আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

তোমার ছোট তরী...বলো নেবে কি?...

আমার বলার কিছু নেই।

মনটা খুব ভাল আজকে। দুই মাস আগে সজল ভাই কে বলে এসেছি আমার আর লিটুর দুইটা টিকিট চাই ই চাই। মিলেছে টিকিট...চার দিনের। যেমন অদ্ভুত নাম নদীটার তেমনটাই তরীর...নিরালার ১ নং নদীর ১০০ নং তরী।

খুব সকালে পৌছে গেলাম তরীর কাছে...মাঝ নদীতে নোঙ্গর করা তিন তলা একটা তরী...চার পাশে অথৈ পানির মাঝে যেন একটা দ্বীপ। এমন একটা তরী দেখে যে কেউ ই প্রেমে পরে যাবে...আর আমিতো পরেছি দুই মাস আগেই। মণ দুয়েক ওজনের ব্যাগটা নামিয়ে কল্ করলাম...ওপাশে বার তিনেক রিং হতেই দরাজ কন্ঠে রিসিভ করলেন লেনিন ভাই..."কোথায় তুই?"...আমি বললাম ভাই আমি পৌছে গেছি...তিন তলায় আমি...সজল ভাই কি আছেন?...লেনিন ভাই দরজাটা খুলে দিয়ে বললেন...ওপাশের দরজা দিয়ে কর্নারের রুমে যাও...সজল আছে। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই ফ্লোরে,এখানে ওখানে মেধার ছড়াছড়ি। কোথাও ট্রেসিং শিট,শোলা,ভাঙ্গা প্লাই উড,অর্ধ সমাপ্ত ডিজাইন...কোথাও বা খালি হয়ে যাওয়া আঠার কৌটা।

বাইরের থেকেও বেশি জঞ্জালের মধ্যে বসে আছেন সজল ভাই...সামনে কম্পিউটার চালানো...একমুখ আঁধার নিয়ে সামনের এক্সেল সিটের দিকে তাকায় আছেন...যার কাজ কঠিন সব ডিজাইন করা সে কিভাবে মেসের মাসের মিল হিসাব করছেন...দেখে অবাক হলাম...বাজছে অর্ণবের গান..."তুই গান গা...ইচ্ছে মতো...বাতাস কে খুশি করে বাঁচ"। ডারউইনের তত্ব বোঝাতেই কিনা কে জানে...একমুখ দাড়ী,ঝাকড়া চুল আর হাল্কা খাকি রংয়ের হাফ প্যান্ট পরে হাজির হলেন মারুফ ভাই...। "আসছো চান্দু..."তার প্রথম অভিবাদন...। সজল ভাই জানালেন থাকতে হবে মারুফ ভাইয়ের সাথেই। যাহোক...ফ্রেশ হয়ে রুম গুলো ঘুরে ঘুরে দেখতে শুরু করলাম।

কোনটা দিয়ে শুরু করি?...শুরু করলাম কর্নারের রুম দিয়ে...। রুমের বাসিন্দা লালন ভাই...সংসার ছাড়া একজন ছেলের রুমে এত কিছু থাকতে পারে?...আমি অবাক হলাম। ছড়ানো ছিটানো অবস্থায় কি নেই?...পুরনো গোটা তিনেক কম্পিঊটার,রেডিও,সাদা কালো টিভি...সব মিলিয়ে ট্রাক দুয়েক জিনিস আর তার মাঝে রুমটার অবস্থার সাথে মিল রেখে লালন ভাই...চার মণ ওজনের গোলগাল এবং এক মাথা ঝাকড়া চুল...চোখে চশমা। মোটকু এই ভাইয়াটার সাথে পরে চোখাচোখি ছাড়া কথা বলা হয়ে ওঠেনি। ছোট একটা রুম...একটা জানালা আর দুই পাশে দুইটা দরজা।

রুমের মাঝে একটা অর্ধ সমাপ্ত মডেলের সামনে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে আছেন সাদিক ভাই...আর সাবরিনা আপা চোখে রাজ্যের বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। সাবরিনা আপার অবাক হবার কারণ টা আমাকে কে জানি পরিস্কার করতেই বলল সাদিক একটু আগে ডিজাইন নিয়ে কথা বলতে বলতে ঘুমিয়ে পরেছে.. সাবরিনা এজন্যেই অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। সাদিক ভাই এর জন্যে ঘুমই হলো জেগে থাকার মতো স্বাভাবিক ব্যাপার নাকি...। দুপুরে ভাত খাচ্ছি আর আমার সামনে গোলগাল ঝাকড়া চুলের সুজন ভাই। উনার প্রশ্নের উত্তরে কি জানি একটা বেফাঁস কথা বলে ফেলেছি...হাল্কা অথচ ভয় জাগানিয়া একটা কথা বলে চুপচাপ আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন তিনি।

