মাঝে মাঝেই ভাবী একটা তালিকা করবো। বন্ধুদের তালিকা। এক জীবনে যেই সব বন্ধুদের সান্নিধ্য পেয়েছি তাঁদের একটা তালিকা থাকবে। আমি পৃথিবীর সেই সব সৌভাগ্যবানদের মধ্যে একজন যাদের বন্ধু ভাগ্য বেসম্ভব ভালো।
তাই প্রবল ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও এক জীবনে এতো বড় তালিকা করা সম্ভব হবে বলে মনে হয় না।
তবে কিছু বন্ধু থাকে, বন্ধুত্বের সংজ্ঞা খুঁজতে গেলেই তাদের নাম সকলের আগে মাথার মধ্যে ঘুরপাক খায়।
তখন আমার উপরে রীতিমত এক্সপেরিমেন্ট চালানো হচ্ছে। প্রথমে একটা মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে কিছুদিন ট্রাই মারা হয়েছিল। ফেল ফেল ফেলটুস! আরবি ভাষা যে কত্ত কঠিন!
শেষে গ্রামের সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে স্থান হল। ক্লাস ফোরের ছাত্র তখন।
ক্লাসের একটা ছেলে কে সকলেই নাথিং বলে ডাকে। একদিন ক্লাস শেষে ওকে উদ্দেশ্য করে বলি, এই নাথিং শোন।
ও রেগে কটমটিয়ে আমার দিকে এসে বল্লঃ আমাকে নাথিং বললি কেন?
--সকলেই তো বলে।
--ওরা সকলে আমার বন্ধু। ওদের ইচ্ছে হলে আমাকে ফাথিং বলবে, তোর কোন সমস্যা?
--হ্যাঁ!
--কি সমস্যা?
--আমিও তোকে ফাথিং বলবো।
পরবর্তী ঘটনা খুব দ্রুত ঘটলো। যতটা না হাতে তার চেয়ে বেশী মুখে শব্দ (মাস অন্তরে বিটিভিতে একটা করে বাংলা সিনেমা দেখে একশান কৌশল মোটামুটি সকলেরই রপ্ত) করে, ইয়ালি ঢিশুম! ইয়ালি ঢিশুম!
ছেলে মেয়েরা সকলে জটলা পাকিয়ে ধরেছে। কেও কম যাই না। ওরা অতি উৎসাহে হাততালি দিচ্ছে। হঠাৎ নাথিঙয়ের একটা ঘুষি আমার তল পেটে এসে লেগেছে, যতটা না ব্যাথা পেয়েছি তার চেয়ে অনেক বেশী ভান করে বসে পড়েছি।
মুহূর্তে পুরা পরিস্থিতি আমার নিয়ন্ত্রণে।
কেও কেও বলা শুরু করেছে, হেডমাস্টার স্যার নাথিংকে মেরে বেদ ফাটাবেন।
নাথিং ভয়ে কাচুমাচু করে আমার পিছে পিছে ঘুরছে। আমি যেন স্যার কে বিশেষ কিছু না বলি। এরই মধ্যে ক্লাস মনিটর মনির এসে বল্ল, তোদের দুই জনকেই স্যার অফিস রুমে ডাকছেন।
স্যারের কাছে যাওয়ার আগে নাথিং আমার হাত চেপে বল্ল, আজ থেকে তুই আমাকে নাথিং, ফাতিং যা ইচ্ছে ডাকতে পারিস। আমি কিচ্ছু বলবো না। শুধু স্যারকে কিছু বলিস না।
আমি মুহূর্তে একটু হাসি হাসি ভাব নিয়ে বল্লাম, বলছিস তাহলে?
--কি?
--তোকে ফাতিং ডাকতে! ফাতিং!
