আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ভাবুক (গল্প)



ব্যস্ত রাস্তা । রাস্তার পাশেই বড় মার্কেটটা । রাস্তা দিয়ে সারাদিন যানবাহন চলছে । মার্কেট এর নিচে কাচাঁবাজার । কাচাঁবাজারে যাওয়ার জন্যে যে সিড়িটা আছে তার পাশেই হাজেরা বসে থাকে ।

এখানেই বসে সে শত শত লোক দেখে । তার কোন ভাবান্তর হয় না। একটা ময়লা ছিন্নবস্ত্র পড়ে সে বসে থাকে । পাশে থাকে তার বহু পুরানো ছেঁড়া পুটলিটা । সেখান থেকে সে একটু পর পর পান বের করে খায় ।

সারাদিন সে বসেই থাকে । বেশি মন উতলা হলে তার পাশে রাখা লাঠিটাতে ভর করে একটু হেটে আসে । এখানে বসে কাচাবাজারের তরিতরকারির ঘ্রাণ নেয় । মনে দোলা লাগে । খিদে লাগলে পাশের একটা হোটেল থেকে খাবার চেয়ে পাঠায় ।

মাস শেষে সে টাকা পরিশোধ করে। হোটেল মালিক মনে করে সে টাকা পরিশোধ করতে পারবে না। প্রতিবারই সে ঠিকই খাবার টাকা পরিশোধ করে,আর প্রতিবারই হোটেল মালিক অবাক হয়। রাস্তার ও পাশেই একটা চায়ের দোকান । তারপাশে আরও কয়েকটা দোকান।

পাশাপাশি। চায়ের দোকানটার পাশ ঘেষে একটা বড় বট গাছ উঠে গেছে । চায়ের দোকানের বাইরে কতগুলো টেবিল বেঞ্চ রাখা আছে । আর সেখানেই প্রতিদিন এসময়ে ছেলেটা আসে । এসেই প্রথমে সিগারেট ধরায় , তারপর চা খায় ।

চা খেতে খেতে কোথায় তাকায় কিছু বোঝা যায় না। মনটা যে তার কোথায় হারায় তা আল্লাহ মালুম। তার আশে পাশে কত লোক হেটে যায়, কারও দিকে তার খেয়াল থাকে না। আলতো করে চায়ে চুমুক দেয় । আর কোথায় যেন হারিয়ে যায় ।

হাজেরা অবশ্য ইচ্ছে করলেই জানতে পারে সে কি চিন্তা করে , কিন্তু দূর থেকেই তার ছেলেটাকে দেখতে ভাল লাগে। টুং , তার থালায় একটা টাকা পড়ার শব্দ । হাজেরা মুখ তুলে দেখে মোটা একটা লোক , তাকে টাকা দিয়ে হেটে চলে যাচ্ছে । তার গাড়ির দিকে । গাড়ির দরজা খুলে বসার আগে হাজেরার দিকে তাকাল ।

সোজাসুজি । ব্যাস এই একটু তাকানিই হাজারার দরকার । চোখের দিকে হাজেরা তাকাল আর লোকটা সম্মোহিত হয়ে পড়ল । হাজারা এখন লোকটার মনের সমস্ত কথা পড়তে পারছে । একটু আগে কোন মেয়ের সাথে কি করেছে , তাকে নিয়ে এখন কি ভাবছে , বাসায় ফিরে তার বউকে কি বলবে ,সবই হাজারা পড়ে ফেলতে পারছে ।

তার আর হাজেরার মন এখন অভিন্ন । একটু পর তার মনের নিয়ন্ত্রণ হাজেরা নিয়ে ফেলল । লোকটা না বসে আবার হাজেরার দিকে আসল । হাজারের সামনে এসে দাড়িয়ে পকেটে হাত দিল । তার পর পকেটে যা আছে সব হাজেরার হাতে গুজে দিল ।

তারপর আবার যন্ত্রর মত গাড়িতে উঠল । একটু পর হুস করে গাড়িটি চলে গেল। হাজেরা মিটিমিটি হাসতে লাগল। হ্যা হাজেরা জানে যে , এই নোংরা বাজারের পাশে তাকে না বসলেও চলে। কিন্তু অন্য পরিবেশের সাথে মানিয়ে নিতে পারে না বলেই এখানে বসে থাকে ।

সে ইচ্ছা করলেই যে কারও মনের ভেতর ঢুকে যেতে পারে । মনের সব কথা পড়তে পারে। এমন কি অন্যের মনকে সে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। ইচ্ছা মত মনের যে কোন স্মৃতি সে ভূলিয়ে দিতে পারে। তার জন্য এটা কোন ব্যাপারই না ।

