পর্ব - ১ পর্ব - ২ পর্ব - ৩ পর্ব - ৪ পর্ব - ৫
An alleged scientific discovery has no merit unless it can be explained to a barmaid.
-Ernest Rutherford
অবশেষে পরমাণুর বিভাজন-
১৯১৮ সালে ট্রিনিটি কলেজের প্রধানের পদ শুন্য হবার পর তা জে.জে. টমসনকে অফার করা হয়। তিনি তখন ৬১ বৎসর বয়সী এবং বৃটিশ বিজ্ঞানীদের মাঝে সেরা বলে স্বীকৃত। তিনি ১৯১৯ এ Cavendish Professorship থেকে পদত্যাগ করেন এবং পদার্থবিদ্যা বিভাগের এক বিশেষ প্রফেসরশীপ গ্রহণ করেন। তিনি আশা করেছিলেন যে গবেষণাগারের নিয়ন্ত্রণ তারই থাকবে।
ক্যাভেন্ডিশ প্রফেসর হিসেবে আর্নেষ্ট রাদারফোর্ডই ছিলেন সবার অবভিয়াস চয়েস।
কিন্তু রাদারফোর্ড জানতেন যে টমসন গবেষণাগারের কর্তৃত্ব রাখতে চান। তিনি ক্যাভেন্ডিশের পূর্ণ ডিরেক্টোরিয়াল কন্ট্রোল পাবার শর্তেই কেবল ম্যানচেষ্টার ছেড়ে যেতে রাজী ছিলেন। তিনি টমসনের সাথে তার বন্ধুত্ব ক্ষুণ্ণ হবে ভেবে প্রথমে এতে রাজী হননি।
সৌভাগ্যবশতঃ দু বৈজ্ঞানিক এটা নিয়ে আলোচনার পর স্থির হয় যে, রাদারফোর্ড গবেষণাগারের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে থাকবেন, তবে টমসনও তার আগ্রহের বিষয়গুলো নিয়ে গবেষণা করতে পারবেন। যদি কোন এমন ছাত্র পাওয়া যায়, যার আগ্রহী বিষয় টমসনের সাথে মিলে যায়, তবে রাদারফোর্ড তাকে টমসনের কাছে পাঠাবেন।
এ ধরণের সমঝোতার ফলে দু বৈজ্ঞানিকেরই তাদের চিরস্থায়ী বন্ধুত্বে ফাটল না ধরিয়ে ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবরেটরীতে গবেষণার সুযোগ ছিলো।
রাদারফোর্ড একেবারে শেষ মুহূর্তে ইলেকশানের দিন টেলিগ্রামের মাধ্যমে ঐ পদের জন্য আবেদন করেন। অবশেষে ১৯১৯ এর ২রা এপ্রিল ৪৭ বৎসর বয়সে নিউক্লিয়ার পদার্থবিদ্যার জনক Cavendish Professor হিসেবে নিযুক্ত হন।
যদিও প্রায় দশ বছর আগেই তিনি প্রমাণ করেন যে অ্যাটমের চেয়ে ব্যাসে প্রায় হাজারগুণে ছোট কেন্দ্রে ধণাত্মক চার্জগুলো জোটবদ্ধ থাকে; এরপর তিনি চেষ্ট করলেন যে এই প্রায় গোলকাকার কেন্দ্রকে বিভাজন করা যায় কিনা।
মার্সডেন বেশ কিছু মৌলকে আলফা কণা দিয়ে বোম্বার্ড করে দেখলেন অনেক ক্ষেত্রে মূল আলফা কণার সংখ্যার চেয়ে প্রায় চারগুণ হাইড্রোজেন আয়ন পরমাণুর ভেতর থেকে বার হচ্ছে।
এদেরকে বলা হতো 'knock-on' protons। রাদারফোর্ড সন্দেহ করলেন যে আলফা কণাগুলো পরমাণু-কেন্দ্র থেকে knocking out particles। সুতরাং তিনি নিজস্ব পরীক্ষা শুরু করলেন।
তিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ১৯১৭'র শেষ দিকে তার পরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। একদিন তিনি তার কাজে এতই মগ্ন ছিলেন যে তিনি ওয়ার রিসার্চ কমিটির এক গুরুত্বপূর্ণ মিটিং মিস করলেন।
তিনি তার অনুপস্থিতিকে ব্যাখ্যা করেছিলেন-
'I have been engaged in experiments which suggest that the atom can be artificially disintegrated. If it is true, it is of far greater importance than a war!'
