আজ (১৪.০২.১১, সন্ধ্যা ৭টা) সন্ধ্যায় রাজশাহী মেডিক্যাল অডিটোরিয়ামে তারেক মাসুদ ও ক্যাথরিন মাসুদের রানওয়ে ছবিটি দেখলাম। তারেক মাসুদের পূর্বের প্রায় সবগুলো কাজই আমার দেখা। কাজেই তার কাজ সম্পর্কে একটা ধারণা আগে থেকেই ছিল- এবং ধরেই নিয়েছিলাম ছবিটি ভালো লাগবে, তাই বলে এতটা ভালো লাগবে আশা করিনি। আমি চলচ্চিত্রের সমালোচক নই, তবে ভক্ত বটে। ছবিটি একবার দেখাতে যে বিষয়গুলো মনে গেঁথে আছে তার কিছুটা তুলে ধরার চেষ্টা করছি এখানে।
নাম শুনে এবং পোস্টার দেখে যেটা মনে হয়েছিল- এটার সেটিং হবে বিমান বন্দর এলাকা এবং বিমানের সাথে সিনেমার পাত্র-পাত্রীদের একটা আপাত যোগসূত্রতা থাকবে। কিন্তু ছবিটা দেখার পর দেখলাম, বিমানবন্দরের সাথে বাহ্যিক অর্থে যোগসূত্রতা খুব একটা নেই, কিন্তু প্রকৃতার্থে বিমান কাহিনীর সঙ্গে প্রচণ্ড প্রাসঙ্গিক ও গুরুত্বপূর্ণ।
চলচ্চিত্রের প্রটাগোনিস্ট খুব সাধারণ ঘরের সন্তান, মাদরাসা থেকে পড়াশুনা করেছে তবে অর্থের অভাবে শেষ করতে পারেনি। ঘটনাচক্রে সহজ সরল ছেলেটি ইসলামী জঙ্গি সংগঠনের সাথে জড়িয়ে পড়ে। বাড়িতে তার মা, ছোট বোন ও দাদী।
আয় রোজগার বলতে, বাবা বিদেশে গেছে- এখনো কাজ পান নি, ছোটবোন গার্মেন্টস এ কাজ করে, মা ক্ষুদ্র ঋণের সহায়তায় গরু-বাছুর পালে। খুব সাধারণ কাহিনী। আর এই খুব সাধারণকেই তলস্তয় বলেছেন- "most simple and most ordinary and therefore most terrible." এবং সেটাই আমরা এখানে দেখতে পাই। আর পাঁচটা টিপিক্যাল দরিদ্র পরিবারের মতই সব। অথচ এই সাধারণ পরিবারের গল্পকেই চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন পরিচালক তারেক মাসুদ।
তথাকথিত মুসলিম দেশ হওয়ার দরুন এখানে এই ধরনের কাহিনীতে বিতর্ক সৃষ্টি হওয়ার একটা সম্ভাবনা থাকে। কিন্তু পরিচালক এত দক্ষতার সাথে বিষয়বস্তুর উপস্থাপনা করেছেন যে সে সম্ভাবনা সৃষ্টি হওয়ার কোনও কারণ দেখছি না। ছবিতে খুব বেশি নাটকীয়তার আশ্রয় নেননি পরিচালক, আশ্রয় নেননি নিজের কল্পনা শক্তিরও। দেখতে দেখতে মনে হয়েছে- হিডেন ক্যাম দিয়ে আমরা বাস্তবের কিছু চরিত্রের বয়ে চলা জীবনকে পর্যবেক্ষণ করছি।
ছবিটির শেষটিও হয়েছে এত তৃপ্তিদায়কভাবে যে এখানে আর কোনও সম্ভাবনার কথা মনে আসছে না।
ছবিটির আরো একটি বৈশিষ্ট্য চোখে পড়ার মত তা হলো ক্যামেরার কাজ। শুরুতেই বিমানবন্দরের আলোকসংকেত আমাদেরকে নতুন এক জগতে প্রবেশ করাই। বিমানের শব্দে দাদার বিছানা কেপে ওঠা ও মাথায় ওপর দিয়ে ঘন ঘন বিমানের আসা-যাওয়া রূপক অর্থে নিলে পুঁজিবাদী সমাজের এক গভীর-গূঢ় রহস্য ভেদ হয়ে যায়। ছবিটিতে প্রচুর symbolism-এর ব্যবহার ছবিটির শিল্প মানকে আরো বাড়িয়ে দিয়েছে। একটা পিচ্চি ছেলের বিমান তাক করে গুল্টি ছুড়ে মারাটা আধুনিক সিনেমা জগতের এক নতুন সংযোজন।
ছোট্ট একটি দৃশ্য যে একটা সিনেমাকে অমরত্ব দান করে তার প্রমাণ বাই সাইকেল থিপ। আমার মনে হয় আলোচ্য ছবিটিও এই দৃশ্যটির কারণে দর্শকদের অনেকদিন মনে থাকবে। শেষ দৃশ্যেও এসে দেখা গেছে চিত্রকল্পের এক অদ্ভূদ সমন্বয়। মূলত এই সিনেমাটিতে চরিত্রগুলোর পাশাপাশি প্রকৃতি একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। আর নতুন অভিনেতাদের raw অভিনয় এই ছবিটিকে অন্য একটি মাত্র যোগ করেছে।
এদের কাছ থেকে বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠিত শিল্পী অভিনয় শিল্পটাকে ঝালিয়ে নিতে পারেন। কৃতিত্বটা বোধহয় পরিচালককেই দিতে হয় বেশি।
ছবির শুরুতে তারেক মাসুদ বলেছেন, বর্তমান বাংলাদেশের চলচ্চিত্র শিল্প নিয়ে বেশ কিছু মূল্যবান কথা। তার কথায় জানতে পারি, তিনি একটি ছবি বানাতে যে শ্রম দেন তার থেকে বেশি শ্রম দেন টাকা জোগাড় করতে এবং আরো বেশি শ্রম দেন ছবিটি দর্শকদের দেখাতে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছবি বানানো থেকে দেখানো পর্যন্ত দায় যদি পরিচালকের উপর বর্তায় তাহলে এ লজ্জা আমাদের, এ লজ্জা আমাদের সরকারের।
‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ এর পরিবর্তে ‘সুস্ত চলচ্চিত্র ধারা’ প্রতিষ্ঠিত করাই হোক আমাদের আগামী দিনের প্রত্যয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।