আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বাংলাদেশের শেয়ার মার্কেট ক্যাসিনো অর্থনীতিতে জুয়ার বাজার



কথায় বলে 'গোদের ওপর বিষফোঁড়া'! দেশের শেয়ার বাজারে এখন যে অবস্থা চলছে তাতে তাকে সেরকম অবস্থায় নিপতিত বলে বর্ণনা করাটা যথার্থই হবে। বিষয়টির ব্যাখ্যা প্রয়োজন। প্রথমে নজর দেয়া যাক 'গোদ' বিষয়টির দিকে। তারপরে দৃষ্টি দেয়া যাবে সেই গোদের ওপর 'বিষ ফোঁড়ার' ব্যাপারটি আবার কী, সেই দিকে। আধুনিক পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে শেয়ার বাজারের গোটা ব্যাপারটি প্রধানত এক ধরনের ফটকা ব্যবসার ভিত্তির ওপর স্থাপিত ও পরিচালিত।

প্রকৃতিগতভাবেই শেয়ার ও স্টক মার্কেটের ব্যবসা এক ধরনের জুয়া খেলার মতো ব্যাপার। এখানে নির্ধারিত কর্তৃপক্ষ ও সংস্থা কর্তৃক নিবন্ধিত বিভিন্ন কোম্পানি ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মূলধনের অংশ বা শেয়ার বিক্রির জন্য বাজারে ছাড়া হয়। বিনিয়োগকারীদের হাত ঘুরে-ঘুরে এসব শেয়ারের কেনাবেচা চলে। কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানের উন্নতি-অবনতির সাথে সাথে তার শেয়ারের দাম ওঠা-নামা করবে, এমনটাই তাত্তি্বকভাবে হওয়ার কথা। কোম্পানির পারফরমেন্সে উন্নতি ঘটবে অনুমিত হলে বিনিয়োগকারীরা পরে বিক্রি করে আরো বেশি দাম পাওয়ার আশায় চলতি দামে তার শেয়ার কিনে রাখে।

শেয়ার বাজারে স্টকের (কিনে রাখা শেয়ারের) দাম ওঠা-নামা সম্পর্কে মনোগত অনুমানের ওপর ভিত্তি করে জুয়া খেলায় ভাগ্য খুঁজে পাওয়ার মতো আশায় তারা শেয়ারের রাখি ব্যবসায় টাকা খাটায়। অনেকটাই ঘোড়দৌড়ের খেলায় ঘোড়ার পেছনে বাজি ধরার মতো ব্যাপার এটি। ভাগ্যগুণে বাজির দান লেগেও যেতে পারে, অভাবনীয় পরিমাণে স্ফীত হয়ে উঠতে পারে পকেটের টাকা। আবার ভাগ্য বিরূপ হলে পকেট শূন্য হয়ে দেউলিয়া হয়ে লাল বাতিও জ্বলে উঠতে পারে। লাভ হবে না লোকসান হবে, হলে তা কি পরিমাণে হবে_এসব নির্ভর করে শেয়ার বাজারের মর্জির ওপর।

কিন্তু শেয়ার বাজারের মর্জি নির্ভর করে কার বা কিসের ওপর_ সমস্ত গোলমালটা এখানেই। বিশুদ্ধ পুঁজিবাদী বাজারের তত্ত্ব অনুযায়ী পণ্যসামগ্রী, শ্রম প্রভৃতির বাজারের মতো পুঁজি তথা শেয়ার বাজারেও মূল্য নির্ধারিত হয়ে থাকে বাজারে বিনিয়োগযোগ্য পুঁজি বা শেয়ারের সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্যের ওপর। পণ্যসামগ্রী (মড়ড়ফং), সেবাসামগ্রী (ংবৎারপবং), শ্রমশক্তি (ষধনড়ঁৎ ঢ়ড়বিৎ) ইত্যাদির একটি প্রত্যক্ষ ব্যবহারিক মূল্য আছে। কিন্তু শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকৃত পুঁজির ব্যবহারিক মূল্য হলো পরোক্ষ। শেয়ার বাজারে ব্যবহারিক মূল্য শুধু পরোক্ষই নয়, তা প্রধানত নির্ভরশীল তার ফটকামূলক (ংঢ়বপঁষধঃরাব) বৈশিষ্ট্যের ওপর।