ম্যানচেষ্টারে থাকার সময়েই ১৯১৮'তে রাদারফোর্ড প্রমাণ করেন যে নাইট্রোজেন পরমাণুকে ভেঙ্গে অক্সিজেন ও হাইড্রোজেন তৈরী করা সম্ভব। যদিও তিনি স্বর্ণ তৈরী করেননি তবুও তার এই পরীক্ষা আলকেমিষ্টদের দীর্ঘ লালিত স্বপ্ন, এক পদার্থকে আরেক পদার্থে রূপ দেয়াকে বাস্তবে সম্ভব করে। তিনি ১৯১৯ সালে তার রিসার্চ প্রকাশ করেন এবং পত্র-পত্রিকায় তা হেডলাইন হয়। ১৯৩০ এর দিকে লোকের ধারণা ছিলো যদি কখনও পরমাণু বিভাজন করা হয় তবে পৃথিবী ধ্বংস হবে। কিন্তু রাদারফোর্ড তার প্রায় দশ বছর আগেই পরমাণুকে ভাঙ্গতে সক্ষম হন।
তিনি অবশ্য তখনও প্রোটন কে 'unknown particle' হিসেবে বলেছিলেন।
১৯১৯ থেকে ১৯২৩ পর্যন্ত তিনি এবং James Chadwick আরও কয়েকটি পরমাণু ভাঙ্গতে সক্ষম হন। সকল ক্ষেত্রেই আলফা কণা ব্যবহার করা হয় এবং সবসময়ই সেই অজ্ঞাত কণা'র দেখা পাওয়া যায়। তারা সিদ্ধান্তে পৌছালেন যে সব ভারী মৌলই হালকা মৌল দিয়ে তৈরী। সব নিউক্লিয়াসই হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াস (proton) এবং হিলিয়াম নিউক্লিয়াস (alpha particle) দিয়ে তৈরী।
সেই সাথে একটি ভবিষ্যতবাণীকৃত কণাও (নিউট্রন) থাকে যার ভর হাইড্রোজেন নিউক্লিয়াসের সমান কিন্তু চার্জ নিউট্রাল।
দুর্ভাগ্যবশতঃ তাদের পরীক্ষা আলফা কণার গতির ওপর নির্ভরশীল ছিলো। রাদারফোর্ড রেডিয়াম নির্গত স্বাভাবিকভাবে পাওয়া আলফা কণা ব্যবহার করতেন। যেহেতু আলফা কণা ধনাত্মক, তাই এটা পরমাণুর কাছে যাওয়া মাত্র বিকর্ষিত হতো। এই বিকর্ষণ বল আলফা আর নিউক্লিয়াসের মধ্যবর্তী দূরত্বের বর্গের ব্যস্তানুপাতিক হারে বেড়ে যেত।
পরমাণু ভাঙ্গার জন্য আলফা কণাকে এই শক্তিশালী বলকে অতিক্রম করে নিউক্লিয়াসের ভেতর ঢুকতে হবে। সুতরাং একে অত্যন্ত দ্রুত আর উচ্চ শক্তির অধিকারী হতে হবে। স্বাভাবিকভাবে পাওয়া আলফা কণাগুলোর নিউক্লিয়াসের চতুর্দিকের ফোর্সফিল্ডকে অতিক্রম করার মত বেগ হতোনা।
সুতরাং কণাকে ত্বরাণ্বিত করার কোন উপায় প্রয়োজন হয়ে পড়লো। সেই সাথে শুরু হলো আজকের যুগের অতিকায় collider এর দিকে যাত্রা।
১৯২৫ এর নভেম্বরে Sheffield University'র এক লেকচারে Thomas Edward Allibone প্রথম রাদারফোর্ড আর চ্যাডউইকের মৌলের রূপান্তরের কথা শোনেন। তিনি Metropolitan-Vickers Electrical Company'তে কাজ করেছিলেন। তার ইচ্ছে ছিলো কৃত্রিম উপায়ে কণা ত্বরাণ্বিত করার জন্য হাই-ভোল্টেজ মেশিন তৈরী করা। তিনি ক্যাম্ব্রীজে পোষ্ট-গ্র্যাজুয়েট বৃত্তির জন্য দরখাস্ত করেন এবং ১৯২৬ এর মার্চে রাদারফোর্ডের সাথে দেখা করার আমন্ত্রণ পান।