নাথিং শুধু অসহায়ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে কথাগুলো হজম করলো। কেমন জানি মায়া লাগলো।
স্যারের কাছে যেয়ে বল্লাম, মোরগ লড়াই খেলতে যেয়ে দুই জনই ব্যাথা পেয়েছি।
সেদিন থেকে ওর সাথে আমার বন্ধুত্বের শুরু। ওর নাথিং নামের পিছনের কাহিনী শুনলাম, ওর আসল নাম শামিম। পড়াশোনার ক্ষেত্রে শুধু অংক ছাড়া তেমন কোন সাবজেক্টই ও ভালো পারে না। তবে অংকতে ও কখনো ২য় হায়েস্ট মার্কস পায় নি।
একদিন ক্লাস টিচার এসে ওকে বলেছিলেন, তুই তো গুড ফোর নাথিং!
সেই থেকে সকলে ওকে গুড টুকু বাদ দিয়ে শুধু নাথিং বলে ডাকে।
পর দিন থেকে হয়তো ও আমার জন্য সিট ধরে রাখতো নয়তো আমি ওর জন্য। দুই জন এক সাথে বসতাম। ক্লাসে অংক না বুঝলে কোন সমস্যা নাই, ও আমাকে বুঝিয়ে দিত।
আমাদের গ্রামে একটা বড় বাঁওড় আছে।
ভরা বর্ষায় ছোট খাট নদীর চেয়ে ফুলে ফেঁপে অনেক বড় হয়ে যায়। তো এমনি এক বর্ষা মুখর দুপুরে আমরা স্বদলবলে গিয়েছি গোসল করতে।
সিদ্ধান্ত হল সাতার কেটে এই বাঁওড় আড়াআড়ি পার হতে হবে। যে সকলের আগে পৌঁছাতে পারবে সে হবে পরবর্তী এক সপ্তাহের জন্য জন্য দলনেতা। তার সিদ্ধান্ত বাকী সকলের মেনে নিতে হবে।
আমি তেমন একটা সাতার জানি না। তবুও শুরু করলাম। চিত হয়ে, কাত হয়ে, উবু হয়ে সাতার দিয়ে মাঝ বরাবর পৌঁছুলাম। ততোক্ষণে নাথিং ওপারে। বাকীরা ওপার ছুই ছুই করছে।
আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। হাত পা ছুড়ে দেয়ার মত আর শক্তি অবশিষ্ট নাই। এপার ওপার কোন পারেই আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়। খেই হারিয়ে কেবলই ভাবছি, কিছুক্ষণের মাঝে আমি মারা যাব। প্রিয় মানুষগুলোর মুখ ভেসে আসছে।
সেই দিন প্রথম আমি বুঝতে পেরেছিলাম, মৃত্যুর আগ মুহূর্তে মানুষের অনুভূতি কেমন হয়!
কোন রকম নাক ভাসিয়ে রেখেছি, হাত পা অনেকটাই নিস্তেজ। যে যার মত ওপারে পৌঁছে জোরে জোরে দম নিচ্ছে। নাথিং হঠাৎ খেয়াল করলো, আমি ডুবে যাচ্ছি।
ও মুহূর্তে আবার সাতরে আমার কাছে চলে আসলো। আমি ততোক্ষণে ডুবে যাওয়ার অপেক্ষায়।
নাথিং ওর পিঠে করে আমাকে ওপারে নিয়ে গেল। পানি খেয়ে মেট ততক্ষণে পিরামিড আকৃতি ধারণ করেছে।
ওপারে নিয়ে ও অনেকটাই ঝাড়ি দিয়ে বল্ল, সাতার পারিস না তবে পাল্লা দিতে গেলি কেন?
এই ঘটনা জানাজানি হবার পর নাথিংদের সাথে পারিবারিকভাবে আমাদের পরিবার একটা সম্পর্ক তৈরি করলো। সেই থেকে যতদিন গ্রামে ছিলাম, নাথিং ছিল আমার কাছে এভরিথিং।
আমার প্রাণের বন্ধু নাথিং!
এবারের বন্ধু দিবসটা তোকে উৎসর্গ করতে চাই, নাথিং!
জানিনা কোথায় আছিস, কেমন আছিস! ভালো যেন থাকা হয়!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।