একটি অর্থনৈতিক-সামাজিক ব্যবস্থা হিসেবে পুঁজিবাদের উদ্ভবের সূচনা থেকে দীর্ঘকাল পর্যন্ত পণ্য উৎপাদন ছিল অর্থনীতির প্রায় একচ্ছত্র খাত। সময়ের পরিক্রমায় ক্রমান্বয়ে অর্থনীতিতে পণ্য উৎপাদনের পাশাপাশি সেবা প্রদানমূলক কাজের গুরুত্ব বাড়তে থাকে। গত শতাব্দীর মধ্যভাগের পর সেবা খাতের গুরুত্ব ও অবদান বাড়তে বাড়তে একসময় প্রধান হয়ে ওঠে। এই ঘটনা দ্রুত ঘটে বিশ্ব অর্থনীতির একচ্ছত্রভাবে বৃহৎ ও নির্ধারক শক্তিরূপে অবস্থানরত উন্নত পশ্চিমা দেশগুলোতে। সেসময় থেকেই অর্থনীতিতে একই সঙ্গে বাড়তে থাকে 'স্পেকুলেটিভ' তথা ফটকামূলক পুঁজি ও ফটকামূলক খাতের গুরুত্ব।

শেয়ার বাজার, স্টক মার্কেট, মুদ্রা বাজার প্রভৃতিতে পুঁজি বিনিয়োগ অকল্পনীয় দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে এই ফটকাবাজি খাত বিশ্ব অর্থনীতির প্রধান খাতে পরিণত হয়েছে। পুঁজিবাদী ব্যবস্থায় উৎপাদন-বণ্টন-ভোগ প্রভৃতির ক্ষেত্রে স্থিতিশীল ধারাবাহিক গতি বজায় রাখা যে অসম্ভব এবং অপরিকল্পিত অতি-উৎপাদন ও উৎপাদন-ঘাটতির চক্রাকারে পুনঃ পুনঃ অবির্ভাবসহ নৈরাজ্যমূলক সঙ্কট সৃষ্টি যে অনিবার্য তা কার্ল মার্কসসহ অনেক পন্ডিত ব্যক্তি তাত্তি্বকভাবে দেখিয়ে গেছেন। পুঁজিবাদের অন্তর্নিহিত নৈরাজ্য সম্পর্কিত এই তত্ত্বের বাস্তব প্রমাণ আমরা বিগত এক-দেড় শতাব্দী ধরে ক্রমাগত দেখে আসছি। অর্থনীতিতে চাঙ্গা ভাবের পরেই উদ্ভব হয় মন্দার।

সেই মন্দার পরিস্থিতি উত্তোরিত হয়ে একসময় আসে রমরমা অবস্থা। কিন্তু কিছুদিন পর আবার ফিরে আসে মন্দা। মাঝে মাঝে সৃষ্টি হয় মহামন্দা। তাতে কোটি কোটি মানুষ আর্থিকভাবে দেউলিয়া হয়ে যায়। সময়ের পরিক্রমায় অর্থনীতি যত পরিমাণে পণ্য খাত থেকে সেবা খাতের এবং তা থেকে ক্রমান্বয়ে ফটকাবাজি খাতের প্রাধান্যের দিকে উত্তরিত হয়েছে, সেই পরিমাণে অর্থনীতিতে অস্থিতিশীলতা ও নৈরাজ্যের পরিমাণও বৃদ্ধি পেয়েছে।

এর কারণ, পণ্য ও সেবা খাতের তুলনায় ফটকাবাজি খাতে অস্থিতিশীলতা ও নৈরাজ্যের উপাদান অনেক বেশি। স্টক মার্কেট, শেয়ার মার্কেট, কারেন্সি মার্কেট প্রভৃতি ফটকাবাজির বাজারে, বিশেষত শেয়ার বাজারে, মূল্য নির্ধারিত হয় সরবরাহ ও চাহিদার উঠতি-পড়তি দ্বারা। কিন্তু এই সরবরাহ ও চাহিদা বস্তুগত ব্যবহারিক প্রয়োজন (যার বাড়া-কমা তুলনামূলকভাবে ধীর ও স্বল্প) দ্বারা মোটেও নির্ধারিত হয় না। তা মূলত নির্ধারিত হয় বাজারে বিরাজমান নির্দিষ্ট মুহূর্তের বাজার-মনস্তত্ত্বের দ্বারা। বাজার-মনস্তত্ত্বের হাল কি হবে সে বিষয়ে অনিশ্চয়তার পরিমাণ অনেক বেশি হওয়ার কারণেই অস্থিতিশীলতা ও নৈরাজ্যের উপাদান এক্ষেত্রে অনেক বেশি।