রাদারফোর্ড অ্যালিবোনের প্রস্তাব শোনার পর তাকে এক রুমে নিয়ে বলেন - 'the biggest room we have'।
ঘরের সিলিং অন্য রুমের চেয়ে উঁচু ছিলো। তিনি জানতে চাইলেন - 'Is this room high enough for you?'। অ্যালিবোনের যন্ত্রে ভোল্টেজের মাত্রা যন্ত্রের উচ্চতার ওপর নির্ভরশীল ছিলো। অ্যালিবোন ঘরটি দেখে ভেবেছিলেন সেখানে ৫,০০,০০০ ভোল্ট তৈরী সম্ভব। রাদারফোর্ড ধারণা করে ছিলেন যে বড় ধরণের ধনাত্মক আয়নের পক্ষে নিউক্লিয়াসে প্রবেশ সম্ভব নয়, কিন্তু হয়তো ইলেক্ট্রন পারবে।
তাই তিনি অ্যালিবোনের প্রস্তাব গ্রহণ করেন এবং তাকে এই উচ্চ বিভব, ডিসচার্জ টিউবের ভেতর ইলেক্ট্রনের ওপর অ্যাপ্লাই করতে বলেন।
অ্যালিবোন সে বৎসর অক্টোবরে ক্যাভেন্ডিশে কাজ শুরু করেন। তিনি ১৯২৭ এ একটি Tesla transformer তৈরী করেন এবং এমন ডিসচার্জ টিউব তৈরীর চেষ্টা করেন যেটা কয়েক লাখ ভোল্ট উইথস্ট্যান্ড করতে পারবে। রাদারফোর্ড কাজের অগ্রগতিতে খুশি হয়ে নভেম্বরে Royal Society'তে বলেন -
'it has long been my ambition to have available for study a copious supply of atoms and electrons which have an individual energy far transcending that of the alpha and beta-particles from radioactive bodies.'
তার এই উক্তি সাড়া পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের মাঝে কণা-অ্যাক্সেলারেটর নিয়ে কাজের আগ্রহ তৈরী করলো।
অ্যালিবোনের টেসলা ট্র্যান্সফর্মার উচ্চ ভোল্টেজের জন্য খুব কাজের উৎস ছিলো, যদিও এটা জোরালো এবং শ্রুতিকটু শব্দ তৈরী করতো।
তাছাড়া এটা radio interference তৈরী করতো যা কাছাকাছি অন্য এক্সপেরিমেন্টে ব্যাঘাত ঘটাতো। এক পর্যায়ে দেখতে চাওয়া হলো এটার Tesla frequency discharge মারাত্মক কিনা? সুতরাং একদল দর্শক যার ভেতর মেডিক্যাল পার্সোনেলও ছিলেন, এমন লোকেদের সামনে অ্যালিবোন একটা ইঁদুরের ভেতর দিয়ে একটা স্পার্ক চালিয়ে দিলেন। ইঁদুরের ভেতর দিয়ে একটা প্রায় দু'সেন্টিমিটার চওড়া গর্ত তৈরী হলো। এরপর থেকে সবাই খুব সাবধানে এর পাশ দিয়ে চলাচল করতেন।
অবশেষে অ্যালিবোনের ডিসচার্জ টিউব রেডী হলো এবং তিনি বিভিন্ন ধাতুর থেকে ইলেক্ট্রন স্ক্যাটারিং পরীক্ষা শুরু করলেন।
