা নির্দিষ্ট প্রকারের যোগ্য একটি জীনকে যে দক্ষতার সাথে বিস্তার করতে পারে সেটা প্রজনন-অক্ষমদের নিজস্ব প্রজননের মাধ্যমে জীন বিস্তারের দক্ষতার থেকে বেশী। তাই এই আত্মত্যাগী আচরণ জীন বিস্তার ও বেঁচে থাকার যোগ্যতা বৃদ্ধির এক উন্নত আচরণ কারণ এটা এ্যাল্ট্রুইষ্ট জীনকেই সাহায্য করছে। অন্য সব ব্যাপারের মতই এই ক্ষেত্রেও দাঁড়িয়ে গেলো দুটো দলের বিজ্ঞানী যেখানে একদলের কাছে এই ব্যাখ্যা জলের মতই পরিষ্কার, কিন্তু অন্য দলের কাছে মারাত্মক তালজ্ঞানহীন ও বিভ্রান্তিকর। আবার প্রকৃতির অনেক এ্যাল্ট্রুইষ্ট আচরণ তো শুধুমাত্রই নিকট সম্পর্কের গোত্রের ভেতরেই ঘটছে না, অচেনা-অজানা সম্পর্কের ক্ষেত্রেও তো দেখা যাচ্ছে এই আচরণ। শুধুই কি অবচেতন ব্যক্তিগত স্বার্থ? নিজের জীনের বিস্তারের আকুতি? যাই হোক, এই মতবাদের পক্ষে অকাট্য যুক্তি নিয়ে আছেন Richard Dawkins এবং তার Selfish Gene বইটি।
কিন্তু কেন যেন মনে হয়েছিলো ক্যাপসুলের ভেতর পুরে ঔষধ বিক্রি করার মতই এই মতবাদ বিক্রি করেছেন তিনি। আমার ভুলও হতে পারে।
অপরপক্ষে, Edward O Wilson নামক এক প্রখ্যাত জীববিজ্ঞানী এই Kin Selection তত্ত্বের বিরোধিতা করছেন। তিনি বলছেন, এ্যাল্ট্রুইজমের উৎপত্তির একমাত্র কারণ দলের বা গোত্রের মঙ্গলের জন্যই, শুধুমাত্র কোন জীনের সুবিধার জন্য নয়। তিনি আরও বলছেন যে এ্যাল্ট্রুইজম উৎপত্তি লাভ করতে পারে শুধুমাত্র একসাথে বসবাস আর পারস্পরিক কর্মচাঞ্চল্যের মধ্যেই, আত্মীয়তাবোধ বা নিকট সম্পর্ক না থাকলেও চলে।
ইথোলজিতে (প্রাণী-আচরণ বিদ্যা) তাই সোস্যাল ডারউইনিজমের ‘survival of the fittest’ এর পরিবর্তে এইরকম এ্যাল্ট্রুইষ্ট আচরণকে অনেক সময় বলা হচ্ছে ‘survival of the nicest’, যদিও অনেক ক্ষেত্রেই এটা ডারউইনের ‘থিউরী অফ ইভ্যুলিউশন’ এর সাথে ঠিক খাপ খায় না। ফলিত গণিত শাস্ত্রের একটি বিশেষ তত্ত্ব, যেটা কিনা game theory নামেই পরিচিত, এইরকম আচরণকে বিশ্লেষণের চেষ্টায় আছে। আবার অস্ট্রেলিয়ান আদিবাসী, সাইবেরিয়ান ইনুট গোত্র আর আফ্রিকার উপজাতি, যারা এখনও প্যালিওলিথিক (middle and upper Paleolithic – second part of Stone age) যুগের মত জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত বলে ধরা যায়, তাদের উপর জেনেটিক্স পর্যেষণা করে এটাই দেখা গেছে যে গোত্রের ভেতর এইসব এ্যাল্ট্রুইষ্ট আচরণ নাকি সেইসব গোত্রের সার্বিক উপযোগিতা বৃদ্ধি করে। মনোবিদ্যার ভাষায় আবার এইসব এ্যাল্ট্রুইষ্ট আচরণ নাকি খুবই স্বাস্থ্যসম্মত psychological defense mechanism অথবা adaptations to life; এনে দেয় মানসিক প্রশান্তি পৃথিবী নামক এই বসবাসযোগ্য স্থানকে সুন্দর করার এক প্রচেষ্টায়।
এবার দেখা যাক সবকিছুর মূলে যেই জায়গাটা, সেই মস্তিষ্ক ও স্নায়ুতন্ত্রের বিদ্যা নিউরোলজী কি বলছে।
খুবই সরাসরি এই বিদ্যা আমাদের জানাচ্ছে যে আর্থিক পুরস্কার, অর্থ-সম্বন্ধীয় ব্যাপার এবং পরহিতকর কাজে অর্থদান (charitable donations) ইত্যাদি কাজে mesolimbic reward pathway সক্রিয় হয় যেটা আমাদের মস্তিষ্কের এক আদিম অংশ যা সচরাচর উজ্জীবিত হয় ক্ষুধা এবং যৌনক্রিয়া সম্পাদনে। কিন্তু যখনই সেই কিছু কিছু আজব কিসিমের মানুষ বা জন্তু অন্যের ভূমিকাকে নিজের থেকে বড় করে দেখতে শুরু করে, অন্যের জন্য করে আত্মত্যাগ, তখন subgenual cortex বা septal region নামে মস্তিষ্কের সম্পূর্ণ অন্য একটি এলাকা আলোড়িত হয়। কি হয় এই এলাকায়? হ্যাঁ, মস্তিষ্কের এই অংশ তখনই সক্রিয় হয় যখন সামাজিক বন্ধন বা সামাজিকতার ভাব কর্তৃত্ব করে আর অন্য প্রজাতির বা শ্রেণীর সাথে সম্পর্ক স্থাপন করতে চায়। তাই অন্যের জন্য এই আত্মত্যাগ বড় কোন নৈতিক ব্যাপার তো নয়, বরং খুবই সাধারণ এবং মৌলিক আমাদের মস্তিষ্কের কাছে যা কিনা একই সাথে সহজাত, অন্তর্জাত এবং শারীরিকভাবে প্রীতিকর।
৩
অভুক্ত এক বৃদ্ধ-বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে নৃশংসভাবে চিন্তিত মনে কল্পনার পকেট হাতড়িয়ে দুটো টাকা ‘নিঃস্বার্থ’ ভাবে দান করে গুনগুনিয়ে রবীন্দ্রভাষ্য আওড়াতে থাকে ছেলেটি,
আমরা লক্ষ্মীছাড়ার দল / ভবের পদ্মপত্রে জল
সদা করছি টলোমল।
মোদের আসা-যাওয়া শূন্য হাওয়া, নাইকো ফলাফল।
যদি সুখ না জোটে দেখব ডুবে কোথায় রসাতল।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।