বাজার-মনস্তত্ত্বে যদি 'ভয়ের' প্রাধান্য থাকে তাহলে বিনিয়োগকারীরা চিন্তা করবে যে এখন শেয়ারের দাম কমতে থাকবে। এই অনুমান করে তারা তাদের হাতে থাকা শেয়ার বিক্রি করার প্রবণতায় ধাবিত হবে। এর ফলে বাজারে বিক্রিযোগ্য শেয়ারের সরবরাহ বাড়বে। শেয়ারের দাম কমতে থাকবে। ভয়ের বাজার-মনস্তত্ত্বের বদলে যদি 'লোভের' মনস্তত্ত্বের প্রাধান্য হয়, তাহলে, শেয়ারের দাম এখন বাড়তে থাকবে এই অনুমানের ওপর ভিত্তি করে শেয়ার কেনার প্রবণতা বৃদ্ধি পাবে।

ফলে শেয়ারের চাহিদা বাড়ায় তার দামও বাড়তে থাকবে। 'ভয়' না 'লোভ', বাজার-মনস্তত্ত্বে কোন ধারণা বিনিয়োগকারীদের মনে প্রাধান্য বিস্তার করে রয়েছে, তার ওপর নির্ভর করে শেয়ার মূল্যের ওঠা-নামা। ('ভয়' আর 'লোভের' ওঠা-নামার ওপর নির্ভর করছে বিশ্ব পুঁজিবাদের স্থিতিশীলতা। মানুষের কল্যাণের বিবেচনার পরিবর্তে 'ভয়' ও 'লোভ' দ্বারা যে ব্যবস্থার ভাগ্য নির্ধারিত হয়, সেটাকে 'সভ্যতা' না বলে 'অসভ্যতা' বলাটাই কি অধিকতর যুক্তিযুক্ত নয়?) শেয়ার বাজারকে কেন্দ্র করে কোন মনস্তত্ত্বের প্রাধান্য থাকবে, 'ভয়ের' না 'লোভের' সেটা প্রধানত অনুমান নির্ভর। একটি নির্দিষ্ট কোম্পানি অথবা প্রতিষ্ঠানের পারফরমেন্সের প্রবণতা থেকে তার সম্ভাব্য উত্থান-পতন সম্পর্কে অনুমান করা যায় মাত্র।

অনেক কারণে সেই অনুমান ভুল প্রমাণিত হতে পারে। পুঁজিবাদী অর্থনীতির গতিধারার অন্তর্নিহিত অনিশ্চয়তা ও নৈরাজ্যের প্রভাবে যেকোনো অনুমান ওলট-পালট হয়ে যেতে পারে। গোটা শেয়ার বাজার সম্পর্কে একই যুক্তি প্রযোজ্য। তদুপরি অর্থনৈতিক বিষয়বস্তু ছাড়াও নানান প্রাকৃতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক ইত্যাদি ঘটনাবলী দ্বারাও 'ভয়' বা লোভের' মনস্তত্ত্ব নির্ধারিত হয়ে থাকে। এসব ঘটনায় কখন কি ঘটবে তার ভবিষ্যদ্বাণী করা দুরূহ।

এ বিষয়ে অনিশ্চয়তার উপাদান আরো গভীর। এই কারণে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগের বিষয়টি চূড়ান্ত বিচারে একটি 'ভাগ্যের খেলা'। এ খেলায় নেমে কারো কপাল খুলতেও পারে, কারোটা আবার ভাঙতেও পারে। কারো কপাল আবার সকাল-বিকাল কিংবা আজ-কালের মধ্যে ভাঙা-গড়ার দোলায় এ-মাথা থেকে ও-মাথায় গড়াগড়ি খেতে পারে। এটি হচ্ছে অনেকটাই বিনোদন পার্কের 'রোলার কোস্টার'-এর মতো ব্যাপার।

প্রকৃতিগত বিবেচনা থেকে শেয়ার বাজারকে তাই জুয়ার বাজার রূপে আখ্যায়িত করা যায়। শেয়ার বাজারসহ ফটকাবাজি অর্থনীতি এখন পুঁজিবাদী ব্যবস্থার প্রধান খাত হয়ে উঠেছে। সবকিছুই তাই জুয়া খেলার বৈশিষ্ট্য দ্বারা প্রভাবিত ও পরিচালিত হচ্ছে। আধুনিক পুঁজিবাদের এই স্বরূপ অনুধাবন করে কমরেড ফিদেল কাস্ত্রো দুই দশক আগেই গোটা ব্যবস্থাকে 'ক্যাসিনো ইকোনমি' হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। ক্যাসিনো হলো সেই স্থান যেখানে নানা পন্থার উঁচু দরের জুয়া খেলা হয়।