কেউ জানে না তার এই ক্ষমতা । ইচ্ছে হলেই সে লোককে পাগল বানায় । একবার এক মন্ত্রী তাকে গালি দিয়েছিল । মন্ত্রী বসা ছিল গাড়িতে । মূহুর্তের মধ্যে সে মনের ভেতর ঢুকে গেল।

মন্ত্রীর নয় , তার গাড়ির চালকের । তার পর একটা চলন্ত ট্রাকের সাথে সরাসরি সংঘর্ষ লাগিয়ে দিল। কেউ কিছু বুঝলনা । গাড়ি চালকটা মারা পড়ল, সাথে মন্ত্রীও । একবার তার উঠতি বয়সে এক পুলিস তার শরীর নিয়ে মন্তব্য করায় , পুরো ল্যাংটো করে ছেড়েছিল।

সে ইচ্ছা করলেই অন্যের মন নিয়ে যা ইচ্ছা তা করে। তার মাঝে মাঝে ভাল না লাগলে মানুষের মধ্যে ঝগড়া লাগিয়ে দেয় । কারও মাথাটা হঠাৎ বিগড়িয়ে দেয় । কারও কারও মধ্যে প্রচন্ড হতাশা জাগিয়ে দোলে । কখনও বা কারও মনে জাগিয়ে তোলে প্রচন্ড কামনার ঝড় ।

তারপর তাদের অবস্থা দেখে হেসে কুটোকুটি হয়। হাসতে হাসতে দেখে রাস্তায় লোকের ঝগড়া, অথবা আত্মহত্যাকারীর শেষ মুখ, বা কামনার বশীভূত মানুষ। সামনে চা এর দোকানে বসে থাকা ছেলেটা এই মাত্র সিগারেট ধরাল। এখন সে বাতাসে ধোয়া ছাড়বে আর কি জানি কি ভাববে । কে জানে কি ভাবে ।

কখনও কখনও ধোয়া ছেড়ে ধোয়ার দিকে তাকিয়ে থাকে । কখনও টোকা দিয়ে ফেলা ছাই এ , যখন ছাইগুলো বাতাসে ভাসতে ভাসতে উড়ে যায় । কখনও খুব গম্ভীর থাকে কখনও মিটি মিটি হাসে । অদ্ভুত । কখনও হাসতে হাসতে গড়াগড়ি খায় ।

কখনও মূর্তির মত বসে থাকে । ঘন্টার পর ঘন্টা। ঠিক এ সময়ই ,প্রায়ই, ছেলেটার বিপরীত পাশ থেকে একটা চটফটে তরুণী হাটতে হাটতে আসে । ছেলেটাকে পাশ কাটিয়ে চলে যায়। রাস্তার সবাই তার দিকে তাকিয়ে থাকে , আর এই উজবুকটি তখন আকাশ দেখে ।

মেয়েটা মাঝে মাঝে ছেলেটার দিকে তাকায় । কখনও কখনও অবাক হয় । কখনও মুচকি হাসে । কখনও কখনও তাকায়ও না। আজ ছেলেটাকে দেখেই হঠাৎ হাজেরার গা জ্বলে উঠল।

ছেলেটাকে জ্বালাবে কিনা চিন্তা করছে । ছেলেটা এখন উদাস হয়ে আকাশ দেখছে । চা আসতে আসতে তার আকাশ দেখা বিশেষ বদঅভ্যাস । আকাশ কি কোন দেখার জিনিস । আর তখনই মেয়েটা উড়ে উড়ে আসতে লাগল।

হাজারা মাথা দুলিয়ে হাসতে লাগল । আজ সে কিছু একটা করবেই । মাঝে মাঝে যদি দূর্ঘটনাই না থাকল , তাহলে আর জীবনে মজা কি ? লাঠির উপর হাত দিয়ে সে তাল তুলতে লাগল। তারপর লাঠি দিয়ে সামনের পাকা জায়গাটায় দুটো বাড়ি দিল। বেশ কয়েকজন তার দিকে তাকল ।

ছেলেটা তখনও আকাশ দেখছে । লাঠি দিয়ে আবার কয়েকটা বাড়ি দিল। আবার কয়েকজন তাকাল , শুধু ছেলেটা ছাড়া । মেয়েটা এগিয়ে আসছে । মনে হচ্ছে হাটছে না উড়ছে ।

