সত্য অথবা মিথ্যা দুটোই হতে পারে। বিশ্বাস করা আর না করা আপনার ব্যপার।
আবদুর রহিম সাহেব একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অল্প বেতনের চাকরিজীবী। বেতনের প্রায় পুরোটাই সংসারের পিছনে চলে যায়। মাস শেষে খুব অল্পই অবশিষ্ট থাকে।
তার স্ত্রীর নাম হামিদা বানু। বেতনের পুরো টাকাটাই এনে হামিদা বানুর হাতে তুলে দেন রহিম সাহেব। প্রতিটি পয়সা গুনে গুনে খরচ করেন হামিদা বানু। এর মাঝে যদি মাস শেষে কিছু টাকা হাতে থেকে যায় সেটা জমা করে রাখেন। কখন কোন কাজে লেগে যায়।
সংসার সামলাতে গিয়ে নিজেদের স্বপ্নের কথা ভাবার সময় হয়ে উঠে না তাদের।
রহিম সাহেবের ৩ মেয়ে। বড়টির নাম হীরা, তারপর মনি আর শেষে মুক্তা। এই নিয়ে হামিদা বানুর খুব একটা কষ্ট আছে। একটা ছেলে থাকত।
ছেলের মুখের দিকে চেয়েও জীবন কাটানো যেত। মেয়েরা তো মেহমান। আজ আছে কাল নেই।
হীরা দেখতে ছিল হিরার মতই সুন্দর। তাই কম বয়সেই বিয়ে দিয়ে দিয়েছিলেন।
লেখাপড়া শেষ করার সুযোগ দেয়া হয় নি। ছেলে ভাল চাকরি করে। নিজেদের একটা ছোট বাড়িও আছে। ছেলের নাকি চাকরীর পাশাপাশি একটা ব্যবসাও আছে। এমন ছেলে হাতছাড়া করতে রাজি ছিলেন না হামিদা বানু।
রহিম সাহেবের কিছুটা অমতেই বিয়েটা হয়ে যায়। বছর না ঘুরতেই ফিরে আসে হীরা। জামাই বলেছে ২ লাখ টাকা নিয়ে যেতে। ব্যবসার জন্য লাগবে। অনেক কষ্টে টাকা জোগাড় করে মেয়েকে পাঠান রহিম সাহেব।
সেই মেয়েকে আবার ফিরে আসতে হয় ৩ বছরের মাথায়। কোলে ছোট বাচ্চা নিয়ে। এবার নাকি ৫ লাখ টাকা না দিলে জামাই আর ঘরে তুলবে না। অনেক হাতে পায়ে ধরেও কোনও লাভ হয় নি। টাকা যোগাড় হয়নি বলে ৪ বছর ধরে হীরা বাবার বাড়িতেই থাকে।
জামাই এসে মাঝে মাঝে মেয়েকে দেখে যায়। হীরা চুপচাপ মেয়েকে নিয়ে থাকে আর কিছু সেলাই কাজ করে নিজের খরচ টা চালিয়ে নেয়।
মেঝ মেয়ে মনি। তার একমাত্র কষ্টের কারন তার চেহারা। তার রঙটা একটু কালোর দিকে।
কেউ বলে কালো, কেউ বলে শ্যামলা। ঠিক উজ্জল শ্যামলা না। বাকি ২ বোনের দিকে তাকালে তার খুব কষ্ট হয়। ইস ওরা কত সুন্দর। সারাখন আয়নার সামনে দাড়িয়ে ভাবে রঙ টা আর একটু উজ্জল হতো।
কলেজের ২য় বর্ষে পড়ে মনি। সামনে এইচ এস সি দিবে।
মুক্তা সবার ছোট। সবার আদরেরও। বাকি ২ বোনের কাছে তার আব্দারের শেষ নেই।
এস এস সি পরীক্ষা দিয়ে এখন বাসায় বসে আছে। সারাদিন বাইরে বাইরে ঘুরে বেরায়। মায়ের হাজার বকা শুনেও তার চঞ্চলতা কমে না একটুও। কিছু কিনতে ইচ্ছা করলেই গিয়ে হীরাকে ধরে কিনে দেয়ার জন্য। কিনতে না পারলে সারাদিন মন খারাপ করে বসে থাকে।