সে সময় ক্যাভেন্ডিশের ঐ largest রুমেই John Douglas Cockcroft মলেকিউলার বীমের ওপর গবেষণা করছিলেন। তাদের সাথে ১৯২৭ সালে Ernest Thomas Sinton Walton যোগ দেন। তিনি ডাবলিনের ট্রিনিটি কলেজ থেকে গণিতে গ্র্যাজুয়েশান করেছিলেন। ওয়াল্টন কণা অ্যাক্সেলারেশানে আগ্রহী হলেন এবং তিনি ১৯২৮ এ রাদারফোর্ডকে একটা 'linear accelerator' প্রস্তাব করেন। যদিও এই খুব ভাল আইডিয়াকে পরে ফার্মিল্যাবে সফলতা দান করা হয়, কিন্তু ওয়াল্টন নিজে এই যন্ত্র তৈরীতে সফল হননি।
সে বছরই পরে তিনি আরেকটি নতুন আইডিয়া পেয়ে যান।
জর্জ গ্যামোভ (Georgiy Antonovich Gamov) নামের এক রাশান ত্বত্তীয় পদার্থবিদ ১৯২৮ সালে Gieger-Nuttall law এর ভিন্ন ব্যাখ্যা দেন। ১৯১২ সালে প্রস্তাবিত এই ত্বত্তে আলফা কণার দূরত্ব, যে তেজস্ক্রিয় নিউক্লিয়াস থেকে এটা বেরিয়েছে তার হাফ-লাইফের সাথে সম্পর্কিত। হাফ-লাইফ যত কম, তত বেশী দূরে আলফা কণা যেতে সক্ষম। এক ধরণের এনার্জি ব্যারিয়ার দিয়ে আলফা কণাগুলো নিউক্লিয়াসে আবদ্ধ থাকে।
পদার্থবিদদের ধারণা ছিলো এই ব্যারিয়ার ওভারকাম করতে পারলেই কেবল আলফা কণা নির্গত হতে পারে। George Gamow কোয়ান্টাম টানেলিং এর মাধ্যমে আলফা-ডিকে ব্যাখ্যা করেন। তিনি ওয়েভ-মেকানিকস্ ব্যবহার করে বলেন যে আলফা কণা টানেলের মাধ্যমে এই এনার্জি ব্যারিয়ার ভেদ করে চলে আসতে পারে, এবং বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা উচ্চ শক্তির কণার ক্ষেত্রে বেশী।
গ্যামোভ এই থিওরীর সাহায্যে রাদারফোর্ডের ১৯১৯ এর পরীক্ষায় কিভাবে আলফা কণা নাইট্রোজেন নিউক্লিয়াসে প্রবেশ করেছিলো। তিনি একটা ম্যানুস্ক্রিপ্ট তৈরী করে ১৯২৮ এর ডিসেম্বরে এটা ক্যাভেন্ডিশে পাঠিয়ে দেন।
এরপর ১৯২৯ এর জানুয়ারীতে তিনি ক্যাভেন্ডিশে তার কাজের ওপর লেকচার দেয়ার জন্য আসেন। কক্রফ্ট গ্যামোভের কাজ দেখলেন। তিনি নিজে পুনঃ নিরীক্ষা করে দেখলেন যে ৩,০০,০০০ ভোল্টে ত্বরাণ্বিত প্রোটন বোরন নিউক্লিয়াস ভেদ করতে পারে কিনা। এর প্রোব্যাবিলিটি ছিল গৌণ, মাত্র ০.৬%। কিন্তু মাত্র ১ মাইক্রোঅ্যাম্পিয়ার কারেন্টই প্রতি সেকেন্ডে বহু মিলিয়ান প্রোটন দিতে পারে।
Cockroft দেখলেন যে ৩,০০,০০০ ভোল্টেই চোখে পড়ার মত transmutations ঘটছে। সুতরাং তিনি বুঝলেন যে অতি উচ্চ ভোল্টের পেছনে দৌড়ান অনাবশ্যক।
রাদারফোর্ড কক্রফটের ক্যালকুলেশানের সাথে একমত হলেন এবং ঠিক করলেন যে এই আইডিয়া নিয়ে আগানো যথার্থ। তিনি ওয়াল্টনকে তার লিনিয়ার অ্যাক্সিলারেটর বাদ দিয়ে কক্রফটের সাথে জুটি বাধতে বললেন। তিনি প্রোটন তৈরী এবং এমন এক ভ্যাকিউম টিউব বানানোর কথা বললেন যে যা দিয়ে প্রোটনগুলোকে ৩,০০,০০০ ভোল্টে ত্বরাণ্বিত করা যায়।