তাকে খুব খুব সুন্দর লাগছে । যেন একটা পরী। এটা সে নিজেও বুঝতে পারছে । মাথা নিচু করে টুকটুক পায়ে হেটে আসছে । ছেলেটা মুখ নামিয়ে চায়ের মধ্যে একটু আলতো চুমুক দিচ্ছে ।

মেয়েটাকে আরও কাছে আসতে দেখে হাজেরা চোখ মুখ ভেঙ্গাল । আজ ছেলেটার একদিন আর তার একদিন । ছেলেটার মনে ঢুকে আজ সে এমন কান্ড তাকে দিয়ে ঘটাবে , যে হয় এ ছেলে আজ আত্মহত্যা করবে অথবা নতুবা সারাজীবন আকাশ দেখা ছেড়ে দেবে । হাজেরা লাঠি দিয়ে আবার কয়েকটা বাড়ি দিল। মেয়েটা ছেলেটার সামনে থেকে এখন হাত দশেক দূরে হবে ।

ছেলেটা আস্তে করে তার লাঠির শব্দর দিকে তাকাল । আ~~~~হা । এরই তো অপেক্ষা ছিল । হাজেরা খেয়াল করল ছেলেটার চোখ কেমন ঘোলাটে ঘোলাটে । হাজেরা তাকাল সরাসরি ।

স্থির চোখে । ছেলেটাও তাকিয়ে আছে । টুক করে সে ছেলেটার মনে ঢুকে পড়ল। ধোঁয়াটে আর ধোঁয়াটে । চায়ের স্বাদটা মুখে লাগল।

আবার ধোঁয়াটে সব । ধোঁয়াটে । আকাঁবাকা পথ । চারদিকে সবুজ গাছপালা । ছোট্ট একটু মেঠো পথ ।

একটু খানি । পাশে শুধু গাছ পালা। কিসের জানি শব্দ । সুরেলা । ধরা যাচ্ছে না।

পথ এখন ধানক্ষেতের পাশ দিয়ে যাচ্ছে । একটা দুটো কৃষক দেখা গেল । সামনে শুধু ধান আর ধান। বাতাস । ঝিরঝির করে বইছে ।

ধানগুলো বাতাসে দুলছে । হঠাৎ পথটা দেখা গেল পাহাড়ের পাশ কেটে নিয়েছে । হাটছে আর হাটছে । অনেক পাখির আওয়াজ । ঝর্ণার শব্দও শুনা যাচ্ছে ।

হয়ত বাকটা পার হলেই ঝর্ণাটা দেখা যাবে । আবার সব চুপচাপ । টুপ টুপ করে বৃষ্টি । একটা পুকুর । পুকুরে বৃষ্টি পড়ছে ।

পানিতে বৃষ্টি পড়ার শব্দ । আস্তে আস্তে বৃষ্টি বাড়ছে । একদম ঝুম বৃষ্টি পড়তে লাগল। বৃষ্টিতে ভিজে শরীর মন সব ভিজতে লাগল। মন কাঁদতে থাকল ।

শব্দ উড়তে লাগল । হঠাৎ অনেক অনেক শব্দ উড়া শুরু করল। বৃষ্টি , মন , চুপচাপ , মনকুয়া . . . . . . হাজার হাজার শব্দ । শব্দ গুলো একটা আরেকটার সাথে জোড়া লাগছে । নিজে নিজে ।

সুন্দর সুন্দর ছন্দ উঠছে । শব্দেরা যেন প্রাণ পেয়েছে । শব্দ জোড়া লেগে বাক্য হচ্ছে । ছন্দ হচ্ছে । আবার হারিয়ে যাচ্ছে ।

আবার শব্দ জোড়া লাগছে । শব্দ জুড়ছে । শব্দ ভাঙ্গছে । হাজেরা তন্ময় হয়ে শব্দ ধরতে লাগল। তাকে শব্দ ধরার নেশা পেয়েছে ।

সে শব্দ জোড়া লাগাতে থাকল , ভাঙ্গতে লাগল , গড়তে লাগল । রাস্তাতে গাড়ি যাচ্ছে গাড়ি আসছে । মেয়েটা হেঁটে চলে গেছে । ছেলেটা বিল মিটিয়ে ফিরে যাচ্ছে । হাজেরার সে দিকে খেয়াল নেই ।

সে এখন শব্দ ধরতে ব্যস্ত । ভাবুক মনে ঢুকে শব্দ রাজ্যে আটকা পড়ে গেছে । আর নিস্তার নেই।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।