আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

রংপুর মেডিক্যালে এক ঘণ্টা



দুলাভাই ভয়াবহ কিডনি রোগে আক্রান্ত, হাসপাতালে নেয়া হয়েছে কদিন আগে। তাকে দেখতেই সেখানে এ ভ্রমণ। দোতলায় উঠবো বলে সিঁড়ি নিলাম। এটা সত্যিই হাসপাতালের সিঁড়ি তো। এ আমি কি দেখছি! এক থেকে দু ইঞি পরিমাণ বহু দিনের পুরনো ময়লা, উৎকট গন্ধ ছড়াচ্ছে, মাছি উড়ছে।

আচ্ছা ডাক্তারগন কখন ও এ সিঁড়ি ব্যাবহার করে কি ? না বোধহয়, তারা অনেক উপরতালার মানু্ষ, আলাদা ব্যাবস্থা নিশ্চয় আছে। এগুলো ক্লিন করার লোক ও নেই মনেহয়। থাকলে তো তারা তাদের কাজ করত। কি জানি বাপু, আমি দেশের প্রশানিক লেভেলে কাজ করিনি, কেমনে বুঝব ওখানকার নিয়মকানুন। ও অনেক জটিল বিষয়, আমার বোঝার অনেক বাইরে।

থাক নিচে তাকানোর দরকার কি, বরং দুইপাশের দেয়াল দেখতে দেখতে ঊঠি। ও মা তাও কি রক্ষে আছে ? কালচে ময়লায় ঢাকা সাদা ওয়াল, তাতে কত কিছু লেখা ! লেখকদের মনের যত সুখ এবং বেদনার সাক্ষী বহন করছে লেখাগুলো, তাই বোধহয় কর্তপক্ষ সযত্নে লালন করছে। কে জানে বাপু, ঐ যে বল্লাম, আমার ছোট মাথায় এতসব খেলে না। করিডর পেরিয়ে যখন ওয়ার্ডে ঢুকছিলাম, মনে হল, কোন জনসমাবেশ পেরিয়ে যাচ্ছি, চারদিকে ব্যাপক কোলাহল, যে যত পারছে, সমস্বরে একে অপরের সাথে কথা বলছে। এদের কে নিষেধ করার কি কেউ নেই এখানে? নাকি থাকলে ও কে শোনে কার কথা! অবশেষে আমার দুলাভাইয়ের দেখা পেলাম।

আহারে বেচারা, বিশালদেহী এই মানুষটার আজ একি হাল হয়েছে, বুকটা ভেঙ্গে আসছিল যেন। খেতে ভীষণ রকম পছন্দ করতেন, আর এখন খেলেই শেষ! আমার আপার একি চেহারা হয়েছে! আমাকে দেখা মাত্রই দুলাভাই বলতে লাগ্লেন, কিভাবে সেখানে থাকা যায়, ছুটির দিন থাকায় গত ৩ দিন কোন ডাক্তার আসেনি, সবেমাত্র মেডিক্যালএ ফিফথ ইয়ার শেষ করেছে, তারাই বিশাল এই হাসপাতালের সব রোগীর দেখভাল করছে। পরিচিত এক ছোট ভাইয়ের ( ইনটার্নি করছিল) কাছে জানলাম, ডাক্তার রা কখনই রাতের শিফটে কাজ করে না, যদি ও তাদের চাকরীর শর্তে বলা আছে, কিন্তু তাতে কি, কাঊকে তো জবাবদিহিতা করতে হচ্ছে না এ জন্য বেতন ও কাটা যাচ্ছে না। তাছাড়া, তারা ও রক্ত মাংসের মানুষ, হাসপাতালের ডিঊটির বাইরে তাদের কত জরুরী কাজ থাকে প্রতিদিন, অমুক খানে প্রাইভেট প্রাকটিস, তো আরেক জায়গায় অপারেশন করতে হয় ইত্যাদি ইত্যাদি। এতকাজের পরে পরিবারের আপনজনের ও একটা আবদার থাকে! তাই রাতটাই এক মাত্র বরাদ্দ।

হাসপাতালের বেডগুলো, কত বছরের পুরান, তা কেউ ঠিকভাবে বলতে পারল না, রোগীরা সবাই যার যার সাধ্যমত কাথা-বালিশ এনেছে। রোগী এবং তাদের সাথে আসা স্বজনের ভারে গিজ-গিজ করছে পুরো ওয়ার্ড টা, গুরতর অসুস্থ্য রোগীরা যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, স্বজনরা পাহাড় সম কষ্ট নিয়ে অপেক্ষা করছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা, যদি কোন ডাক্তার আসে! মনটা ভীষণ ভারী হয়ে উঠছে। আল্লাহকে অসংখ্য ধন্যবাদ দিলাম মনে মনে, আমাকে সুস্থ্য রাখার জন্য। আমি গণনা করার সাহস পেলাম না, সর্বমোট কতজন লোক সেখানে অবস্থান করছিল তখন। কয়েক গুন বেশী হবে এই আর কি।