মা বলেন ঘরের কাজ করতে, কিন্তু সেটা একদম পছন্দ না মুক্তার।
হামিদা বানু আজ অনেক ব্যস্ত। আজ দেখতে আসবে মনিকে। ছেলে ব্যবসা করে। দেখতেও ভাল শুধু বয়সটা একটু বেশি।
তাতে কি। ছেলেদের বয়স বেশি হলে কিছু হয় না। রান্নার কাজ তারাতারি করে শেষ করছেন তিনি। মেয়েটা না জানি কি করছে। একটু সেজে-গুজে যে থাকবে সেটাও তো পারেনা।
পারে শুধু কাঁদতে। কিছুক্ষণ পরেই চলে আসবে সবাই। অথচ এখনো রহিম সাহেব বাসায় ফিরেন নি। ছেলেপক্ষ চলে এলে কি বলবেন সেটাই ভাবছেন শুধু।
হীরা বসেছে মনিকে সাজাতে।
হিরার একটা শাড়ি পরিয়ে সাথে হাল্কা কিছু প্রসাধন। মনির কেমন যেন লাগছে। ভঁয়-লজ্জা-আনন্দ সব মিলিয়ে অন্য রকম একটা অনুভুতি। কারো দিকে তাকাতে পারছে না। হঠাৎ মুক্তা দৌড়ে আসে।
হীরাকে বলে,
--"জানিস আপা, ওরা চলে এসেছে। "
--''তাই নাকি? বাবা ফিরেছে কিনা দেখে আয় যা। '' হীরা বলে।
--''ফিরেছে তো একটু আগেই। জানিস আপা দুলাভাই দেখতে কি সুন্দর।
''
--''এখনো কি দুলাভাই হয়েছে নাকি?হলে তখন ডাকিস। এখন যা এখান থেকে। মাকে সাহায্য কর গিয়ে। ''
মুক্তা চলে যেতেই হীরা মনিকে কি করতে হবে সেগুলো শিখিয়ে দিতে থাকে।
মেয়ে দেখার অনুষ্ঠান শেষে ছেলে পক্ষ চলে যায়।
রহিম সাহেব আর হামিদা বানু নিজেদের ঘরে গিয়ে বসেন। হামিদা বানু বলেন,
--''কি গো, কেমন লাগল তোমার?’’
--''ভাল। তবে ছেলের বয়সটা একটু বেশি মনে হল। ''
--''আরে না। এটা তেমন কিছু না।
তাও যদি মেয়েটাকে পছন্দ করে তাহলেই হয়। ''
--''কি জানি। '' বলেন রহিম সাহেব। ''হিরার মত না হলেই হয়। ''
একটা দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ২জন জানালা দিয়ে দুরের আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকেন।
বেশ অনেকক্ষণ দুষ্টমি করার পর মুক্তা ঘুমিয়ে পরেছে। মনির চোখে ঘুম আসছে না। ঐ লোকটার কথা মনে হচ্ছে ঘুরে ফিরে। মনির দিকে তাকিয়ে একবার হেসেছিল। মনি মনে মনে একটা সংসার কল্পনা করতে থাকে।
বেশ সুন্দর গোছানো একটা ঘর। যেখানে কষ্ট বলেই কিছু নেই। যেখানে টাকার জন্য পছন্দের জিনিস না কিনে ফিরে আসতে হবে না। মানুষ টা সারাজিবন এভাবে হাসি মুখে তাকিয়ে থাকবে তার দিকে। কালো হওয়ার দুঃখটা মনেই থাকে না মনির।
আজ একটু জলদি বাড়ি ফিরে আসেন রহিম সাহেব। হামিদা বানুকে ঘরে ডেকে নিয়ে যান। একটু পর হীরাকেও ঘরে নিয়ে যান হামিদা বানু। হীরা ঘর থেকে বেরিয়ে মনির ঘরে ঢোকে। মনির পাশে এসে দাড়ায়।
বলে,
--''মনি একটা কথা বলব তোকে। ''
--''বল আপা। কি হয়েছে?'' হীরার মুখ দেখে মনির ভঁয় করে ভীষণ।
--''সহ্য করতে পারবি?''