রাদারফোর্ড একটা ৩০০ kV ট্র্যান্সফর্মার কেনার জন্য ১০০০ পাউন্ডের একটি ইউনিভার্সিটি গ্র্যান্ট যোগাড় করলেন। অ্যালিবোন রেক্টিফায়ার ডিজাইন করে দিলেন যেন এসি থেকে স্টেডি ডিরেক্ট কারেন্ট পাওয়া যায়। যন্ত্রটি ঘরের দরজা দিয়ে ঢোকার পক্ষে খুব বড় ছিলো। তাই দু'জন Metropolitan-Vickers ইন্জিনীয়ারকে আসতে হলো এর নির্মাণ শেষ করতে।
১৯২৯ এর শেষে কক্রফট এবং ওয়াল্টন ৩০০ kV উইথস্ট্যান্ড করতে পারে এমন ডিসচার্জ টিউব তৈরীতে সক্ষম হলেন।
১৯৩০ সালের মার্চে তা টেস্টিং এর জন্য রেডী হয়। টিউবের ওপরের অংশে একটা ছোট গ্লাস চেম্বারে নিম্ন শক্তির প্রোটন তৈরী করে টিউবের ভেতর দিয়ে খুব সূক্ষ্ম বীমের আকারে অ্যাকসিলারেট করা হয়। টিউবের ওপর প্রান্ত দিয়ে হাই এনার্জি পার্টিকেল বেরিয়ে এসে টার্গেটে হিট করতো।
কক্রফট এবং ওয়াল্টন লিথিয়াম ও বেরিলিয়ামের মত হালকা মৌল, আর সীসার মত ভারী মৌলের ওপর বম্বার্ডিং শুরু করলেন। তারা গামা-রে দেখার আশা করলেন কিন্তু নিরাশ হলেন।
যন্ত্রের সীমা ছিলো ২৮০ kV, কিন্তু সেই রেন্জেও তারা কোন nuclear transformation এর মাধ্যমে গামা রশ্মি নির্গত হতে দেখলেন না। তাই কক্রফট হাইয়ার ভোল্টেজ পাওয়ার উপায় চিন্তা করা শুরু করলেন।
তিনি কন্ডেন্সার দিয়ে একটা 'voltage-multiplying' circuit তৈরী করলেন যা দিয়ে নিম্ন শক্তির এসি থেকে উচ্চ শক্তির ডিসি পাওয়া যায়। তিনি আর ওয়াল্টন মিলে পাঁচটি রেক্টিফায়ার ডায়োড আর ক্যাপাসিটর দিয়ে তৈরী একটি কলাম বানালেন, যা ট্র্যান্সফর্মারের এসিকে চারগুণ বেশি শক্তির ডিসিতে রূপান্তর করতো।
সৌভাগ্যবশতঃ ১৯৩১ এর মে মাসে কক্রফট আর ওয়াল্টনকে তাদের বড় রুমটি ছেড়ে দিয়ে Balfour Library'তে চলে যেতে হলো।
এর সিলিং ছিলো আরও উঁচু। ৬০০ পাউন্ডের এক অর্থ সাহায্যের মাধ্যমে তারা একটি জেনারেটর তৈরী করলেন যা প্রায় ৫০০-৭০০ kV'র মত তৈরী করতো। তারা ভাবলেন ৩০০ kV'তে যা দেখা যায়নি এ দিয়ে সেই disintegration তৈরী করা যাবে। য্ন্ত্রটি তৈরীর পর তারা গামা রশ্মির সন্ধান করলেন।
মেরী-পিয়েরে কুরীর মেয়ে আর জামাতা আইরিন আর ফ্রেডারিক জোলিও কুরী বেরিলিয়ামকে আলফা পার্টিকেল দিয়ে বম্বার্ড করে তীব্র ভেদন ক্ষমতা সম্পন্ন গামা-রে পেয়েছিলেন; তাই কক্রফট-ওয়াল্টনও ভেবেছিলেন যে প্রোটন দিয়ে হালকা মৌলকে আঘাত করলেও একই ধরণের রশ্মি পাওয়া যাবে।