এই নামকরণ যে কতো যথার্থ তা সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে ও হচ্ছে। শেয়ার বাজার বহুলাংশেই ক্যাসিনো তথা জুয়ার বাজারের মতো একটি স্থান। রাতারাতি বাজি মাত করার লোভ দেখিয়ে লাখ-লাখ মানুষকে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে প্রলুব্ধ করা হয়। সহজে মুনাফা লাভের আশায় লোভে পড়ে পেনশনের টাকায়, ঘর-বাড়ি বিক্রি করে, ঋণ করে_ নানাভাবে অর্থ সংগ্রহ করে তারা ছুটে আসে শেয়ার বাজারে। উৎপাদনশীল বিনিয়োগ, নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি ইত্যাদি ক্ষেত্রে যে স্থবিরতা চলছে, এবং শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা যেভাবে বাড়ছে তাতে 'সহজে টাকা কামাই'-এর এই প্রলোভনে মরণ ঝাঁপ দেয়াটা দেশের লক্ষ লক্ষ সাধারণ মানুষের জন্য অস্বাভাবিক নয়।

কিন্তু 'স্বাভাবিক' নিয়মেই যখন শেয়ার বাজারে 'অস্বাভাবিক' ধস নামে, তখন তাদের পথে বসা ছাড়া কোনো উপায় থাকে না। এই পরিণতি নেমে আসে সাধারণ ক্ষুদে বিনিয়োগকারীদের ভাগ্যে। কিন্তু শেয়ার বাজারের বড় বড় চাঁই ও প্রতিষ্ঠানগুলোর অপার আর্থিক সামর্থ্য থাকায় তারা শেয়ার বাজারের ধসের সময়ের সঙ্কট উৎরে উঠতে সক্ষম হয়। ফলে ধসের পর যখন শেয়ার বাজার আবার চাঙ্গা হয়ে ওঠে তখন পথে বসা লক্ষ-লক্ষ ক্ষুদে বিনিয়োগকারীর হারানো টাকা এসে জমা হয় এই সব বড়-বড় বিনিয়োগকারীর হাতে। শেয়ার বাজারের ইচ্ছানিরপেক্ষ একটি বৈশিষ্ট্যই হলো, তা ক্ষুদে পুঁজি সৃষ্টি করতে সমর্থ হয়।

আর, তারপর সেই পুঁজি তার মালিকের হাত থেকে স্থানান্তর করে বড় পুঁজির মালিকদের হাতে কেন্দ্রীভূত করে। বড় আরো বড় হয় এবং ছোট আরো ছোট হতে হতে একসময় সর্বস্বান্ত হয়। এসবই হলো 'গোদ' বিষয়ক সমাচার। তার ওপরে 'বিষ ফোঁড়ার' আবির্ভাব ঘটে তখন, যখন উপরন্তু শেয়ার বাজারকে তার স্বাভাবিক নিয়মকানুন লঙ্ঘন করে অসাধু পন্থায় প্রভাবিত করতে জোচ্চুরির আশ্রয় নেয়া হয়। ১৯৯৬ সালে সে ধরনের একটি বিশাল জোচ্চুরির ঘটনা ঘটেছিল।

সুপরিকল্পিতভাবে নির্দিষ্ট কয়েকটি শেয়ারের কেনাবেচার পরিমাণ ম্যানুপুলেট করে সে সব শেয়ারের দাম অস্বাভাবিক বাড়ানোর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এর প্রভাবে সমস্ত শেয়ার বাজারের মূল্যসূচক ফুলেফেঁপে উঠেছিল। হাজার হাজার মানুষের বিনিয়োগ করতে ছুটে এসেছিল শেয়ার বাজারে। অপরাধী জোচ্চোর চক্র তখন শেয়ারের বেড়ে যাওয়া দামে তাদের হাতে থাকা বিশাল পরিমাণের শেয়ার হঠাৎ করে বিক্রি করে দিয়েছিল। রাতারাতি কয়েক হাজার কোটি টাকার মুনাফা কামিয়ে নিয়ে তারা কেটে পড়েছিল।

কিন্তু বাজারে শেয়ার বিক্রির পরিমাণ অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় ধস নেমেছিল শেয়ারের দামে। পথে বসেছিল 'বাতাসে উড়া টাকা ধরতে আসা' অবুঝ সাধারণ বিনিয়োগকারীরা। জোচ্চুরি ধরা পড়েছিল। অনুসন্ধান করে খলনায়কদের চিহ্নিতও করা হয়েছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত তাদের বিচার ও শাস্তি হয়নি।