--''আহা বলই না। এমন না করে বল।
আমার ভঁয় লাগছে। ''
--''আরে গাধা মেয়ে, তোর বিয়ে ঠিক হয়েছে। সামনের সপ্তাহে তোর বিয়ে। '' বলেই হেসে উঠে হীরা।
লজ্জায় লাল হয়ে যায় মনি।
তাহলে এবার তার স্বপ্ন গুলো সত্যি হতে যাচ্ছে। হাসবে না কাদবে বুঝে উঠে না মনি।
এক সপ্তাহ পর বিয়ে মনির। হামিদা বানু কি রেখে কি করবেন বুঝতেই পারেন না। সাহায্য করার মত কেউ নেই সাথে।
তবে আশার কথা হল, ছেলে পক্ষ বলেছে বেশি আয়োজন না করতে। সাদা-মাটা ভাবেই বিয়ে করিয়ে তারা মেয়ে নিয়ে যাবেন। তাদের তেমন কোন চাহিদাও নেই। এই নিয়ে হীরাকে বলেন তিনি,
--''তোর তো সংসারটা টিকল না। এখন মনিটাকে ভালয় ভালয় বিয়ে দিতে পারলে হয়।
কালো মেয়ে আমার ভাগ্য নিয়ে এসেছিল বলেই এমন ঘর পেল। ''
মাথা নিচু করে চলে যায় হীরা। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে রাখে কিছুক্ষণ। ভাবে, আমার জীবনটাই এমন হল কেন?
দুইদিন পর হবু জামাই জলিল আসে রহিম সাহেবের বাসায়। হামিদা বানু তখন বাসায় নেই।
পাশের বাসায় গেছেন। বাসায় শুধু মনি আর হীরা। হীরা দরজা খুলে অবাক হয়ে যায়।
--''আপনি? আসুন ভিতরে এসে বসেন। '' বলেই এলোমেলো ঘরটা একটু গুছিয়ে নেয়।
--''আসলে কি কি কিনতে হবে জানতে আসলাম। মনিকে একটু যদি জিজ্ঞেস করতেন। '' লাজুক স্বরে বলে জলিল। হীরা হেসে বলে,
--''আপনি বসেন আমি মনিকে পাঠাচ্ছি। ''
মনির ঘরে এসে হীরা হেসে উঠে।
বলে,
--''জামাই বাবু এসেছে। তুই সামনে যা। আমি কিছু একটা বানিয়ে নিয়ে আসি। ''
মনি ঘরে ঢুকতেই জলিল উঠে দাঁড়ায়। মনি অবাক হয়ে যায়।
তাকে দেখে কেউ এভাবে উঠে দাঁড়াবে ভাবতেই পারছে না। জলিল মনিকে বসতে বলে।
--''কি কি লাগবে তোমার জানতে এসেছিলাম। আমি ঠিক এগুলু জানিনা। '' বোকা বোকা ভাবে বলে জলিল।
মনি কি বলবে ভেবেই পায় না।
--''আমি কি বলব। আপনি মাকে জিজ্ঞেস করবেন। ''
--''কিছুই বলবা না?''
মনি চুপ করে থাকে। জলিল আবার বলে,
--''তোমাকে নিয়ে একদিন বাইরে যাব ভাবছিলাম।
যাবে আমার সাথে?''
--''মা বললে যাব। ''
--''সব কিছু মা বলতে হবে কেন? আমি কি কেউ না?'' একটু যেন মন খারাপ হয় জলিলের। মনির মনটা কেমন করে উঠে। হটাৎ করেই জলিল মনির হাত ধরেন। মনি চমকে উঠে।
তখনি হীরা আসে ঘরে নাস্তা নিয়ে। হাত চট করে সরিয়ে নেয় জলিল। মনি উঠে ভিতরে চলে যায়। একটু পর চলে যায় জলিল। বারান্ধা দিয়ে তাকিয়ে থাকে মনি।
এত সুখ ছিল কপালে?