আসলে বিকিরণের প্রকার নির্ধারণে কুরীদের ভুল হয়েছিলো। তা ছিলো আসলে নিউট্রন। ১৯৩২ এর জানুয়ারীতে জেমস চ্যাডউইক সেই পরীক্ষার পুনরাবৃত্তি করে দেখেন যে ১৯২০ এ রাদারফোর্ড এর ঘোষণা দেওয়া সেই নিরপেক্ষ কণা পাওয়া যাচ্ছে। তা ছিলো নিউট্রনের আবিষ্কার। চ্যাডউইকের আবিষ্কারের কয়েক মাস পর রাদারফোর্ড কক্রফট আর ওয়াল্টনের কাছে গিয়ে তাদের বলেন 'ought to put in a fluorescent screen and get on with the job'।
রাদারফোর্ড নিশ্চিতভাবেই আলফা কণা দেখার কথা ভাবছিলেন এবং ফ্লুরোসেন্ট স্ক্রীনই তা দেখার সবচেয়ে ভাল উপায়।
১৯৩২ এর ১৪ই এপ্রিল ওয়াল্টন, টিউব সেট করে তা দিয়ে হাই-এনার্জি প্রোটন তৈরী করে লিথিয়ামকে বোমা মারা শুরু করলেন। যন্ত্রটির নীচে একটি অবজার্ভেশান কেবিন তৈরী করা হয়েছিলো। তিনি গুঁড়ি মেরে সেই কেবিনে ঢুকে সাথে সাথেই সেই বিখ্যাত scintillations of the fluorescent screen দেখতে পেলেন। পরীক্ষার ফলে সত্যি সত্যি আলফা কণা নির্গত হচ্ছিলো।
সাথে সাথে কক্রফট আর রাদারফোর্ডকে জানানো হলো। রাদারফোর্ডকে 'manoeuvred with some difficulty into the cabin'। তিনি চিৎকার করে ওয়াল্টনকে নির্দেশ দিলেন 'Switch of the proton current! Increase the accelerating voltage!'। অবশেষে তিনি বেরিয়ে এসে একটা টুলের ওপর বসলেন আর বললেন-
'Those scintillations look mighty like alpha-particle ones. I should know an alpha-particle when I see one for I was in at the birth of the alpha-particle and I have been observing them ever since'
রাদারফোর্ড দু'জনকেই শপথ করিয়েছিলেন যেন তারা পরবর্তী ক'দিন পরীক্ষার সফলতা গোপন রাখেন; যেন তারা কোন ব্যাঘাত ছাড়া পরীক্ষাটি ভালমত ভেরিফাই করতে পারেন। কিন্তু আনন্দের আতিশয্যে Cockroft লাফাতে লাফাতে কিংস কলেজের সামনে দিয়ে যাওয়া King's Parade রাস্তায় 'We've split the atom! We've split the atom!' বলে চেঁচাতে চেঁচাতে ছুট লাগালেন।
১৬ই এপ্রিল তারা রাদারফোর্ডের বাড়ীতে বসে একটা পেপার তৈরী করলেন, আর ৩০ এপ্রিল তা Nature পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
কক্রফট আর ওয়াল্টনের পরীক্ষাই ছিলো প্রথম disintegration, যা পুরোপুরি মানব নিয়ন্ত্রিত। লিথিয়াম ভেঙ্গে দু'টো হিলিয়াম তৈরী হচ্ছিলো। তারা দু'জন এ'দুটো নিউক্লিয়াসের বেগ পরিমাপ করে, ভর কমে যাওয়ার সাথে শক্তি তৈরীর সমীকরণের যথার্থতা দেখতে পান। তাদের পরীক্ষাই ছিলো আইনস্টাইনের বিখ্যাত সূত্রের প্রথম বাস্তব প্রমাণ।