ভাত এর দিকেই আমার মনযোগ এমন একটা ভাব নিয়ে থাকলাম...ভেতরে ভেতরে আমার নিম্নচাপ স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হতে শুরু করলো। তরীর একপাশে সুন্দর বারান্দা...ভয়,কান্না আর গায়ের ঘাম শুকাতেই অক্টোবর মাসের ঠান্ডাতে দাড়ালাম বাড়ান্দায়...। কঠিন আর অসমাপ্ত ডিজাইন যেন বাস্তবের মুখ দেখার আগেই ভেঙ্গে পরেছে মারুফ ভাইয়ের মাথায় তাই কম্পিউটারে ছেড়ে দিয়েছেন..."তোমরা কেউ কি দিতে পারো প্রেমিকার ভালবাসা"। হই হই করতে করতে লেনিন ভাই কোথা থেকে হাজির হলেন...হাসতে হাসতে বললেন...আজকে নাকি আমি মুরগী আর আমাকে রাতে জবাই দেয়া হবে। এত শান্ত একটা লোক এগুলা কি বলে...?।

মনে হাজার চিন্তা নিয়ে নিজের ব্যাগ থেকে জিনিস বের করা শুরু করলাম। ব্যাগের পাশে ওটা কি?সুন্দর একটা ছোট ব্যাগ...তার মধ্যে কি নেই?...দামী রেজর,শেভিং ফোম,আফটার শেভ লোশন,নেইল কার্টার আর চিরুনী। কার ব্যাগ জিজ্ঞেস করতেই সজল ভাই এক গাল হাসি দিয়ে বললেন "মারুফের"। বিকেলে তরী থামল কিছুক্ষন...সজল ভাই আমাকে নিয়ে বের হলেন বাইরে। মোড় মতো জায়গাটা...অসংখ্য মানুষ সেখানে।

সজল ভাই একটা বেকারীতে ঢুকে আমাকে বললেন কি খাবি বল?। দেরী হতে নিজেই বললেন জামতলার মিষ্টি খেয়েছিস কখনো?। আমি ভাবলাম এটা আবার কি জিনিস...ভয়ে ভয়ে...না বলতেই ভাইয়া বললেন খা খুব টেষ্ট। বড় সাইজের রসগোল্লার মতো...মুখে দিতেই মাখনের মতো গলে গেল। মনে মনে ধন্যবাদ জানালাম ভাইয়াকে।

আমার একটা কাজ ছিলো তাই সজল ভাই কে বললাম আমি পরে যাব...ভাইয়া বললেন তাড়াতাড়ি চলে আসিস। ঘুরতে ঘুরতে কখন যে আটটা বেজে গেছে খেয়াল ই করিনি। মোড় একজায়গায় কেন এত জটলা তা খুজতে যেয়েই দেখি ছোটখাট একটা লোক একমনে চা বানাচ্ছে...নাম তার ফারুক। এমন ভাল চা আমি খাই নাই কখনও। চা খেতে খেতে মনে পড়ল...আমার এক টুকরা স্বচ্ছ কাঁচ দরকার...কিন্তু এত রাতে আর দোকান খোলা পাবোনা...।

আজকে রাতে লাগবেই...জানাতে ব্যাস্ত ফারুক ভাই আমাকে অবাক করে দিয়ে তার বিস্কিটের টিনের একপাশ থেকে কাঁচ খুলে দিলেন। দাম কতো বলতেই...হাসি দিয়ে বুঝিয়ে দিলেন এটা ঠিক না। রাতে ব্যাস্ত সজল ভাই জানালেন...আজকে বাজার হয়নি...আইটেম আলু ভর্তা আর ডাল। তরীতে উঠতে পেরেছি তাই বেশ...খাবার আইটেম নিয়ে কি চিন্তা করার সময় আছে?খাবার একটু পর মুভি দেখতেছি...হঠাত কালো মতো একটা লোক ঢুকল রুমে...আরও ভীতিকর ব্যাপার হলো তার চোখ দুইটা লাল...। সজল ভাই বললেন ওর নাম রনি...থাকে দ্বিতীয় তলাতে আরো বল্লেন খুব সাবধান ওর খুব রাগ।