আমার এ গরীব দেশে এটাই তো স্বাভাবিক। বাসে আসন সংখার অতিরিক্ত যাত্রী উঠবে, লঞ্চ বা ইস্টিমারে ধারণ ক্ষ্মমতার বহুগুন যাত্রী উঠবে, ট্রেন বা বাসের ছাদ এর এক ইঞি ও ফাকা রাখা চলবে না। ফুটপাত, সে আবার কি জিনিষ ভাই, দোকানদার আর হকার রা তাহলে কোথায় বেচবে তাদের মালামাল, এটাই যে তাদের একমাত্র জীবিকার উপায়। আমার চিন্তায় ছেদ পড়ল আপার কথায়, “একটু এখানে থাক, আমি টয়লেট থেকে ঘুরে আসি”। আমি ভাবলাম, ওর সাথে যাই, স্বচক্ষে দেখিতো রোগী এবং তাদের স্বজনরা কিভাবে এই মৌলিক কাজটা সারছে।

এইবার আমার গা গুলিয়ে বমি চলে আসলো। ছোটখাটো একটা ময়লা পানির খাল বয়ে যাচ্ছে যেন। মশা-মাছির নিরাপদ বাস-স্থান, রোগ-জীবানু ছড়ানোর উত্তম জায়গা নিঃসন্দেহে । আর অসহনীয় দুরগন্ধের কথা নাইবা বললাম! জানতে পারলাম, দিনে একবার থেকে দুবার ক্লিন করা হয়, সাপ্তাহিক বা অন্য কোন ছুটির দিনে (বিরধী দলের ডাকা হরতাল, এই দিবস, সেই দিবস, কর্মচারী ধর্মঘট ইত্যাদি ইত্যাদি। ) তাও হয়না, আর আমাদের স্বভাব কে না জানে! ভাবছি, আপার মত মাতরাত্মক মাত্রার পরিচ্ছন্ন মেয়েটা ওখানে যেতে পারল কিভাবে! বিপদে পরলে মানুষ কতকিছুই না পারে, বিশ্বাস করলাম আরেকবার।

আর যাই হোক, এটা রোগ নিরাময়ের কেন্দ্র না, রোগ-জীবাণু টেনে আনার জায়গা। আমার রোগী দেখা শেষ, এবার ফেরার পালা, আবার সেই সিঁড়ি বেয়ে নামতে হবে, ওয়াক্‌ ওয়াক্‌। নাহ্‌ সে খারাপ লাগা জল হয়ে গেল একটু পরেই এখানে আসা অনেকের কথা ভেবে । আমার প্রিয় আপা –দুলাভাইকে এখানে আর ও কয়েক ঘণ্টা অতিক্রম করতে হবে সে আতংকে, আর তাদের সহযাত্রী হাজার জনের কষ্টের কথা ভেবে। জাতীয় সম্পদের কি ভয়ানক অপচয় দেশের সর্বত্র ! দেশপ্রেমের কি বিরাট নমুনা দেখলাম আজ।

অথচ সুন্দর বনকে বিশ্বের সেরা প্রাকৃতিক সৌন্দের্যের স্বীকৃতি আদায়ের কতনা চেষ্টা দেশের তরুন সমাজের, দেশের সচেতন জনসাধারণের! ফেসবুকে গ্রুপের পর গ্রুপ, পত্রপত্রিকায় লেখনির পর লেখনি । কি হবে তা দিয়ে আমার, সেখানে ও নিশ্চয় মৌলিক সুবিধার কথা কখনই ভাবা হবে না। কই দেশের তরুণ সমাজকে তো কোনদিন শুনলাম না রাস্তাঘাট পরিছন্ন রাখার কিংবা পাবলিক পার্ক গুলো রক্ষার জন্য সামাজিক আন্দলনের ডাক দিতে, ফেসবুকে কোন গ্রুপ খুলতে। এজন্য একটা হরতাল হলে কেমন হত কে জানে ! উপসংহারঃ কত মানুষ বেকার পরে আছে দেশে, সরকার কি পারে না এইসব হাসপাতাল গুলোতে লোক নিয়োগ দিতে, যারা প্রতিদিন হাসপাতালের সিঁড়ি গুলো পরিষ্কার করবে? টয়লেট গুলো প্রতি ঘণ্টায় ঘণ্টায় ক্লিন করবে? রোগীদের বেড গূলো ক্লীন করবে? ভয়াবহ বেকার সমস্যা সমাধানের কত উপায় আছে । নেই শুধু সদিচ্ছা।

নেই কোন প্রকৃত পরিকল্পনা এবং সেগুলোর বাস্তবায়ন। জায়গামত সরকারী ব্যয় করা হোক, এবং ন্যুনতম মজুরিতে লোকবল নিয়োগ দেয়া হোক, বেকার সমস্যা ও কিছুটা কমবে, এইসব দুর্বিসহ ভোগান্তি ও কমবে খানিকটা। তবে সবার আগে চাই সততা, সবার সহযোগীতাপুর্ন মনোভাব। সর্বপরি যার যা কাজ তা করার মানসিকতা। সবার কাজের প্রতি সমান শ্রদ্ধাবোধ, যেটা আমাদের দেশের কর্মক্ষেত্রে দেখা যায় না ।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.