মৌলের প্রথম নিয়ন্ত্রিত কৃত্রিম বিভাজন সারা পৃথিবীব্যাপী সংবাদপত্রের মনোযোগ আকর্ষণ করলো, আর কক্রফট এবং ওয়াল্টন 'the atom splitters' হিসেবে সেলিব্রিটির মর্যাদা লাভ করলেন। এক সাক্ষাৎকারে রাদারফোর্ডকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিলো যে, কোনদিন পরমাণুর শক্তি, দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা পূরণের পর্যায়ে আসবে কিনা? রাদারফোর্ড না বোধক জবাব দিয়েছিলেন। তার বিশ্বাস ছিলো 'the atom will always be a sink and never a reservoir of energy'। কক্রফট তার বিরোধিতা করেছিলেন। তার সাত বৎসর পর অটো হান ইউরেনিয়াম ফিশান আবিষ্কার করেন।
Cockroft এবং Walton ১৯৫১ সালে পদার্থবিদ্যায় নোবেল জেতেন-
'for their pioneer work on the transmutation of atomic nuclei by artificially acelerated atomic particles'
যদিও তাদের ১৯২৯ থেকে ১৯৩২ পর্যন্ত আবিষ্কারে লেগেছিলো, কিন্তু তার পরও তারা পরবর্তী যুগের হাই-এনার্জি ফিজিক্সের প্রথম দিককার গবেষণাকারী হিসেবে টিকে ছিলেন।
ক্যাম্ব্রীজ অ্যাক্সিলারেটরের পর আরও বিভিন্ন ধরণের ত্বরণ যন্ত্র তৈরী হয়। যার মাঝে ছিলো Ernest Orlando Lawrence এর cyclotron আর Van der Graaff generator। কিন্তু Cockroft-Walton এর ধাঁচের যন্ত্র 'pre-accelerator' হিসেবে এখনও বিভিন্ন শক্তিশালী যন্ত্রে ব্যবহৃত হয়।
বিভিন্ন আদি যুগের যন্ত্রের আলোচনা আপাতত শেষ।
অনেক বিজ্ঞানীর অবদান আর অনেক পথ পাড়ি দিয়ে, তবেই আজকের দিনের অত্যাধুনিক কয়েক বিলিয়ান ডলার মুল্যমানের বিভিন্ন অ্যাপারেটাসের আবিস্কার। আর্নেস্ট লরেন্সের ৪ ইঞ্চির প্রথম সাইক্লোট্রন তৈরীতে বড়জোড় ২৫ ডলার খরচ হয়েছিলো। আবিস্কারের চাকা থেমে থাকেনি। আজ থেকে কয়েক যুগ পর হয়তো LHC নিয়ে লোকে হাসাহাসি করবে - "মোটে ১৪ টেভ ছিলো!' তখন নিশ্চয়ই প্ল্যাংক স্কেল বা প্ল্যাংক ভ্যালুর কাছাকাছি এনার্জ লেভেলে যাওয়া হবে।
এ পর্ব আর আগের দু'টি পর্ব মিলে আসলে একটি পর্ব।
ক্লাসিকাল মেকানিকসের জগতের আলোচনা শেষ। আগামী পর্বেই আমাদের কোয়ান্টাম জগতে ঢু মারতে হবে। দু'চারটা বিষয়ে উঁকি দিয়ে এরপরই নীলস বোর, ল্যাম্ব, রাইডবার্গ, শ্রোডিঞ্জার আর ফেইনম্যানের হাত ধরে QED'র দিকে যাত্রা হবে শুরু।
পদার্থবিদ্যার জগতটা বড়ই মজার। রাদারফোর্ডের উক্তি দিয়ে এ পর্ব শেষ করছি-
All science is either physics or stamp collecting.
-Ernest Rutherford
পর্ব - ৭
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।