গত ১ মাসের মধ্যে পর পর দুই দফায় আবার শেয়ার বাজারে রেকর্ড দরপতন ঘটেছে। প্রথম দফায় কয়েকদিনে দেড় হাজার পয়েন্ট এবং পরের বার প্রায় দুই হাজার পয়েন্ট দরপতন ঘটেছে। শেয়ার বাজারের ৩৩ লক্ষ সাধারণ বিনিয়োগকারীর অধিকাংশই ইতোমধ্যে বিপুল লোকসানের শিকার হয়েছে। শেয়ার বাজারের মোট লোকসান হয়েছিল প্রথম দফায় প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা এবং দ্বিতীয় দফায় প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। ১০ জানুয়ারি ১ দিনে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সূচক পড়ে গিয়েছিল ৬৬০ পয়েন্ট।

ভয়াবহ দরপতনের এই 'কালো সোমবারের' পরদিন ১১ জানুয়ারি ঘটেছে মূল্যসূচক উত্থানের বিস্ময়কর চমক। সূচক ১ দিনে লাফিয়ে ১ হাজার ১২ পয়েন্ট বেড়েছিল। রাজপথে বিনিয়োগকারীদের সহিংস বিক্ষোভকে আপতত স্থিমিত করা সম্ভব হয়েছে। কিন্তু যেসব পন্থা অবলম্বন করে তা করা হয়েছে, সেসবের ভবিষ্যৎ ফলাফল সম্পর্কে গভীর সংশয় ও উৎকণ্ঠা রয়েছে। প্রায় সব বিশেস্নষকেরই রায় হলো, শেয়ার মার্কেট স্থিতিশীল হয়েছে এমন কথা মোটেও বলা যাবে না।

সঙ্কটের আরো বড় টাইম বোমা বিস্ফোরিত হওয়ার অপেক্ষায় আছে। এই সতর্কবাণী কেবলমাত্র 'নিরাশাবাদীদের বচন' নয়। দেশের গোটা অর্থনীতি এক ধরনের গোড়ায় গলদ নিয়ে চলছে। শেয়ার মার্কেটে বিনিয়োগের যে বিশাল বিস্তৃতি ঘটেছে, সেই তুলনায় পণ্য ও সেবাখাতে প্রবৃদ্ধি অতি নগণ্য। সুতরাং কোনো বস্তুগত ভিত্তি ব্যতিরেকেই অনেকটাই কেবলমাত্র হাওয়ার ওপরে শেয়ারের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে চলেছে।

এই অবস্থা বাতাসের বুদ্বুদ অথবা ফুলানো বেলুনের মতো অতি ভঙ্গুর হতে বাধ্য। ইংরেজিতে একে 'বাবল ইকনমি' বলা হয়। এক মুহূর্তের খোঁচায় ফুলানো বেলুনের চুপসে যাওয়ার মতো বাজার সম্পূর্ণ ধসে পড়ে মহামন্দার পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে পারে। তাছাড়া, বাণিজ্যিক ব্যাংকসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো পণ্য ও সেবাখাতে বিনিয়োগের প্রতি দৃষ্টি দেয়ার বদলে দ্রুত মুনাফার লোভে শেয়ার বাজারে ঢুকে পড়েছে। এর ফলে অন্যান্য ক্ষতিকর ফলাফলের পাশাপাশি শেয়ার বাজার বড় বড় বিনিয়োগকারীদের হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে।

জুয়া হলো এমনিতেই ভাগ্যের খেলা, যে খেলা একসময় নেশার টানে পাকা জুয়াড়িকেও পথের ভিখারী বানিয়ে দেয়। তার ওপরে জুয়ার আসরে যদি জোচ্চুরি থাকে, তাহলে সাধারণ খেলোয়াড়দের সব হারিয়ে ফকির হওয়াটা প্রায় নিশ্চিত একটি ব্যাপার মাত্র। যুধিষ্ঠিরকে পাশা খেলার বাজিতে দ্রৌপদীসহ সর্বস্ব হারাতে হয়েছিল। একেতো তা ছিল ভাগ্যনির্ভর খেলা। তার ওপর, দুর্যোধনের মন্ত্রণাদাতার ভূমিকায় ছিল তার দুষ্ট 'শকুনী মামা'।

'গোদের ওপর বিষফোঁড়া' হলে তা থেকে বাঁচার উপায় নিঃসন্দেহে খুব দুঃসাধ্য। শেয়ার বাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা অবস্থার ফেরে আজ সেই সর্বনাশা 'ভাগ্যের খেলার' অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছে। মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম: সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি ( সিপিবি), সংগ্রহ: সাপ্তাহিক একতা।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.