বিয়ের কেনাকাটার কথা বলে মনিকে নিয়ে বের হয় জলিল। মনিকে নিয়ে যাবে শুনে হামিদা বানুও একটু খুশিই হন। হীরা বলে মুক্তাকে সাথে নিতে। কিন্তু মুক্তা ঘরে থাকলে তো? শেষে দুজনেই বের হয়ে যায়। এ দোকান সে দোকান ঘুরে দুজনে মিলে।
মনি কোনটা ছেড়ে কোনটা কিনবে ভাবতে থাকে। এভাবে আর তো কখনও আসা হয় নি। মনির ভাল লাগা বারতেই থাকে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হয়ে যায়। অনেক কিছু কিনে দেয় জলিল।
সবার জন্য এটা সেটা কিনে দেন। একসাথে দুপুরে খাবার খায় ওরা। অবশেষে বিকেল বেলা জলিল মনিকে নিয়ে একটা হোটেলে উঠেন। মনি বেশ অবাক হয়।
--''এখানে কেন?''
--''এমনি।
বাইরে কত মানুষ। নিরিবিলি যাতে একটু কথা বলতে পারি তাই আসলাম। কেন আমাকে বিশ্বাস কর না তাই না?''
--'' না না তা কেন হবে। ''
জলিল সাহেবের এগিয়ে আসা দেখে মনি একটু চমকে যায়। এটা কি ঠিক হচ্ছে?
--''কেন হবে না? আমি তোমার স্বামী।
তাই না। ২ দিন পর আমাদের বিয়ে। তারপর তো আমরা এক হয়ে যাব। ''
মনির সব বাধা ভাসিয়ে নিয়ে যায় জলিল। সম্পূর্ণ নতুন এক অনুভিতির সাথে পরিচয় হয় মনির।
সব কিছু নতুন লাগে মনির কাছে।
মুক্তা ঘর সাজাচ্ছে আজ। মনির বিয়েতে যতটুকু সম্ভব করতে চায় সবাই। জলিলের দেয়া নতুন জামা পরেছে আজ মুক্তা। হীরা মনিকে সাজিয়ে দিচ্ছে বউয়ের সাজে।
হামিদা বানু ব্যস্ত রান্না নিয়ে। রহিম সাহেব বারান্ধায় বসে আছেন। বাড়িতে কত মানুষ আজ। একটু পর ছেলে পক্ষ চলে আসে। এসেই বিয়ে পড়াতে চায়।
একটু যেন তাড়াহুড়া সবার মধ্যে। রহিম সাহেব আগে সবাইকে খাওয়া- দাওয়া করে নিতে বলেন। সবাই খেতে বসে। মুক্তা দুষ্টুমি করতে থাকে দুলাভাইয়ের সাথে। সবাই খুব খুশি।
খাওয়া শেষে ছেলে পক্ষের মুরুব্বিরা আর দেরি করেন না। বিয়ে করিয়ে তারাতারি মেয়ে নিয়ে যাবেন। কিছু পড়ে এক লোক আসে রহিম সাহেবের কাছে। রহিম সাহেব তাকে ভিতরে নিয়ে যান। তার সাথে কথা শেষে বেরিয়ে আসেন ।
বাড়ির ভিতরে গিয়ে বলেন,
--''বিয়ে হবেনা। ছেলের আগের বউ আর ৩ মেয়ে আছে। আমাদের সাথে অনেক বড় ধোঁকা দেয়া হয়েছে। ''
রহিম সাহেব মাটিতে বসে পড়েন। হীরা আর হামিদা বানু চিৎকার করে কেদে উঠে।
মুক্তা চুপ করে থাকে। আর মনি যেন পাথর হয়ে যায়। আর কিছুতেই তার কিছু যায় আসে না।
পরদিন সকালে হীরা মনির ঘরে ঢুকে তার ঝুলন্ত পা দুটির দিকে তাকিয়ে থাকে। কি হয়েছে বুঝতে তার বেশ সময় লাগে।
মনির নিষ্পাপ মুখটা কেমন যেন বীভৎস হয়ে আছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।