আমার ব্লাড প্রেশার আবার লো হয়ে গেল। মারুফ ভাইয়ের সাথে ভয়ংকর ফাজলামী করে আমি সজল ভাই ভয়াবহ তাড়া খেলাম। একফাকে পরিচয় হয়ে গেল ত্বার্কিক মুনিম ভাইয়ের সাথে। তার আর সজল ভাইয়রে ঝগড়াটা বেশ উপভোগ্য। আস্তে আস্তে রুমের দরজা নক্ করলাম...দরজা খুলে দিলেন একটু আগে আমার ব্লাড প্রেশার লো করে দেওয়া স্বয়ং রনি ভাই।

অনেক কথা হলো রনি ভাই আর রুমের আরেক বাসিন্দা মুন ভাইয়ের সাথে। উপরতলা আর নীচ তলার মাঝে আকাশ পাতাল পার্থক্য। ফিরতে ফিরতে সজল ভাইয়ের ভয় দেখানোর ক্ষমতাকে বাহবা দিলাম। ঘুমাতে হবে খুব ক্লান্ত লাগছে...। ঠিক কত নাম্বার হাঁচিতে আমার ঘুম ভাংলো জানিনা...উঠে দেখি লিটু তার বিছানায় বসা।

হাতে গামছা...এবং যথারীতি পরবর্তি হাঁচির জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে। গুনে গুনে দশটা দিবে...অদ্ভুত ব্যাপার। বাথরুম দিয়ে বের হতেই জানালো..."দোস্ত আজকে যেমনে হোক স্কেলের(রেজা ভাই) আগেই মুরগীর রান্ টা সরাতে হবে"। স্কেল আর কেউ না ইসিইর বড় ভাই যিনি মুরগীর মাংস অর্ধ কাঁচা থাকতেই নিয়ে কেটে পরতেন। উনার কাছে এটা কোন ব্যাপার না হলেও অধিকার সচেতন আমাদের কাছে যেমন কষ্টের তেমন রাগের।

যথারিতী কয়েক সেকেন্ডের দেরী...রান্না ঘর থেকে গট গট করে অর্ধ কাঁচা মুরগীর রান্ নিয়ে বের হয়ে গেলেন আমাদের স্কেল ভাই। লিটু আমার মুখের দিকে ফ্যালফ্যাল করে তাকায় থাকল্...আমি সেখানে স্কেল ভাইকে পুড়ে ভস্ম হয়ে যেতে দেখলাম। ছোটখাট সনি ভাই এক রকম বুলেটের বেগে তেড়ে এলেন..."কেনো তুমি বাথরুমে আমাকে দেখানোর জন্যে লিখে রাখলে..."অযাথা লাইট জ্বালায় রাখবেন্না"?...উপরে উপরে যতই বলি না ভাই আপনাকে দেখানোর জন্যে না...এটা সবার জন্যে... মনে মনে বলি...ভুলটা তো আপনিই করেন সবসময়। রাতে ফিরে দেখি লিটু বা রনি ভাই কেউ নেই। সনি ভাইতো গেছেন আগেই।

রুমের দরজা খুলে দেখি বাথরুমের দরজা একটু ফাকা করে রাখা...লাইট জ্বালানো। হঠাৎ রনি ভাই এসে বললেন একটু আগে আমি ভেতর থেকে দরজা বন্ধ রেখেছিলাম কিনা?...আমি না বলতেই উনি বললেন বাইরের দরজা বন্ধ ছিলো...এবং কে যায় তা দেখার জন্যেই তিনি তিন তলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন...কিন্তু কেউ বের হয়নি আমি আসার আগে। ভয়ের একটা শীতল স্রোত বয়ে গেল আমার মেরুদন্ড দিয়ে। নেমে গেলাম তরী দিয়ে অনেক আগেই। শুধু ছিলেন রনি ভাই আর লিটু...বাকিরা আগেই চলে গেছেন।

বেশ কিছুদিন পর ১০০ নম্বর তরীতে ঢোকার সুযোগ হয়েছিলো...বয়সের ছাপ পরে গেছে তার গায়ে,যে সিড়ি বেয়ে ব্যাস্ত সবাই নামতাম আছে প্লাষ্টারহীন তেমনি। রং লেগেছে আমাদের জিবনের গায়ে কিন্তু ১০০ নম্বর আছে বর্ণহীন সাদাই। মাঝখানে একটা ফ্যামিলি উঠেছে মনে হয়...কারণ ব্যাচেলরের তরী ১০০ নম্বরের সামনের দরজা কখনই বন্ধ থাকেনা। তিন তলাতে কাউকে পেলাম না...তাই অনেক আপন এক পাল্লার দরজা ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করা হলোনা। না প্রবেশ করাই ভাল...পরম আরাধ্য,হাসি কান্না আর সুখ দুঃখের ১০০ নম্বর তরী কে এক সময় অবহেলা করে চলে এসেছিলাম...প্রবেশ করতে দেবে কেনো সে?


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.